হুমায়ূন আহমেদ

জনপ্রিয়তা ও সাহিত্য মূল্য

প্রকাশ | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

মাজহার মান্নান
যখনই হুমায়ূন আহমেদের তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তখনই সাহিত্য বোদ্ধাদের একটু ঢিমেতালে বা গড়িমসি ভাব লক্ষ্য করা যায়। হুমায়ূনের লেখনীর সাহিত্যমূল্যকে তারা বিশ্বমানের বলতে নারাজ। সাহিত্য সমালোচনা ছাড়া কোনো সাহিত্যই পূূর্ণতা পায় না। সাহিত্য সমালোচনাকে ইতিবাচকভাবেই দেখতে হবে। কিন্তু সেই সমালোচনা হতে হবে গবেষণালব্ধ। ব্যাপক গবেষণা ছাড়া কোনো জনপ্রিয় সাহিত্যকর্মকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার সুযোগ নেই। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা হয়নি বললেই চলে। কিছু খন্ডিত ও বিচ্ছিন্ন সমালোচনা পাওয়া যায় তার লেখনীকে ঘিরে। আর খন্ডিত সমালোচনা দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের লেখনীর সাহিত্য ও শৈল্পিক মূল্য কতটুকু যাচাই করা সম্ভব সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশ্বের বেশির ভাগ খ্যাতিমান লেখকেরা মৃতু্যর পর বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। এদিক থেকে হুমায়ূন আহমেদ অনেক বেশি সৌভাগ্যবান। তিনি তার জীবদ্দশায় তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন এবং মৃতু্যর পরেও সেটা অব্যাহত আছে। সমালোচকরা বলতেই পারেন যে হুমায়ূন শুধু তার পাঠক, শ্রোতা আর দর্শকদের বিনোদন দিতেই লিখে গেছেন, লেখার মৌলিকত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে তার মুন্সিয়ানায় ঘাটতি ছিল। কেউ আবার বলতে পারেন, হুমায়ূনের লেখনীর সাহিত্য গভীরতা কম। কেউ হয়তো বলবেন তার লেখনীকে ক্লাসিক প্যাটার্নে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আরও অনেক সমালোচনা থাকতে পারে। কিন্তু চরিত্র রূপায়নের ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের মুন্সিয়ানা নিয়ে কোনো সমালোচক প্রশ্ন তুলতে পারেন নি। আর চরিত্র রূপায়নের মাস্টার ছিলেন বলেই তিনি আজ এত জনপ্রিয়। ম্যাকবেথ, ওথেলো, কিং লেয়ারের মতো সর্বকালের চরিত্র সৃষ্টি করে শেকসপিয়ার বিখ্যাত হয়েছিলেন। জনাথন সুইফটও গালিভারের মতো চরিত্র সৃষ্টি করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ঠিক একইভাবে হিমু, মিসির আলী, শুভ্র-এর মতো চরিত্র রূপায়ন করে হুমায়ূন আহমেদ আজ জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছেন। বাকের ভাইকে বাঁচাতে দর্শক শ্রোতাদের যে আবেগের বিস্ফোরণ ঘটেছিল বিশ্বসাহিত্যে বা শিল্পে তা ঘটেনি। হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তার কারণ ব্যাখ্যা করা আমার এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। তার লেখনী এবং সৃষ্টিকর্মের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক ও প্রায়োগিক প্রভাব ব্যাখ্যা করাই এই প্রবন্ধের লক্ষ্য। