শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

কখনো শিক্ষক হতে চাইনি

বাসার তাসাউফ
  ৩০ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
কখনো শিক্ষক হতে চাইনি

আমি যে কখনো মাস্টার হতে চাইনি- অমলকান্তির মতো রোদ্দুর হতে চেয়েছিলাম- এ কথাটা এখন আমার কাছের বন্ধু-স্বজন কেউ বিশ্বাস করবে না। তবে আমার স্কুল জীবনের সহপাঠী বশির, মনির, রিপন বা এনামুল- যারা এখন আমার কাছাকাছি নেই, বছরে দু-একবার মুঠোফোনে যাদের সঙ্গে কথা হয় মাত্র, তারা বিশ্বাস করবে। কারণ তারা আমাকে সেই শৈশব-কৈশোর থেকেই জানে। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় থেকে গল্প-কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম। তাই বড় হয়ে আমি রোদ্দুর নাকি বাতাস হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম তারা জানত। অবশ্য তখন আমরা একেকজন একেক রকম স্বপ্ন দেখতাম। বশির এখন ব্যাংকার। অথচ সে বিসিএস ক্যাডার হতে চেয়েছিল। মনির চেয়েছিল উকিল হতে। সে এখন ইঞ্জিনিয়ার। ধর্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাস থাকায় রিপন চেয়েছিল ইসলামিক স্কলার হতে। হতে পারেনি। সে এখন একটি মাদ্রাসায় ছোট ছোট বাচ্চাদের স্কলার বানাতে চেষ্টা করছে। এনামুল চেয়েছিল সমাজকর্মী হতে, প্রাইভেট কোম্পানির ব্যবস্থাপক এখন সে। আর আমি? সেই যে রোদ্দুর-ফোদ্দুর হতে চেয়েছিলাম- ভাগ্যের চক্রে এখন মাস্টার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'একরাত্রি' গল্পের নায়কের মতো ভাঙা-স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার।

স্কুল বা কলেজ জীবনে আমি কখনো মনোযোগী ছাত্র ছিলাম না। গল্প, কবিতা, নাটক-থিয়েটার নিয়ে নিমগ্ন থাকতাম। মনের মধ্যে স্বপ্ন নামে কোনো শব্দ ছিল না। জীবনে উচ্চাশার মতো দুরাশা করিনি কখনো। থিয়েটারে রিহার্সাল করতে গিয়ে একদিন নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতায় অমলকান্তিকে আবিষ্কার করলাম। সেই থেকে কিছু বুঝে না বুঝেই আমিও অমলকান্তির মতো রোদ্দুর হতে চাইলাম। কিন্তু রোদ্দুর হয়ে কী করব? সেটা অবশ্য ভাবিনি। কারণ তখনো যে আমি জীবনের রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হইনি। বাজারে গিয়ে ২০০ টাকা কেজি পেঁয়াজের দাম দেখে খালি থলে নিয়ে বাসায় ফেরার