প্রাক্তন
প্রকাশ | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
সাঈদুর রহমান লিটন
আজ ও সেই বাড়িটার পানে না তাকিয়ে পারলাম না। এই বাড়িটার পানে কেন যেন তাকাতেই হয়। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় এই রাস্তা দিয়ে গেলে অটোমেটিক চোখ ওই বাড়িটার পানে চলে যায়। বাড়িটার নাম জুঁই প্যালেস। এই তাকানো অভ্যাসটা আমার অনেক দিনের। নিয়মিত তাকাতে তাকাতে হয়তো অভ্যাস হয়ে গেছে। নয়তো নেশায় পরিণত হয়েছে। নয়তো রোগে রূপ নিয়েছে। মধ্যে মনে হয় এই তিনভাবেই আমাকে গ্রাস করেছে। এ অবস্থা থেকে কখনো মুক্তি চাইনি। তবে মনে মনে পরীক্ষা করেছি, আমি যেন এ বাড়িটার দিকে আর না তাকাই বা আর কখনো তাকাব না। আমি সব সময় পরীক্ষায় ফেল করেছি। নিজেকে শক্ত কঠিন বাঁধ দিয়েও আটকাতেই পারি নাই যে আমি জুঁই প্যালেসের দিকে আর তাকাব না। মোট কথা আমার চোখ আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। জুঁই প্যালেসের সামনে দিয়ে গেলেই আমার ভালো লাগে। এক ধরনের শীতল হাওয়া বয়ে যায় অন্তরে। মনের ভিতরে রোমাঞ্চকর রোমাঞ্চকর ভাব আসে। ভিন্ন এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে। মনে হয় এ বাড়িতে আমার আপন কিছু আছে। এ বাড়িতে আপন কেউ বাস করে। জুঁই প্যালেস টাই যেন আমার আপন মনের কেন্দ্রবিন্দু। যা আমার মনকে নিয়মিত কেন্দ্র করে টানে। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় জুঁই প্যালেসের রাস্তায় যেতে বাধ্য হই। এ-এক অসাধারণ ভালো লাগার রাস্তা। রাস্তার শুরুতে পা রাখলেই শরীর মন জানান দেয়। সামনেই জুঁই প্যালেস। মনোযোগী হও।
জুঁই প্যালেসের জুঁই আমার বান্ধবীর ছোট বোন। আমরা তখন সবেমাত্র অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। জুঁই পড়ে প্রথম বর্ষে। মাধ্যমিকে পড়ার সময় জুঁইকে আমি কয়েক মাস বিনা পারিশ্রমিকে পড়িয়েছিলাম। তাই জুঁই অনেকটা আমার কাছের মানুষ। জুঁই যখন একই কলেজে ভর্তি হলো, তখন সে নবীন। তার চেনাজানা কেউ নাই আপন বোন আর আমি ছাড়া। ওর বড় আপুর নাম চামেলী। দুজনই ফুলের নামে নাম। ওর বড় আপু অন্য সাবজেক্টে পড়ে। জুঁই ও আমি একই বিষয়ে পড়ি। চামেলী আমার কাছে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আসে দেখা করতে। আমাদের বাড়ি একই এলাকায়। একটা মরা নদীর এপার আর ওপার। জুঁইদের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়েই আমার মূল যাতায়াত। যাইহোক চামেলী যখনই আসে আমার সঙ্গে জুঁইকে দেখতে পায়। হয়তো একসঙ্গে লাইব্রেরি ওয়ার্ক করছি, নয়তো পুকুর পাড়ে বসে আছি, নয়তো বাদাম খাচ্ছি, আবার একই বেঞ্চে পাশাপাশি ক্লাস করছি, কৃষ্ণচূড়া চত্বরে বাদাম খাচ্ছি।
প্রথম প্রথম চামেলী তেমন কিছু মনে করত না। কিন্তু জুঁই-চামেলীর কাছে আমার প্রশংসা করত প্রচুর। প্রতিনিয়ত আমার প্রশংসা করত চামেলীর কাছে। চামেলী কিছুটা বিরক্ত হতো। চামেলীদের জেলা শহরে নিজস্ব বাসা আছে। ছাদে ফুলের চাষ করত। চামেলী আমার জন্য আসার সময় কোন না কোনো ফুল নিয়ে আসত। আমি সেই ফুলের জন্য অপেক্ষা করতাম। বেশ কিছুক্ষণ ধরে আর ফুল আনে না। একদিন জুঁই দেখি একটা সুন্দর ইরানি লাল গোলাপ নিয়ে এসেছে। জুঁই আমাকে লিটু ভাইয়া বলে। জুঁই বলল লিটু ভাইয়া তোমার জন্য ফুল। আমি খুব আনন্দচিত্তে গ্রহণ করলাম। জুঁই খুব সুন্দর একটা মেয়ে। অনেকটা হাসনাহেনা ফুলের মতো সুন্দর এবং দীপ্তময়ী। সারাদিন ওর সঙ্গে ক্লান্তিহীনভাবে কাটানো যায়। আর অনেকটাই আপন মনে হয়। ফুল দেওয়াটা চামেলী দেখে ফেলল, বলল, বাহ বাহ বাহ বেশ তো।
তাহলে তো তোর ফুল দেওয়ার লোক পেয়ে গেছিস।
আমি বললাম আরে নানা, ও আজ....। বাক্যটি শেষ করতে না দিয়ে চামেলী বলল, থাক আর বলতে হবে না, বলেই চলে গেল। আর কোনো দিন আমাদের সেকশনে চামেলী আসে নাই। ফুলও আনে নাই।
জুঁই নিয়মিত এখন ফুল নিয়ে আসে। জুঁই মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকেই আমার সঙ্গে খুব ফ্রি ছিল। আমাকে খুব ভালো জানত। সেই সুবাধেই বার্ষিক পরীক্ষার আগে আগে ওকে অংক, ইংরেজি দেখিয়ে দিতাম। এ জন্য জুঁই আমার খুবই আদরের একজন মানুষ। আর চামেলী আমার সহপাঠী। জীবনের সব কথা আমার কাছে শেয়ার করত। কলেজে গিয়েও আমার পাশাপাশি থাকার চেষ্টা করত। যখন চামেলী আমার কাছে আর আসত না আমার খুব কষ্ট লাগত। জুঁই এলে সব কষ্ট ভুলে যেতাম। জুঁইকে আমার অন্তরের মধ্যমণি মনে হতো। তখন চামেলী কলেজে না এলে খুব একটা কষ্ট হতো না। কিন্তু জুঁই না এলে সেদিন আর কলেজে থাকতে ইচ্ছা হতো না। এখন চামেলীর সঙ্গে দেখা হলে আগেকার মতো সেই মুচকি হাসি দিয়ে বলে না লিটু কেমন আছিস। শুধু হাই হ্যালো হয়। তাও অন্তরঙ্গতা তেমন থাকে না। কেন এমন হলো আমার বুঝে আসে না। এর মধ্যে রোজার ছুটিতে ধবাড়ি এলাম। চামেলী গ্রামে এলো না। জুঁই এলো। প্রতিদিন ওদের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা হয়। ওই রাস্তায় গেলে আমি সেই ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকাকালেই তাকাতাম। চামেলী বলত ওকে নিয়ে যেতে। ওদের বাড়ি পার হয়ে আমাদের হাইস্কুলে যেতে হতো। তাই আমি আর চামেলী একসঙ্গে যেতাম। আমাদের বাড়ি থেকে কিলো দুই দূরে স্কুল ছিল। জুঁই ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠলে আমরা তিনজন একসঙ্গে যেতাম। এজন্য বলা যায় আমরা তিনজন ছিলাম তিন দেহের অভিন্ন আত্মার মানুষ।
কলেজ খুললে আমার পারিবারিক সমস্যার কারণে কয়েক দিন দেরিতে কলেজে যেতে হয়েছে। জুঁয়ের সঙ্গে তেমন সাক্ষাৎ করতে পারি নাই। সে যুগে মোবাইল ফোন ছিল না কথা বলতে পারি নাই।
আমি যেদিন কলেজে গেলাম, জুঁইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। সঙ্গে চামেলী ছিল। চামেলী দ্রম্নত চলে গেল। জুঁই হাউমাউ করে কেঁদে দিল আমার হাত ধরে। বলল, লিটু ভাই আমাকে এই কলেজ থেকে বদলি করে দেবেন্দ্র কলেজ মানিকগঞ্জে ভর্তি করেছে। আবু্ব ওখানে চাকরি করে।
আমি বললাম তুমি জান না। না জানি না। তাহলে?
রোজার বন্ধে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু্ব আর আপু গিয়ে ট্রান্সফার করিয়েছে। বললাম কেন?
বলল, আমি জানি না লিটু ভাইয়া। তবে শুনেছি আমার আর তোমার সম্পর্কে অনেক আজেবাজে কথা আম্মু আর আবু্বকে আপু বলেছে। আমার মনে হয় সেই রাগেই এমনটি করেছে। আমাকে কিছু বলে নাই।
জুঁই বলল, তোমাকে আমার খুব মনে পড়বে লিটু ভাইয়া। আর দেখা হবে কিনা জানি না বলেই হু হু করে কেঁদে দিল জুঁই। আমি ও কেঁদে দিলাম বিদায় বেলায়।
জুঁই আমাকে আর কিছু না বলে চলে গেল।
তারপর বহু বছর কেটে গেছে। জুঁই লেখাপড়া শেষে কানাডায় গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে শুনেছি নারায়ণগঞ্জ এক অধ্যাপকের সঙ্গে বিয়ে করেছে। স্বামী সংসার বাচ্চা, কাচ্চা আছে।
আমারও জুঁইয়ের মতো সব আছে। জুঁইদের গ্রামের বাড়িতে এখন কেউ থাকে না। অফিস ভাড়া হয়েছে। কিন্তু জুঁই প্যালেস লেখাটি এখনো জ্বলজ্বল করছে। এখনো ওই পথে গেলে ওই বাড়ির দিকে তাকাই। তাকালে আমি জুঁইয়ের মুখটি দেখতে পাই। জুঁই প্যালেস লেখাটি দেখতে পাই। এক অন্যরকম আনন্দে মন ভরে ওঠে।