ময়মনসিংহের নেত্রকোনা, কলমাকান্দা, সুসঙ্গ দুর্গাপুর, পূর্বধলা, হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, শেরপুর ও জামালপুরের পাহাড়ি ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অধু্যষিত অঞ্চলে ১৯৪৬-৫০ সালে টঙ্ক ও জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলন হয়। আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড মণি সিংহ। তার সঙ্গে আরও যুক্ত ছিলেন প্রমথ গুপ্ত, রবি নিয়োগী, পুলিন বক্সী, খোকা রায়, আলতাব আলী, ক্ষিতীশ চক্রবর্তী, পবিত্র শঙ্কর, মুন্সী জহির উদ্দিন, জিতেন মৈত্র, জলধর পাল, ললিত সরকার, বলস্নভী বক্সী, ভূপেন ভট্টাচার্য, নগেন সরকার প্রমুখ।
মণি সিংহ কমিউনিস্ট নেতা হলেও সুসঙ্গ রাজপরিবারের নিকটাত্মীয়। সুসঙ্গের মহারাজ ভূপেন্দ্র চন্দ্র সিংহ তার মামা। টঙ্ক ও জমিদার প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলনে হাজং, বানাই, ঢালু, কোচ, গারো, হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে সব শ্রেণি ও নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ অংশগ্রহণ করলেও হাজংদের অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগই বেশি। এদিক থেকে বিচার করে কেউ কেউ একে হাজং আন্দোলন বলে থাকে।
টঙ্ক প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলনের দীর্ঘ ও সুপ্রাচীন আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস আছে। লেখক সমীর আহমেদ টঙ্ক ও জমিদারি প্রথা উচ্ছেদকে উপজীব্য করে একটি জনপদের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর গৌরবদীপ্ত, ত্যাগ ও সংগ্রামমুখর ইতিহাসের সাহিত্য ভাষ্য রচনা করেছেন। তিনি শুধু ১৯৪৬-৫০ সালের কালপর্বের ভেতর উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহকে বৃত্তবন্দি না করে সুসঙ্গে জমিদারির গোড়াপত্তনের ইতিহাস ও টঙ্ক আন্দোলনের আদি উৎপত্তিকে চিহ্নিত করেছেন। লেখক নিজেই কথকের ভূমিকায় সুসঙ্গের জমিদার মহারাজ রাজকৃষ্ণ সিংহের সময়কাল থেকে টঙ্ক আন্দোলনের উৎপত্তির ইতিহাস বয়ান করেন। কিন্তু সুসঙ্গ রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে অশোকবৃক্ষের একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। মূলত মহারাজ রাজকৃষ্ণ সিংহের পূর্বপুরুষ সুসঙ্গের জমিদারির স্থপতি সোমেশ্বর অর্থাৎ সোমনাথ পাঠকের অশোকবৃক্ষ রোপণের মিথকে কেন্দ্র করে আখ্যানের সূচনা হয়।
কার্যত ব্রিটিশ ভারতের সামগ্রিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থায় অনেক দেশীয় রাজ্য, পুরাতন জমিদার শ্রেণি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার কারণে দায় দেনা ও অর্থনৈতিক ভগ্নদশার শিকার হয়। এগুলোর মধ্যে সুসঙ্গের মহারাজা রাজকৃষ্ণ সিংহের জমিদারি একটি। আগে থেকেই পূর্বপুরুষের ভবিষ্যৎ বাণী- অশোকগাছ সংক্রান্ত মিথ যুক্ত হয়ে মহারাজা রাজকৃষ্ণ সিংহকে অস্থির ও অপরিণামদর্শী করে তুলে। মহারাজা রাজকৃষ্ণ সিংহ অমোঘ মিথ ও নিয়তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নায়েবের পরামর্শে হাজংদের ভূমিতে টঙ্ক নির্ধারণ করে। এখান থেকেই টঙ্কের সূচনা, সংঘাত ও বিদ্রোহ শুরু।