পর বউয়ের কপট কটাক্ষ শোনার বাস্তবতা ছিল না তখন। প্রতি মাসে ২ হাজার ৬০০ টাকা ইলেকট্রিসিটি বিল আর ১ হাজার ৭০০ টাকা গ্যাস বিল দেওয়ার পর উইকেন্ডে প্রতিবেশীর মেয়ের বিয়েতে নেমন্তন্নে যাওয়ার বাস্তবতাও ছিল না। ৫০ টাকা সিএনজি ভাড়া বাঁচাতে হেঁটে কর্মস্থলে যেতে যেতে জুতোর ফিতে ছিঁড়ে ফেলে মুচির কাছে সেলাই করতে গিয়ে ১০০ টাকা খরচ করার মতো বাস্তবতার মুখোমুখি হইনি। তখন ছিলাম স্বপ্নিল এক জগতের বাসিন্দা। চুলে জেল মেখে হাওয়ায় উড়িয়ে রোদ্দুর হওয়ার বাসনা নিয়ে উড়নচন্ডী আর বাউন্ডুলের মতো উড়তাম, ঘুরতাম আর সহপাঠীর প্রেমের অনলে পুড়তাম। এভাবে উড়ে উড়ে, ঘুরে ঘুরে ও পুড়ে পুড়ে কলেজে ক্লাস করে না করেও বিএ পাস করে ফেললাম। এমএ ক্লাসে ভর্তি হওয়ার পর হঠাৎ একদিন রোড অ্যাকসিডেন্টে বাবার মৃতু্য হলে আমার জীবন থেকে সব ওড়াউড়ি, ঘোরাঘুরি ও হাওয়া-বাতাস-রোদ্দুর হওয়া স্বপ্ন চিরতরে উধাও হয়ে গেল। অগত্যা সংসারের হাল ধরতে হলো আমাকে। আর তখনই জীবনের রূঢ় এক বাস্তবতার মুখোমুখি হলাম। সংসারের বোঝা পুরোপুরি কাঁধে চড়ল আমার। তাতে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ল। লেখাপড়ার পর্বটা শেষ করে কাজে লেগে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু চাইলেই তো কাজে লেগে পড়া যায় না। কাজের খোঁজে কিছুদিন এখানে ওখানে ঘোরাঘুরি করলাম। সবখানে বাংলা সিনেমার দৃশ্যের মতো 'কর্ম খালি নেই' সাইনবোর্ড দেখে আশাহত হয়ে ফিরে এলাম। এরপর পত্রিকার পাতায় যত রকম নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলো তাতে নজর রাখলাম। দু-এক জায়গায় আবেদনও করলাম। কিন্তু পরীক্ষা দেওয়ার পর আর কোনো খবর পেলাম না। হঠাৎ একটা হাইস্কুলে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ল। কী মনে করে দরখাস্ত জমা দিলাম। স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাকে পরীক্ষার জন্য ডাকল। এ পর্বটা উতরে গেলাম। এরপর ভাইভা, পরীক্ষামূলক ক্লাস ও অন্য ধাপ পেরিয়ে চূড়ান্ত নিয়োগের সুপারিশ পেলাম। হেড মাস্টার নিয়োগপত্র হাতে দিয়ে ছাত্রদের পড়ানোর অনুমতি দিল। আমি হাফ ছাড়লাম। কবিদের ভাষায় এটাকে বলে দীর্ঘশ্বাস। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেও আমি দম নিয়ে ছেলেদের পড়াতে লেগে গেলাম।

স্কুলটা বেশ নামকরা। উপজেলা সদরে অবস্থিত। সুবিশাল ভবন ও বিস্তৃত খেলার মাঠ আছে। শুধু ছেলেদের পড়ার সুযোগ মিলে। মেয়েদের জন্য পাশেই আরেকটা বালিকা বিদ্যালয় আছে। দূর-দূরান্তর থেকে প্রায় দেড় হাজার ছেলে পড়তে আসে। নতুন মাস্টার সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। আমারও তাদের বোঝার ক্ষমতা সীমিত। তাই দুই পক্ষেরই অপার কৌতূহল। কৌতূহল মেটানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগলাম।

আমাকে প্রথম দিন পাঠানো হলো অষ্টম শ্রেণিতে। এক টিচার গোপনে জানিয়ে দিলেন, এই ক্লাসের ছেলেরা যেমন মেধাবী তেমনই দুষ্টুও বটে। তা-ই দেখা গেল। প্রথম ক্লাসে সবাই হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল না। উলটা-পালটা প্রশ্নও করল। কলেজে পড়াকালে টিউশনের অভিজ্ঞতা থাকায় বেশ স্বাভাবিকভাবে সামলে নিলাম।

পরদিন ক্লাসে গিয়ে একটু মুশকিলে পড়লাম। এখানে ছাত্ররা কড়া শাসনে অভ্যস্ত নয়। এমনকি সাদামাটা বকুনি, কানমলা বা কানধরে উঠবোস করানোও যায় না। কারও গায়ে বেতের আঘাত দেওয়া তো কল্পনারও অতীত। 'দাঁড়িয়ে থাক' বলে কিছুক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখার মতো শাস্তি দেওয়ারও অনুমতি নেই। আসলে অনুমতি নেই কোনো প্রকার শাস্তি দেওয়ারই। না স্কুল কর্তৃপক্ষের না শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। দু-একদিন পর ছাত্ররা হয়তো আমার সম্পর্কে ধারণা পেতে শুরু করেছে। ক্লাসে অতিরিক্ত কথা বলা বন্ধ করে দিল। কেউ গোলমালও করল না। বাধ্য ও সৌম্য ছেলের মতো সবাই পড়া শিখে আসতে লাগল। খেয়াল করলাম, প্রায় সবাই আমার ক্লাসটা উপভোগ করে। কিন্তু মুশকিল হলো অন্য ক্লাসগুলোয় গিয়ে। বিশেষ করে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে যেসব ছেলে আছে তারা প্রায় সবাই 'দুষ্টের শিরোমণি লঙ্কার রাজা' টাইপের। সদ্য প্রাইমারি শেষ করে হাইস্কুলে পড়তে এলেও তাদের মধ্যে শিশু শিশু ভাবটা রয়ে গেছে। কড়া ধমক দিই, দাঁড় করিয়ে রাখি। কিন্তু ওসব থোড়াই কেয়ার করে। হেডমাস্টার পড়া আদায়ের চেয়ে ডিসিপিস্ননের দিকে নজরধারী করেন বেশি। একদিন আমায় ডেকে বললেন, 'ইয়াং মাস্টার, ক্লাসে ডিসিপিস্ননটার দিকে খেয়াল রাখবেন। একটু গোলমাল হচ্ছে। ছেলেরা পড়াটড়া শিখে আসে তো? দরকার হলে একটু শক্ত হবেন।'

ভেবে পেলাম না কী করব! বা কী করা উচিত?

অন্য মাস্টাররা বুদ্ধি দিলেন, 'দু-একটাকে ধরে শাস্তি দেবেন। তবেই বাকিরা শান্ত হয়ে যাবে।'

সিনিয়র এক টিচার শিখিয়ে দিলেন, 'এসব সোজা ছেলে নয়। বাঁদর ও বিচ্চু! বেত নিয়ে শরীর বাঁচিয়ে টেবিলে কিংবা ফাঁকা জায়গায় বারিটারি দিয়ে রাগ দেখাবেন। সোজা হয়ে যাবে। একদিন এক্সপেরিমেন্ট করে দেখুন।'

অনেক টিচার মাথা নাড়লেন। বুঝলাম, এই ফরমুলায় তাদেরও সায় আছে।

আমি চুপ করে রইলাম। ছাত্রদের মারধোর করতে আমার ভালো লাগল না। আমি যে স্কুলে পড়েছি সেখানে মারের রেওয়াজ ছিল। তবে নিজের বাড়িতে বা স্কুলে কখনো মার খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। আমার ধারণা মেরেধরে ছেলেদের শোধরানো যাবে না। এতে ছেলেরা প্রথম প্রথম ভয় পাবে বটে। কিন্তু পরে মার সহ্য হয়ে গেলে ভোঁতা হয়ে যাবে। তার চেয়ে অন্তরে ঘা দিতে পারলে কথা শুনবে। কিন্তু ঘা দেওয়ার উপায়টা যে কী? ভেবে পেলাম না।

অন্য মাস্টাররা যে বেত দিয়ে মেরে শাসন করে তা নয়। কিন্তু তাদের ভারিক্কি চেহারা, চোখ পাকিয়ে ধমক এবং গার্ডিয়ান বা হেডমাস্টারকে নালিশ করার হুমকিতে কাজ হয়। সেটুকু আমিও রপ্ত করব নাকি নিজের মতো ফরমুলা তৈরি করে নেব? ভাবতে লাগলাম। অল্প বয়সে মাস্টার হয়ে গেছি আর সেটাই কি আমার কাল হলো? অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির ক্লাসে সমস্যা হয় না। শুধু নিচের দিকের ক্লাসগুলোতে একটুআধটু সমস্যা হচ্ছে। এভাবে চললে হেডমাস্টার যদি আমায় অযোগ্য ভাবেন? মনে মনে মুষড়ে পড়লাম।