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপস্নবের পটভূমি রচনায় জ্যাক রুশোর লেখা 'মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত' লাইনটি অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। একজন লেখকের লেখা একটি দু'টি লাইনই সামাজিক কম্পন তৈরি করতে পারে। এমনকি বিশ্বসভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। সক্রেটিসের 'নিজেকে জানো' উক্তিটি বিশ্বসভ্যতার ইমেজকে ধারণ করে। মানুষকে যতই পরাধীন করে রাখা হোক না কেন সে তার সহজাত স্বাধীনতাকেই প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যে স্বাধীনতার কথা বলে গেছেন সক্রেটিস, জ্যাক রুশো, জনাথন সুইফট, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদ হিমু চরিত্রটিকে সার্বজনীন করতে পেরেছেন। হিমু তার সহজাত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় এবং অবিচল। স্বাধীনচেতা হিমু শুধু একটি নির্দিষ্ট কালের প্রতিনিধি নয়, সে সর্বকালের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে। কালজয়ী চরিত্রে নিজেকে দাঁড় করাতে পেরেছে। হিমু এমন একটি দর্শন ধারণ করেছে যে দর্শন সে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে এবং আর্থ-সামাজিক আর সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে অনুঘটকের ভূমিকা রেখেছে। সমাজের তরুণ কিশোররা কল্পিত চরিত্র হিমুকে অনুসরণ করেছে। তার ব্যক্তিত্ব, চাল চলন, কথাবার্তা, পোশাক অনুকরণ করেছে। হিমু চরিত্রের স্রষ্টা হুমায়ূনের কৃতিত্ব ঠিক এখানে। নগণ্য একটি চরিত্র কীভাবে সার্বজনীন হয়ে উঠতে পারে হুমায়ূন তা প্রমাণ করে দিলেন। জার্মান কবি ও নাট্যকার ইবৎঃড়ষঃ ইৎবপযঃ লিখলেন, আফ্রিকাতে মানবতাবাদের শুরু হয় খাবার টেবিলের সকালের নাস্তা থেকে। তার এই উক্তির পর মানবতাবাদের ধারণা অনেকটাই বদলে গেল। মানবতাবাদের ধারণায় এলো নতুনত্ব। হুমায়ূন আহমেদের লেখনীর বড় শক্তি ছিল এই নতুনত্ব। নাটক এবং উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে তিন নব নব রূপে উপস্থাপন করতে পারতেন। নান্দনিকতা ছিল হুমায়ূূনের লেখনীর প্রাণশক্তি। একটি লেখনীর নান্দনিকতা সেটাকে অমর করে রাখে। মান্না দের কফি হাউজের গানটি নান্দনিকতার জন্যই অমর হয়ে থাকবে। মান্না দে সেই কফি হাউজে যেতেন না, কিন্তু গানটিকে এমন নান্দনিক করে গাইলেন যে শ্রোতারা বিশ্বাস করতে শুরু করল এটি তার জীবনেরই গল্প। একটি লেখনী বা সাহিত্যকর্মের ক্ষেত্রে শব্দচয়ন খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শব্দচয়নে হুমায়ূন এক অনন্য স্রষ্টা। রোমান্টিক সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয়েছিল শব্দচয়নকে কেন্দ্র করে। ক্লাসিক সাহিত্যের ভারবোজিক এবং জন মিল্টনের ব্যোমবাস্টিক শব্দে সাহিত্য রচনার ধারা থেকে বের হয়ে