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এ অঞ্চলে পাগলপন্থি বিদ্রোহ ও হাতি খেদা বিদ্রোহের পূর্ব ঐতিহ্য আছে। স্বভাবত হাজং জাতি টঙ্ক পরিশোধে অস্বীকৃতি জানায়। গোরাচাঁদ হাজংয়ের নেতৃত্বে মহারাজ রাজকৃষ্ণ সিংহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে এবং প্রাথমিক সাফল্যও পায়। হাজংদের প্রতিরোধ করতে না পেরে মহারাজা রাজকৃষ্ণ সিংহ ভয়ে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন নিয়ে কলকাতায় চলে যান। জমিদারির দায়িত্ব দিয়ে যান মদ্যপ, দুরাচারী ও নিষ্ঠুর জং বাহাদুরকে। বস্তুত জমিদারি, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের স্বার্থ একসূত্রে গাঁথা। জং বাহাদুর প্রথম পর্যায়ের আন্দোলন ব্রিটিশ প্রশাসন ও পুলিশের সহায়তায় দমন করতে সমর্থ হয়। হত্যা, নিপীড়ন চালিয়ে নৃশংসভাবে দমন করে। তাদের বাড়িঘর আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ক্ষেতের ফসল লুট করা হয় ও নারীদের নির্বিচারে ধর্ষণ করা হয়। পুলিশের হাতে হাজং বাহিনীর নেতা গোরাচাঁদ হাজং, বিশ্বমিত্র, রামেশ্বর ও গৌতম গ্রেপ্তার হয়। জেলে তাদের করুণ পরিণতি বিশ্বমিত্র বয়ান করে এভাবে- 'ভিড় জমে বিশ্বমিত্রের বাড়িতে। রামেশ্বর আর গৌতমও সেই সময় উপস্থিত ছিল। জেলজীবনের নানা দুঃখ-কষ্টের কথা বলতে থাকে তারা। হঠাৎ গোরাচাঁদের প্রসঙ্গ উঠতেই তাদের চোখমুখ, চেহারা বিষণ্ন, থমথমে হয়ে যায়। বিশ্বমিত্র বলে, জমিদার লৌ ঘর বায় নিয়ৌ যাওয়ালা পরে লাঠিয়াল বাহিনী আমাগে বাখার কে মাইরধাইর করে। শৈল ফাইট্টা রক্ত বাইর হইবা থাকে। তারপর আমরৌ জ্ঞান হারাইয়া ফেলে। এর পরে যি কী ঘট্টিছে, কাইয়ুবো কিছুই কুবাগো না পাবৌ। তারপর যিবৌলা জ্ঞান ফিরাইয়া আহে, আমরৌ চাইয়ৌ দেখে ট্রেননি কে। আমা লগন গোরাচাঁদ কাকা হু আছে। উলা হু উবুলা জ্ঞান না থাকিবৌন! ... কলকাতা যাওলা আগে উলা জ্ঞান আর ফিরিয়ৌ নিই আহে। কলকাতানি যাওলা পরে, ট্রেন থকন আমাগে এক লগনতে নামায়। এর পরে হে আমাগে তিনজন থকন ওগে আলাদা কুরিয়ৌ ফেলাই। তারপরে আর কুনু সম্বাদ আমারৌ কুনু দিন্নৌ জানিবৌ গে নিই পাই।' (পৃঃ ৯৬, টঙ্ক, সমীর আহমেদ, প্রাগুক্ত)
\হগোরাচাঁদের রহস্যময় মৃতু্য, রামেশ্বর, গৌতম ও বিশ্বমিত্রের দুঃসহ জেলজীবন, টঙ্কের বিরুদ্ধে হাজং জনজাতির গণসংগ্রাম থেমে গেলেও পরবর্তী প্রজন্মে আবার তা জেগে ওঠে। দ্বিতীয় পর্বে রামেশ্বরের ছেলে কার্তিক টঙ্কের বিরুদ্ধে স্বজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে। সঙ্গে যোগ দেয় বন্ধু ভোলানাথ, অজয়, বিজয়, সুবল, গণেশ, শেখর ও যুবসমাজ। লেখক বলেন, 'হাজংরা আবার জেগে উঠবে। খুব শিগগিরই জেগে উঠবে, টঙ্কের বিরুদ্ধে- কদিন ধরে এই স্বপ্নে বিভোর কার্তিক। প্রথম দিকে হাজংদের জাগানো যতটা কঠিন, সে মনে করেছিল, কাজে নামার পর এখন আর তা মনে হচ্ছে না। এখন হাজংরা তাদের একজন নেতা হিসেবে কার্তিককে মেনে নিয়েছে। চেংড়া, বুড়ো সবাই এখন তার ওপর নির্ভর করে। আবার জেগে ওঠার স্বপ্ন দেখে। তার বক্তৃতার সময় মাঝে মাঝে চেংড়া, বুড়ো অনেকেই এখন চেঁচিয়ে ওঠে আমলা আছে তোমির লগন।... এজন্য কত পরিকল্পনা! কত কাজ! দুঃসাহসী চেংড়াদের বাছাই করে যুদ্ধবিদ্যায় তাদের পারদর্শী করে তুলতে হবে। আগামীকাল বিকাল থেকে সেই ট্রেনিং শুরু। এ গ্রামে কিংবা আশপাশের গ্রামে যে সব বয়স্ক লোক, তির, ধনুক, লাঠি, ঢাল, তলোয়ার, সড়কি, টেঁটা, বলস্নম চালনায় খুব দক্ষ, তাদের ওপর দায়িত্ব দিতে হবে চেংড়াদের ভালোভাবে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য। সে কাজও প্রায় পাকাপাকি।' ( পৃঃ ১৪৯, টঙ্ক, সমীর আহমেদ, প্রাগুক্ত)
প্রত্যেক জাতির মধ্যে কিছু বিশ্বাসঘাতক, স্বার্থপর ও দালাল থাকে। হাজং জাতির মধ্যে এমন একজন দালাল সুশীল দাশ ও তার ছেলে কানাইলাল। তাদের ষড়যন্ত্রে সোমেশ্বরীর পানিতে ভেসে ওঠে ভোলানাথের লাশ ও কার্তিক নিখোঁজ হয়। আর এভাবেই হাজং জনজাতির দ্বিতীয় পর্যায়ের টঙ্ক আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বস্তুত লেখক সমীর আহমেদ ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আখ্যানের গল্প বুনন করেন।
স্থানিক কৃষক বিদ্রোহ হোক কিংবা জাতি রাষ্ট্রের মুক্তি- স্বাধীনতার গণসংগ্রাম হোক, তার রাজনৈতিক দর্শন ও সাংগঠনিক কাঠামো থাকা জরুরি। শুধু গণসমর্থন ও আত্মত্যাগ দিয়ে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়। হাজং বিদ্রোহও তার ব্যতিক্রম নয়। আখ্যানে আমরা দেখি একবার গোরাচাঁদ হাজং আরেকবার কার্তিক হাজংয়ের নেতৃত্বে হাজং বিদ্রোহ হলেও সাংগঠনিক-রাজনৈতিক দর্শন না থাকায় জমিদার ও রাষ্ট্রের যৌথশক্তির বিরুদ্ধে সফল হতে পারেনি। চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে কমরেড মণি সিংহ হাজং আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে শুধু হাজং জনজাতি নয়, স্থানীয় গারো, কোচ, ঢালু, বানাই, হাদি, হিন্দু ও মুসলমান জনগোষ্ঠী টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। শেষ মুহূর্তের টঙ্ক আন্দোলনে নানা বাঁক সৃষ্টি হয়। মুসলমানরা ব্রিটিশ ভারত পর্বে যতটা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম ছিল, পাকিস্তান পর্বে ততটা সক্রিয় ছিল না, যদিও তারা সুবিধাভোগী ছিল। আবার ১৯৪৭ সালের পর দেশভাগের সময় সুসঙ্গ রাজপরিবার তাদের জমিদারি উঠতি ধনী মুসলমান ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করে চিরতরে কলকাতায় পাড়ি জমায়। পাকিস্তান পর্বে পাকিস্তান গোষ্ঠী টঙ্ক আন্দোলনকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভারতের ষড়যন্ত্র নামে প্রচার করে। শুধু তাই নয়, মুসলিম আলেম সমাজ ও খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারকদের মাধ্যমে টঙ্ক আন্দোলনকে নাস্তিক কমিউনিস্ট পার্টির ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচার করার অপপ্রয়াস চালায়। বাধ্য হয়ে সরকার ১৯৫০ সালে টঙ্ক ও জমিদার প্রথা বিলোপের ঘোষণা দেয়।
