স্বতন্ত্রধারার কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান

প্রকাশ | ৩০ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

এস ডি সুব্রত
সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান। ষাটের দশকের অন্যতম উজ্জ্বল কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান। পেছনে রেখে গেছেন প্রায় পাঁচ দশকের সাহিত্যকীর্তি, যদিও সমকালীন সাহিত্যিক মহলে তার নাম অনেকটা অনুচ্চারিতই ছিল। সভা-সমাবেশ-সাহিত্যমঞ্চে কোথাও তার উপস্থিতি ছিল না তেমন। কিন্তু বাংলাদেশের স্বতন্ত্র সাহিত্য-যাত্রায় রিজিয়া রহমানের অবদান অপরিসীম। রিজিয়া রহমানের জন্ম কলকাতায় ২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৯, মৃতু্য : ১৬ আগস্ট ২০১৯। শৈশবটাও কেটেছে ওখানে। মা ছিলেন শিক্ষিত ও গুণী। বাবা পেশায় চিকিৎসক। সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস চর্চা হতো তাদের পরিবারে। লেখালেখি করার মতো চমৎকার পারিবারিক আবহে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। আমাদের অধিকাংশ পরিবারে যেখানে কবিতা লেখার জন্য পিতা-মাতা অখুশী হন, সেখানে ক্লাস ফাইভে একটি কবিতা লিখে বাড়ির সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন রিজিয়া রহমান। পরিবারে তার কদর বেড়ে যায়। বাড়িতে মেহমান এলে কবিতা পড়ে শোনানোর ডাক পড়ত তার। দেশভাগের পর এই পরিবারটিকে চলে আসতে হয় ঢাকায়। রিজিয়া রহমান চোখের সামনে বদলে যেতে দেখেন সমাজ দেশ রাষ্ট্র, এমনকি নিজের আত্মপরিচয়টাও। বাবা সরকারি ডাক্তার ছিলেন। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে চলে এলে পোস্টিং দেওয়া হয় ফরিদপুরে। ওখানেই রিজিয়া রহমানের প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হয়। স্কুলে পড়ার সময় প্রথম কবিতা ছাপা হয় একটি পত্রিকার ছোটদের পাতায়। এভাবে কবিতা ও ছড়া দিয়ে লেখালেখির শুরু হলেও কলেজজীবনে শুরু করেন গল্প লেখা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্স করার সময় একটি গল্প ছাপা হলো ম্যাগাজিনে। গল্পটি ছাপানোর পেছনে যে গল্প, তার মধ্য দিয়ে আমরা উপলব্ধি করতে পারি রিজিয়া রহমান লেখালেখি জীবনের শুরু থেকেই আপস করেননি। গল্পটি প্রকাশের আগে অশ্লীলতার অভিযোগ তোলেন বিভাগীয়প্রধান। উনার আপত্তি বাধে 'হুইস্কি' শব্দটি নিয়ে। গল্পের চরিত্রটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ে, ফলে সে পরিবারের কথা বলতে গিয়ে হুইস্কির প্রসঙ্গ এসেছে। শিক্ষক বলেন, 'হুইস্কি' শব্দটি ফেলে দিলে গল্পটি প্রকাশিত হবে। রিজিয়া রহমান বললেন, 'থাক স্যার। গল্পটা ছাপার দরকার নেই।' প্রথম গল্প ছাপা হওয়ার মোহ তিনি দমন করেছেন। পরে অবশ্য কোনোরকম কাটছাঁট ছাড়া সেটি প্রকাশিত হয়। রিজিয়া রহমান আমৃতু্য লেখক হিসেবে কোনো বিশেষ সুবিধা আদায়ের জন্য কাটছাঁট করেননি। ছোটগল্প, কবিতা, শিশুসাহিত্য, আত্মজীবনী, অনুবাদের পাশাপাশি তিনি ৩০টার বেশি উপন্যাস লিখছেন। রিজিয়া রহমানের প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় সত্তর দশকের শুরুতে। তিনি ষাট দশকের লেখক। তার উপন্যাসে বিষয়বৈচিত্র্য চোখে পড়ার মতো। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস থেকে আধুনিক বাংলাদেশের জন্মকষ্ঠ, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের বাস্তবতা, বস্তিবাসী, বারবণিতা, চা-শ্রমিক, সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর জীবন-লড়াই, প্রবাসী জীবনের নানা সংকট থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট উপজীব্য হয়ে উঠেছে। তিনি লিখেছেন কঠিন শ্রম ও সাধনায় নিজের বিশ্বাসের জায়গা থেকে। রিজিয়া রহমানের প্রথম উপন্যাস 'ঘর ভাঙা ঘর'। স্বাধীনতার পর নদী ভাঙনে শিকার মানুষ ঢাকায় চলে আসছে বেঁচে থাকার জন্য। গড়ে উঠছে বস্তি। তাদের নিয়ে এই উপন্যাস। পতুর্গিজ জলদসু্যদের কাহিনী নিয়ে লিখলেন 'উত্তর পুরুষ' উপন্যাসটি। আট হাজার বছর আগের সমাজ নিয়ে লিখলেন নৃতাত্ত্বিক উপন্যাস 'শুধু তোমাদের জন্য'। পাশাপাশি 'পবিত্র নারীরা' ও 'তৃণভূমি বাইসন' নামে আরও দুটি নৃতাত্ত্বিক উপন্যাস তিনি লেখেন। 