উপায় একটা বেরিয়ে এলো।

ক্লাস সেভেনে ইংরেজি পড়াচ্ছিলাম। হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা হয়ে গেছে। তখনো রেজাল্ট বেরোয়নি। পড়ার চাপ কম। ছেলেদের ক্লাসে শান্তশিষ্টভাবে আটকে রাখাই প্রধান কর্তব্য, যেটাকে বলে ক্লাস ম্যানেজ। কিছুক্ষণ পড়িয়ে লক্ষ্য করলাম, ছেলেগুলো আর পড়তে চায় না। ছটফট করছে। দুষ্টুমি করার চেষ্টা করল একজন আরেকজনের সঙ্গে। ধীরে ধীরে ক্লাসে গোলমাল শুরু হয়ে গেল। ছোট ক্লাসে এই গোলামালটা সামলানোই কঠিন। নবম-দশম শ্রেণির ক্লাসে পরীক্ষা বা পাঠ্য বিষয়ে আলোচনা করলে সবাই মনোযোগী হয়ে ওঠে। সিক্স-সেভেনের ছেলেদের ওসব ভালো লাগে না। ধমক দিলাম- 'অ্যাই আস্তে, চুপ! কথা নয়।'

গোলমাল একটু কমল। কিছুক্ষণ পর আবার বাড়ল। পাশের ক্লাসে সহকারী হেডমাস্টার ক্লাস নিচ্ছেন। উনি এসে যদি রাগ ঝাড়েন। কী করা যায়? একটু ভাবতে লাগলাম। হঠাৎ সোহেল নামে এক ছাত্র দাঁড়িয়ে বলল, 'স্যার একটা গল্প বলেন।' আমি গল্প অনেক জানি। নিজেও পত্রপত্রিকায় লিখে থাকি। অলরেডি আমার পাঁচ-সাতটা গল্প-উপন্যাস বই প্রকাশিত হয়ে গেছে। হঠাৎ যখন ছেলেরা ধরেছে গল্প বলতে তখন ভাবতে লাগলাম, ক্লাসে গল্প বলা উচিত হবে কিনা? হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। বললাম, 'গল্প বলতে পারি যদি তোমরা চুপ করে থাক। কথা না বল। কী, রাজি?'

সবাই আশ্বাস দিল, 'আচ্ছা স্যার।'

শুরু করে দিলাম গল্প বলা।

গল্প বলা আমার অভ্যেস আছে। যেহেতু নিজে গল্প লেখি। তাই প্রথম প্রথম রূপকথা থেকে কিছু গল্প বললেও পরে নিজের লেখা গল্প থেকে বলা শুরু করলাম। অনেক রং মাখিয়ে, সং সাজিয়ে ও ঢং করিয়ে এমনভাবে বলতে লাগলাম যে, গল্পের পাত্রপাত্রীদের হাবভাব, বীরত্ব, অ্যাডভেঞ্চার শুনে ছেলেরা যেন মনের আয়নায় পরিষ্কার দেখতে পায় সেই কল্পিত দেশের কল্পিত লোকগুলোর ছবি। পেছনের বেঞ্চে দুজনকে কিঞ্চিত ঠেলাঠেলি করতে দেখে গল্প বলা থামিয়ে বললাম, 'আবার দুষ্টুমি করলে গল্প বলা বন্ধ করে পড়াতে শুরু করব।'

হৃদয় নামে একজন দাঁড়িয়ে বলল, 'স্যার, ও আমাকে কলম দিয়ে গুঁতা দিয়েছে।'

তক্ষুনি দ্বিতীয়জন কাতর কণ্ঠে বলল, 'ইচ্ছে করে নয় স্যার। গুঁতা লেগে গেছে।'

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, 'আচ্ছা, দুজনেই একটু দূরত্ব বজায় রেখে বস। আর শোনো, আবার দুষ্টুমি হলে কিন্তু গল্প বলব না।'

গল্পটা আবার বলা শুরু করা যায়নি। স্কুলের দপ্তরি ঢং ঢং শব্দে ঘণ্টা বাজিয়ে দিল।

'বাকিটা পরের দিন বলব...।' বলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলাম।

পরদিন এই ক্লাসে ঢুকতেই 'গল্প গল্প' করে চেঁচাতে লাগল সবাই। বললাম, 'আগে একটু পড়াই। তারপর বলব। গোলমাল করলে কিন্তু বলব না।'

সবাই গল্প শোনার লোভে মন দিয়ে পড়া শুরু করল। ঘণ্টা বাজার পাঁচ কিংবা সাত মিনিট আগে আবার গল্প বলা শুরু করলাম। এইভাবে পাঁচ দিনে শেষ করলাম একটা গল্প।

