ওয়ার অ্যান্ড পিস ও মানবতা

ওয়ার অ্যান্ড পিস উপন্যাসটি ১৮০৫ থেকে ১৮১২ সালব্যাপী রাশিয়া এবং ফ্রান্সের যুদ্ধের পটভূমিতে লেখা একটি ফিকশোনাল উপন্যাস। উপন্যাসটি সেই সময়ের অভিজাত শ্রেণির দৃষ্টিতে যুদ্ধকে তুলে ধরেছে। সেই সময়ের ফরাসি অভিজাত শ্রেণির জীবনযাত্রার কাহিনির মধ্য দিয়ে তিনি যুদ্ধের কাহিনি প্রতিভাত করেছেন। ঘটনার বর্ণনা শুরু হয়েছে সেন্ট পিটাসবার্গের আন্না পাভলভনার বাড়িতে আড্ডার মধ্য দিয়ে

প্রকাশ | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

সালেহ ইমরান
কাউন্ট লিও নিকোলায়েভিচ তলস্তয় একজন শক্তিমান লেখক। তাকে পৃথিবীর সর্বকালের সেরা লেখকদের একজন বলে মনে করা হয়। তিনি ১৮২৮ সালের ২৬ আগস্ট রাশিয়ার ইয়াসিনা পলিয়ানায় জন্মগ্রহণ করেন। তার অনেক বিখ্যাত লেখার মধ্যে 'ওয়ার অ্যান্ড পিস' অন্যতম। বিখ্যাত এই উপন্যাসটি তাকে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি এবং সম্মান এনে দেয়। তার লেখা দীর্ঘতম উপন্যাসের মধ্যে এটি একটি এবং অপরটি হলো 'আন্না ক্যারেনিনা'। ওয়ার অ্যান্ড পিস উপন্যাসটি ১৮০৫ থেকে ১৮১২ সালব্যাপী রাশিয়া এবং ফ্রান্সের যুদ্ধের পটভূমিতে লেখা একটি ফিকশোনাল উপন্যাস। উপন্যাসটি সেই সময়ের অভিজাত শ্রেণির দৃষ্টিতে যুদ্ধকে তুলে ধরেছে। সেই সময়ের ফরাসি অভিজাত শ্রেণির জীবনযাত্রার কাহিনীর মধ্য দিয়ে তিনি যুদ্ধের কাহিনী প্রতিভাত করেছেন। ঘটনার বর্ণনা শুরু হয়েছে সেন্ট পিটাসবার্গের আন্না পাভলভনার বাড়িতে আড্ডার মধ্যে দিয়ে। এরপর একে একে প্রিন্স অন্দ্রম্ন, পিয়ের বেজখুভ, প্রিন্স ভাসিলি, রুস্তভ প্রমুখদের মাধ্যমে নির্মিত হয়েছে উপন্যাসের পস্নট। মাঝে মাঝেই কাহিনী প্রবাহে ছেদ এনে লেখক তুলে ধরেছেন তার দার্শনিক চিন্তাধারা। উপন্যাসটি ফরাসি অভিজাত শ্রেণির সমাজ বাস্তবতার নিরিখে সেই সময়ে নেপোলিয়ন এবং সম্রাট আলেকজান্ডারের মধ্যে ঘটে যাওয়া যুদ্ধ, সন্ধি এবং নেপোলিয়ন কর্তৃক মস্কো অভিযানের কথা তুলে ধরেছেন। ফ্রান্সের প্রায় ছয় লাখ সৈন্য নিয়ে গঠিত শক্তিশালী সেনাবাহিনী যখন একের পর এক অঞ্চল জয় করছিল, তখন রাশিয়ার সৈন্যরা খেই হারিয়ে একদিকে মৃতু্যর কোলে ঢোলে পড়ছিল। অন্যদিকে, প্রতিঘাত হানতে না পেরে ক্রমাগত তাদের পিছু হটতে হচ্ছিল। বরদিনো যুদ্ধে ফরাসি বাহিনী, রাশিয়ার শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়লেও পরবর্তী সময়ে বিনা বাধায় মস্কো দখল করতে সমর্থ হয়। সেই সময়ে রাশিয়ার প্রধান সেনাপতি কুতজুভ বরদিনো যুদ্ধে তাদের বিজয় দাবি করলেও, অনেকেই তা মেনে নিতে পারেননি। মূলত মস্কোর পতন ফরাসিদের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে ফরাসিরা যেহেতু মস্কো দখল করতে সক্ষম হয়েছে, সুতরাং পুরো রাশিয়ার পতন হয়েছে। নেপোলিয়ন সেই সময়ে ভেবেছিল, মস্কোর পতনের পর হয়তো রাশিয়ার সম্রাট আলেকজান্ডার তার বশ্যতা স্বীকার করবে এবং নেপোলিয়ন তাদের প্রতি উদারতা দেখিয়ে পুরো ইউরোপে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। আমরা যদি ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখব যখন কোনো দেশের সেনাবাহিনীর পরাজয় ঘটে তখন সেই জাতিরও পরাজয় ঘটে। যদিও সেনাবাহিনী সংখ্যায় একটি দেশের জনসংখ্যার খুবই সামান্য অংশ। তবুও সেনাবাহিনী এবং রাজধানীর পতনের সঙ্গে সঙ্গেই সেই জাতির পতন হয়। পরাধীনতার শৃঙ্খল তাদের আবদ্ধ করে। রাশিয়া সেনাবাহিনী মস্কো পরিত্যাগ করে পিছু হটবার আগে আরও একবার