নবগঙ্গা নদীর পাড়ে বড় বড় গাছের গুঁড়ি কুড়াল দিয়ে কেটে জ্বালানি কাঠ বের করত কিংবা গুঁড়িগুলোকে সাইজ করত কাঠুরিয়া চাচারা। কুড়ালের কোপের শব্দ; স্কুলের দেওয়ালে লেগে তৈরি হতো প্রতিধ্বনি নামক এক অপরূপ মধুর ছন্দ। কাঠুরিয়া চাচাদের হাতে ছিল না কোনো ঘড়ি; সময় মাপার জন্য। না ছিল কোনো বাদ্যযন্ত্র; তাল লয় তৈরির জন্য। তাদের হাতে থাকতো নিষ্ঠুর কুড়াল। সেই হিংস্র কুড়ালের নির্মম কোপের ভ্রূণ থেকে জন্ম নিত ফুটফুটে মায়াবী ছন্দ। যেই ছন্দ স্কুল পড়া এই শিশু মনকে কেড়ে নিত শিক্ষকের পাঠদানের পাঠশালা থেকে। বেতের শাসনের শাসনালয় থেকে। বিভোর মনে কান দিয়ে শুনতাম কুড়ালের নির্মম কোপের ভ্রূণ থেকে জন্ম নেয়া ফুটফুটে মধুর ছন্দ। নদীর কূলে কাঠের পাটাতনের উপর কাপড় কাচতো ধোপা কাকু কিংবা গ্রামের মা চাচিরা। নদীর পানিতে নাচতে নাচতে দূরের কোনো অচেনা বাঁকে শেষ হতো, পাটাতন ও কাপড়ের মলস্নযুদ্ধ থেকে তৈরি অপরূপ ছন্দ। কর্কশ দ্বন্দ্ব তৈরি করত মায়াবী ছন্দ। কেউ শুনতো কী না জানি না। আমি শুনতাম কান খাড়া করে। মন উজাড় করে। আহ্ কী অপরূপ ছন্দ। কী মনোহারি ছন্দ। বাইশ হর্স পাওয়ারের রাইস মিলের ধোঁয়ার পাইপ থেকে বের হতো ছান্দসিক গতির কাব্যিক শব্দ। কামারশালার অতুল দাদু আর স্বপন মামার ছোট এবং বড় হাতুড়ির রুদ্র আঘাতে জ্বলন্ত লোহার জঠর থেকে বেরিয়ে আসতো ছান্দসিক বিপস্নবী ডাক। ক্লান্তির ঘাম উবে যেত সেই ছন্দের ছোঁয়ায়। রাস্তার পাশে ট্রাক দাঁড়িয়ে উঠানো হতো বড় বড় গাছের গুঁড়ি। ঘেমে যেত শ্রমিকদের শরীর। তবে মুখে থাকতো অজ্ঞাতনামা কবিদের সৃষ্ট দুই চার চরণের পদাবলি। যা ছন্দ দিয়ে গাঁথা। সেই পদাবলি পাঠ করে শ্রমিকরা উঠাতো ভারী গাছের গুঁড়ি, পেত শক্তি। আমি শুনতাম আনমনে শ্রমিকদের ছন্দে ভরা মধু মাখা পদাবলি। নদীতে নৌকাবাইচের সময় কাসার ঘণ্টা বাজিয়ে হাতে ঢাল এবং রামদা উঁচিয়ে গাওয়া হতো উদ্দীপনাময় দীপ্ত চরণ। যার আগা মাথা সবই ছিল ছন্দ দিয়ে মোড়ানো। কিন্তু কোন কারিগর সেই ছন্দের রূপকার কেউ হয়ত তা জানত না। তাইত, আমি নৌকাবাইচের গতির চেয়ে ছন্দের তালে ভেসে যেতাম নদীর সঙ্গী হয়ে। কালবৈশাখী ঝড়ের ভয়ংকর বাতাস ফুঁসতে ফুঁসতে ছুটে আসত; ভেঙে দিত বাড়ি ঘর। উপড়ে ফেলত গাছপালা। ভয়ংকর রুদ্ররূপ; তবু তার মধ্যে শুনতে পেতাম ছান্দনিক কোরাস। নদীর তীরে কাশের বনের সাদা ঢেউ। ধানের ক্ষেতের সবুজ দোলা সব জায়গাতেই দেখতে পেতাম অপরূপ ছন্দের নান্দনিক খেলা। পাখির গানে। ঝিঁঝি পোকার ডাক। ঘোড়ার দৌড়ে। সাপের চলনে। ছায়াপথের গাঙে। উঠনে পুঁথি পাঠের আসরে। সব জায়গায় পেতাম ছন্দের কলতান। আর এসব দেখে দেখে ছন্দে ছাওয়া একখানা শোনের ঘর তৈরি হয়েছিল আমার হৃদয়ের উঠোন মাঝে। যেখানে আমি পেতাম প্রচন্ড রোদ্দুরে এক টুকরো ছায়া। দুঃখের বৃষ্টিতে একটুখানি আশ্রয়। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরের ছন্দের অভিস্রবণ হতে থাকে মন আর সাদা পাতার সঙ্গে। লিখতে থাকি অন্ত্যমিলের পদাবলি। প্রকৃতির ছন্দ ধার করে। যা আমার মতো সব কবিকে প্রথম কবিতা লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। মনে মনে নিজেকে কবি ভাবতে থাকি। তারপর বুঝতে পারি ছন্দের ব্যাকরণ আছে এবং তা আয়ত্ত করে লেখার চেষ্টা করি স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত আর মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতা। এখানে বলে রাখা ভালো, শুধু ছন্দ জানলেই ভালো কবিতা লেখা যায় না। কবিতার অনেক বড় অনুষঙ্গের মধ্যে ছন্দ তার মধ্যে একটি উপাদান মাত্র। আবার কবিতার বিষয়বস্তু, ভাব ভালো হলে; শব্দ চয়ন, অলংকার, উপমা ঠিক থাকলেও যদি ছন্দের গড়মিল থাকে তালে তা সার্থক কবিতা হবে না। কোকিল কোনো ব্যাকরণ জানে না কিন্তু তার কণ্ঠ ও ছন্দ ভালো বলে আমরা কোকিলের গান শুনি। কাকের চিৎকার অপছন্দ করি। বিরক্ত হই। প্রহর গুণে শিয়াল যখন ছান্দনিক কোরাস গায়, নির্জন রাতটা যেন ছন্দে ভরে যায়। আবার কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ চোর তাড়াতে সহায়ক হলেও তাতে মায়াবী ছন্দের কোনো গন্ধ পাওয়া যায় না। সবুজ ধানের মায়াবী ঢেউ দাঁড়িয়ে দেখতে ইচ্ছে করে শুধু তার নান্দনিক ছন্দের কারণে। কবিতাও কালোত্তীর্ণ হয়, পাঠক প্রিয়তা পায় ছন্দের কারণে। অনেকই বলে থাকেন আধুনিক কবিতা লিখতে ছন্দের প্রয়োজন নেই এবং আধুনিক কবিতার ধুয়ো তুলে ছন্দকে বর্জন করতে চায়। তাদের অনেকেই হয়তো জানে না ত্রিশ দশকের আধুনিক কবিদের অন্যতম কবি জীবনানন্দ দাশও প্রবোধ চন্দ্র সেনের ছন্দ মেনে কবিতা লিখতেন। তার বিখ্যাত কবিতা বনলতা সেন অক্ষরবৃত্ত ছন্দ লেখ্য। আবার আসিব ফিরে কবিতা একটা বিশুদ্ধ সনেট। এমনি ভাবে জীবনানন্দ দাশের সব কবিতাই ছন্দ আর উপমায় মাখামাখি হয়ে আছে। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কবি ফররুখ আহমদ, কবি আহসান হাবিব, কবি আল মাহামুদসহ সকল প্রতিষ্ঠিত কবি ছন্দ মেনে আধুনিক কবিতা লিখতেন। কবিতা আর ছন্দ যেন একই দেহের দুই অঙ্গ। কবিতার মাঝে ছন্দ থাকতে হবে। তা প্রবোধ চন্দ্র সেনের ছন্দ হোক বা কবির নিজস্ব ছন্দ হোক। কবি আল মাহামুদ 'আধুনিক কবিতা' নামে মুক্ত ছন্দে একটা কবিতা লিখেছেন। কবি লিখেছেন : প্রশ্নকারীরা আজকাল আমাকে খুব উত্ত্যক্ত করে।/ ভদ্রতার খাতিরে আমি তাদের সব প্রশ্নের জবাব দিতে থাকি।/আধুনিক কবিতা বলতে আপনি কি বোঝেন?/ আমি বলি, সে তো লাল মাটিয়া মহিলা কলেজে /এখন মেয়েদের বাংলা পড়ায় আর পরীক্ষার খাতা দেখে/ নিজের নৈসঙ্গ যাপন করছে।/ বিশ্বাস করো, লোকটা একটুও না হেসে তার প্রশ্নের/ পাশে তোমার নামের নির্ভুল বানান/ লিখে নিয়ে চলে গেল।/