আমার গল্প বলার খ্যাতি হু হু করে ছড়িয়ে পড়ল সারা স্কুলে। যে ক্লাসেই যাই দাবি আসতে লাগল, 'স্যার, একটা গল্প বলেন।'

খেয়াল করলাম, ক্লাসে গল্প বলার কারণে দুটো কাজ গুছিয়ে করা যাচ্ছে। প্রথমত, গল্প শোনার লোভে ছেলেরা চুপ করে থাকে। গোলমাল করে না। দ্বিতীয়ত, এই টোপ দিয়ে দিব্যি পড়াটাও তৈরি করিয়ে নেওয়া যায়।

প্রতি ক্লাসেই ঘণ্টা বাজার কয়েক মিনিট আগে গল্প বলা শুরু করি। এর লোভ দেখিয়ে ক্লাসের বাকি সময়টা পড়া আর পড়া। আগের দিনের দেওয়া হোমওয়ার্ক ধরা, নতুন পড়া বুঝিয়ে দেওয়া। নিয়ম করেছি, পড়া ধরলে ক্লাসে বেশিরভাগ ছাত্র উত্তর না দিতে পারলে সেদিন গল্প বলা বন্ধ। ফলে কেউ পড়া না পারলে অন্য ছেলেরাই তাকে খেঁকিয়ে ওঠে- 'অ্যাই পড়া শিখিসনি কেন?'

একটা গল্প প্রায় পনের দিন ধারাবাহিকভাবে বলে গেলাম। তবে ক্লাস নাইন-টেনে গল্প বলতে কিছুতেই রাজি হইনি। সেসব ক্লাসে পড়ার চাপ বেশি। সবদিন গল্প বলার সময় মেলে না। তবু ছেলেরা ছাড়ে না। তাই যেদিন সময় পাই নানা টুকিটাকি গল্প বলি। বিখ্যাত সব ঐতিহাসিক ঘটনা। রাজা-বাদশাহর কাহিনি ছাড়াও, সোলায়মন পগম্বরের গল্প, এমনকি নাম করা লেখক, বৈজ্ঞানিক, পর্যটকদের জীবনের বিচিত্র কাহিনী বলে যাই গল্পের মতো করে।

একদিন হেডমাস্টার আমায় ডেকে বললেন, 'আপনি নাকি ক্লাসে বেশ মজার মজার গল্প বলেন?'

আমতা আমতা করে বললাম, 'পিরিয়ডের শেষের দিকে একটু-আধটু বলি...।'

হেডমাস্টার স্বভাসূলভ গম্ভীর মুখে বললেন, 'দেখবেন পড়ায় যেন ক্ষতি না হয়।'

'গল্প বললেও পড়ায় কোনো ক্ষতি হয় কিনা সেদিকে আমার খেয়াল আছে, স্যার। আমি সিলেবাস ধরে পড়া চালিয়ে যাচ্ছি।'

'ঠিক আছে। অবশ্য ভালো গল্প শুনলে মানসিক বিকাশে বেশ সাহায্য হয়।'

হেডমাস্টার আমার গল্প বলার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন এবং অখুশি নন জেনে খুশি হলাম।

এভাবে বছরখানেক চলার পর গল্প বলায় ক্লান্তি বোধ করতে লাগলাম। কিন্তু গল্প শুনে অভ্যস্ত ছাত্ররা আমায় ছাড়ল না। উঁচু ক্লাসে মোটিভেশানাল গল্প বলে চালিয়ে দিতে পারলাম। তাতে দু-একজন মোটিভেটেড হয়েও গেল।

