একজন জব্বারের গল্প
প্রকাশ | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ওয়াহিদ জামান
মানিকখালি সরকারি গোরস্তানের খাসজমির দক্ষিণ পাশের তালগাছটার গাঘেঁষে জব্বারের ছোট্ট ছনের ঘর। হাল জামানায় এরকম জীর্ণশীর্ণ কুটির- যা শহরের বস্তিতে দেখা মেলে। গাঁও-গ্রামে এমন চিত্র আর দেখা যায় না। গ্রামেও এখন কংক্রিটের বাড়ি। নির্মমতার এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা জব্বারের এ আশ্রয়। আষাঢ় শ্রাবনে ফুটো চাল দিয়ে হইহই করে বৃষ্টির পানি ঢোকে। কালবোশেখি ঝড়ে তার ঘরের চালা উড়ে যায় হরহামেশাই। এতে তার কোনো মনোকষ্ট নেই। জীবন গৃহের ছাঁদ ফুড়ে কষ্টের নোনা পানি ঢুকেছে বিশ বছর আগে।
সে পানি এখন রোজকার মতোই হৃদয় আঙিনায় হানা দেয় তার। সীমাহীন দুঃখের সাগরে যে ভেসে বেড়ায় ঠিকানাহীন কচুরি পানার মতো, সামান্য এ কষ্ট তার গায়েই বাঁধে না। জব্বারের এহেন হালহকিকত আগে ছিল না। স্বচ্ছল কৃষক পরিবারে তার জন্ম। নিয়তির কঠিন কষাঘাতে জর্জরিত জব্বার এখন পথের ভিখারি। অথচ দশক দুই আগে যৌবনের প্রারম্ভে জব্বার ছিল আশাশুনি গ্রামের শাহেন শাহ।
\হআয়েশি জীবনে যার কোনো তুলনাই ছিল না। সম্পদশালী কৃষক পিতার একমাত্র উত্তরাধিকারী জব্বার এখন মানুষের কাছে হাত পেতে চলে। পঞ্চাশোর্ধ জব্বারকে দেখে মনে হবে আশি বছরের বৃদ্ধ। শরীরে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি ক্যানসার। এখন শুধু বিদায়ের অপেক্ষার পালা।
সবার মতো তারও স্বপ্ন ছিল সুস্থ জীবনের, স্বপ্নীল জীবনের, বেঁচে থাকবার অধিকার। কিন্তু ভয়াল খোলপেটুয়া নদীর করাল গ্রাসে তার স্বপ্ন ভেসে গেছে নোনা জলে। এখন সে এক স্বপ্নহীন জীবন্ত মহাকাব্য যার প্রতিটা অক্ষর, প্রতিটা পঙক্তি এক একটা দুঃখের বিরামহীন কাহিনী। নদীর ভাঙন তাকে যতটা নিঃশ্ব করেছে, সম্পদে আর অর্থবৈভবে তার চেয়ে নিঃস্ব করেছে তার মন যে নারী- তার কথা আজ জানব। এখন থেকে বিশ বছর আগে। জব্বার তখন ফুটন্ত গোলাপের মতো এক যুবক।
যৌবনের তেজোদ্দীপ্ত উলস্নাসে সে ভাসতো অসীম স্বপ্ন নিয়ে। এলাকার সুন্দরী মেয়েদের মনে সে ছিল এক রাজপুত্র। পৌরুষ সৌষ্ঠবে ভরা যৌবনের রুপালি স্রোতে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল এক অপরূপ রূপসীর। যার প্রেমের বলি হয়েছিল অনেক যুবক। কিন্তু কেউ তার নাগাল পায়নি। জব্বার সেই সৌভাগ্যবান যার প্রেমের জালে আটকা পড়েছিল সে রূপসী। নাম তার আলেয়া, জব্বারদের গ্রামের আর এক কুলীন কৃষক পরিবারের সন্তান।
জব্বার যখন সদ্য বিএ পাস করেছে আলেয়া তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। আগুন ঝরা বয়সে দুজনেরই পদার্পণ। কোনো এক বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা হয় দুজনের। পৌরুষ সৌন্দর্যে ভরা জব্বারকে দেখে আলেয়াই আগে প্রেমে পড়ে। কাছের মানুষের কাছে জব্বারের খোঁজখবর নেয়। একই এলাকায় গ্রামের দুপ্রান্তে তাদের বাড়ি।
আলেয়া মনে মনে খুশি হয়। ভাবে একটু দূরত্ব হলেও গ্রামতো এক। নানা অজুহাতে জব্বারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে আলেয়া। শুঙ্গু যে আলেয়ার ভেতরে টান তা নয়, জব্বারও আলেয়ার প্রতি মুগ্ধ হতে থাকে বারেবারে। সুন্দরী রমণীর অদৃশ্য আহ্বানে- হৃদয়ের আকুতিতে পুরুষ মানুষ মুগ্ধ তো হবেই। এটিই নর-নারীর ললাট বিধান। বিয়ে অনুষ্ঠানের কোনো এক মুহূর্তে তাদের বোঝাপড়া হয়, মনের লেনদেন হয়।
তারপর দুজন দুজনে আবদ্ধ হয় মনের অজানা বন্ধনে। কাছে আসাআসি, দেখা সাক্ষাৎ অবিরাম ধারায় চলতে থাকে। দু'টি অবুঝ মনের অজানা কথা একে অন্যকে সঁপে দেয় দিধাহীনভাবে। সে প্রেমের ইতিহাস হয়তো নামিদামি মানুষের কাছে অজানা কিন্তু জগৎ সংসারে তার মূল্য এতটুকু কম নয়।
কোনো এক বসন্তের বিকালে তারা সিদ্ধান্ত নেয় চিরকালের জন্য একে অপরের হওয়ার। জব্বার বলে, এভাবে হয় না আলেয়া।
- কীভাবে?
- আমি আর একা থাকতে পারছি না
- কেন?
- তুমি বুঝ না?
- বুঝি
আলেয়া হঠাৎ জব্বারের ঠোঁটে চুমু খায়। মুহূর্তেই জব্বারের শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরায় কি যেন দোল খেয়ে যায়। অদৃশ্য অদ্ভুত এক ভালোলাগা অনুভব করে। মুখে তার কোনো কথা ফোটে না। অবাক বিস্ময়ে অপলক দৃষ্টিতে আলেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। লাজুক আলেয়া মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। নীরবতা নিমিষে গিলে খায় তাদের। সব নীরবতার শৃঙ্খল ভেঙে আলেয়া বলে, আমি দ্রম্নত বিয়ে করতে চাই। তুমি ব্যবস্থা কর।
একথা বলে আপন মনে জিহ্বায় কামড় খায় আলেয়া। মনে মনে ভাবে, নির্লজ্জের মতো একথা সে নাও বলতে পারত। জব্বারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতে পারত। কিন্তু না, তার মনের গহিনে কে যেন তাড়া করে ফিরছে বারবার। যার আহ্বান অস্বীকার করার ক্ষমতা আলেয়ার নেই।
উত্তরে জব্বার বলে, তাই করব।
জব্বারের উত্তর শুনে আলেয়া যেন আসমান নাগালে পায়। মনে হয় জগতে সে সবচেয়ে সুখী নারী। তার হৃদয় বাসনা পূর্ণ হতে চলেছে। নিজের ভেতরে এক অব্যক্ত কামনা তাকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে। ঘুমন্ত মানুষ যেমন জেগে উঠলে পৃথিবীর সবকিছু তার কাছে নতুন মনে হয়, সজীব মনে হয়, আলেয়ার সেরকম মনে হয়। সে যেন নতুন পৃথিবীর আহবানে এক অন্তহীন সুখের আলো দেখে। জীবন তার কাছে অনেক অর্থবহ লাগে।
তারপর কোনো এক শুভক্ষণে দু'পরিবারের সিদ্ধান্তে তাদের বিয়ে হয়। দুটি হৃদয় খুঁজে পায় জীবনের নতুন ঠিকানা। তাদের জীবন চলতে থাকে ভালোবাসার পরশে। বিয়ের দু'বছর পরে আলেয়া অন্তঃসত্ত্বা হয়। জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে এসে জব্বার-আলেয়া আর এক নতুন জীবনের স্বাদ গ্রহণ করে। সীমাহীন এ সুখের স্রোতে তারা ভাসতে থাকে। কিন্তু তাদের এ সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এ কারোর ষড়যন্ত্র নয়, নয় কারো প্রতিহিংসা। তাদের জীবনের যবনিকা টেনেছে প্রকৃতি, তাদের নিষ্ঠুর নিয়তি। সে এক বেদনাদায়ক কাহিনী। আলেয়াকে বিয়ের পর জব্বার পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হয়ে যায়। যদিও তার কোনো অভাব ছিল না। পিতার অঢেল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকার সে। কিন্তু জব্বার নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়, নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চায়। অবশ্য তার এরকম চিন্তার পেছনে এক মহৎ নারীর ইশারা আছে, সে হচ্ছে আলেয়া। জব্বারের সমস্ত ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য তার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
জব্বার পল্ট্রি ফার্ম পরিচালনা করে। আলেয়ার উৎসাহ, সহযোগিতায় তাদের ফার্ম ধীরে ধীরে মহিরুহ ধারণ করে এবং লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ফার্মের মুরগির খাবার আনতে জব্বার প্রায়শ সাতক্ষীরা জেলা শহরে যায়। নিয়মমাফিক কোনো এক শনিবারে জব্বার সাতক্ষীরা যায়। ফিরে আসতে তার গভীর রাত হয়। অনেক মালপত্র কিনে আসতে জব্বারের দেরি হয়। পথে মোবাইলে আলেয়ার সঙ্গে তার কথা হয়।
জব্বারের আসতে বিলম্ব হচ্ছে বলে, আলেয়া অস্থির হয়ে ওঠে। আগে কখনো এত দেরি জব্বারের হয়নি। আজ আলেয়ার কেন যেন মনটা বেশি বিচলিত। মাত্র ১২ ঘণ্টা তার কাছ থেকে জব্বার দূরে। এরকম গত দু'বছরে ঘটেছে কয়েকবার। কিন্তু আলেয়ার আজকের মতো এত মন অস্থির হয়নি কখনো।
এত স্বল্প সময়ের মধ্যে জীবনের এতবড় বিষাদ কাহিনী সৃষ্টি হবে জব্বার তা কোনো দিন ভাবেনি।
মাঝরাতে জব্বারের বাড়িতে পৌঁছানোর আগে ঘটে যায় নির্মম ইতিহাস। যার রেশ জব্বারের জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি হবে।
সন্ধ্যার পর থেকে দমকা বাতাস বইতে শুরু করে। থেকে থেকে বৃষ্টি। নদীর তীরে জব্বারদের বাড়িতে আঁচড়ে পড়তে থাকে ঝড়ো বাতাস। খোলপেটুয়া নদী আজ যেন অতীতের চেয়ে বেশি বীভৎস ও ভয়ংকর। নদীর পানি ফুঁসে উঠতে থাকে ক্ষণে ক্ষণে। রাত ১২টা। আশপাশের বাড়ি ঘর থেকে মানুষের আতঙ্কিত আহাজারি আলেয়ার কানে আসে। আলেয়ার শ্বশুর শ্বাশুড়ি আলেয়াকে বলে, চল নিরাপদ আশ্রয়ে যাই। শুনলাম বান আসছে। নদীর তীর ভেঙে কয়েকটি বাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। মানুষজন নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু আলেয়া অনড়। সে বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। এক প্রকার বিরক্ত হয়ে আলেয়ার শ্বশুর জিজ্ঞেস করে, কি জন্য তুমি এখানে থাকবে?
আলেয়ার দৃঢ় জবাব, আপনার ছেলে ঘরে ফেরেনি। ও এসে আমাকে কোথায় পাবে?
শ্বশুর মানিক সরদার ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, আমরা কী হারিয়ে যাচ্ছি? আমরা এ গ্রামের কোথাও থাকব।
কিন্তু আলেয়া যাবে না। সে জব্বারের ঘরে ফেরার অপেক্ষায় থাকে। জব্বারের আর ঘরে ফেরা হয়নি। নিষ্ঠুর খোলপেটুয়ার বানের জলে ভেসে যায় আলেয়াসহ পরিবারের সবাই।
মাঝরাতে জব্বার এসে দেখে এক কিলোমিটারব্যাপী কোনো বাড়িঘর নেই। সাগরের মতো অথৈ পানির হলিখেলা। কোথায় তার আলেয়া, কোথাই তার পরিবার। ভয়ংকর ক্ষুধার্ত খোলপেটুয়া নদীর উদরে তাদের জামিন হয়েছে তা তার বুঝতে বাকি রইল না।
তারপর থেকে জব্বার মানসিক প্রতিবন্ধী। এত বড় বিষাদের কাহিনী তার জীবনে ঘটতে পারে তা সে কোনো দিন ভাবেনি। পিতার বাদবাকি সহায়সম্পদ সে আর কোনো দিন ভোগ করেনি। সেসব সম্পত্তি এখন বারোভূতে খায়। মানিকখালি সরকারি গোরস্তানের খাসজমিতে ছোট্ট ছনের ঘরে সে থাকে। বাজারে মানুষের কাছে হাত পেতে যা পায় তাই তার নিত্যদিনের আহার।
মরণব্যাধি ক্যানসারের সঙ্গে এখন জীবনের শেষ যুদ্ধ। জব্বার জানে এ জগতের মায়া তাকে অতিসত্বর ত্যাগ করতে হবে। সে স্পষ্ট শুনতে পায়, গভীর রাতে দেখতে পায় আলেয়ার আগমন। আলেয়া বলে, ওগো তোমাকে ছাড়া আমি যে কষ্টে আছি। বিশাল নদীর জলে আমার ভয় করে। তুমি আসো, আমার গর্ভে তোমার একমাত্র উত্তরাধিকার তোমার অপেক্ষায় ভূমিষ্ট হচ্ছে না।
জব্বার আলেয়ার আকুতি আর শুনতে চায় না। একদিন গভীর রাতে আলেয়া যেখানে খোলপেটুয়ার গ্রাসে বিলীন হয়েছিল সেখানে যায়। বিড়বিড় করে পৃথিবীর উদ্দেশে বলে, তুমি অনেক নিষ্ঠুর, অনেক অত্যাচারী। আমার সুখের জীবন দহনের নোনাজলে ভাসিয়ে তোমার কী লাভ। তোমাকে মুক্তি দিলাম। আজ আমি আবার আলেয়ার, যেমনটি হয়েছিলাম তাকে পাওয়ার পর।
পরের দিন জব্বারে মৃত লাশ গ্রামবাসী খোলপেটুয়া নদীতে ভাসতে দেখে।