কবি আল মাহমুদের স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতাগুলো যেমন কালোত্তীর্ণ কবিতার তালিকায় স্থান পেয়েছে। তেমনি মুক্ত ছন্দের কবিতাও কালোত্তীর্ণ কবিতার তালিকায় স্থান পেয়েছে। আমার তার 'এপিটাফ' পড়লেই বুঝতে পারি তিনি মুক্ত ছন্দে কত পারদর্শী ছিলেন। কবি ফররুখ আহমেদের লাশ কবিতা আধুনিক কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। যেখানে আছে ছন্দের মাখামাখি। কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী তার 'কবিতার ছন্দ' বইতে লিখেছেন যে, কবিকে ছন্দ জানতে হবে। তবে তা পরে ভুলে গেলেও চলবে। মোট কথা প্রচলিত ছন্দের ব্যবহার কবি নাও করতে পারেন। তবে কবির কিন্তু একটা নিজস্ব ছন্দ তৈরি করে নিতে হবে। যাতে পাঠক কবিতা পড়ে ছন্দ রসে পস্নাবিত হতে পারে। কবিতার সংজ্ঞা থেকে আমরা জানতে পারি যে, কবিতা হলো ছন্দের মাধ্যমে প্রকাশিত কবির মনের ভাব। যা সাহিত্যের একটি অন্যতম মাধ্যম। আধুনিক কবিতার চরণে চরণে আছে ছন্দ আর পরাবাস্তবতা। তাইতো কবি জীবনানন্দ দাশ, কবি সৈয়দ আলী আহসান, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার এত চাহিদা। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি জসীমউদ্দিন, কবি বন্দে আলী মিয়ারাতো পুরানো হয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁদের কবিতা? দিন দিন নতুন রূপ লাভ করছে। নতুন নতুন পাঠক সৃষ্টির মাধ্যমে। কবিতার ভাব, শব্দ চয়ন, অলংকার, উপমার পাশাপাশি অবশ্যই ছন্দ থাকতে হবে। তা প্রবোধ চন্দ্র সেনের ছন্দ হোক আর কবির নিজস্ব ছন্দ হোক। তবে অন্ত্যমিলের কবিতায় এখনো স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তের প্রবোধ চন্দ্র সেনের ব্যাকরণ মেনেই ছন্দে ছন্দে কবিতা লিখে থাকেন ছান্দনিক কবিরা। পাখির গানে, নদীর কলতানে আছে ছন্দের ঢেউ। কবির কবিতায়ও থাকতে হবে ছন্দের জোয়ার। তা না হলে কবিতার সঙ্গে পাঠকের বেধে যাবে দ্বন্দ্ব। কবিতা অবশ্যই ছন্দ থাকতে হবে। কবিতা ছন্দে লিখতে হবে। তা না হলে কবিতা আর দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয়র মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। প্রকৃতির মাঝে যেমন বিছানো আছে ছন্দের শীতলপাটি তেমনি কবিতার মাঝেও থাকতে হবে ছন্দের পালঙ্ক। তবেই কবিতা পাবে পাঠক প্রিয়তা। কবির নাম স্থান পাবে কালোত্তীর্ণ কবিদের সোনালি তালিকায়।