অজয় নদীর বাঁকে

প্রকাশ | ২৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

রাজকুমার শেখ
কেমন ছোপ ছোপ বাদামি রঙের প্রলেপ। ধানগুলোর গায়ে পড়ন্ত বিকালের ছায়া। অঘ্রাণ এসে গেছে। এখন মাঠে মাঠে ধান কাটা শুরু। অজয় নদীর জল দিয়ে চলে চাষ। বর্ষা না হলে লালমাটি হয় আট-ফাটা। ধানের চাষ বন্ধ হয়ে যায়। চাষিরা পড়ে মহাবিপাকে। তবে এখন কিছু কিছু জায়গায় জল মেশিন বসিয়ে চাষ হয়। তবে বর্ষার চাষটা এখানে বেশি প্রাধান্য। এই ধান দিয়েই এখানকার মানুষের চলে যায়। ধানের জমিতে এখন মুনিষ পাঠ কাজ করছে। বেলা শেষ হলেই তারা ঘরে ফিরবে। এখানে আদিবাসী মেয়েরা কাজ করে। সেই কোন সকালে বের হয়। সঙ্গে পান্তা ভাতের একটা পুঁটলা। খাবারের জায়গাটা কাপড় দিয়ে জড়িয়ে নেয়। মাথায় সেটা রেখে, কোলে শিশুটাকে নিয়ে ওরা চলে ধান কাটতে। বঙ্গ ছত্রের এটা নিত্যদিনের ছবি। এই দৃশ্য দেখা যায় রোজই। ওরা আসে। আবার কাজ সেরে চলে যায়। বঙ্গ ছত্রের রাস্তায় ওরা সার বেঁধে গাঁয়ে ফেরে। মরদরা সারাদিন তালের রস খেয়ে পড়ে থাকে। ওরা কেউ কাজে বের হয় না। এসব কথা যখন শুনছিল ইসরুপের মুখে। তখন নমিন মুগ্ধ হয়ে গেছিল। নমিন বঙ্গ ছত্র এসেছে একটা জরুরি কাজে। কিন্তু ও অন্য জগতে ঢুকে পড়ছে। বীরভূমের এই রাঙা মাটির কত কাহিনী ছড়িয়ে চারপাশে। এই বিস্তীর্ণ মাঠ। মাঠে মাঠে পাকা ধান। সবাই ব্যস্ত। নতুন ধান উঠছে। ধানের গন্ধ। খড়ের গন্ধ। মাটির সোঁদা গন্ধ। অজয়ের জলজ গন্ধ। অজয় এখন অনেক শান্ত। জলকে তলে ফেলে লাল বালি জেগে উঠেছে একটু একটু করে। নদীর দুই পাশে শুধুই ক্ষেত আর ক্ষেত। ক্ষেতের সঙ্গে যেন অনবরত কথা বলছে নীলাকাশ। সেও যেন নেমে এসেছে বঙ্গ ছত্রের মাঠে। যেন হাত দিয়ে তাকে ছোঁয়া যাবে। নমিনের খুব ভালো লেগে যায়। সারা দুপুর সে ঘুরে বেড়ায়। ক্ষেত দেখে, নদী দেখে তার সময় কেটে যায়। তার আগামীকাল শান্তিনিকেতনে কাজ আছে। কাজ সেরেই সে ফিরবে। কিন্তু তার ফিরতে মন করছে না। যেন মনে হচ্ছে এখানে সে থেকে যাবে। এখন সবাই ব্যস্ত। ধান উঠছে। মাঠে মাঠে চাষিদের মেলা বসেছে যেন। কেমন এক উৎসবে মেতে উঠেছে। আদিবাসী মেয়েরা ধান কাটছে। ওদের গোটা গায়ে ধানের মিষ্টি গন্ধ লেপ্টে। পায়ে হাতে কাস্তেতে সকালের স্নিগ্ধ শিশির লেগে। খসখস করে কাস্তে চলছে। মাঠের পর মাঠ। জমির পর জমির। সব পাকা ধানে ছেয়ে। অজয় বর্ষার জল দিয়ে সে এখন শুয়ে আছে। সেও যেন ক্লান্ত। এই নদীর জল নিয়ে চাষাবাদ হয়। বর্ষার জল না হলে এই নদীই ভরসা। সরকারি ক্যানেল দিয়ে সোজা জল ঢুকে পড়ে ক্ষেতি জমিতে। নমিন মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। মাঠে মাঠে সে ঘুরে বেড়ায়। কখনো তাল গাছের নিচে বসে। বসে বসে মাঠ দেখে। কেমন একটা উদাসী ভাব। তার মনে গান আসে। সে গুনগুন করে গান ধরে। ওর মাথা থেকে কাজের ভাবনাটা উধাও হয়ে যায়। কোন বাগাল গুঁজে গরু বেঁধে রেখে গেছে। সে চড়ে ঘাস খায় খুঁটে খুঁটে। এসব দৃশ্য তাকে টানে। তার শহরে শুধুই বিষাক্ত বাতাস। ইটপাটকেল। ও হাঁপিয়ে ওঠে। এখানে কেমন এক জীবনের পরশ। কে যেন বলছে ফিসফিস করে- এলিক বটে বাবু,/এত দেরি করলেক কেনে? মনটো আমার পুড়ছে /এই ভাদু বিয়েনে! নমিনের ঘুম এসে গেছিল। তাল গাছের ছায়ায় ও বেশ আরাম করে বসেছিল। তখন মাঠের শীতল বাতাস এসে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। কিন্তু ওর হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। দেখছে অনেকগুলো মেয়ে জল খাবার খাচ্ছে গাছের ছায়ায় বসে। পান্তা ভাত। পিঁয়াজ কামড়ে। ওরা নিজের ভাযায় কথা বলছে। নমিন ওদের কথা বুঝতে পারছে না। ওকে দেখেই মনে হয় হাসাহাসি করছে। ওদের মধ্যে একটি শ্যামবর্ণ মেয়ে ওর দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে। সে খাচ্ছে না। ওর এই মাঠের মতোই রূপ। চোখের মণি দুটো ভীষণ উজ্জ্বল। চোখ দুটো যেন তালদীঘি। জলের ছলাৎ ছলাৎ। নমিন যেন তলিয়ে যাবে। খোঁপায় একটা লাল ফুল। এলোমেলো চুল। যত্ন হয় না মনে হয়। মাঠের কাজে এসেছে সে। নমিন চুপ করে বসে ওদের কথা শুনছে। একটু পরই ইসরুপদা ওকে ডাকতে আসবেন। কিন্তু ওর এখন এখানেই থাকতে মন করছে। এক সময় আবার সবাই কাজে চলে গেল। শ্যামলা মেয়েটি যাওয়ার সময় খিলখিল করে হেসে চলে গেল। নমিনের বুকটা সে হাসিতে কেমন যেন করে ওঠে। নমিন তাদের চলে যাওয়া দেখে। আলে আলে সার বেঁধে তারা হেঁটে যায়। যেন কোনো পরিযায়ী পাখি ঝাঁক বেঁধে উড়ে গেল। তাদের আর ধরা যাবে না। নমিন সে দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রোদের মধ্যে সে মেয়েটি যেন গা ডুবিয়ে ডুবিয়ে হাঁটছে। তার ভরাট বুকে অজয়ের ঢেউ। ২. নমিনের সারারাত ঘুম নেই। শান্তিনিকেতনের কাজ সেরে ও এবার ফিরবে। কিন্তু সেই পান্তা ভাত খাওয়া মেয়েটির কথা বারবার ওর মনে উঁকি দিচ্ছে। বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে। ও কোথায় থাকে? নিশ্চয়ই ও বঙ্গছত্রের আশপাশ কোনো গাঁয়ে থাকে। ওদের সেই বিকালে সার বেঁধে কাজ সেরে চলা। ওদের মৃদু মৃদু কথোপকথন। ফিসফিসানি। হাঁটুঅবধি কাপড়। মাথার খোঁপায় বুনো ফুল। পুঁটলিতে বাঁধা খাবারের জায়গা। কারও কোলে শিশু। চুলগুলো কেমন এলোমেলো। নগ্ন পায়ে কাদা। সারাদিন