বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল। লালমনিরহাট জেলার তিস্তা নদীর তীরের নিকটবর্তী। নিম্ন চরাঞ্চলের মানুষ আবিদ মিয়া। মাটির মতো যার মন। স্ত্রী ঊর্মি ছেলে শিশির আর মেয়ে ঝর্ণাকে নিয়ে বেশ সুখের সংসার তার। মেয়ে ঝর্ণা বড়। এ বছর ঝর্ণা লালমনিরহাট কলেজ থেকে বিএ ফাইনাল দিয়েছে। বেশ বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে ঝর্ণা এখন। ছেলে শিশির ছোট। দশ বছর মতো বয়স হবে ছেলে শিশিরের। শিশির স্থানীয় গ্রামের স্কুলে ফাইভে পড়ছে। তিন বিঘা জমির ওপর কৃষিকাজ করে আর কিছু গরু-ছাগল পোষে আবিদের আগে বেশ সচ্ছলতার সঙ্গে সংসার চলত। কিন্তু বেশ কয়েকটা বছর পাহাড়ের উজান ঢল নামার কারণে। আর প্রতিটা বছর ভারতীয় তিস্তা নদীর বাঁধ আর ফারাক্কার বাঁধ খুলে দেওয়ায় বন্যার জলে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়াতে সংসারে এখন অভাব-অনটন দেখা দিয়েছে। এ বছর চরের পানি নিচে নদীতে নেমে যাওয়ার পর চর জেগে উঠেছে। আর তাই আবিদ মিয়া দুচোখে অনেক স্বপ্ন আর এক বুক আশা নিয়ে জমি চাষের উপযোগী করার জন্য নাওয়া-খাওয়া ভুলে উঠে-পড়ে লেগেছে। রাতে ঘুমানোর সময় আবিদ বউ ঊর্মিকে বলল- ও বউ, কাল কিন্তু খুব সকালে আমাকে মাঠে যেতে হবে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল...
দেখি, এবার ফসল করে সংসারের হাল ফেরাতে পারি কিনা। বউ ঊর্মিও দীর্ঘ হাই ছেড়ে বলল...হুম..দ্যাখো..কয়বছর যেভাবে বন্যায় ডুবে ফসল নষ্ট হলো। এবার যদি একটু সুখের মুখ দ্যাখা যায়। তারপর ঊর্মি আবিদের দিকে তাকিয়ে বলল...নাও, ঘুমিয়ে পড়ো..আজ কয়দিন খাটাখাটুনি
করে তোমার শরীরের ওপর যে ধকল যাচ্ছে...।
আবিদ বলল, ঘুম যে আমার চোখে আসে না ঝর্ণার মা। মেয়ে ঝর্ণা যে বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে।
যতক্ষণ একটা সৎ কর্মঠ পাত্র, ভালো ঘর দেখে মেয়েটার ব্যবস্থা করতে না পারছি...। বোঝই তো...
