বাংলা ভ্রমণ সাহিত্যে ভিন্নধারার প্রবর্তক সৈয়দ মুজতবা আলী (জন্ম : ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দ-মৃতু্য: ১১ ফেব্রম্নয়ারি, ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ)। তিনি অসাধারণ সব ভ্রমণ সাহিত্য লিখেছেন- যা এখন পর্যন্ত কেউ অতিক্রম করতে পারেননি। আজন্ম বোহেমিয়ান, মননে ঋদ্ধ, বহুভাষাবিদ মুজতবা আলীর মূলত ভ্রমণ সাহিত্য ৫টি। বইগুলো হচ্ছে: 'দেশে- বিদেশে' (১৩৫৬), 'জলে-ডাঙায়' (১৩৬৩), 'ভবঘুরে ও অন্যান্য' (১৩৬৯), 'মুসাফির' (১৩৭৮) এবং 'বিদেশে' (১৩৫৯)।
মুজতবা আলীর লেখা প্রথম বইটিই ছিল 'দেশে-বিদেশে'। এটি ১৯৪৮ সালের মার্চ মাস থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় কলকাতার 'দেশ' পত্রিকায়। প্রথম লেখা ভ্রমণ কাহিনী দিয়েই মুজতবা আলী বাংলা সাহিত্যে তার আসনটি পাকা করে নিয়েছিলেন। দুই-খন্ডে প্রকাশিত 'দেশে-বিদেশে'র প্রথম খন্ড হচ্ছে কলকাতা থেকে রেলপথে কাবুল যাত্রার এক চমৎকার বিবরণ। ট্রাভেলের ভঙ্গিতে লেখক সেখানে তুলে ধরেছেন তার যাত্রাপথের বিচিত্র সব চরিত্র, জীবনপ্রণালি ইত্যাদি। চলার পথের বিভিন্ন অঞ্চলের রীতি, প্রথা, বৈশিষ্ট্য, আচার-আচরণ, পোশাক-আচরণ, সংস্কৃতি ইত্যাদি। সরস-প্রকাশভঙ্গি পাঠককে মুগ্ধ করছে। শুরু হয়েছে কলকাতার ফিরিঙ্গি সহযাত্রীকে নিয়ে। পরে তা বিস্তৃত হয়েছে পাঞ্জাব ও পেশোয়ারসহ ভারত-পাকিস্তানের সহযাত্রীদের কথা। দ্বিতীয় খন্ডে আমূল পরিবর্তন। প্রথমভাগের ভ্রমণ কাহিনী রূপান্তরিত হয়েছে ভ্রমণগদ্যে। এখানে লেখকের নতুন কর্মস্থল আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতার চিত্র। সেখানকার প্রগতিশীল আমানুলস্নাহর আধুনিক আফগানিস্তান গঠনের স্বপ্ন আর মোলস্নাতন্ত্রের বিরোধিতার চিত্র। কাবুলের মানুষের জীবনযাত্রা, ঐতিহ্য দক্ষ শিল্পীর মতো তুলে ধরেছেন।
'দেশে-বিদেশে' ভ্রমণ কাহিনীটি শুরু হয় হাওড়া স্টেশন থেকে পেশওয়ারের দিকে ট্রেনযাত্রা দিয়ে। লেখকের বর্ণনায় পাঠানদের আন্তরিকতা ও আড্ডার মনোভাবের বেশ ভালো ছবি ফুটে উঠেছে। যখন আপন দেশ ছেড়ে পেশওয়ারের ট্রেনে ওঠার পর তার দেখা হয় এক পাঠান বৃদ্ধের সঙ্গে তার নির্জলা আন্তরিকতা ফুটে উঠেছে তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে রসবোধ আর পান্ডিত্য। পেশওয়ারে নামার পর লেখক আহমদ আলীর বাসায় মেহমান হয়ে আশ্রয় নেন। তার সঙ্গে লেখকের খোশগল্পের বর্ণনাগুলোও বেশ উপভোগ্য। আমরা জানি, আফগানিস্তান মরুময়, প্রাণহীন, রসহীন একটি দেশ। যেখানে শুধু যুদ্ধবিগ্রহ। সেখানকার বালি, পাথর, কাদা সবকিছুতেই তার অতিসূক্ষ্ণ নজর রেখেছিলেন মুজতবা আলী। ভৌগোলিক ও সামাজিক ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশিয়ে অন্য এক আফগান, অন্য এক কাবুল নির্মিত হয়েছে। আসল পরিচয় এটাই, আফগানের সত্তা এটাই। বর্তমানেরটা হয়ত বাহ্যিক। মুজতবা আলীর চৌকস ও অন্তর্নিহিত পর্যবেক্ষণে এই রুক্ষ দেশটির চাঞ্চল্য, জীবনযাত্রা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। পাঠককে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, কাবুলে- আফগান সংস্কৃতি-ঐতিহ্যে বা ইতিহাসেও। ২০১৫ সালে 'দেশে-বিদেশে' বইটি 'ওহ ধ খধহফ ভধৎ ভৎড়স ঐড়সব' শিরোনামে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত করা হয়েছে।