পরের বছরের শুরুতে হেডমাস্টার রুটিন করার সময় ক্লাস টেন ও নাইনে বাংলা পড়ানোর দায়িত্ব দিলেন আমাকে। ক্লাস টেনে আমি দ্বিতীয় পিরিয়ডে বাংলা পড়াই। এখানে কিছু শিক্ষার্থী বেশ মনোযোগী আর কিছু আছে একেবারে বাউন্ডুলে। কেউ চঞ্চল, কেউ আবার স্থির। আমি কাউকে কিছু বলি না। পাঠ্যবইয়ের মুখস্ত পাঠ চাকরি জীবনে কখনো কাজে লেগেছে বলে আমার মনে পড়ে না। পাঠ্যবইয়ের পড়া মুখস্ত করে পাওয়া সার্টিফিকেটটি হাতে পাওয়ার পর একাডেমিক বইগুলো মূল্যহীন হয়ে পড়ে। তখন কেজি দরে বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো কাজে লাগে না। চাকরির জন্য আবার নতুন জিনিস পড়তে হয়। তখন ভরসা হয়ে পড়ে নীলক্ষেতের বইয়ের দোকান। সেখান থেকে সাধারণ জ্ঞানের বিভিন্ন বই কিনে নেলসন ম্যান্ডেলা কত সালে মারা গেছে, হাঙ্গেরির রাজধানীর নাম কী, পর্তুগালের মুদ্রার নাম কী, শেষের কবিতা কী ধরনের বই- এসব প্রশ্ন নিজে নিজে মুখস্ত করতে হয়। এই যে পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে চাকরির পরীক্ষায় আসা প্রশ্নের কোনো সংযোগ নেই তো ক্লাসে এত এত বই পড়িয়ে লাভ কী? গণিতের সূত্রগুলো বাস্তব জীবনে কি কোথায় কাজে লাগে? হিসাব বিজ্ঞানের এত হিসাব-নিকাশ জীবনের জবেদা খাতায় কী জমা করেছে? ম্যাট্রিক্সের জটিল সমীকরণ কারও জীবনের সমীকরণ মিলিয়ে দিয়েছে? পৃথিবীর অন্য দেশের শিক্ষার্থীরা যখন চাঁদে কিংবা মঙ্গলে যায়- আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা অদ্ভুত এই শিক্ষব্যবস্থার কারণে আদিমকালের জঙ্গলে পড়ে থাকে। ভারতের শিক্ষার্থীরা যখন চাঁদে যায় তখন আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা চাকরির পরীক্ষায় পাস করতে সেই দিন-তারিখটি মুখস্ত করে...।

ক্লাসে প্রায় এ রকম লেকচার দিয়ে থাকি। আর তাতে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই ছাড়াও 'আউট' বই পড়তে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তাদের মনে স্বপ্নবীজ বপন করে দিতে পেরে আমি আনন্দিত হই। কিছুদিন পর দেখা গেল, ক্লাসের প্রায় সব ছেলেই স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। তাদের স্বপ্ন শুধু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা উকিল-ব্যারিস্টারে সীমাবদ্ধ নেই। সবাই মানুষ হতে চায়। আর এই মানুষ হওয়া ছেলেদের মধ্যে একজনের নাম ইমরান। কম কথা বলা ছেলে। চোখে সাদা চশমা পরে চুপচাপ বসে থাকে ক্লাসে। নিয়মিত স্কুলে আসে। মাঝখানে অথবা পেছনের বেঞ্চিতে বসে। কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে সবার আগে উত্তর দেয়। কোনো পাঠ না বুঝলে সবিনয়ে জানতে চায়। তার এ রকম জ্ঞানতৃষ্ণা আমার ভালো লাগল। আমি তাকে অন্যদের চেয়ে একটু বেশি ভালোবাসতে লাগলাম। তার প্রতি একটু যত্নবানও হলাম।

একদিন ক্লাসে সবাইকে প্রবন্ধ লিখতে দিলাম। ইমরান সবার আগে লিখে আমার কাছে নিয়ে এলো। সবার আগে লিখে ফেলাটা তার অভ্যাস। তার খাতাটি দেখে আমি আনমনে এককোণে লিখে দিলাম, 'ইমরান, তুমি যদি একটু মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর এবং বাবা-মাকে ভালোবাসো-তবে তোমার ফলাফল ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে।' নিচে তারিখ লিখে সই দিলাম। লেখাটি পড়ে তার চোখেমুখে আনন্দ ফুটে উঠল। ক্লাস নাইন কিংবা টেনে এ ধরনের পরিবেশ তৈরি করতে পারলেও নিচের ক্লাসগুলো নিয়ে ভাবনাটা রয়ে গেল। এরা গল্পের টানেই পড়া তৈরি করে আসে। ক্লাসে ডিসিপিস্নন বজায় থাকে। ঠাকুরমার ঝুলি থেকে কিছু গল্প নিয়ে নিজেই বানিয়ে লম্বা করে একটা গল্প ধারাবাহিকভাবে বলে যেতে লাগলাম দিনের পর দিন। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র যদি জানতেন আমার হাতে পড়ে তার গল্পের কাহিনীর কী হাল হচ্ছে, তাহলে বোধহয় আমার নটেগাছটিও মুড়োত, গল্প বলাও ফুরোত।