সেয়ানা বিয়ের লায়েক মেয়ে ঘরে। দুশ্চিন্তার কি শেষ আছে? ঊর্মি বলল, হুম তা-অবশ্য ঠিক বলেছ। আমি যে মেয়ের মা। চিন্তা আমারও তো হয়। কিন্তু কি করব? বিয়েতে তো একটা মোটা খরচ আছে। পরপর কয়বছর বন্যায় ফসল নষ্ট না হলে কি আর এ-তো অভাবে পড়তাম। তারপর
দুজন যে-যার মতো পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল। শেষ রাতে পাড়ার মসজিদ থেকে মাইকে ফজরের আজানের শব্দ কানে আসতেই আবিরের ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দ্রম্নত দাঁত মেজে ওজু করে ফজরের নামাজ পড়ে নিল। তারপর একটু ভোরের আলো ফুটতেই মাঠে যাওয়ার জন্য গরু লাঙ্গল জোয়াল মই গোছাতে লাগল। ওদিকে স্ত্রী ঊর্মি নামাজ শেষে কিছুক্ষণ কোরআন পড়ে সকালের বাসি কাজকর্মে মন দিয়েছে। মেয়ে ঝর্ণা উঠে নামাজ পড়ে তার ঘরে বই পড়তে বসেছে। ছেলে শিশির এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। আবির বলল ও ঝর্ণার মা? ঊর্মি বলল। হঁ্যা, বল শুনছি। আবির বলল, দ্যাখো তো, আমার পান-সুপারির কৌটাটা কোথায়? খুঁজে পাচ্ছি না- যে...! তারপর ব্যস্ততার ভাব করে বলল! আমার যে দেরি হয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি মাঠে যেতে হবে। ঊর্মি বলল, হঁ্যা দেখছি একটু দাঁড়াও। তারপর ঊর্মি হাতের কাজ রেখে বারান্দায় তক্তার ওপর কৌটা দেখে বলল। এইতো পানের কৌটা এখানে।
কিভাবে যে খোঁজ না বুঝি না...। তারপর কৌটায় পান-সুপারি চুন জর্দা গুছিয়ে বলল, এই নাও কৌটা। ততক্ষণে ছেলে শিশিরও ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। মেয়ে ঝর্ণা ঘর থেকে বেরিয়ে বলল, বাজান তুমি মাঠে যাইতেছ? আবিদ বলল, হ-রে মা, কেন...কিছু বলবি মা ঝর্ণা? ঝর্ণা বলল, না বাজান এমনিতেই জিগাইলাম। ছেলে শিশির চোখ কচলাতে কচলাতে এস বলল, বাজান আমি ও তোমার সঙ্গে মাঠে যাব। আবিদ বলল, এখন না বাপজান। একটু আলো ফুটলে তখন যাইও। তারপর আবিদ মাঠে যাওয়ার সময় বউ ঊর্মিকে বলল, মাঠে কিন্তু আমার অনেক কাজ। যদি পার একটু বেলা হলে আমার খাবার পানি পাঠিয়ে দিও...? ঊর্মিও বলল, আচ্ছা ঠিক আছে যাও। আবির মাঠে গিয়ে হালচাষ শুরু করল। কিছুক্ষণ পর গাঁয়ের পশ্চিম পাড়ার মনু মেম্বার মাঠে ঘুরতে এসেছে। আবিদকে দেখে বলল, কেমন আছ আবিদ মিয়া? আবিদ, জি মেম্বার সাব ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? মেম্বার, এই তো আছি। আলস্নাহ নিয়ে যাচ্ছে এক- ভাবে। তা-খুব দেখছি কষ্ট করছ জমিতে আজ কয়দিন। তা-কি লাগাবা জমিতে ভাবছ? আবিদ বলল, কি আর লাগামু মেম্বার সাব...। চিন্তা করছি এই জমিতে পাট, আর ওই পাশের উঁচু জমিটাই সবজি বুনব। আর ওই দূরে যে জমিটা ওটাই বাদাম লাগাব। মেম্বার তা-বেশ বেশ খুব ভালো লাগাও। তারপর মেম্বার বলল, মেয়ে কি বিয়ে দিবা আবিদ মিয়া? একটা ভালো ঘরের ডাক্তার পাত্র আছে। গত বছর পাস দিয়ে বেরিয়েছে। দেখতে শুনতেও মাশাআলস্নাহ। তোমার মেয়ে মা ঝর্ণার সঙ্গে মানাবে ভালো। আবিদ বলল হ মেম্বার সাব, মেয়ে যখন বড় হয়েছে বিয়ে তো দিতেই হবে। ভালো সম্বন্ধ যখন বলছেন...