একটি পর্যায়ে এসে টঙ্ক আন্দোলন গেরিলা যুদ্ধ রূপান্তরিত হয়। মণি সিংহ নিজের দলের ছেলেদের মাধ্যমে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করে পুলিশ ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করেছেন। পুলিশ যেমন হাজংদের নির্বিচার হত্যা করেছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে নির্বিচার ফসল লুট করেছে তেমনি অনেকবার গেরিলা হামলায় পর্যদুস্ত হয়েছে। বাধ্য হয়ে পুলিশ প্রশাসন গুপ্তচর নিয়োগ দিয়েছে। তারপরও পুলিশ প্রশাসন হাজং বাহিনীকে দমাতে পারেনি। এমনকি জনমানস ও সরকারি মহলে মণি সিংহ কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত হয়েছেন। তার ঘোড়াটি আন্দোলনে মিথে পরিণত হয়।
জমিদারি ও টঙ্ক প্রথা সরকার বিলোপ করে দিলেও হাজংদের পুলিশি নির্বিচার নৃশংসতা সইতে হয়। বাধ্য হয়ে অনেকে আসাম ও মেঘালয়ে চিরতরে পাড়ি জমায়। এর মধ্য দিয়ে সরকারের সাম্প্রদায়িক ও প্রতিহিংসামূলক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
\হলেখক আখ্যানে কেবল ইতিহাসে বলেননি, একটি জনপদের জীবন আখ্যানকে ভাষা দিয়েছেন। লেখক স্থান কাল পাত্র নির্বিশেষে হাজংদের মুখের ভাষা ব্যবহার করেছেন। লেখক অনেক সময় নিজেই কথকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। লেখক হাজং জনজাতির, আচার, সংস্কার, জীবনযাপন পদ্ধতিসহ তাদের বিশ্বাস ও অবিশ্বাসকে ভাষায় বর্ণনা করেছেন। অনেক ছোট বড়ো বিষয় যেমন নেত্রকোনার নাগড়ার মাঠে কৃষক সম্মেলন, স্থানীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ভূমিকাও ব্যক্ত করেছেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের প্রসঙ্গ স্বল্প পরিসরে উত্থাপিত হলেও বুঝা যায় কৃষক ও নিম্নবিত্ত মানুষের প্রতি তার একটি সহজাত টান ছিল। তিনি প্রজাস্বত্ব আইন পাস করেছিলেন এবং জমিদার প্রথা উচ্ছেদের জন্য সোচ্চার ছিলেন। এভাবেই তিনি টঙ্ক আন্দোলনের ইতিহাসের সাহিত্যরূপ ও জীবন আখ্যান তৈরি করেন। শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে মর্মন্তুদ আত্মত্যাগে রচিত হয় একটি জনজাতির বিজয়গাথা ও ভূমির অধিকার। লেখক ঘোরলাগা সহজ-সরল ভাষায় আখ্যানের গল্প ভাষা শৈলী নির্মাণ করেছেন।
টঙ্ক : সমীর আহমেদ, প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রম্নব এষ। বইটি প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য, মূল্য ৯৫০ টাকা।
বইটির বহুল প্রচার প্রত্যাশা করি।
সোহেল মাজহার