'কাছেই সাগর', 'বং থেকে বাংলা', 'উত্তর-পুরুষ', 'একটি ফুলের জন্য' উপন্যাসগুলো লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধ ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে। 'অলিখিত উপখ্যান', 'আবে-রওয়াঁ' ও 'আল বুরুজের বাঘ' উপন্যাসগুলো ইতিহাসনির্ভর। চা-শ্রমিকদের জীবন বাস্তবতা নিয়ে লিখেছেন 'সূর্য সবুজ রক্ত' উপন্যাসটি। নব্বইয়ের স্বৈরচারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে লেখেন 'হারুণ ফেরেনি' উপন্যাসটি। 'বাঘবন্দি' উপন্যাসটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। নতুন আঙ্গিকে লেখা। মনের ভয় বাঘের প্রতীক হিসেবে এসেছে। গ্রামে বাঘ ঢুকেছে। সবাই ভয় পাচ্ছে। একেক রকম ভয় থেকে বাঘটাকে একেকজন ভিন্ন ভিন্ন করে বর্ণনা করে। যেমন মৌলবি ওয়াজে বলছেন, মেয়েরা সবাই পর্দা থেকে বেরিয়ে এসেছে, কাজে যাচ্ছে, এজন্য বাঘটা এসেছে। প্রেমের উপন্যাস লিখেছেন কয়েকটি, যেমন 'সবুজ পাহাড়', 'প্রেম আমার প্রেম', 'তবু গোলাপ তুমি', 'বান্ধবী প্রিয়দর্শিনী', 'ঝড়ের মুখোমুখি' ইত্যাদি। এভাবেই রিজিয়া রহমান কোনো একটি বিষয় বা প্রেক্ষাপটে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। তিনি প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পস্নটের সন্ধান করেছেন। যখন যে বিষয় নিয়ে লিখেছেন সে বিষয়ে ফিল্ডওয়ার্ক প্রয়োজন হলে তা করেছেন। সময় নিয়ে খেটে তিনি লিখেছেন সেই উপন্যাস, যা তিনি লেখা উচিত বলে মনে করেছেন। 'নারী লেখকের' দুর্বলতা তার উপন্যাসে নেই, বরং উপন্যাসের বিষয় নির্বাচন, বর্ণনা-কৌশলের দিক থেকে তিনি স্বতন্ত্র ছিলেন। তথাকথিত জনপ্রিয় ধারার দিকে তিনি যাননি। ষাটের দশকের শুরুতে দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় 'অনন্য পৃথিবী' নামে একটি গল্প ছাপা হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্যে প্রবেশ করেন। উনিশশ সাতষট্টি-আটষট্টি সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে মাস্টার্স পড়ার সময় তিনি প্রথম উপন্যাস ঘর ভাঙা ঘর (১৯৭৪) লেখা শুরু করেন এবং সাপ্তাহিক ললনায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হলে তা পাঠকমহলে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। স্বামীর চাকরি সূত্রে উনিশশ উনসত্তরের দিকে তিনি তখন চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। এ সময় সাপ্তাহিক ললনার অনুরোধে মাত্র পনেরো দিনের মধ্যে চট্টগ্রামে পর্তুগিজদের উত্তর পুরুষ ফিরিঙ্গি বাজারের আধুনিক ফিরিঙ্গিদের জীবনযাপন নিয়ে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে লেখেন দ্বিতীয় উপন্যাস উত্তর পুরুষ (১৯৭৭)। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায় (১৯৭৭) প্রকাশিত হয় তার তৃতীয় উপন্যাস রক্তের অক্ষর। রিজিয়া রহমান সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৮), যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৪), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), আসফ-উদ-দৌলা রেজা স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৪), বাংলাদেশ লেখক সংঘ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৫), কমর মুশতারি সাহিত্য পদক (১৯৯০), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৫) নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, একুশে পদক (২০১৯)। রিজিয়া রহমান ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী কথাসাহিত্যিক। সাহিত্য আসর, বক্তৃতামঞ্চ, টেলিভিশন, বিদেশযাত্রায় তাকে তেমনভাবে দেখা যায়নি। আমন্ত্রণ পেলে সবিনয়ে ফিরিয়ে দিতেন। বিশ্বাস করতেন লেখকের কাজ লেখা। আপনমনে লিখে গেছেন একের পর এক অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভিন্নধর্মী লেখা। তার প্রতিটি লেখাই আলাদা। নির্মাণ ভঙ্গি এবং বিষয়বৈচিত্র্য স্বতন্ত্র। তিনি ছিলেন আত্মমর্যাদাশীল। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে রিজিয়া রহমানের মতো আত্মপ্রত্যয়ী আর আত্মমর্যাদাশীল লেখকের খুব অভাব।