জরি এখন কোথায় যাবে?

প্রকাশ | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

রেজাউল করিম খোকন
এক হাসপাতালের ধবধবে সাদা বিছানায় শুয়ে আছে জরি। ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরছে ওর। একসময় চোখ মেলে তাকায় সে। মাথার ওপর সাদা ছাদটা শুধু চোখে পড়ে। এপাশওপাশ ফিরে আশপাশটা দেখতে চায়। কিন্তু পুরো শরীরটা কেমন অবশ লাগে। প্রথমে নড়তে-চড়তে বাধা পায় যেন। তারপর আস্তে আস্তে এই অবশ ভাবটা ক্রমেই কেটে যেতে থাকে। সারা শরীরের আনাচে-কানাচে এক ধরনের সচলভাবে জেগে ওঠে। জরিকে নড়েচড়ে উঠতে দেখেই একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সটা অস্থিরভাবে ছুটে আসে। ঝুঁকে শুয়ে থাকা রোগীর অবস্থা জানতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। 'এখন কেমন লাগতাছে তোমার?' কিছুটা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চায় মধ্যবয়সি নার্সটা। জরি প্রথমে বুঝে উঠতে পারে না, কোথায় আছে সে, কীভাবে এখানে এসেছে, কেন এসেছে, তারা তাকে এখানে এনেছে? কিন্তু এক সময় সব মনে পড়ে যেতে থাকে তার। একটা গ্রাম, সরু একটা নদী সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে পাশ দিয়ে। সেই নদীর পাড়ে সবুজ প্রান্তর ছড়িয়ে পড়েছে বহুদূরে। মাত্র অল্প কয়েকদিনের বৃষ্টিতে এভাবে বন্যা শুরু হবে ভাবতে পারেনি ফুলতলী গ্রামের কোনো মানুষ। হঠাৎ এত পানি এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সব কল্পনা করতেও পারেনি কেউ। গ্রামের বুড়োবুড়িরাও জীবনে কোনোদিন এর আগে তেমন সর্বনাশা বান দেখেনি। বর্ষার শেষ এসে ভাদ্র মাসে যে রকম বৃষ্টিবাদল হয় সে রকমই হয়েছে স্বাভাবিকভাবে। এই বৃষ্টিবাদলে এত পানি হওয়ার তো কথা নয়। কিন্তু প্রলয়ের মতো দু-তিনদিনের মধ্যে ফুলতলী গ্রামের প্রায় পুরোটাই পানির নিচে তলিয়ে যেতে দেখে সমিরুদ্দিন ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। দু'চোখে কেবলই অন্ধকার দেখে। বয়স বেড়েছে। শরীরে আগের মতো শক্তি আর সাহস নেই। তবুও একমাত্র সন্তান জরিকে নিয়ে ঘরের মধ্যে বাঁশের মাচা বানায়। অল্পবয়সি একটা মেয়ে জরি। যতটা পারে বাবাকে মাচা বানাতে সাহায্য করে। তার কোনো ভাই নেই। এই বিপদে পুরুষ মানুষের খুব দরকার। একটা ভাই থাকলে বাবার অনেক ভরসা হতে পারত- ভাবে জরি। বেশ কিছুদিন ধরে তার মা ভীষণ অসুস্থ। শোয়া থেকে উঠে বসতে পারছে না শুধুই বলছে-'আমি আর বাঁচুম না, জরিরে কে দেখব আমি মইরা গেলে।' বিলাপ করে কাঁদছে শুধু জরির মা। অসুস্থ স্ত্রীকে কোনোভাবে মাচার ওপর তুলতে না তুলতেই ঘরের মধ্যে বুকসমান পানি এসে যায়। সমিরুদ্দি সারারাত মাচার ওপর বসে অসুস্থ স্ত্রী ও মেয়েকে পাহারা দেয়। সারারাত অন্ধকারে এক ধরনের আতঙ্ক চেপে থাকে মাঝবয়সি মানুষটির বুকের মধ্যে। পরদিন ভোরের আলো ফুটে উঠতেই সমিরুদ্দি কোনোভাবে ঘরের চালায় ওঠে। আশপাশের অবস্থা জানতে তাকিয়ে দেখতেই আঁতকে ওঠে মানুষটা। ভয়ে বুকের ভেতরটা শুকিয়ে যায় তার। এই জীবনে একসঙ্গে এত পানি দেখেনি সে। এই গ্রামে এমন বানের পানি আসেনি আগে কোনো সময়। চারদিকে পানি থইথই করছে। কয়েকটা বাড়ির চালা এখনো পানির নিচের ডুবে যায়নি। চালার ওপর ঘরের নারী-পুরুষ শিশু সবাই আশ্রয় নিয়েছে। চারদিকে পানির ছলছল কলকল শব্দে সমিরুদ্দির বুকের মধ্যে নিঃসীম বেদনার ঝড় ওঠে। মাথাটা হঠাৎ ঘুরে ওঠে। কোনোভাবে নিজেকে সামলে নেয় সে। ঘরের চালার ওপর বসে পড়তেই চোখে পড়ে পাশেই ফণা তুলে আছে একটা বড় বিষাক্ত সাপ। ওটাও আশ্রয় নিয়েছে এখানে! নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়। সাপটাকে কিছু করতে পারছে না। অথচ সারা গ্রামে সবাই তাকে দুর্দান্ত সাহসী একজন মানুষ হিসেবে জানে। কারও বাড়িতে বিষাক্ত সাপ দেখা গেলে সমিরুদ্দির ডাক পড়ত মারার জন্য। তার মতো সাহস নিয়ে আর কেউ এগিয়ে যেতে পারত না। অথচ এই সর্বনাশা বানের কারণে সাপ আর মানুষ পাশাপাশি এক জায়গায় ঠাঁই নিয়েছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে ভাবছিল সে, তারপর কী হবে। হঠাৎ ভয়ে ঠান্ডা শীতল একটা স্রোত সমিরুদ্দির শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে থাকে নিচের দিকে। শিউরে ওঠে সমিরুদ্দি ঘরের মধ্যে মাচার ওপর জরি ও তার মায়ের কথা ভেবে। সারাটা আকাশ এখনো মেঘে ঢাকা। রাতে বৃষ্টি হয়নি। তবে খানিকক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি নামবে আকাশ দেখেই বোঝা যায়। 'বাজান, জলদি কইরা আস, মায়ে জানি কেমুন করতাছে- জরির আর্তচিৎকারে সমিরুদ্দি দ্রম্নত ঘরের চালা থেকে নেমে মাচার মধ্যে আসে। জরি ভয়ার্ত মুখে ওর মায়ের ওপর ঝুঁকে আছে 'কি হইছে মাগো তোমার, এমন করতাছো ক্যান', মায়ের শরীরটা ঝাঁকুনি দিতে দিতে কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে থাকে সে। জরি দেখে মায়ের সারা শরীর ক্রমেই নীল হয়ে যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারে না সে। জরির মা ক্ষীণ কণ্ঠে একবার ফিসফিস করে শুধু উচ্চারণ করে, 'সাপে কাটছে আমারে, সাপের বিষে পুইড়া যাইতাছে আমার শরীলডা।' জরির চোখের সামনে ছটফট করতে করতে কিছুক্ষণের মধ্যে হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে পড়ে তার মায়ের শরীরটা। হাউমাউ করে চিৎকার দেয় সমিরুদ্দি, 'জরিরে সর্বনাশ হইছে, তোর মায়েরে সাপে কাটছে, এহন আমি কী করুম, আলস্নাগো এমন হইলো ক্যান এহন তারে বাঁচামু কেমনে-' সমিরুদ্দির আর্তনাদ আকাশ-বাতাসে কাঁপন ধরালেও তার বিপদে কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে পারে না। নিয়তির কাছে নিজেদের ভীষণ অসহায় মনে হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় জরি বিমূঢ় হয়ে যায়। কী করবে হঠাৎ বুঝে উঠতে পারে না। শুধুই ফ্যালফ্যাল করে নিথর হয়ে যাওয়া মায়ের মরা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চারদিকে পানি আর পানি। শুধু অথই পানি। মনে হয় সীমাহীন অথই জলরাশি। মাঝেমধ্যে দু-একটি গাছের মাথা ভেসে আছে। বানের পানি সমিরুদ্দির ঘরে চালা ছুঁয়ে ফেলেছে। তার মধ্যে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। পানি বাড়ছে আরও। অল্পক্ষণ আগে কলাগাছের ভেলাতে সাপে কাটা জরির মাকে ভাসিয়ে দিয়েছে সমিরুদ্দি। তিন-চার মাইলের মধ্যে কবর দেওয়ার জন্য সাড়ে তিনহাত মাটিও পানির ওপর নেই। আশপাশে কয়েকজন মিলে চার-পাঁচটা কলাগাছ জোগাড় করে ভেলা বানায়। আর তাতে করেই ভাসিয়ে দেওয়া হয় জরির মায়ের মৃতদেহটা। আগের মতোই নীরব নিথর হয়ে বসে আছে জরি। একটা পাথরের মূর্তির মতো। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে মাথার ওপর। তা থেকে নিজেকে রক্ষা করার কোনোরকম চেষ্টা বা ইচ্ছে নেই মেয়েটির। বিষণ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জরি অথই জলরাশির দিকে। সমিরুদ্দি মেয়ের দিকে তাকিয়ে একবার শুধু বলে, 'মাগো, কিছু খাইবি, ক্ষিধা লাগছে? কিছু না খাইলে বাঁচবি কেমনে?' জরির মনে কোনো ভাবান্তর ঘটায় না তার বাবার কথাগুলো। সে আগের মতোই বসে থাকে। সমিরুদ্দি হাতের পুঁটলি থেকে শুকনো চিঁড়া বের করে খেতে থাকে। শুকনো চিঁড়া চিবোতে চিবোতে তার চোখের কোনা আবার ভিজে ওঠে। টলমল করে গাল বেয়ে চোখের পানি পড়তে থাকে। কিছুক্ষণ আগে একটা নৌকাতে করে কতগুলো লোক এসে চিড়াগুলো দিয়ে গেছে। ঢাকা-শহর থেকে রিলিফ নিয়ে এসেছে লোকগুলো। চিড়াগুলো না পেলে না খেয়েই থাকতে হতো। সমিরুদ্দি মেয়েকে সঙ্গে করে যখন রিলিফ ক্যাম্পে এলো তখন প্রচন্ড জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। আর দাঁড়াতে পারছিল না। হাজার হাজার লোকের ভিড় এখানে। আশপাশের পনেরো-বিশটা গ্রামের মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছে মফস্বল শহরের তিনতলা কলেজ বিল্ডিংটাতে। কলেজের পাশে আর দু-তিনটা সরকারি অফিসের বিল্ডিং রয়েছে। সেখানেও পিঁপড়ের মতো গিজগিজ করেছে নারী-পুরুষ ও শিশু। জরি তার বাবাকে রিলিফ ক্যাম্পের ফ্লোরে হঠাৎ শুয়ে পড়তে দেখে ভয় পেয়ে যায়। কী হলো বাবার, এতক্ষণ তো ভালোই ছিল। কলেজ ছাত্রদের উদ্ধারকারী নৌকাটা যখন ঘরের চালায় বসে থাকা সমিরুদ্দি ও জরিকে নিতে আসে তখনো সমিরুদ্দি গো ধরে বসেছিল। সর্বনাশা বানের পানি তার ঘরদোর ভাসিয়ে নিয়েছে, স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়েছে, তবুও তার মনোবল ভেঙে পড়েনি। সমরিুদ্দি ভেবেছিল, নিজের বাপ-দাদার ভিটেমাটি, বাড়িঘর ছেড়ে কোথাও যাবে না। এর আগেও কত ঝড়-তুফান, বন্যা গেছে, সব ধ্বংস হয়েছে, সেই ধ্বংসের মধ্যেই লড়াই করে বেঁচেছে। কিন্তু নিজের সোমত্ত বয়সি মেয়ে জরির কথা ভেবে সমিরুদ্দি তাকে নিয়ে উদ্ধারকারী নৌকাটায় চড়ে বসেছিল নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। রিলিফ ক্যাম্পে পৌঁছার পর সমিরুদ্দির জ্বর বাড়তে থাকে আরও। হায় আলস্না, জ্বরে যে বাজানের শরীলডা পুইড়া যাইতাছে, এইখানে ডাক্তার পামু কই, বাবার পাশে বসে আপন মনে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে জরি। এখানে তো কাউকে চেনে না সে। কার কাছে গিয়ে ওর বাবার অসুখের কথা বলবে, ডাক্তার দেখানোর কথা বলবে, ভেবেচিন্তে কুল পায় না জরি। ওপাশে রান্না করা খিচুড়ি দেওয়া হচ্ছে। এখানে বসে থাকলে কেউ তা এনে দেবে না। লাইন ধরে দাঁড়িয়েছে ছেলে, বুড়ো, নারী-পুরুষ সবাই। কার আগে কে নিতে পারে ধাক্কাধাক্কি চলছে। জরি একবার ওদিকে তাকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। মেয়েকে কাঁদতে দেখে সমিরুদ্দি চোখ মেলে তাকায়, 'কি রে মা, কি হইছে, ক্ষিধা লাগছে খুব, খিচুড়ি খাইবি, আইন্যা দিমু?' উঠে বসতে চায় সমিরুদ্দি। তাকে জোর করে শুইয়ে দেয় জরি। এই প্রচন্ড জ্বরে ফ্লোরে শুয়ে থাকাটা আরও বিপদ ডেকে আনে রোগীর জন্য। আস্তে আস্তে সমিরুদ্দির জ্ব্বর আরও বেড়ে যায়। জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বকতে শুরু করে। ভয় পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে জরি। ওর কান্না শুনে আশপাশের কয়েকজন নারী-পুরুষ এগিয়ে এসে জানতে চায়, 'অ্যাই মাইয়া কি হইছে, কানতাছো ক্যান তুমি?' 'আমার বাজানরে বাঁচান আপনারা, তার ভীষণ জ্বর, আবোলতাবোল বকতাছে,' এটুকু বলে আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে জরি। রিলিফ ক্যাম্পে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। তাদের আশ্রয় দিতে এবং খাবার সংস্থান করতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক, বড় রাজনৈতিক নেতা ও কর্তা-ব্যক্তিরা। এখানে আশ্রয় গ্রহণকারীদের চিকিৎসার জন্য তখনো কোনো ডাক্তার পৌঁছায়নি এখনো। শহরে যারা ছিল, তারাও দূরে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। ঢাকা থেকে দু-একদিনের মধ্যে ডাক্তার আসবেন। কিন্তু রোগ-শোক, বিপদ-আপদ তো তার জন্য অপেক্ষা করে থাকছে না। রিলিফ ক্যাম্পের বেশ ক'জন জরির বাবার চিকিৎসার জন্য অনেক চেষ্টা করতে লাগল। অনেক কষ্টে একজন গ্রাম্য ডাক্তার জোগাড় করে আনলো। তখন রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। ডাক্তার চিন্তিত মুখে কাঁপা হাতে খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন। কিন্তু ওষুধ পাওয়া যাবে কোথায়? সর্বনাশা বানের পানির কাছে মানুষ যে কত অসহায় হতে পারে, পুরো রিলিফ ক্যাম্পের সব নারী-পুরুষ অনুভব করতে থাকে। এক সময় জরির বাবা সমিরুদ্দি মরণের সঙ্গে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়। নিজের চোখের সামনে বাবাকেও মায়ের মতো লাশ হয়ে যেতে দেখল জরি। পৃথিবীতে আপনজন বলতে তার আর কেউ থাকল না। একা হয়ে গেল সে এত বড় পৃথিবীতে। এখন তাকে কে দেখবে, কোথায় যাবে মেয়েটি? দুই বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। মানুষ আর রিলিফ ক্যাম্পে বোঝা হয়ে পড়ে থাকতে চায় না। তারা নিজ নিজ বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে রিলিফ ক্যাম্পটাও খালি হয়ে আসছে। জরিও এক সময় ক্যাম্প ছেড়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। পানি নেমে গেলেও চারদিকে সর্বগ্রাসী বন্যার ধ্বংস চিহ্ন শুধু চোখে পড়ে। মনে হয়, কোনো এক দানব প্রচন্ড শক্তিতে সবুজ গ্রাম, প্রান্তর সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে। জরি নিজেদের বিধ্বস্ত বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে নিজেদের ঘর ভিটেমাটিও চিনতে পারে না প্রথমে, হঠাৎ করে। পাশের বাড়ির নসু চাচা না বলে দিলে জরি তাও চিনতে পারত না। ওর বুক ফেটে কান্না আসে। বাবা-মা দু'জনই চলে গেছে তাকে একা ফেলে। এই বাড়িতে একা একা থাকবে কী করে? তাকে কে দেখবে? ওকে দেখার মতো কেউ রইল না আর। জরিকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে নসু চাচাও কেঁদে ফেলে। এই প্রলয়ংকরী বন্যায় তার দুই ছেলে পানিতে ডুবে মারা গেছে। তারও ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। নসু চাচা জরিকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হঠাৎ খুঁজে পায় না। তবুও কোনোভাবে উচ্চারণ করে, 'মাগো, কাইন্দা কী হইব, আমাগো চোখের পানি ঝরবো শুধু, যারা গেছে তারা তো ফিরব না, মনডারে একটু শক্ত কর মা, এখন তোর বাঁচতে হইব এই দুনিয়ায়।' গত কয়েক দিনে জরি নিজেকে অনেক সামলে নিয়েছে। নিজেদের ঘরের ভেসে যাওয়া খুঁটি, বাঁশ ও থালাবাসন আশপাশে যা খুঁজে পেয়েছে তাই এনে জড়ো করেছে। নসু চাচার মেয়ে ফুলি, পাশের বাড়ির ফজল আলী ভাই জরিকে এ কাজে সাহায্য করে। দু'দিনের মধ্যে এলোমেলো ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িটাকে মোটামুটি বসবাসের উপযোগী করে তোলে ওরা সবাই মিলে। সরকার সাহায্য দেবে, এজন্য কিছু মানুষ এসে ঘরবাড়ি দেখে যায়। জরিদের বাড়িতেও আসে। তাকে অনেক প্রশ্ন করে। ওর বাবা-মায়ের মৃতু্যর কথা জানতে চায়। কয়েকজন ক্যামেরা দিয়ে জরির ছবিও তোলে। গ্রামের কয়েকজন বলে, টেলিভিশনে দেখাইবো জরির ফটো, পেপারেও ছাপাইবো মাইয়াডার দুঃখের কথা সবাই জানতে পারবো। এতে যদি তার কোনো সাহায্য হয় তা হইলেই ভালো হইবো।' সবাই জরির দুঃখ-কষ্টে কয়েকদিন সমবেদনা জানালেও কিছুদিনের মধ্যে যে যার নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। জরি এমনিতেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। বাবা-মাকে হারিয়ে এই পৃথিবীতে একেবারেই একা হয়ে পড়েছে সে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে উপলব্ধি করে জরি, এই পৃথিবীতে কতটা অসহায় সে। বাবার রেখে যাওয়া ভিটেতে একাকী একটা মেয়ে হয়ে কীভাবে থাকবে সে। তার মতো উঠতি যৌবনা, সুন্দরী একটি মেয়ের জন্য তো বিপদ ওঁৎ পেতে থাকে সবসময়। নিজের ভিটেতে তার একাকী জীবনযাপন সম্ভব নয়- বুঝতে পেরে পাড়া-প্রতিবেশীর পরামর্শে একই গ্রামে তার দূর সম্পর্কের এক মামা বাড়িতে আশ্রয় নেয় জরি। মামা মানুষটি ভদ্রলোক হলেও মামী জরির প্রতি সদয় হতে পারেনি। জরিকে উটকো ঝামেলা ভেবে সব সময় লাঞ্ছনা-গঞ্জনা দিতে থাকে। যার মাত্রা দিনে দিনে বাড়তে শুরু করে। ও বাড়িতে রাত-দিন কাজ করতে হতো তাকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে করতে দু'চোখে অন্ধকার দেখতে থাকে জরি। তবুও রেহাই পায় না। তবুও মামীর মন ভরে না। মারধর চলতে থাকে বেদমভাবে। দিনে দিনে বিষিয়ে উঠতে থাকে জরির জীবন। এক সময় ওর টলমলে ঝলমলে যৌবনটা কাল হয়ে দাঁড়ায়। মামীর সৎভাই সলিম মেম্বার বেশ কয়েকবার কুপ্রস্তাব দিয়েছিল জরিকে। অথচ জরি সলিম মেম্বার মানুষটিকে আপন মামার মতো জানত, শ্রদ্ধা করতো। কিন্তু লোকটির জঘন্য মনোবৃত্তি আর পাশবিক ইচ্ছের প্রকাশ দেখে চমকে যায়। জরির মামী সৎভাই সলিম মেম্বারের টাকা খেয়ে কয়েকবার গভীর রাতে ঘরের দরজা খুলে দিয়ে একদিকে সরে পড়েছে। কিন্তু অলৌকিকভাবে প্রত্যেকবারই জরি বেঁচে গেছে সলিম মেম্বারের জান্তব লালসার ভয়াল থাবা থেকে। জরি পাশের বাড়ির টগবগে যুবক মানিককে মনের অনেক দুঃখ-বেদনার কথা খুলে বলেছে সুযোগ পেলেই। মানিককে ওর বেশ লাগত। যৌবনের শুরুতে মনের গহিনে অদ্ভুত এক শিহরণ অনুভব করত সে মানিককে কাছে পেলে। মানিকও তাকে খুব পছন্দ করত। আসলে জরি তাকে মনে মনে ভালোবাসতে শুরু করেছিল। জরির আশা ছিল মানিককে সঙ্গে নিয়ে দুঃখ-কষ্ট আর সব বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে, তার সঙ্গে ঘর বাঁধবে একদিন। তখন সব দুঃখ-যাতনা অপমানের দিন শেষ হবে। মামীর অন্যায়-অত্যাচার আর নিগ্রহের কবল থেকে রক্ষা পাবে। একদিন সুখের জোয়ার শুরু হবে এই জীবনে। মানিককে নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল জরি। গরিব হলেও মানিক প্রচন্ড সাহসী এবং স্বাধীনচেতা তরুণ। হঠাৎ একদিন গ্রামের রিলিফের গম আত্মসাতের বিরুদ্ধে সলিম মেম্বারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলেছিল মানিক। জরির কাছে লম্পট স্বভাবের মানুষটির উত্ত্যক্ত করার নানা অভিযোগ শুনে এমনিতেই বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল সে। সলিম মেম্বার তাকে অপমান করার প্রতিশোধ নিতে মানিককে মিথ্যে মারামারির ক্লেসে ফাঁসিয়ে দেয়। গ্রামের কেউ কেউ তাকে ছাড়িয়ে আনতে চাইলেও সলিম মেম্বার তার প্রভাব খাঁটিয়ে তা হতে দেয়নি। ভরা মজলিসে তাকে অপমান করার প্রতিশোধ নিয়েছে ভালোভাবেই। আদালতের রায়ে মানিকের পাঁচ বছরের জেল হয়। যাকে জরি তার পাশে একমাত্র সহায় ভেবেছিল সেই মানুষটি জেলে যাওয়ার পর তার সব আশা ভরসা, সুখের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে যায় নিমিষেই। তিন একটা কাজ এবং নিরাপদ সুন্দর জীবনের আশায় শহরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জরি। গ্রামে থাকলে সলিম মেম্বার এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা জরির যৌবনভরা টলটলে সুন্দর শরীরটাকে ছিঁড়ে খুবলে খাবে। কেউ তা ঠেকাতে পারবে না। জরি কোনোভাবেই নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না ওদের জান্তব লালসার গ্রাস থেকে। গ্রামজুড়ে এখন সলিম মেম্বার আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের দাপট, প্রভাব, প্রতিপত্তি। দিনদুপুরে ওরা মানুষ খুন করে ফেলছে। গ্রামের অনেক যুবতী-কিশোরীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পাট ক্ষেতে কিংবা তাদের কারও আস্তানায় পালাক্রমে ধর্ষণ করছে। কিন্তু কেউ তার প্রতিকারে এগিয়ে আসতে পারছে না সাহস করে। ওদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মতো শক্তি, সাহস নেই কারও। থানাপুলিশ, গ্রাম্য সালিশ বিচার সবই তাদের হাতের মুঠোয়। আনমনা হয়ে পড়েছিল জরি। হঠাৎ প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটা থেমে পড়ায় চমকে ওঠে সে। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়, বিরাট ছাদঅলা একটা স্টেশনে গাড়িটা থেমে আছে এখন। হুড়মুড় করে সবাই নামছে, বোধ হয় ঢাকা এসে গেল, জরি মনে মনে ভাবে। 'এ্যাই জরি, বইয়্যা রইছস ক্যান, ল ওঠ, ঢাকা আইয়া পড়ছি, এহন নামবি চল', পিঠে ঝাঁকুনি দিয়ে কুলসুম মৃদু হেসে বলে। সেও এসেছে ঢাকা শহরে, ভাগ্যের অন্বেষণে। তাদের এনেছে জমিলা বেগম। গ্রাম থেকে অনেক মেয়ে ঢাকা শহরে এনে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে সে আগে। এখন জমিলার ওপর ভরসা করে তার হাত ধরে আসতে হয়েছে জরিকে একান্ত বাধ্য হয়েছে। জরি নরম দৃষ্টিতে তাকায় জমিলা বেগমের দিকে। ও লক্ষ্য করে জমিলা বেগমের দু'চোখে লোভ যেন চকচক করছে, গ্রামে কোনোদিন এভাবে দেখেনি সে জমিলা বেগমকে, ঢাকা শহরে এসে হঠাৎ যেন রূপ বদলে গেছে ওর। জরি আরও ভয় পেয়ে যায়। ভেতরে ভেতরে ভয়ের হিমশীতল একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় ওর শিরদাঁড়া বেয়ে। ফুলতলী গ্রামের অসহায় মেয়ে জরি এখন নতুন এক জীবন গড়ার আশায় রাজধানী ঢাকা শহরে পা রেখেছে। এতো বড় ঢাকা-শহরের কিছুই চেনে না সে। আগে কখনো এই শহরে আসেনি সে। নানাজনের মুখে শুধু ঢাকা শহরের অনেক গল্প শুনেছে। এখন ট্রেন থেকে নেমে ভীরু পায়ে অনেক দ্বিধা, সংকোচ, ভয়, শঙ্কা বুকে নিয়ে হাঁটতে থাকে অজানা গন্তব্যের দিকে। এখানে জরি কতটা নিরাপদ,তার অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের নিশ্চয়তা কতটা, সে কিছুই জানে না।