শত্রম্নদের মুখোমুখি হতে চেয়েছিল। কিন্তু বরদিনোর যুদ্ধের পর নতুন করে আবারও প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হওয়ার মতো অবস্থা বাস্তবে তাদের ছিল না। তাই বিনাযুদ্ধে পতন হয়েছিল ক্রেমলিনের। রাশিয়ার সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। বিনাবাধায় মস্কো দখল করে নেপোলিয়ন। সাধারণভাবে বিবেচনা করলে এই যুদ্ধে ফ্রান্সের বিজয় এবং রাশিয়ার পরাজিত হওয়ার কথা। কিন্তু ঘটলো উল্টো ঘটনা। মস্কো বিজয়ের পর নেপোলিয়নের বাহিনী শহরজুড়ে চালাতে শুরু করল লুটপাট। শৃঙ্খলিত সৈন্যরা হয়ে উঠল দস্যু। একের পর এক দালান পড়তে শুরু করল। মস্কো পরিণত হলো ছাই এবং ধোয়ার নগরীতে। এই অগ্নিকান্ড আসলে কারা ঘটেছিল সেটা নিয়ে দ্বিমত আছে। কিছু ইতিহাসবিদ মনে করে এই অগ্নিকান্ডের পেছনে দায়ী নেপোলিয়নের বাহিনী আবার অনেকেই মনে করেন এই অগ্নিকান্ড ঘটিয়েছিল রুশরা। তবে অগ্নিকান্ড এবং লুটতরাজের কারণে মস্কোতে দেখা দিল সৈন্যদের রসদ ঘাটতি। ফলশ্রম্নতিতে এত বড় বিশাল সৈন্য বহরের অনেকেই তীব্র ঠান্ডায় মৃতু্যবরণ করতে শুরু করল। যখন অনেক দিন হয়ে গেলেও মস্কোর পক্ষে কেউ আত্মসমর্পণ করতে এলো না, অপরদিকে, রসদের অভাবে সৈন্যরা প্রাণে মরতে শুরু করল, শহরজুড়ে চোরাগুপ্তা হামলা শুরু হলো, তখন এই পরিত্যক্ত শহরই পরিণত হল ফরাসিদের মরণফাঁদে। একরকম বাধ্য হয়েই নেপোলিয়নকে মস্কো ছেড়ে পিছু হটতে হলো ফ্রান্সের পথে। কিন্তু তিনি এমন রাস্তা ধরে পিছু হটতে শুরু করলেন যেই অঞ্চল আগেই যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে রসদের অভাব ও তীব্র শীতে নেপোলিয়নের বৃহৎ বাহিনী পতিত হলো ধ্বংসের মুখে। যখন ফরাসিরা রাশিয়া ছাড়ল, তখন সম্রাট আলেকজান্ডার ফ্রান্স অভিমুখে সৈন্য পরিচালনা করলেন। মিত্র শক্তির সহায়তায় নেপোলিয়নকে করলেন ক্ষমতাচ্যুত ও নির্বাসিত করলেন সেন্ট হেলেনা দ্বীপে। যুদ্ধের এই কাহিনীর সঙ্গে সমান্তরালে উঠে এসেছে পৃথিবীর কিছু সুন্দরতম প্রেম কাহিনী। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠাজুড়ে লেখক লিখেছেন প্রিন্স অন্দ্রম্ন, নাতাশা, পিয়ের, রুসতভ ও প্রিন্সেস মারির প্রেমের গল্প। উঠে এসেছে সোনিয়ার আত্মত্যাগ, আন্দ্রম্নর মৃতু্য এবং তার প্রতি নাতাশার সীমাহীন ভালোবাসার কথা। প্রিন্স অন্দ্রম্ন শেষ দিনগুলো তার প্রিয়তমার সান্নিধ্যে থেকে আস্তে আস্তে ঢলে পড়েন মৃতু্যর কোলে। নাতাশার প্রতি পিয়েরের সুপ্ত প্রেম পরবর্তী সময়ে তাদের আবদ্ধ করে সংসার জীবনে। উপন্যাসের একদম শেষ অংশে তাদের সুখের সংসারের গল্প উঠে এসেছে। দ্বিতীয় বা, শেষ পরিশিষ্টে লেখক যুদ্ধ এবং যুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে তার দার্শনিক চিন্তাভাবনা তুলে ধরেছেন। তিনি বলছেন, জাতি ও মানুষকে নিজেকে চিন্তে শেখানোই তো ইতিহাসের লক্ষ্য। তিনি আরো বলছেন, যতদিন কোনো ঘটনায় অংশগ্রহণকারী মানুষের ইতিহাস লেখা না হবে ততদিন একটা শক্তিকে মেনে না নিলে মানুষের অগ্রগতির বর্ণনা করা অসম্ভব। ঐতিহাসিক এই উপন্যাসে যেমন যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে, সেই সঙ্গে তিনি এটাও বলেছেন যুদ্ধ কখনোই মানব কল্যাণের বিষয় হতে পারে না। যুদ্ধ মানুষের শান্তির পরিপ্রেক্ষিত। বিশ্বে হাজার হাজার গল্প, উপন্যাস, কবিতা রচনা করা হয়েছে যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে। কিন্তু তলস্তয়ের 'ওয়ার অ্যান্ড পিস'-এর সমতুল্য সৃষ্টি পৃথিবীতে বিরল।