তই আমার একটা কথা আছে। মেম্বার বলল তা- তোমার কি কথা বল? আবিদ বলল, যদি ছেলে পক্ষের পছন্দ হয়। বিয়ে কিন্তু ফসল ওঠার পর হবে। মেম্বার বলল, ও, এই কথা। আচ্ছা ঠিক আছে সেটা আমি দেখব। আচ্ছা কাজ কর আবিদ ছেলে পক্ষ কবে আসবে আমি তোমাকে জানাব কেমন। তারপর চলে গেল। একটু বেলা হলেই ছেলে শিশির মা- ঊর্মিকে বলল মা, বাজানের লাগি ভাত দাও। ঊর্মি বলল, হ বাজান দিচ্ছি। তারপর ভাত বেড়ে গুছিয়ে দিল। শিশির ভাত নিয়ে মাঠে গেল। দূর থেকে একটু জোরে ডাক দিল। বাজান...ও বাজান তোমার জন্য খাবার আনছি খেয়ে যাও। আবিদও দূর থেকে একটু জোরে বলল...হ..আসছি বাজান। শিশির একটা উঁচু জমির আইলের পাশে খাবার রেখে দাঁড়িয়ে রইল। আবিদ চুমকো দিয়ে গরু দাঁড় করিয়ে গরু লাঙ্গল
রেখে ছেলে শিশিরের কাছে এসে খেতে বসল।
এর বেশ কিছুদিন পর পাটের চারাগুলো একটু বড় হয়েছে। আবিদের সঙ্গে ছেলে শিশির জমির আগাছা পরিষ্কার করছে। মেয়ে ঝর্ণা আর ওর মা ঊর্মি খাবার নিয়ে মাঠে গেল। ঝর্ণা বলল, দেখছ মা আমাদের পাটের চারা কি সুন্দর লকলক করছে? আর ওই চেয়ে দ্যাখো বাদাম গাছ
সবজিও কত সুন্দর হয়ছে। ঊর্মি বলল, হ-রে মা, খুব সুন্দর হয়ছে। না হলে আমরা বাঁচুম কি খেয়ে। একসময় ঝর্ণা বলল, ও বাজান তোমাদের লাগি খাবার আনছি এসে খেয়ে নাও। আবিদ বলল আসছি মা। তারপর বাপ-বেটা এসে খেতে বসল। আবিদ বলল কচি ছেলেটা রৌদ্রে পুড়ে আমার সঙ্গে কাজ করছে। আবার এই রৌদ্রে মা- ঝর্ণাকে মাঠে আনলে কেন? ঊর্মি বলতে যাবে...সে সময় ঝর্ণা বলল, মা নিয়ে আসতে চাইনি বাজান। আমি নিজে আসছি ফসল দেখব বলে।
কি সুন্দর পাটশ বাদাম গাছ, সবজি হয়েছে দেখে দুচোখ যেন জুড়ায় যাচ্ছে বাজান। আবিদ বলল হ-রে মা খুব সুন্দর হয়েছে। ছেলে শিশির বলল, জান বুবু, এই ফসল উঠলে বাজান তোমার বিয়ে দেবে। মেম্বার কাকা তোমার লাগি একটা ডাক্তার ছেলে দেখেছে। শুনে ঝর্ণা মা-বাবার সামনে বেশ লজ্জা পেল। ঊর্মি বলল, তাই নাকি শিশিরের বাপ? আবিদ বলল হ, মেম্বার সাব একটু আগে বলছিল। শিশির বলল বাব্বাহ ডাক্তার দেখলে আমার কি-যে ভয় করে। আমি বড় হলে ডাক্তার হব না। ঝর্ণা হেসে বলল তুই কি হবি তাহলে ভাই শিশির জর্জ-ব্যারিস্টার? আবিদ বলল, না তাও না। আমি বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হব দেখে নিও হুম। ওদের দুই ভাই-বোনের খুনসুটি কথাবার্তা শুনে আবিদ আর ঊর্মি হাসতে লাগল। একসময় খাওয়া শেষ হলে সব গুছিয়ে ঊর্মি বলল চল মা ঝর্ণা..এবার বাড়ি যায়। আবিদ বলল যা- মা ঝর্ণা। আমরা এই কাজটুকু শেষ করে আসছি। তারপর শিশিরকে বলল চল বাজান...। শিশির বলল হ চল বাজান। এর বেশকিছু দিন পর মেম্বার মেয়ে ঝর্ণার বিয়ের সম্বন্ধ আনল। দ্যাখা-শোনা বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেছে। ফসল ঘরে উঠলেই বিয়ে। এদিকে পাহাড়ের উজানের ঢল একটু একটু করে নামা শুরু করেছে। আবিদ প্রতিদিন মাঠে যায় ক্ষেতের ফসল দেখতে। চারি আইলের কোল ঘুরে ঘুরে ক্ষেতের ফসল দ্যাখে।
কিন্তু, কথায় বলে না.....
