শেষ স্নান
প্রকাশ | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শারমিন সুলতানা রীনা
গালিব, কেমন আছিস। খুব অবাক লাগছে তাই না এতদিন পর কোত্থেকে এলাম। আমার নিজের কাছেও খুব অবাক লাগছে শেষ পর্যন্ত তোকেই লিখতে হলো। আমার জীবনের শ্বাসরুদ্ধকর গল্পের শরিক তুইও হলি। এখন অনেক রাত। ঘুম আসছে না। কেন যেন চোখেরও কোনো ক্লান্তিবোধ হচ্ছে না। কিছুক্ষণ এ ঘর ও ঘর পায়চারী করলাম। বারান্দায় যেয়ে আকাশের দিকে তাকালাম খানিক। চাঁদকে ঘিরে নক্ষত্রের মেলা বসেছে। আসলে রাত যত আঁধার হোক তারও নিজস্ব একটা সৌন্দর্য আছে আর এই সৌন্দর্যকে ধারণ করতে পারে বিরহী মন। মনে হচ্ছে, চাঁদটা বড় বড় চোখ মেলে আমার দিকেই মুগ্ধতায় তাকিয়ে আছে। জোছনা ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির বুকে। হাত বাড়াই মুঠো মুঠো জোছনা জলে ভিজে যায় করতল। আমার বাসার পশ্চিমে সরকারি বাগানবাড়ি। মাঝখানে উঁচু দেয়াল। গাছের পাতা নড়ার শব্দ। মাঝে মাঝে নিঃশব্দে ঝরে যাওয়া পাতার নীরব কান্না বুকে বিঁধে। মনে পড়ে তোর আর আমার ছোট বেলার সেই সব গল্প। জীবনের পরতে পরতে অগাধ অভিজ্ঞতার ফুলঝুরি। আজ চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে ফেলে আসা অতীত স্মৃতিতে। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে জোনাকির শরীরের আলো জ্বলছে আর নিভছে। বহু দিন পর শুনতে পেলাম ঝিঁঝিঁর ডাক।
আজ চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কাউকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু কাকে ধরব। বিশ্বভ্রমান্ডে আজ আমি ভীষণ একা। পোড়া জমির মতো আমার বুকেও ধরেছে ফাটল। শিশিরের মতো অশ্রম্ন বিন্দু চিকচিক করছে চোখে। ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে, পারছি না- মনে হচ্ছে, কেউ হয়ত পাথরে চাপা দিচ্ছে আমায়। আমার এমন একটা দিন আসুক তুই কি চেয়েছিলি?
বুকের ভেতরে পস্নাবিত আবেগের ঢেউ। তছনছ করে দিচ্ছে আমায়। শরীরে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে আর নিজকে লাশ কাটা ঘরে হিম হয়ে থাকা লাশ কল্পনা করছি। আমি মরে গেলেও কি আমার এই দেহ টুকরো টুকরো করে পোস্টমর্টেম করবে? এক হাতে বিষের শিশি আরেক হাতে কলম। পোস্টমর্টেম শেষে আমার লাশটা তোরা আনতে যাসনে। দান করে দিস মেডিকেলের ছাত্রছাত্রীদের রিচার্সের জন্য।
আমাদের ছেলেবেলাটা কী মজারই না ছিল হাত ধরে দুজনে কত জায়গায় গেছি। ঝুম বৃষ্টিতে কতই না মজা করে ভিজেছি। মনে পড়ে তোর শীতের ভোরে স্কুলে যাওয়ার সময় ঠকঠক করে কেঁপেছি। চারদিকে সবুজ শস্যের হাতছানি। কী মুগ্ধতায় আমরা দেখতাম। ছুটির পর মধুমতী নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নদীর ঢেউ গুনতাম। অপলক চেয়ে দেখতাম মানুষের আনাগোনা। মাঝির কণ্ঠের ভাটিয়ালি আজও আমাকে টেনে নেয় গ্রামে। মন চাইছে আজও ছোট হয়ে তোর হাত ধরে মেঠো পথে হাঁটি। আমরা দু'জন কেন বড় হলাম? আমাদের ছোট বেলাটা কতই না আনন্দের ছিল। স্কুলের পড়া শেষ করে যখন কলেজে ভর্তি হলাম বুঝলাম বড় হয়ে গেছি। তুই আমাকে ভালোবাসতি মুখ ফুটে কখনো বলিসনি। তাই আমি তোকে ভাই-বন্ধু ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারলাম না। আমাদের দু'জনের মাঝখানে কখন যে সাইফ জায়গা দখল করে নিল বুঝতেই পারলাম না। আমি ভালোবেসে ফেললাম সাইফকে তুই কষ্ট পেলি। বুঝিয়ে দিলি কতখানি চাস তুই আমাকে। কেন এই কথা তুই আগে বলিসনি। কিছু কথা প্রকাশ করতে হয়। না করলে বিশ্ব সংসারে বঞ্চিত হতে হয় সবকিছু থেকে। তোর মনের ভাষা যে আমি পড়তে পারিনি। সাইফ মুহূর্তে আমার সবকিছুই দখল করে নিল। তোর আর আমার দূরত্ব বাড়ল। আমার অস্তিত্ব জুড়ে সাইফ ছাড়া আর কিছু টের পাই না। আমাদের দুটি সত্তা একসত্তায় মিশে গেল। আমাদের দুই পরিবার চেয়েছিল তোর আর আমার বিয়ে হোক। তাই কেউ সাইফকে মেনে নিতে পারল না। আর তুইতো পারলিই না। তুই যেদিন আমার হাতটা ধরে বলেছিলি তুই আমাকে ছাড়া থাকতে পারবি না বাঁচতে পারবি না আমাকে ছাড়া, সেদিনের সেই নিবিড়তায় তোর জন্য আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। আমি তখন কাঁদছিলাম তুই কী বুঝেছিলি। আমি জানি, তুই আমাকে পাষাণ নিষ্ঠুর আরো কত উপমায় ভূষিত করলি। কিন্তু নিজের অপারগতা প্রকাশ করলি না আমাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তুই গ্রাম ছাড়লি। তারপর আর যোগাযোগ করলি না। আমারও কেন যেন ইচ্ছে করল না তোর খোঁজ নিতে। আমার বাবাকেতো তুই চিনতি- যেন একটা বাঘ। কথা বললে মনে হোতো বাঘের হুংকার। বাবা সাইফকে মেনে নিতে পারেনি। কারণটাতো তুই জানিস। বাবা-মা চাইতো আমি উচ্চশিক্ষা লাভ করে নিজের পায়ে দাঁড়াই। আমিতো নিজের পায়েই দাঁড়ানো তার জন্য উচ্চশিক্ষা লাগবে কেন? সেই রাগে একদিন রাতের অন্ধকারে সাইফের হাত ধরে পালিয়ে গ্রাম ছাড়ি। আমার অজান্তে বাড়িতে কী হয়েছিল আজও আমার অজানা। ঢাকা এসে আমরা বিয়ে করলাম। আসিফ চাকরি পেল তারই এক আত্মীয়ের কোম্পানিতে। আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হলো। আমি নিজেও চাকরি করতে চাইলাম আসিফের বাধায় আটকে গেলাম। আমাদের ছোট্ট সংসারে চাঁদের আলো খেলা করে। ভালোবাসা এক অবাধ্য অনুভূতি আসিফকে পেয়ে বুঝলাম। যে অনুভূতি সন্মোহিতের মতো একজন আরেকজনকে টানে। প্রেমে পড়া মন দুরন্ত ফড়িং। সাহসী যোদ্ধা। মানুষকে অন্ধ করে দেয় এই প্রেম। হয়ে যায় বেহিসেবি। শুধু একটা মানুষকে অন্ধের মতো ভালোলাগা আর ভালোবাসা অন্য মানুষের প্রতি নিষ্ঠুর হতে শেখায়। সে আচরণ আমি নিজেই করে আসছি আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে। আবেগের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে কখন যে কত সময় পার হয়ে গেল টের পেলাম না। আমরা অপেক্ষা করছিলাম একটি দেবশিশুর জন্য। যে আমাদের ভালোবাসার বন্ধনকে আরো দৃঢ় করবে। আমাদের সুখ লিখতে বিধাতার কালির কলম ফুরিয়ে গেল। সাইফের কোম্পানিটা বন্ধ হয়ে গেল। তিমিরে ঢেকে গেল আমাদের জীবন। সাইফ অনেক চেষ্টা করেও আর কোথাও জয়েন করতে পারল না। কারণ ওদের কোম্পানির এমডি সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়েছে। সারাদেশে ছড়িয়ে গেল সে কথা পত্রিকায়, টিভি চ্যানেলগুলোতে হেড লাইনে প্রকাশিত হতে থাকল এ ঘটনা। আমার নিজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাই বাইরের জগৎ আমার কাছে অচেনা। মধ্য গগনে এসে সূর্য ডুবে গেল। আমরা স্রোতের শেওলার মতো ভাসতে থাকি কোথায় যাব, কি করব, কোনো উপায় খুঁজে পাই না। মা-বাবার কাছে যাওয়ার মতো মুখ নেই। বেঁচে থাকার মতো কোনো সম্বল না থাকলেও সাইফেট ব্যবসায়িক নজর পড়ল আমার শরীরের দিকে এটাকেই সে আয়ের উৎস বানাতে তৎপর।
অতঃপর একরাতে আমার ঘরে এলো নতুন আগন্তক আমি বিস্মিত হওয়ার অনুভূতি হারিয়ে ফেলি। আমি কাকে ধিক্কার দেব? মেনে নিলাম এই জীবন। প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষের আবির্ভাব। সাইফ পাশের রুমে অপেক্ষা করতে থাকে। আমি নিজেকে প্রশ্ন করি সাইফের মনোভাব কেমন। মানুষটা চলে গেলে আমি ফ্রেশ হই। সাইফের হাতে চকচকে টাকাগুলো তুলে দেই। নতুন টাকার মতো ওর চোখ চকচক করে। মনে হয় একদলা থুথু ছিটিয়ে দেই ওর মুখে। আমি ঘৃণায় ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেই। প্রতিদিনের এই যুদ্ধ শরীর আর নিতে পারছে না। গায়ে জ্বর আসে সাইফ জ্বরের ওষুধ আর কন্ডমের প্যাকেটগুলো নির্বিকারভাবে আমার হাতে তুলে দেয়। আমার আর কান্না আসে না আসিফের ওপর ঘৃণাও কমে গেছে। মনে হচ্ছে আমার মনুষ্যত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ইদানিং খেয়াল করছি তন্ময়ের আমার উপরে মায়া বেড়ে গেছে শরীর অসুস্থ দেখলে টাকাটা দিয়ে সে চলে যায়। নিঃস্বার্থভাবে টাকাটা কেন দিচ্ছো প্রশ্ন করলে বাঁকা হাসি দিয়ে বের হয়ে যায়। টের পাচ্ছি আমার ওপর ওর মায়া বেড়ে গেছে। বেশ্যাকে কেউ মন থেকে সত্যিকার ভালোবাসতে পারে এটাও এক আশ্চর্য ব্যাপার। কিন্তু এটা আমার পথ নয়, পেশা নয়। আমাকে বাধ্য করা হয়েছে। সাইফ আমার শরীর ছুলে মনে হয় অজগর সাপের অস্তিত্ব। আমি ঝটকা মেরে ওকে সরিয়ে দেই। সাইফ আমার সামনে দাঁড়ালে আমি তন্ময়কে খুঁজি।
এক সপ্তাহ তন্ময়ের দেখা নেই। মনে মনে ভাবি ওর কি কোনো বিপদ হলো। ওর ভালো চেয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি। তন্ময় আসে আমি ব্যাকুল হয়ে যাই ওর সান্নিধ্যে। নানা প্রশ্ন করি, এতদিন কেন আসনি। সাবলিলভাবে ওর উত্তর কাজে বিজি ছিল। ওর জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে পছন্দ হলে সামনের মাসে বিয়ে। এক তন্ময় চলে গেলেও আরো কত তন্ময় ছুঁয়ে যায়। এই শরীর সব ভাবনা উপেক্ষা করে কেন যেন তন্ময়ের জন্য হৃদয়ে উপচে পড়ছে বেদনার নোনাজল। ওর চলে যাওয়ার সময় হয়েছে আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখি পরম নির্ভরতায়।ও আলতো করে আমার কপালে চুমু খায় যেখানে লালসা নয় আশ্রয়ের অঙ্গীকার। সাইফ তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। তন্ময় চলে যায় আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। টেবিলে খাবার দিয়ে সাইফকে ডাক দেই। শুনতে পাই ও হুহু করে কাঁদছে। আমি ওকে সান্ত্বনা দেয়ার মতো কথা খুঁজে পাই না। রাত বাড়ে সাইফের নাক ডাকা শুরু হয়। আমার ঘুম আসে না। আজ দুমাস পিরিয়ড হয় না। ইদানীং মাথা ঘোরে বমি বমি ভাব। কিছু খেতে পারি না। আমার ভেতরে এক নতুন প্রাণের অস্তিত্ব টের পাই। যে ব্যাকুল হয়ে আছে পৃথিবীতে তার আগমন জানান দিতে। যে আসতে চায় তাকে আমি কার পরিচয় দেব। কে তার বাবা? কি হবে তার পরিচয়। আমি আর ভাবতে পারছি না।
রাত এখনো শেষ হয়নি মাঝে মাঝে খন্ড খন্ড মেঘ এসে চাঁদকে আড়াল করে দিচ্ছে। মেঘ সরে গেলে চাঁদ আবার তার জোছনায় আলোকিত করছে চারিপাশ আমি প্রাণ ভরে জোছনা জলে স্নান করি হয়ত-বা এটাই আমার শেষ স্নান।