খেটেখুটে যেটুকু রোজগার করে, তাই দিয়ে দিব্যি সুন্দর বেঁচে আছে। রাতে মহুয়া খায়। গান করে। ওদের চোখের ভাষা সহজে পড়া যায়। অজয়ের স্বচ্ছজলের মতো বয়ে যায় বহুদূর। জীবনটা ওদের কাছে এই নদীর মতোই। কাজ সেরে সন্ধ্যাবেলায় মরদের জন্য খস খসে হাতে রুটি বানায়। এরপর রাতে মাটির দাওয়ায় শুয়ে ঘুমিয়ে যায়। ওদের তেমন চাওয়া-পাওয়া নেই। জন খাটতে যায় বাহিরে, নতুন হাট, কূলে, বোলপুরের আশপাশের মাঠে। অন্য সময় কাজ না থাকলে। ওরা শহরে নাচতে যায়। সার বেঁধে মাদলের তালে তালে নাচে। পলাশ ফুলের মতো ওরা এক গভীর ভালোবাসায় লাল হয়ে ওঠে। পলাশ কুঁড়ি খোঁপায় গুঁজে নাচে ওরা। ফাগুন আসে চুপিচুপি ওদের জীবনে। আবার ফাগুন না বলে চলেও যায়। আবার সেই ক্ষেতি জমিন। মাটির সঙ্গে মিশে থাকে তারা। আকাশ দেখার সাধ নেই। কখনো দুমুঠো জুটে গেলেই হলো। এতেই খুশি। নমিন আজ ঘুমোতে পারবে না। অজয়ের জলের কুলকুল শব্দ। লাল বালির গায়ে হিমেল রাতের পরশ। কুচকুচে কালো রাতকে চিরে শিয়াল ডাকছে। একটা পেঁচা ভয় পেয়ে উড়ে পালাল। তার ডানার শব্দ শোনা যাচ্ছে। অঘ্রাণের শিশির পড়ছে টুপটুপ করে। একটা হিমহিম ভাব। নমিন একটা চাদর জড়িয়ে শুয়ে। মাটির ঘর। সোঁদা গন্ধ। বেশ আরাম। নমিনের আজ ঘুম আসবে না। একবার মনে হলো ওর, ধানের খামারের পাশে গিয়ে বসতে। এখন কত রাত কে জানে। বেশ অন্ধকার। ঘড়ি দেখা যায় না। এখানে শিয়াল খুব বেশি। ডাকছে অনবরত। রাতের নিঝুমতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ওদিকে দুলু মিয়ার কাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। নমিন চেনে দুলু মিয়াকে। ইসরুপের বড় বাপ। খুউব ভালো মানুষ। এখন বয়স হয়েছে। মাঠে-ঘাটে আর যেতে পারেন না। এখন তার দুই ছেলে চাষাবাদ করে। বড়খোলা পুকুরের ওপারে হাজরাদের বাস। ওরাও জন খাটে। কিছু কিছু জমিজিরাত আছে ওদের। বেশিরভাগই মানুষ চাষে খাটে। অন্য সময় বিড়ি বাঁধে। এখানে বিড়ির মহাজন আসে। কাজ দেয়। বিড়ি বেঁধে মেয়েরাও রোজগার করে। অবশ্য এখন নতুন ধান উঠেছে। সবাই ধান নিয়ে ব্যস্ত। গোটা গ্রামে পাকা ধানের গন্ধ। কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ বাতাসে মিশে ভেসে আসছে। নমিনের চোখের দুই পাতা বন্ধ হচ্ছে না। এমন রাত সে ঘুমিয়ে কাটাতে চায় না। এমন রাতে সে শিশির মেখে ঘুরে বেড়াতে চায়। অনেক দূর হেঁটে চলে যেতে চায়। যেখানে পেঁচা ডাকবে। ওকে দেখে শিয়ালরা পালাবে। শিশিরে ভিজে যাবে পা। মাটির সোঁদা গন্ধ। অজয় নদীর জলজ গন্ধ। সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। এরপর ও