মিসরকে 'নীল নদের' দেশ বলা হয়। আবার সপ্তম আশ্চর্যের একটি পিরামিড। পিরামিডের দেশও মিসর। ফলে, ঘোরাঘুরি করা বা জ্ঞানার্জন, ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে যোগাযোগ বা পরিচয় করার জন্য আদর্শ একটা দেশ। সৈয়দ মুজতবা আলী কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন, মিসর ভ্রমণও করেছেন। অধ্যাপনার সময়ে সমগ্র মিসর ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর সেই অভিজ্ঞতা থেকেই লিখেছেন ভ্রমণকাহিনী 'জলে-ডাঙায়'। এ বইয়ে তেইশটি অধ্যায় ও একটি পরিশিষ্ট রয়েছে। 'জলে-ডাঙায়' নিছক ভ্রমণ কাহিনী নয়, এ যেন এক পরিপূর্ণ, নির্ভেজাল কিশোর সাহিত্যও বটে। এ গ্রন্থের শুরু মাদ্রাজ থেকে পোর্ট সঈদ পর্যন্ত বন্দরের বৈচিত্র্য কর্মকান্ড নিয়ে বর্ণনা। এই ভ্রমণের 'জলে' অংশটি মাদ্রাজ বন্দর থেকে সুয়েজ বন্দর পর্যন্ত জলপথের বা জলের বিভিন্ন কর্মকান্ডের চিত্র অঙ্কন। এরপর কায়রো শহর এবং পরে ট্রেনে পোর্ট সঈদ পর্যন্ত ভ্রমণ 'ডাঙায়' অংশের অন্তর্ভুক্ত। দু-অংশ মিলিয়ে এ ভ্রমণ কাহিনী হওয়ার নামকরণ করেন 'জলে-ডাঙায়'। ভ্রমণে তিনি তার দুই কিশোর বন্ধু পল আর পার্সিকে নিয়ে জাহাজে-বাজারে-রেস্তোঁরায় আড্ডায় মত্ত থেকেছেন। সে-আড্ডার খাঁজে-ভাঁজে বিস্তর গালগল্প ও চুটকি পরিবেশন করেছেন। গল্পের টানে এসেছে ইতিহাসের খুঁটিনাটি, এসেছে আবহাওয়ার খবর, জীবনযাত্রার গল্প এবং সমাজ-সংস্কৃতির নানা-প্রসঙ্গ। এ গ্রন্থের বর্ণনায় মুজতবার বন্দরের উপলব্ধি এমন- 'বন্দরে বন্দরে তখন যে চিৎকার, অট্টরব ও হুঙ্কারধ্বনি ওঠে সে সর্বত্র একই প্রকারের। একই গন্ধ, একই স্বাদ। চোখ বন্ধ করে বলতে পারবে না, নারায়ণগঞ্জে দাঁড়িয়ে চাঁটগাঁইয়া শুনছ, না হামবুর্গে জর্মন শুনছ।'
মুজতবা আলীর ভ্রমণ কাহিনী নানা বিষয় ও বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। ভ্রমণ সাহিত্যে আছে পাহাড়-বনাঞ্চলসহ ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক ঘটনাবলি। তার ভ্রমণ সাহিত্যও বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছে বিপুল জনপ্রিয়। উচ্চশিক্ষা অর্জন বা কর্মসূত্রে বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। ভ্রমণকৃত বিভিন্ন দেশের তার অভিজ্ঞতার বিবরণ হয়েছে অসাধারণ গদ্য শৈলী- হয়ে উঠেছে অপূর্ব ভ্রমণ-সাহিত্য। মুজতবার অন্যান্য সাহিত্যেও ভ্রমণের বিভিন্ন প্রসঙ্গ ও অনুসঙ্গ এসেছে। তার গদ্যশৈলীতে মুগ্ধ পাঠক। কাহিনি বা গদ্যের আড্ডায় বা বর্ণনায় গল্প ও ইতিহাসের বাঁক পেরিয়ে যান সহজেই আবার অবলীলায় ঢুকে পড়েছেন অন্য প্রসঙ্গে। ট্রেনের জংশন পেরিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু যাত্রী বা দর্শকের সেদিকে খেয়াল নেই। মনোযোগ মুজতবার গল্প বা আড্ডার দিকে।
মুজতবা আলীর ভ্রমণ সাহিত্য থেকে সংশ্লিষ্ট দেশ ও জাতির ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা, জীবনযাত্রা, আবহাওয়া পরিবর্তন, ভূগোল ইত্যাদি বিষয় জানা যায়। তার সমগ্র লেখার মধ্যেই তাই খুঁজে পাওয়া যায় সরস আড্ডার রস ও মেজাজ। তাই তার লেখা পড়তে গিয়ে পাঠককে কখনো থমকে যেতে হয় না। তার লেখাগুলোতে পাঠক ও লেখকের মধ্যে কোনো আড়াল বা আবছায়া নেই। আছে সেতুবন্ধনের ক্ষমতা, আছে পাঠক ধরে রাখার সম্মোহনী।