এলেন ডরষষরধস ডড়ৎফংড়িৎঃয, ঔযড়হ কবধঃং এবং ঝযবষষু. তাদের হাতে রচিত হলো নতুন যুগের, যে যুগের কাব্য ও সাহিত্যের শব্দগুলো ছিল খুবই সহজ সরল আর প্রাঞ্জল। আর এই সহজ সরল, প্রাঞ্জল ভাষা আর শব্দ হয়ে উঠল হুমায়ূন লেখনীর অন্যতম অনুষঙ্গ। সাধারণ মানুষের ভাষা সহজ। আর তাই সহজ ভাষাতেই হতে হবে সাহিত্যকর্ম। হুমায়ূন সাধারণ পাঠকের মন পড়তে পারতেন। হুমায়ূন তার লেখনীতে সহজ সরল আর প্রাঞ্জল ভাষা ব্যবহার করেছেন কিন্তু ভাষার মাধুর্যতার প্রশ্নে তিনি আপস করেননি। ভাষার মাধুর্যতা একটি লেখাকে পাঠকের কাছে আকর্ষনীয় করে তোলে। লেখার পরতে পরতে যে রস পাঠকেরা পেয়ে থাকেন সেটা এই মাধুর্যতার কারণেই। হুমায়ূন আহমেদের লেখনীতে বৈচিত্র্য বিদ্যমান। কমেডি এবং ট্রাজেডির যৌক্তিক সমন্বয় করতে তিনি ছিলেন ওস্তাদ। তার অনেক নাটকে এবং লেখায় এর প্রমাণ মিলেছে। পাঠক বুঝতে পারছে অমুক চরিত্রটির ট্রাজিক পরিণতি হবে (যদিও পাঠক মনে মনে সেটা কামনা করছে না) কিন্তু শেষ অবস্থায় সেই চরিত্রটির কমিক পরিণতি হলো এবং পাঠক তার মনের সুপ্ত স্বস্তি পেয়ে গেল। ট্রাজেডি এবং কমিডির এমন সমন্বয় আমরা উইলিয়াম শেকসপিয়ারের নাটকে দেখি। হুমায়ূন আহমেদ তার কমিক চরিত্রগুলোকে রোমান্টিক ধাঁচে উপস্থাপনে মাস্টার ছিলেন, যা সচরাচর অন্য লেখকের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এ্যারিস্টিটল তার 'পয়েটিকস'-এ নাটকের তিনটি ইউনিটির কথা বলেছিলেন, যেটা ক্লাসিক নাটকের অপরিহার্য উপাদান ছিল। কিন্তু উইলিয়াম শেকসপিয়ার নাটকের সেই তিনটি ইউনিটকে ভঙ্গ করলেন, কিন্তু নাটকে সৃষ্টি করলেন এক নতুন মাত্রা। হুমায়ূন আহমেদের নাটকে ঠিক এই দিকটা প্রবল ছিল। তিনি নাটকের গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে এসে নাটকের বহুমাত্রিক বিষয়ে প্রাধান্য দিলেন। নাটকের পস্নটগুলোকে তিনি ভিন্ন ধাঁচে সাজালেন। নাটকের কল্পরূপকে জীবন্ত করে তুলতে লাগলেন। প্রতিটি চরিত্রকে এমনভাবে উপস্থাপন করলেন যেন কোনোটার চেয়ে কোনোটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গল্পের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা এবং সেই ধারাবাহিকতায় সব ধরনের পাঠক, শ্রোতা ও দর্শককে মজিয়ে রাখা এবং হাসি, কান্না, রসবোধে চাঙ্গা রাখার মতো অসাধ্য কাজটি খুব নিখুঁতভাবে করতে পারতেন হুমায়ূন আহমেদ। বিশ্বের সব ক্লাসিক সাহিত্যের চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা একটি মূখ্য ভূমিকায় থেকেছে। হুমায়ূন আহমেদ চরিত্র নির্মাণে নিরপেক্ষ থেকে ক্লাসিক সাহিত্যের ধারাকে সমুন্নত রেখেছেন। হিমু, মিসির আলী, শুভ্রসহ আরও যত চরিত্র তিনি সৃষ্টি করেছেন তাদের সবগুলোর অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো নিরপেক্ষতা। উইলিয়াম শেকসপিয়ারের 'কিং হেনরি ফোর' নাটকে দেখা যায় রাজার ছেলে তার দুষ্টু বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে থাকে, সময় কাটায়। কিন্তু রাজার ছেলে যখন সিংহাসনে বসল তখন সে নিরপেক্ষ হয়ে গেল। বন্ধুদের অন্যায় আবদারকে সে পাত্তা দিল না। হুমায়ূন আহমেদের রচনার আরেকটি অনবদ্য দিক হলো পয়েটিক জাস্টিস। বাস্তবিক ন্যায় বিচার আর কাব্যিক ন্যায় বিচারের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। নাটকীয়তার ধাপে ধাপে পয়েটিক জাস্টিস প্রতিষ্ঠিত হয়। পয়েটিক জাস্টিসের মাধ্যমে পাঠক, দর্শক, স্রোতাকে মূলত কিছু বার্তা দেওয়া হয় এলিগরিক্যাল ধাঁচে। অনেক সমালোচকের মতে হুমায়ূন আহমেদ সংস্কার নিয়ে লেখেননি। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ লেখনীতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংস্কারের আভাস মিলে। লেখার মাঝে জীবনের বাস্তবতাকে তুলে আনা এবং পাঠককে নতুন করে স্বপ্ন দেখায় তার লেখনী। পাঠক ও দর্শকদের মনোজগতে বিচরণ করতে পারতেন হুমায়ূন। বিমূর্তকে মূর্তরূপে এবং প্রাণহীনকে প্রাণ দিয়ে উপস্থাপন করতে পারতেন। পাঠকের অনুভূতির জায়গাগুলো তার ভালো করে জানা ছিল। পাঠককে কল্পজগতে বিচরণ করিয়ে বাস্তবতার স্বাদ গ্রহণ করাতে পারতেন। সব ধর্ম, মত ও পথকে সম্মান করে লিখে গেছেন। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও প্রথাকে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপনে দক্ষ ছিলেন। লেখায় ভারসাম্যতা, বস্তুনিষ্ঠতা, সেন্স অব হিউমার, দেশপ্রেম ও মানবতাবাদ প্রাধান্য পেয়েছে। দৃশ্যকল্প ফুটিয়ে তুলতে ঝানু ছিলেন। মিসির আলী সিরিজে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা দিয়েছেন সুনিপুণভাবে। সাহসী লেখায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ব্যঙ্গ করতেন উচ্চমার্গের লিখন শৈলীতে, যা পাঠকের হৃদয়ে রসদ যোগাতো। তার ব্যঙ্গ রচনার ধাঁচ দেখে জনাথন সুইফটকেই মনে পড়ে যায়। মোটিভেশন এবং চমক তার উপন্যাস এবং নাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তার সাহিত্যকর্মের প্রতিটি চরণেই যেন নতুন চমকের আস্বাদন। তার গল্প বলার ধরন এবং উপস্থাপন কৌশল স্বতন্ত্র। সাবলীল, ইউনিক এবং ড্রামেটিক সংলাপে তিনি পান্ডিত্য দেখিয়েছেন। সংলাপে হিউমারকে এক অনন্য রূপ দিয়েছেন। ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে চরিত্রের বিশ্লেষণ এক ভিন্ন সংযোজন তার লেখনীর। গল্পের পস্নট এবং চরিত্রগুলোর বিন্যস্তকরণ এমনভাবে তৈরি যেখানে তারা মধ্যপন্থি হয়, আপস করে চলে কিন্তু অন্যায় করে না। প্রজ্ঞা ও আবেগের দারুণ সমন্বয় চরিত্র রূপায়নে। জাদুকরী নির্মাণ কৌশলের কারণে তার উপন্যাসগুলো পাঠক সমাদৃত হয়েছে। তার কথা সাহিত্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের মানুষের অভিনব মনস্তত্ত্ব প্রাধান্য পেয়েছে। তার নন্দিত নরক উপন্যাস যেটার বড় নজীর। হুমায়ূন আহামেদ কোনো বিশেষ শ্রেণির জন্য লেখেননি। তিনি তার লেখনীতে দেখিয়েছেন প্রতিটি মানুষই পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিশেষ হতে পারে। প্রতিটি ব্যক্তি কীভাবে নিজের মতো চলতে পারে এবং সমস্যার সমাধান করতে পারে সেটার নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন। সংকট, সংকট উত্তরণ, রোমান্স, রসবোধ সব কিছুতেই ব্যক্তি দর্শনের একটি প্রভাব দেখা যায়। কাহিনী রচনায় বাঙালির রুচি, সংস্কৃতি ও চেতনাকে ধারণ করতেন তার লেখায়। ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনায় অভিনবত্বের স্বাক্ষর দেখতে পাই। তার শ্যামল ছায়া উপন্যাসে হাসান আলীর রাজাকার থেকে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠার গল্পটি পাঠকদের মুগ্ধ করে, নতুন ভাব জগতে নিয়ে যায়। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক লেখক। তার দেয়াল উপন্যাসটিতে অসাম্প্রদায়িকতার চিত্র ফুটে উঠেছে। সাম্প্রদায়িক চেতনা একটি সমাজকে কতটা পিছে ঠেলে দেয় তা তিনি তুলে ধরেছেন তার বিভিন্ন উপন্যাসে। বাঙালি সম্প্রীতির অনন্য নজীর দেখা যায় তার 'জোছনা ও জননীর গল্প' উপন্যাসে। হুমায়ূন আহমেদ তার রচনাগুলোতে কাহিনী, সংলাপ, এ্যাকশন এমনভাবে সাজাতেন যেন যে কেউ পড়লে সে ভাবতে শুরু করত এটা বুঝি তার নিজের জীবনেরই গল্প। কাহিনী বর্ণনার প্রতিটি পর্বে নাটকীয়তা বিদ্যমান। কাহিনীর নাটকীয়তা পাঠককে শুরুতে সংশয়ী ও নৈরাশ্যবাদী করলেও সমাপ্তিতে পাঠক আশাবাদী হয়েছে এবং হতাশা নয়, আশাতেই যে জীবনের পূর্ণতা তা উপলব্ধি করেছে। অনেক লেখকের ব্যক্তিগত জীবন তার লেখনীর ওপর প্রভাব ফেলে। হুমায়ূন আহমেদ তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিতর্কিত হয়েছেন, কিন্তু তার লেখনীতে এর একটু আঁচও লাগেনি। আর এখানেই হুমায়ূনের বিশেষত্ব। তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, গল্পকার, কবি, গীতিকার, নাট্যকার ও চলচিত্রকার। তিনি ছিলেন এমনই একজন সৃষ্টিশীল মানুষ যিনি তরুণ আর কিশোরদের বইমুখী করতে পেরেছিলেন, দর্শকদেরকে নাটকমুখী করতে পেরেছিলেন এবং সুস্থ ধারার বাংলা চলচিত্র নির্মাণ করে মানুষকে সিনেমামুখী করেছিলেন। সুস্থ ধারার বিনোদন দিয়ে বাংলা সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। প্রেম, বিরহ, ট্রাজেডি, কমিডি, ট্রাজিক-কমিডি, রোমান্টিক-কমেডি, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, কবিতা, গান, নাটকসহ নানা বিষয়ে এক ভিন্নমাত্রিক লেখা জাতিকে উপহার দিয়েছেন। বহুব্রীহি, এই সব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমনি, নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার-এর মতো মৌলিক এবং হৃদয়গ্রাহী লেখা খুব কম লেখকই উপহার দিতে পেরেছেন। জীবনের অনেক ছোট ছোট বিষয়কে কাব্যময় করে তুলতে পারতেন। তিনি যে চরিত্রগুলোর রূপায়ন করেছেন সেগুলোর ওপর নির্দিষ্ট কোনো মতাদর্শ চাপিয়ে দেননি। চরিত্রায়নে উদার নৈতিক দর্শন দৃশ্যমান। শেকসপিয়ারের নাটকে সমাজের উচ্চবিত্তকে হিরোইজমের ভূমিকায় দেখা গেছে কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের নাটকে সমাজের মধ্যবিত্তদের হিরোইজমের ভূমিকায় দেখা গেছে। একজন মধ্যবিত্তের মাঝেও যে হিরোইজম কাজ করতে পারে তা তিনি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বাঙালিয়ানার গড় বৈশিষ্ট্য তার লেখনীতে ওঠে এসেছে। পারিবারিক বলয়ে বাঙালি জীবনের গল্পগুলোকে তিনি শিল্প রূপ দিয়েছেন। সিগমান্ড ফ্রয়েড মানুষের সাবকনসাস মাইন্ডের কথা বলেছেন, যেখানে মানুষ তার কল্পলোকে বিরাজ করে। হুমায়ূন আহমেদ পাঠকের এই সাবকনসাস মাইন্ডকে খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি খুব সহজেই পাঠককে স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরিয়ে আনতে পারতেন। ভাষার সারল্যেও ভাবগাম্ভীর্য আর গভীরতা বজায় রেখেছেন। ধর্মীয় নিরপেক্ষতা, নারী-পুরুষের সাম্যভিত্তিক সমাজ চিত্রিত করেছেন। পুরুষতন্ত্র প্রাধান্য পায়নি তার লেখায়। এমনকি ক্ষমতাবান নারীকেও তিনি পারিবারিক বলয়ের ভেতরে রেখেই উপস্থাপন করেছেন। মানুষ সহজাতভাবেই গল্প পছন্দ করে। কিন্তু সেই গল্পটি হওয়া চাই তার নিজের জীবনের মতো। প্রতিটি মানুষের জীবনের গল্প ভিন্ন কিন্তু সবার গল্পগুলো যেন একই সুতায় গাঁথা মালার মতো। হুমায়ূন আহমেদ ঠিক এই দর্শনটিই বুঝতে পেরেছিলেন। ভিন্ন ভিন্ন গল্পগুলোকে সার্বিকীকরণ করে সবার মনের কথাগুলোকে কাব্যময় করে উপস্থাপন করেছেন। নিঃসঙ্গতা জীবনের একটি বড় অংশ। আর এটিকে হুমায়ূন তার 'তোমাকে' উপন্যাসে দারুণভাবে চিত্রিত করেছেন। মানুষ অর্থবিত্তে স্বচ্ছল হলে বড়লোকিপানা দেখাতে পছন্দ করে। হুমায়ূন তার 'নক্ষত্রের রাত' উপন্যাসে রেবেকার মার চরিত্রের মাধ্যমে। সাধারণ মানুষ প্রাণ খুলে হাসতে চায়, গল্প শুনতে চায়, নিজেদের গল্প বলতে চায়। আর সেটিই দশকের পর দশক ধরে করে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন, মানুষ তাকেই মনে রাখে যিনি বাঁক নিতে জানেন, নতুন পথের সন্ধান দিতে পারেন। শ্রোতা, দর্শক আর পাঠককে আকৃষ্ট করতে তাকে ভাঁড়ামি, অশ্লীলতা আর অযথা বাক্য বয়ানের প্রয়োজন হয়নি। চরিত্রায়নের মধ্যে পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা, সহমর্মিতা, স্নেহ আর হাস্যরসের মাধ্যমে এক ধরনের বৈচিত্র্যময় নান্দনিকতা তৈরি করতে পারতেন। 'এই সব দিনরাত্রি' এবং 'আজ রবিবার' নাটকে তিনি যৌথ পরিবারের বন্ধনকে তুলে ধরেছেন চমৎকারভাবে। 'নিমফুল' নাটকে ডাকাতের চোখ তোলা হবে বলে চরম কর্মযজ্ঞের আয়োজন হয়েছিল এবং দর্শকদের মাঝে চরম আশংকা তৈরি হয়েছিল, কিন্তু শেষ দৃশ্যে তাকে পুলিশের মুখোমুখি করে স্বস্তির জায়গা তৈরি করলেন। চরম ক্ষ্যাপাটে চরিত্রকেও তার নাটকে অতি মানবিক রূপে উপস্থাপিত হতে দেখা যায়। কোথাও কেউ নেই নাটকে এমনটি দেখা গেল। তিনি নির্জলা সত্যের আড়ম্বরহীন উপস্থাপন করতে পারতেন। নেতিবাচক চরিত্রেও যে ইতিবাচক কিছু দিক থাকে তা তিনি দেখিয়েছেন 'কোথাও কেউ নেই' নাটকে। মন্দতেও ভালো কিছু থাকে এটি আমরা শেকসপিয়ারের নাটকেও দেখি। তার বিখ্যাত একটি লাইন 'ঝবিবঃং ধৎব :যব ঁংবং ড়ভ ধফাবৎংরঃু'. এখানে নাট্যকার মন্দের মাঝে ভালো গুণ আবিষ্কার করেছেন। মিসির আলী, হিমু, শুভ্র চরিত্রগুলোকে সাদা চোখে হয়তো মূল্যহীন মনে হবে। কিন্তু বাস্তব জীবনে যা করা সহজ নয়, তারা তাই করে দেখিয়েছে। এজন্যই এই চরিত্রগুলো সর্বকালের প্রতিরূপ। জীবন ঘনিষ্ঠ বিষয়ের অপূর্ব দৃশ্যায়ন বা চিত্রায়ন করতে পারতেন। তার বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার লেখনীতে চরিত্রের রূপায়ন পাঠকের বিষণ্ন্ন মনকে ম্যাজিকের মতো প্রশান্তি এনে দিয়েছে। তার লেখনী দেশের পর্যটন শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। তার রচিত সমুদ্রবিলাস উপন্যাসের মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপটি বিশ্ব পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। তার 'দ্বারুচিনি দ্বীপ' প্রকাশের পর সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় শুরু হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন এমনই একজন লেখক যিনি তার লেখনীর মাধ্যমে একটি জাতীয় রুচি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার সহজাত কাব্যিক প্রকাশ পাঠককে মুগ্ধ করত। খুব বেশি কবিতা তিনি লেখেননি। তবে তার গৃহত্যাগী জোছনা কাব্য সংকলনটি ১৯৯৬ সালে প্রকাশের পর পাঠক একটি ভিন্ন স্বাদের কাব্য উপহার পেয়েছিল। সাহিত্যের মূল স্রোতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হুমায়ূন আহমেদ বলতে গেলে উদাসীন ছিলেন। তার সহজাত এবং স্বভাবজাত গল্প বলার ধরন আর ব্যতিক্রমী লেখনীর কারণেই শ্রোতা, দর্শক আর পাঠকেরা তার সৃষ্টিকর্মকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে গবেষণা করার জাতীয় দীনতার ছাপ দেখি। তাকে নিয়ে তিক্ত সমালোচনাও কর্ণগোচর হয়েছে। তিনি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে লেখেন এমন বাচ্য উচ্চারিত হয়েছে। আমার প্রশ্ন হল যারা বাণিজ্য করেননি তাদের লেখা জনগণ লুফে নিল না কেন? হুমায়ূন আহমেদের লেখা কেন জনগণের পছন্দ হলো? কী জাদু আর মধু তার লেখায় আছে? যাহোক আমি অত বড় বোদ্ধা নই। তাই অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাখ্যায় যাব না। যাহোক গতানুগতিক সাহিত্য পাঠ দিয়ে হুমায়ূন আহমেদকে মূল্যায়ন করা যাবে না। তিনি ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৯৪ সালে একুশে পদকে ভূষিত হোন। কিন্তু এ দু'টি পুরস্কারই তার সৃষ্টিকর্মের জন্য যথেষ্ট নয়। তার সৃষ্টিকর্মগুলোকে জাতীয়ভাবে গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়নের সময় এসেছে।