হেঁটে যাবে। দেখবে রাতকে। সুন্দরী জোনাকিকে। মন নেচে উঠবে। হয়তো ও আবার গেয়ে উঠবে, বেহান বেলা আসবি বাবু, উঠোন রাখব লেপে। ওই মেয়েটির সঙ্গে হয়ত আর দেখা হবে না। তার হাসির ঝলকে মনটা যেন কেমন করে ওঠে। নমিনের মনের কলস ভেঙে যায়। তার মধুভরা কলস তাকেই দিতে চায়। সেকি নেবে? ভাবে ও। নমিনও কাস্তে হাতে যাবে ধান কাটতে। তার সঙ্গে বসে খাবে মহুয়া। তার বাদামি রঙা চুলে হাত বুলিয়ে দেবে। জামরঙা গালে ছুঁয়ে দেবে লাল পলাশ। খোঁপায় গুঁজে দেবে শালুক। ছাতিম পাতায় শুইয়ে দেবে আদরে। এক গভীররাতে মহুয়ার নেশাতে বুঁদ হবে দুইজনে। হঠাৎ আবার একটা শিয়াল ডেকে উঠল। নমিনের ঘুম আসে এবার। রাত বুঝি কাবার হয়ে এলো। নমিন এক সময় শিশিরের শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। ৩. যাওয়ার সময় হলেই মনটা কেমন যেন করে ওঠে। দুদিনের মেহমানি। এত কিছু পাওয়া। মনের কুঠুরি যেন কানায় কানায় ভরে ওঠে। যেমন আষাঢ়ে এই বৃষ্টি কলস ভেঙে গেলে ভরে ওঠে নদী। যৌবনা নদী ভাসিয়ে দেয় সব। নমিনের ঠিক তেমন দশা। ও এক সময় অজয়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। নৌকা ওকে পার করে দেবে। যাবার সময় সেই মেয়েটির সঙ্গে দেখা হল না। যাওয়া হলো না ওদের বস্তিতে। অজয়ের বুকে এখন ঢেউ উঠেছে। এত সকালে তেমন কেউ নেই। লাল বালুতে রোদ পড়ে চকচক করছে। নৌকা এলেই ও পার হয়ে যাবে। নতুন হাট হয়ে চলে যাবে কাটোয়া। ওর মনটা কেমন যেন করছে। কেউ কি আসবে? ওর মনে কেমন দোলাচল, এমন সময় হঠাৎ ও দেখছে নদীর পাড় ধরে সেই মেয়েগুলো হেঁটে আসছে। নমিন এগিয়ে যায়। দেখছে সেই মেয়েটি মুখ টিপে হাসছে। ওরা কাছাকাছি হয়তো থাকে। কাজে যাচ্ছে দল বেঁধে। ওর সামনে দিয়ে একে একে সব চলে গেল। কিন্তু ওই মেয়েটি দাঁড়িয়ে গেল ওর সামনে এসে। হাঁটুর নিচ-অবধি শাড়ি। গা-গতর কোনো রকমে ঢাকা। এলোমেলো চুল। রাঢ মাটির মতোই সরল সহজ। নমিন ওকে বলে, কাজে বের হয়েছ? হঁ্যা, গো বাবু। সরল জবাব মেয়েটির। নমিন অবাক হয় ওর কথা শুনে। এখানি কি করছ বাবু? ঘর যাব। ঘর? কুথা ঘর বটেক? অনেক দূর। ও বাবু, তুমার উখানে যাব। লিয়ি যাবি? হুম। তুমি যাবে? মেয়েটি খিলখিল করে হেসে ওঠে। অজয়ের জলে হাসির শব্দ ছড়িয়ে যায়। পারাপারের মাঝি ডাকে। সে ডাক শুনতে পায় না নমিন। আরও এগিয়ে যায় মেয়েটির কাছে। মাদলের ছন্দের মতো ওর কোমর। যেন অজয়ের ঢেউ খেলানো শরীরময়। মাতাল বাতাসে ওর যেন নেশা ধরে গেছে। এই পাগল নদীর বাঁকে বাঁকে কত সুখ লুকিয়ে আছে। নমিন ওর হাতে হাত রাখে। এই প্রথম ওর অন্তর কেঁপে উঠল একটু সুখের ছোঁয়ায়।