শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২ আশ্বিন ১৪৩১

বহুমাত্রিক

আবু হেনা মোস্তফা কামাল
  ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বহুমাত্রিক

আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছিলেন একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক এবং গীতিকার, যার জীবন ছিল এক বিশাল সংগ্রামের কাহিনী। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান যেমন সময়ের সীমানা ছাড়িয়ে আজও প্রাসঙ্গিক, তেমনি তিনি হয়ে উঠেছেন বহুমাত্রিক প্রতিভার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সাহিত্য ও সৃজনশীলতায় তার অবদান তাকে পরিণত করেছে এমন এক ব্যক্তিত্বে, যিনি বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি ও উন্নতির জন্য সর্বদাই অনুপ্রেরণার উৎস।

তার জন্ম এক সাধারণ পরিবারে। ছাত্রজীবনের শুরুটাও অসাধারণ ছিল না। বরং নবম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি অধিকাংশ বিষয়েই উত্তীর্ণ হতে পারছিলেন না। এই সময় তার জীবনে নেমে আসে এক ধাক্কা। যখন বাবা শাহজাহান আলী মারা যান। বাবার মৃতু্য তার মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে, কিন্তু এই ক্ষতই তাকে বদলে দেয়, নতুন উদ্যমে জাগিয়ে তোলে। তিনি পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী হন আর ধীরে ধীরে নিজের শিক্ষা, মেধা ও প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে থাকেন। মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানে তেরোতম স্থান অর্জন করে তিনি প্রমাণ করেন যে, ইচ্ছাশক্তি আর কঠোর পরিশ্রম মানুষকে অসম্ভবকে সম্ভব করার শক্তি দিতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্তও ছিল সাহসিকতার প্রতীক। ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনার প্রচলিত ধারা উপেক্ষা করে বাংলা সাহিত্যে মনোনিবেশ করার মাধ্যমে তিনি জানান দেন, বাংলা ভাষার প্রতি তার গভীর ভালোবাসা। এই ভালোবাসাই তাকে নিয়ে যায় বাংলা সাহিত্যের গভীরে, যেখানে তিনি সাহিত্য, প্রবন্ধ এবং গবেষণায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি অসুস্থতার কারণে অনার্স পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। তবে পরের বছর প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে প্রমাণ করেন, তিনি শুধু একজন প্রতিভাবান শিক্ষার্থীই নন, বরং সাহিত্যে গভীর মননশীলতার অধিকারীও। মাস্টার্সেও একই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে প্রথম স্থান অধিকার করেন।

আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতায় রয়েছে অন্তর্নিহিত বোধ ও আবেগের মেলবন্ধন। তিনি অত্যন্ত সরল ভাষায় এমন গভীর দর্শন ও অনুভূতি প্রকাশ করেছেন, যা সাধারণ মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করে। তার কবিতার বিষয়বস্তুতে পাওয়া যায় ব্যক্তিগত দুঃখ-বেদনা, প্রেম, দেশপ্রেম, সমাজের বিভিন্ন অনুষঙ্গ এবং বাঙালির ইতিহাস। বিশেষ করে 'অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে' কবিতাটি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে রচিত, যেখানে তিনি বাঙালির আবেগকে জাগ্রত করেছেন।

গীতিকার হিসেবে তিনি ছিলেন বাংলা গানের জগতে এক উলেস্নখযোগ্য নাম। তার লেখা গানগুলো আজও শ্রোতাদের মনে গেঁথে আছে। বিশেষ করে 'আমি সাগরের নীল নয়নে মেখেছি' গানটি বাংলাদেশ টেলিভিশনের সূচনালগ্নে প্রচারিত হওয়ার পর থেকে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তার গানের মধ্যে যেমন ছিল প্রকৃতির রূপের বর্ণনা, তেমনি ছিল মানুষের অভ্যন্তরীণ বেদনা ও আবেগের প্রতিফলন। গানগুলো আধুনিক বাংলা গানের ধারাকে সমৃদ্ধ করেছে এবং তা বাংলা গানের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

প্রাবন্ধিক আবু হেনা মোস্তফা কামালের প্রবন্ধের মধ্যে সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতি নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ রয়েছে। 'শিল্পীর রূপান্তর' গ্রন্থে তিনি শিল্পের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও ভূমিকা নিয়ে কথা বলেছেন। আর 'কথা ও কবিতা' গ্রন্থে তিনি বাংলা কবিতার ইতিহাস, তার নান্দনিকতা এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোকপাত করেছেন। তার প্রবন্ধগুলোতে যেমন রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ, তেমনি রয়েছে শিল্পের প্রতি একান্ত ভালোবাসা।

গবেষক আবু হেনা মোস্তফা কামালের অবদান বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য। তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভ 'ঞযব ইবহমধষর চৎবংং ধহফ খরঃবৎধৎু ডৎরঃরহম' (১৮১৮-১৮৩১) বাংলা সংবাদপত্রের প্রাথমিক সময় এবং সাহিত্যে প্রভাব নিয়ে এক মূল্যবান গবেষণা। এই গবেষণা বাংলা সাহিত্য এবং সংবাদপত্রের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হয়।

শিক্ষক হিসেবে আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার পাঠদান ছিল সহজবোধ্য, মনোগ্রাহী এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সমৃদ্ধ। শিক্ষার্থীদের প্রতি তার ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ এবং জ্ঞানগর্ভ আলাপ তাকে শিক্ষার্থী এবং সহকর্মীদের মধ্যে একজন অনুকরণীয় আদর্শ শিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকলেও তার জাতীয়তাবোধের কোনো ঘাটতি ছিল না। পাকিস্তান সরকারের দেওয়া 'সিতারা-ই-ইমতিয়াজ' পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। তার কবিতায় যেমন বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহা রয়েছে, তেমনি সাহিত্যেও রয়েছে রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। জীবদ্দশায় তার প্রতিভার পূর্ণ মূল্যায়ন হয়নি। সমসাময়িক লেখক, সম্পাদক এবং সমালোচকরা অনেক সময়ই তাকে যথাযথভাবে সম্মান দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার সাহিত্যকর্ম অনেক ক্ষেত্রেই অবমূল্যায়ন হয়েছে, বিশেষত তার কবিতা এবং প্রবন্ধগুলো। তার বহুমুখী প্রতিভা হয়তো অনেকের জন্য ঈর্ষার কারণ হয়েছিল- যা তাকে বারবার অবহেলার শিকার করেছে।

আবু হেনা মোস্তফা কামাল তার ৫৩ বছরের স্বল্প জীবনে যে সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং দেশপ্রেমিক হিসেবে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন, তা অনুকরণীয়। তার জীবন সংগ্রাম, সাহিত্যকর্ম এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ আমাদের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস। তার সাহিত্য ও জীবনের মূল্যায়ন করতে হলে শুধু তার কবিতা বা প্রবন্ধ পড়লেই চলবে না, বরং তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়কে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। তিনি আমাদের বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার আলো চিরকাল প্রজ্বলিত থাকবে।

ম ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে