অচিন রাগিণী
প্রকাশ | ৩০ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
জোবায়ের রাজু
দুপুরের দিকে বুকের ব্যথাটা হালকা করে বাড়তে থাকল নাজিম চৌধুরীর। প্রথমে ভেবে নিয়েছেন গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা। তাই গ্যাস্ট্রিকের ক্যাপসুল খেয়ে ভেবেছেন আরোগ্য লাভ হবে। কিন্তু উপকারের ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না, বরং বুকের ব্যথা ক্রমশ বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে ঘামও। প্রচন্ডরকম ঘামতে থাকেন নাজিম চৌধুরী। কিছুটা তিনি আঁচ করতে পেরেছেন যে কি হতে চলছে। স্ট্রোকের লক্ষণ। না, বাসায় আর এক সেকেন্ডও থাকা যায় না। এখনই হাসপাতালে যেতে হবে। ছোট ভাই জুয়েলের কাছে গিয়ে বললেন, 'আমার কাছে অস্বস্তি লাগছে। হাসপাতালে চলো আমার সঙ্গে।' কিন্তু জুয়েল বড় ভাইকে মুখের ওপর বলে দেয়, 'পারব না ভাইয়া। আমি একটা পার্টিতে যাব।' ছোট ভাইয়ের আচরণে কিছুটা কষ্ট পেলেন নাজিম চৌধুরী, কিন্তু কষ্টকে এখন পরোয়া করা যাবে না। ব্যথায় তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে ঘামেও ভিজে জবুথবু হয়ে একাকার। ছোট বোন সুইটি তার ঘরে ফেসবুকে ব্যস্ত। নাজিম চৌধুরী বুকের ব্যথা নিয়ে সুইটির কাছে গিয়ে বললেন তাকে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। কিন্তু বাবার সমতুল্য বড় ভাইয়ের এই বিশেষ আবদার না রেখে সুইটি বরং বিরক্তি নিয়ে বলল, 'ভাইয়া, আগামী সাত তারিখে আমার ভার্সিটিতে প্রোগ্রামে গাইতে হবে। একটু পর হারমোনিয়াম নিয়ে রেওয়াজ করতে বসব।' বোনের কথা শুনে মনে মনে আন্দোলিত হয়ে ওঠেন নাজিম চৌধুরী। এখন আন্দোলন করার সময় নয়। বুকের যন্ত্রণায় তার দম বন্ধ যাচ্ছে। মা রিজিয়া বেগম ইজি চেয়ারে বসে আয়েস করে দই খাচ্ছেন। পুত্রের অবস্থা খুব একটা পরখ করতে পারেননি রিজিয়া বেগম। নাজিম চৌধুরীও বয়স্ক মাকে তার অসুস্থতার ব্যাপারে কোনো কিছু বুঝতে দেননি। কিন্তু জ্ঞানী দুটি ভাইবোন তো ইচ্ছে করলে পারে এই নাজিম চৌধুরীকে হাসপাতালে যাওয়াতে সহায়তা করতে। অথচ তাদের জন্য তিনি কিনা করেছেন। থাক এখন সেসব কথা।
নিরুপায় নাজিম চৌধুরী একা একা ছুটলেন হাসপাতালের দিকে বুকের ব্যথা নিয়ে। তিনি রিকশা চেপে বসলেন। ঝড়ের বেগে রিকশা চলছে প্রাইম হসপিটালের দিকে। জুয়েল আর সুইটির ব্যবহার তাকে এই দুঃসময় আঘাত দিয়েছে। পরিবারে দিন দিন তিনি নগণ্য হয়ে যাচ্ছেন। অথচ এই পরিবারের সবার কান কথা ধরে স্ত্রীর সন্তানদের সঙ্গে তিনি সব সময় দুর্নীতি করে এসেছেন। ইয়াসমিনের সঙ্গে আটাশ বছরের সংসার। দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী সন্তানদের সঙ্গে তিনিও শুভ আচরণ করে এসেছেন। নাজিম চৌধুরী দু'সন্তানের জনক। পুত্র হিলেস্নাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকে অনেক দিন থেকে। বড় সন্তান জয়া। স্বামী সন্তান নিয়ে মিরপুরে তার সংসার। স্ত্রী ইয়াসমিন এখন সেখানেই আছেন। নাজিম চৌধুরীর সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করে তিনি মেয়ে জয়ার বাসায় চলে গেছেন দুই মাস আগে। এই ঝগড়ায় ইয়াসমিনকে একরৈখিক দায়ী করা যাবে না। সহনশীল মহিলা ইয়াসমিন। গায়ের বর্ণ কালো হওয়াতে ইয়াসমিন শ্বশুরালয়ে সব সময় তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছেন। শাশুড়ি, ননদ দেবর ও অন্যদের কাছ থেকে সারা জীবন অবহেলা অর্জন করা ইয়াসমিনকে তার সংসারের একমাত্র ভরসার মানুষ নাজিম চৌধুরীও সুস্থ জ্ঞানে টিটাকরী করে গেছেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা গুণের অধিকারিণী ইয়াসমিনের শতভাগ মুনশিয়ানা দেখানোর ক্ষমতা থাকলেও রূপ সৌন্দর্যের দৌড়ে ইয়াসমিন ছিলেন পেছনে পড়ে থাকাদের একজন। বর্ণবাদী এই সমাজে শুধু দেখতে চোখে পড়ার মতো রূপের মোহনীয়তা না থাকার কারণে ইয়াসমিনের সব গুণকে মূল্যায়ন করেনি শ্বশুরবাড়ির বিজ্ঞজনরা। বাসর রাতে স্ত্রীকে প্রথম দেখে মূর্ছা যান নাজিম চৌধুরী। এ সম্পর্ক তিনি রাখবেন না বলে বারবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কিন্তু মোজাম্মেল চৌধুরী যেখানে পুত্র নাজিমের জন্য বংশ মর্যাদা যাচাই করে বউ ঘরে এনেছেন, সেখানে তার কথার সীমালঙ্ঘন করার দুঃসাহস দেখানোর স্পর্ধা কেউ দেখাতে পারবে না। কেবল রক্ষণশীল পিতার সামনে স্ত্রীকে নকল টান দেখানোর চর্চা করে গেছেন বেশ কয়েক বছর। ততদিনে দুই সন্তানের মা হন ইয়াসমিন। কিন্তু মোজাম্মেল চৌধুরীর মৃতু্যর পর স্বামীর অবহেলা বাড়তে থাকে। একদিন আড়াল থেকে কান পেতে ইয়াসমিন শুনতে পান তার শাশুড়ি রিজিয়া বেগম ও খালা শাশুড়িরা নাজিম চৌধুরীকে কুমন্ত্রণা আর শালাপরামর্শ দিয়ে ইয়াসমিনকে ডাইনিরূপে উপস্থাপন করেছে।
সেদিন সারারাত কেঁদেছেন ইয়াসমিন। অন্যের কান কথা ধরে স্বামীটি তার সঙ্গে রূঢ় আচরণ করছেন। এ যেন মেনে নিতে না চাইলেও মেনে নেওয়া। ননদ সুইটি ও দেবর জুয়েলের মনে দিন দিন ঘৃণার পাত্রী হতে থাকেন চৌধুরী পরিবারের বড় বউ ইয়াসমিন।
নাজিম চৌধুরীর স্ট্রোক করেছে। প্রাইম হাসপাতালের ডাক্তারের তীক্ষ্ন পর্যবেক্ষণে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু নাজিম চৌধুরীকে এত বড় শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে একা আসতে দেখে ডাক্তার হাসনাত তাগিদ দিয়ে বললেন, 'আপনার পরিবারের কেউ আসেনি কেন? জলদি কাউকে আসতে বলুন। আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে এবং খুব জলদি।'
প্রাথমিক চিকিৎসার পর বুকের ব্যথা কিছুটা কমেছে। কিন্তু ডাক্তার জানিয়ে দিলেন পরিবারের কাউকে থাকা অত্যাবশ্যক, কিন্তু নাজিম চৌধুরী এই মুহূর্তে কাউকে ভরসা পাচ্ছেন না। ভাইবোনদের আসল রূপ দেখে এসেছেন এখানে আসার আগে।
আচ্ছা হিলেস্নালকে কল দিলে কেমন হয়। বাবার অসুস্থতার কথা শুনলে সে নিশ্চয়ই না এসে পারবে না এখানে।
হিলেস্নালকে কল দেন নাজিম চৌধুরী। বাবার মুখে সব শুনে হিলেস্নাল আধা ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে এসে হাজির। ডাক্তারের মুখে সব শুনে জলদি সে বাবাকে ভর্তি করিয়ে দেয়। ২০৭ নাম্বার কেবিনে পূর্ণ চিকিৎসা চলতে থাকে নাজিম চৌধুরীর। কিন্তু ডাক্তার নাজিম চৌধুরীর স্ত্রীর উপস্থিতি কাম্য ভেবে হিলেস্নালকে বললেন, 'তোমার মা'কে এই মুহূর্তে খুব দরকার। তাকে জলদি আসতে বল। স্ত্রীর সেবার দরকার এখন তোমার বাবার।' নাজিম চৌধুরী দূর থেকে সব শুনে নীরবতা পালন করে গেছেন শুধু।
হিলেস্নাল মা'কে কল দেয়। এক ঘণ্টার ব্যবধানে ইয়াসমিন হাসপাতালে এসে পৌঁছে। নাজিম চৌধুরী অনুতপ্ত দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকান। বড় অসহায় দেখাচ্ছিল ইয়াসমিনের মুখটি তখন।
বাবার সেবা যত্নে মাকে রেখে দিয়ে হলে ফিরে যায় হিলেস্নাল। ডাক্তার এসে ইয়াসমিনকে বুঝিয়ে দিলেন কখন কোন ওষুধ খাওয়াতে হবে। ইয়াসমিন কায়মনোবাক্যে সব বুঝে নিলেন।
হার্টের ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে ইয়াসমিনের পুরনো দিনের সব কথা মনে পড়তেই গাঢ় কণ্ঠে বললেন, 'জীবনভর যাদের কথায় আমাকে অবহেলায় দূরে ঠেলে রেখেছো, আজ এই দুর্দিনে ওরা কোথায়? সেবা তোমাকে এখন কে করছে? আমি নাকি ওরা? স্ত্রীর মর্যাদা থেকে তুমি সব সময় আমাকে বঞ্চিত করেছো।'
নাজিম চৌধুরীর মুখে কোনো ভাষা নেই প্রতি উত্তরের। ইয়াসমিন যা বলছে, সব তো সত্য। যাদের কান কথা ধরে স্ত্রীকে অবহেলায় দাম দেননি কখনো, আজ সেই মানুষটি নির্বিকারের মতো তাকে সেবা করতে হাসপাতালে এসেছেন। বাকিরা সব নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।
২.
বাথরুমে শাওয়ার নিচ্ছেন ইয়াসমিন। আধা ঘণ্টা পর বেরিয়ে এসে দেখেন নাজিম চৌধুরীর শিওরের পাশে একগুচ্ছ কাশফুল। স্ত্রীকে দেখে কাশফুলগুলো এগিয়ে দিয়ে বললেন, 'তোমার জন্য এগুলো।' ইয়াসমিন বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন, 'এই হাসপাতালে কাশফুল পেয়েছো কোথায়?' নাজিম চৌধুরী তরল গলায় বললেন, 'হাসপাতালের জানালা দিয়ে দেখি বাইরে খালপাড়ে এই শরতে কাশফুল ফুটেছে। নার্সকে নিয়ে এ কাশফুলগুলো এনেছি তোমার জন্য। নেবে না আমার ভালোবাসার কাশফুল?'
ইয়াসমিনের চোখে পানি চলে এসেছে। বিয়ের এতটা বছর পর ঘরের মানুষটি আজই প্রথম তাকে এত নিবিড় করে ভালোবেসে মন ভরিয়ে দিলেন। ইয়াসমিনের আজ বড় সুখের দিন। কাশফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি শিশুর মতো কাঁদতে থাকলেন। এ যে সুখের কান্না। সুখেও মানুষ কাঁদে। সে কান্নায় চোখের কোণ বেয়ে যে জলগুলো বেরিয়ে আসে, সে জলের নাম হয়েছে- আনন্দ অশ্রম্ন।