একবার ভাগ্য যদি টলে,
তবে তার সুখ আসে না কোনোকালে।
তেমনি ঘটল আবিদ আর তার পরিবারের সবার জীবনে। হঠাৎ এক ঘুমন্ত গভীর রাতে ভারত থেকে তিস্তা আর ফারাক্কার অনেক বাঁধ একসঙ্গে খুলে দেওয়ায় বন্যায় শেষ হয়ে গেল তাদের আশা স্বপ্ন সব। বন্যার প্রচন্ড জলের স্রোতে বাড়িঘর ভেঙে ভেসে গেল। সেই সঙ্গে ভেসে গেল গোয়ালে বাঁধা হালের গরু। আবিদ আর বউ ঊর্মি চিৎকার করে হাউমাউ করে কাঁদছে আর অথই জলের স্রোতের এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে আর বলছে। আমার যে সব শেষ হয়ে গেল রে বউ...আমার যে সব শেষ হয়ে গেল। কে-কাকে বাঁচাবে চারদিকে আহাজারি আর কান্নার রোল। হঠাৎ প্রচন্ড স্রোতে ছেলে আবিদের কণ্ঠ শুনতে পেল। আবিদ বলছে মা-
বাজান আমাকে বাঁচাও....আমাকে বাঁচাও..একটু
পরে সে শব্দ ম্স্নান হয়ে গেল। অন্ধকারে বাপজান...শিশির...ও শিশির...শিশিররে... কোথায় বাজান তুই? এভাবে মা-ঊর্মি আর বাবা আবিদ জলের চারদিকে হাতড়িয়ে খুঁজতে লাগল ছেলে শিশিরকে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেল না।
একসময় মেয়ে ঝর্ণার কথা মনে হতেই আবিদ বলল....আমার মেয়ে মা ঝর্ণা...মা ঝর্ণা কই?
ঊর্মি, ঝর্ণা...ও মা ঝর্ণা...মা তুই কই? আবিদও ডাকতে লাগল...কিন্তু কোথাও খুঁজে পেল না।
একসময় রাতের আঁধার কেটে গেল। মেয়ে ঝর্ণার লাশ খুঁজে পেল দূরের একটা বাঁশঝাড়ে। স্রোতের সঙ্গে ভেসে গিয়ে বাঁশঝাড়ে আটকে গেছে ঝর্ণার লাশ। আর ছেলে শিশিরের লাশের খোঁজ এখনো পাইনি। বন্যার জল কমতে শুরু করেছে। বিভিন্ন জায়গায় পচাগলা লাশ পাওয়া যাচ্ছে। যখনই কোথাও লাশ পাই আবিদ আর ঊর্মি কাঁদতে কাঁদতে পাগলের মতো সেখানে ছুটে যায়। আর বলে কই! আমাদের ছেলে, আমাদের ছেলে শিশির কই? কিন্তু না...শিশিরকে কোথাও পাচ্ছে না কোথাও..না...। কি করে পাবে...কোথায় খুঁজে পাবে তাকে? তাকে যে টেনে নিয়ে গেছে সর্বনাশা বন্যার বানের জলের ভয়াবহ নিষ্ঠুর করালগ্রাসে...।