ক্লাস সিক্সে যে গল্পটা বলেছিলাম সেটা শেষ হয়ে গেছে। সেভেনের ক্লাসে গিয়ে আবার সেটা নতুন করে বলা শুরু করলাম। এর মধ্যে দশম শ্রেণির মোতালিব নামে এক ছেলের মাঝে একটা গল্পের পস্নট পেলাম। গল্পটা লিখে পত্রিকায় পাঠালে কেমন হয়? যেহেতু পত্রপত্রিকায় আমার কিছু গল্প ছাপা হয়েছে। গল্পটা পাঠিয়ে দিলাম একটি দৈনিকের সাহিত্য পাতায়। গল্পটা মজার এবং আকারে ছোট হওয়ায় পড়ের সপ্তায়ই ছাপা হয়ে গেল। পত্রিকায় আমার গল্প ছাপা হয়েছে জেনে পুরো স্কুলের প্রায় প্রতি ক্লাসের ছাত্রদের মাঝে পত্রিকাটি কেনার হিড়িক পড়ে গেল। মোতালিব হয়ে উঠল সবার মধ্যমণি। এতদিন যারা আমার মুখে গল্প শুনতে পেত তারা পত্রিকার পাতায় গল্প পড়ে আরও আনন্দিত হলো। অনেকেই আমার মতো গল্প লিখতে চাইল। আমি তো এমনটাই চাই। চাই প্রত্যেকের চোখে স্বপ্নের বীজ বপন করে দিতে। যে স্বপ্ন শুধু তাদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, ব্যারিস্টার হওয়া স্বপ্ন দেখাবে না, বরং মানুষ হওয়ার স্বপ্নও দেখাবে। হয়তো ইমরান তেমনই স্বপ্ন দেখেছিল। তাই তো জানতে পারলাম আচমকা একদিন আমার ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে ইমরানের ম্যাসেজ দেখার পর। ইমরান লিখেছে, 'স্যার, কেমন আছেন? আমি ইমরান। ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছি। আপনার দেওয়া চিরকুট আমাকে সবসময় অনুপ্রাণিত রেখেছে। আমি সবসময় সেটা সঙ্গে রেখেছি!'

আমি খুশি হয়েছি যত অবাক হয়েছি তার চেয়েও বেশি। বলে কী ছেলেটা? একটা সাধারণ চিরকুট এত বছর ধরে সঙ্গে নিয়ে বেড়াচ্ছে! ইমরানকে যাচাই করতে রিপস্নাই দিলাম, 'সেই চিরকুটটা কি তোমার কাছে এখনো আছে? যদি থাকে ছবি তুলে পাঠাও।'

ইমরান সঙ্গে সঙ্গে ছবি তুলে পাঠাল। আমি কী বলব ভাষা খুঁজে পেলাম না। ভাষার খেই হারিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। চোখের পাতা ছুঁয়ে দেখি সেখানে যে জল জমে আছে। ধুর! চোখে জল এলো কখন? হাতের উলটো পিঠ দিয়ে জলটুকু মুছতে মুছতে মনে পড়ল, আমি কখনো মাস্টার হতে চাইনি। যদি মাস্টার না হতাম এ রকম ঘটনা সাক্ষী হতে পারতাম? মাস্টার হওয়ার জন্য নিজেকে ধন্য ও গর্বিত মনে করলাম।

এরপর ক্লাস সিক্স, সেভেন, নাইন, টেন- সব ক্লাসে ইমরানের গল্পটা বলে ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করতে লাগলাম। যতদিন আমি মাস্টারি করব ততদিন গল্পটা বলে যাব। কেননা, কিছু কিছু গল্প আছে, অন্তহীন পথের মতো। যুগ যুগ ধরে বলে গেলেও বলা শেষ হয় না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে