শেষ রাতের চিঠি

প্রকাশ | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

লাভলী ইসলাম
তখন কর্মক্লান্ত দুপুর হেলে পড়ে বিশ্রামে ব্যাকুল ছিল বিকালের সোনা রোদ গায়ে মেখে। গাছের নুইয়ে পড়া সবুজ পাতারা সবে উঠে দাঁড়িয়েছে সোজা হয়ে। পথের ধুলোবালি রৌদ্র তাপে হেলিয়ে দিয়েছে নিজেদের বালুকাবেলায় প্রকৃতির কোলে। আমি নদীর কিনারে হেঁটেছি সারাটা বিকেল আনমনে। গোধূলি প্রত্যাবর্তন পূর্বে আমিও ক্লান্ত পায়ে বসে পড়েছি নদীর কূলের অদূরে ঘাসের বুকে আঁচল পেতে। এই তো কিছুদিন আগেও গত পৌষের পড়ন্ত বিকালে শীতের চাদর জড়িয়ে তুমি আমি বসে ছিলাম ঠিক যেই জায়গাটাতে। দক্ষিণা হাওয়ায় শৈত্যপ্রবাহের শীতল বাতাস এসে আমাকে ছুঁয়ে দিয়েছিল বারে বারে। হাত দুটো ধরেই তুমি চমকে উঠে বলেছিলে হায় ঠান্ডায় বরফ হয়ে গেলে যে... ওমনি তোমার গায়ের কাশ্মীরি শালটা আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিলে পরম আদরে। ওম পেয়ে তোমার কাঁধে মাথা রেখে স্বপ্ন বুনছিলাম গোধূলির মায়াবী সাঁঝে প্রকৃতির সবুজ সতেজ নানা রঙিন আবেগে। তুমি আমার কাঁধের পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে দূর আকাশে দলবেঁধে ডানা মেলে উড়ে চলা এক ঝাঁক শ্বেত বলাকা দেখিয়ে বলেছিলে, সুপ্রিয়া দেখ দেখ ওই যে চেয়ে দেখ... বলাকারা উড়ে যায় কোন সে সুদূরে। চলো আমরাও উড়ে উড়ে হারিয়ে যাই তাদের সঙ্গে। অজানা কোনো রাজ্য জয়ে ছুটে যাব দুজনে হাতে হাত ধরে। আমি নীরবে স্বপ্ন চাদরের রঙিন সুতোয় স্বপ্ন বুনে চলছিলাম আকাশের প্রতিটি স্তরে স্তরে আমাদের সুখ বসতির বাসর সাজিয়ে। আমাকে আলতো করে তোমার বুকের সঙ্গে চেপে ধরতেই আমি সম্বিত ফিরে পেয়ে স্বপ্ন ভেঙে দেখি এক ঝাঁক মন বলাকা উড়োজাহাজের মতো কখনো ডানে আবার কখনো বামে হেলে দুলে উড়ছে আপন খেয়ালে। ঠিক তারই এক অপূর্ব দৃশ্য সেদিন আমার হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল আমৃতু্য পুরো জীবন জুড়ে সেই স্বর্ণালি সন্ধ্যায়। গাঙ্গচিলেরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছিল নদীর উপরের জলরাশির ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। সেদিনের সেই মায়াবী পড়ন্ত বিকেল, গোধূলির লগ্ন পেরিয়ে মধুময় সন্ধ্যা আমাকে বারবার নিয়ে যায় নদীর কিনারায়। সবই আছে সেই আগের মতই; শুধু তুমি নেই আমার কাছে। আছো মন মননে হৃদয়ের বসত ঘরে। সেই বলাকার দল গাঙ্গচিলের ঝাঁক বিশাল নীল আকাশ সব.... সবই আছে, কেবল যে নদীর ঢেউ বুকে প্রণয়ের সুর জাগাতো সেই নদীর অথৈ ঢেউ আজ বুকের পাঁজরগুলো ভেঙে খানখান করে দেয়। আমার নয়ন কাজল গলে ধুইয়ে নিয়ে যায় প্রচন্ড বাঁধ ভাঙা জোয়ার এসে। তবে আমাকে ভাসিয়ে নেয় না- এটাই ওদের বড় করুণা। ওরা ছলাৎ ছলাৎ স্বরে অবিরত বয়ে যাচ্ছে। আমি কখনো কখনো মন ভুলে হাসি নদীর জল আর ঢেউয়ের এই নিদারুণ করুণা দেখে। তুমি চলে গেছ ওই আকাশের নীল বুকে হাজার তারাদের ভিড়ে। আমি খুঁজে পাই তোমাকে শুকতারার মাঝে। স্থির হয়ে বসে থাকো নড়াচড়া করো না দেখো আমাকে। আমিও বসে বসে দেখি তোমাকে আর চোখ ভরে জল পড়ে নদীর জলের গায়ে। এখন রাত প্রায় শেষ। হয়ত আর কিছুক্ষণ পরেই আজানের ধ্বনি ভেসে উঠবে মানুষের কর্ণকুহুরে। তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে রাতগুলো কাটে এক পৃথিবী যন্ত্রণাময় আত্মচিৎকারে। তোমাকে ভেবে ভেবে ঘিরে থাকে রাতের বড্ড ক্লান্ত তন্দ্রাবলি। সে সব বুকফাটা কষ্টের কথা কাকে কীভাবে বুঝিয়ে বলি? তুমি যে ছিলে আমার কেবলই সেই তুমি। প্রায় প্রতি রাতেই তোমাকে মিথ্যে করে শেষ রাতে চিঠি লিখি। ওগো তুমি ভালো থেক যেখানে আছ আমার চাওয়ার শূন্যতায় এখন একটাই পূর্ণতা করি মিথ্যা চিঠি লিখি তোমাকে রাতের কালো আঁচলে বিষাদের কালিতে। ইতি তোমারই আমি......