বাংলা সাহিত্যে আশরাফ পিন্টু একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি একাধারে কবি, শিশু সাহিত্যিক, গল্পকার ও গবেষক। তবে গবেষক হিসেবে তিনি সমাধিক পরিচিত। তার অণুগল্পের ভান্ডার বেশ সমৃদ্ধ। 'ষোড়শীর অসম প্রেম' তার সপ্তম অণুগল্পের বই। গ্রন্থটিতে মলাটবন্ধ হয়েছে ৬৬টি অণুগল্প। এ গ্রন্থ প্রসঙ্গে লেখকের বক্তব্য হলো- কেউ কেউ দিনলিপি লেখেন, আমি লিখি অণুগল্প। তবে দিনলিপির মতো প্রতিদিন অণুগল্প লেখা হয়ে ওঠে না। একটি ক্ষুদ্রায়তন অণুগল্প লিখতে অনেক চিন্তা ও সময়ের প্রয়োজন পড়ে।
'ষোড়শীর অসম প্রেম' গ্রন্থে আমাদের সমাজ জীবনের নানা অণুচিত্র তুলে ধরেছেন। প্রতিটি অণুগল্প এক কথায় চমৎকার। একটি গল্পের সাথে আর একটি গল্পের মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটি গল্প পড়লে আর একটি গল্প পড়তে ইচ্ছে করে। মানবজীবনের এমন কিছু মুহূর্ত অসামান্য দক্ষতায় মলাটবন্দি করেছেন আশরাফ পিন্টু; তা গল্পগুলো না পড়লে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে না। শহর বা গ্রামের মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখের অভাবনীয় সব বর্ণনা রয়েছে এ গ্রন্থে। এ গ্রন্থে ভাষা ব্যবহারে লেখক তার নিজস্বতার পরিচয় দিয়েছেন। কিছু গল্পের সংলাপে আঞ্চলিক ভাষার ও ব্যবহার করেছেন।
পঞ্চাশোর্ধ্ব ভুজা ফকির পঙ্গু-অসহায়। স্ত্রীও মারা গেছেন। প্রতিবেশী বিধবা খড়কির মাকে বিয়ে করার ইচ্ছে। খড়কি মা রাজি না। খড়কি বড় হচ্ছে। মেয়ের বিয়ে-সাদি দিতে হবে। এক বৃষ্টি দিনে ভুজা ফকিরের খুপরি ঘর থেকে কোঁকানির শব্দ শুনে খড়কি উঁকি দেয়। ভুজা বলে- খিদা, খিদায় মইরা যাইতেছি। খড়কি তার জন্য নিয়ে আসা খাওয়া ভুজাকে খেতে দেয়। কিন্তু খড়কিকে দেখে ভুজার চোখ চক চক করে। হঠাৎ খড়কির ডান হাত ধরে হেঁচকা টান...। গল্পের নাম- 'খিদা'।
'উত্তল ফেন'-এ সন্ধান ও কবিতা দম্পতির মধ্যরাতের গল্প। 'খিদা' গল্পের মতো এটিরও উপজীব্য বিষয়- জৈবিক চাহিদা। আসলে জীবন এমনই। 'ভয় ও সাহস'- এ ফসলের ক্ষেতে কিম্ভূতকিমাকার একজন লোক বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ডিম্বাকৃতির মাথা, মুখমন্ডল কালো, চোখ দুটো যেন ইটের ভাটা। পাখিরা ভয়ে অস্থির। তাদের পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা। অথচ কেউ ওই ক্ষেতে যেতে সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু একদিন সাহস করে ওই লোকটার কাছাকাছি যায়। অতঃপর দেখে ওটি মানুষ নয়, কাকতাড়ুয়া।
জ্যোতিষী প্রসেনজিৎ হাত দেখে মানুষের ভবিষ্যৎ বলেন। যাদের ভাগ্যে শনি-রাহুর প্রভাব রয়েছে তারা তার কাছে প্রতিকারের উপায় জানতে ব্যস্ত। সবশেষে চাদরপরা এক আগন্তুক আসে। জ্যোতিষী তাকে হাত দেখাতে বলেন। আগন্তুকও হাত দেখায়। আগন্তুকের হাত কবজি পর্যন্ত কাঁটা...। এ এক অসাধারণ গল্প 'ভাগ্য'।
এ গ্রন্থে মজার গল্পও রয়েছে। গল্পের নাম 'বউ পড়ুয়া একজন'। শিহাব শাহরিয়ার হঠাৎ বদলে যায়। ছাত্রজীবন থেকে প্রচন্ড বই পড়ার নেশা। একটু বেশি বয়সে বিয়ে করছেন। 'বই পাগল' শিহাব রাতারাতি হয়ে গেল 'বউ পাগল'। সব শুনে বন্ধু সোহেল তাকে প্রশ্ন করলে জবাবে সে বলল, কে বলল, আমি বই ছেড়েছি? বই এবং বউ দুটোই আমার কাছে সমার্থক। দুটোই এখন আমি নিড়িরভাবে পড়ছি।
এ রকম অসংখ্য গল্প রয়েছে। গল্পগুলো পড়তে খুব বেশি সময় লাগে না। কিন্তু একবার পড়লে মনের মধ্যে গেঁথে যায়। মনে হয় আর একবার পড়ি।
এ গ্রন্থে আরও কিছু অণুগল্প আছে যা এক কথায় চমৎকার- খোঁজ, অবিকল মানুষের মতো, অন্তর্গত কান্না, লাল পিঁপড়ের বন্দী জীবন, চুম্বক, ডোম মুন্না, রাত্রি দিবার গল্প, বাঁশির কান্না, মোমবাতি, কঙ্কালরাও মানুষ ছিল ও মুক্তি। কিছু গল্প লেখক ছয় লাইন, আট লাইন, দশ লাইন এ রকম লিখেছেন। অন্ধকার, অভিনয়, খোলস, তরুণী যখন বৃক্ষ, দাওয়াত, নগ্নতা, নদী শুকালে শব্দ হয় না। নদী ও নৌকা, পুতুল, প্রস্তুতি, ফাঁসির আসামির শেষ ইচ্ছে, বটবৃক্ষের ইচ্ছে, বন্ধুত্ব, মায়া নেকড়ে। এ ধরনের গল্পে ও লেখক তার চাক্ষুস অভিজ্ঞতা ও পড়াশোনার চিত্তাকর্ষক পরিচয় দিয়েছেন।
আমি বেশ কয়েক বছর ধরেই আশরাফ পিন্টুর অণুগল্পের নিবিষ্ট পাঠক। তার অণুগল্পে তিনি জীবনচক্রের বিভিন্ন ধাপ এবং ভিন্ন আর্থসামাজিক পটভূমির নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে থাকেন। অণুগল্প পড়ে মনে হয় গল্প নয় সত্যি।
এ গ্রন্থের প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছে কবি বন্দে আলী মিয়ার আঁকা একটি ছবি। যা প্রায় একশত বছর (১৯২৫ সালে অংকিত) আগের। যা থেকে জানা যায় কবি বন্দে আলী মিয়া ও একজন দক্ষ চিত্রশিল্পী ছিলেন। বইটি ২০২৩ সালে ফেব্রম্নয়ারি মাসে গতিধারা প্রকাশ করেছে। মূল্য রাখা হয়েছে ১৫০ টাকা। বইটির বহুল প্রচার প্রত্যাশা করি।