শামসুর রাহমানের কবিতায় ভিন্ন প্রকরণ

প্রকাশ | ২৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

আহমদ মতিউর রহমান
বাংলা কবিতার ঐতিহাসিক পরিক্রমায় কবি শামসুর রাহমান অনন্য-অসাধারণ এক নাম। তিনি কবিতায় নানা বর্ণের ফুল ফুটিয়েছেন। কখনো উদ্ভাসিত করেছেন পাঠককে কখনো বা নৈরাশ্যের আঁধারে ডুবিয়েছেন। কবিতার মাধ্যমে সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে চিরকালীনতার অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবি শামসুর রাহমান। নিজের কবিতার জমিনে তিনি পরিস্ফুটিত করেছেন চিরকালীন বেদনা, প্রেম, মৃতু্য, ভালোবাসাসহ নানা বিষয়। সেগুলো শৈল্পিক ব্যঞ্জনা এক কথায় অসাধারণ। তার কবিতার প্রকরণগত বৈশিষ্ট্যটি অন্য অনেকের থেকে আলাদা। তিনি একদিকে যেমন নাগরিক কবি, প্রবলভাবেই নাগরিক কবি আবার সমকালীন দ্রোহ-প্রেম, আনন্দ-বেদনা রাজনীতি, জাতির আকাঙ্ক্ষা সবটাই প্রকাশিত ও পরিস্ফুটিত। তিনি স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত মানুষকে জুগিয়েছেন প্রেরণা আবার তা অর্জনের পথে সৃষ্ট বাধা বিঘ্নে হয়েছেন সমালোচনামুখর। কবি শামসুর রাহমান বাংলা কবিতার পথ-পরিক্রমায় তিরিশের আধুনিকতা পেরিয়ে চলিস্নশের অভিনবত্বে স্নাত হয়ে পঞ্চাশের দশকের বাতাবরণে নিজেকে নির্মাণ করেছেন একজন স্বতন্ত্র কবিকণ্ঠ হিসেবে। তার কবিতায় উপমা উৎপ্রেক্ষাসহ নানা রসের ব্যবহার হয়েছে কবিতার বাকনির্মিতির প্রয়োজনানুসারে। ২. কবি শামসুর রাহমানের জন্ম ২৩ অক্টোবর, ১৯২৯ পুরান ঢাকায়। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ তথা পঞ্চাশের দশকে তিনি আধুনিক কবি হিসেবে বাংলা কবিতায় আবির্ভূত হন। এবং অল্প সময়ের ভেতরেই দুই বাংলায় (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম বাংলায়) কবি হিসেবে পরিচিতি পান। আধুনিক কবিতার অনন্য পৃষ্ঠপোষক বুদ্ধদেব বসুর 'কবিতা' পত্রিকায় ১ 'রূপালি স্নান' কবিতাটি প্রকাশিত হলে কবি হিসেবে শামসুর রাহমান সুধীজনের দৃষ্টিলাভ করেন। পরবর্তী সময়ে উভয় বাংলাতেই তার শ্রেষ্ঠত্ব এবং জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি নাগরিক কবি হিসেবে খ্যাত, তবে নিসর্গ তার কবিতায় খুব কম ছিল না। তিনি ১৭ আগস্ট, ২০০৬ সালে ইন্তেকাল করেন। মৃতু্যর এত বছর পরও তার কবিতা মানুষকে আলোড়িত করে। তার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৭০টি। এগুলো যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে তা এক কথায় অসাধারণ। সমালোচকরা বলেছেন, '৭১-পরবর্তী ৬০টি কাব্যের প্রতিটিতেই তিনি কয়েকটি কবিতা উপহার দিয়েছেন যা রসোত্তীর্ণ।' ১৯৭৬ সাল থেকে সাহিত্যপ্রকাশ নিয়মিত প্রকাশিত করে চলেছে 'শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা' এবং প্রতিটি সংস্করণেই গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে কারণ দুই সংস্করণের অন্তর্বর্তীকালে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি নতুন কাব্যগ্রন্থ। কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথসহ বড় কবিদের সঙ্গে তার তুলনা করেছেন। তুলনা বা প্রতিতুলনায় আমরা যেতে চাই না। কারণ একজন কবি মূল্যায়িত হন তার কালের বিচারে। মহাকালই তার সঠিক বিচারক বা মূল্যায়নকারী। ৩. সমালোচকার বলে থাকেন, কবিতায় শামসুর রাহমান নিজেকে প্রগতিশীল, মানবতাবাদী এবং জাতীয়তাবাদী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তার কাব্য ভান্ডারে সঞ্চিত হয়েছে যুদ্ধের ক্ষতি-ধ্বংস, মন্বয়ন্তরকবলিত মানুষের আর্তনাদ-ক্রন্দনধ্বনি, দেশ-বিভাজনের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। ভাষা-আন্দোলন ও ঊনসত্তরের শহীদদের কথাও রয়েছে। প্রবলভাবে পাই স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালির স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের দুঃসহ যন্ত্রণা, প্রত্যাশা ও অচরিতার্থতার বেদনা। শামসুর রাহমানের কাব্য-ভুবন নির্মিত হয়েছে এসব পরিবর্তিত বাস্তবতায়। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে অস্থির রাজনীতি, নীতিনৈতিকতার অবক্ষয়ের অন্তরালে তিনি নির্মাণ করেছেন আশাবাদী কাব্য-প্রকরণ। আত্মকেন্দ্রিকতার খোলস ছেড়ে তার কবিতা যখন সামষ্টিক চেতনায় উদ্ভাসিত হলো তখন তিনি হয়ে ওঠেন নাগরিক কবি। তার কাব্যভাষায় উপমা-প্রতীক-চিত্রকল্পের পাশাপাশি পুরাণ প্রসঙ্গ শিল্পিত সুষমায় প্রকাশ পেয়েছে। রূপক-উপমা-প্রতীকের মধ্য দিয়ে তিনি কবিতার বিষয়কেও আত্মস্থ করে নিয়েছেন। তবে শামসুর রাহমানের এই কাব্য-প্রকরণে মিথের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা পিডিয়ায় তার কাব্য প্রকরণ নিয়ে আলোচনায় বলা হয়েছে- 'তার দীর্ঘ (পঞ্চাশোবর্ধ) কবিজীবনে শামসুর রাহমান কবিতার বিষয় ও ভাষায় নিরন্তর পরীক্ষাপ্রবণ ছিলেন। ব্যক্তি জীবনের উত্থান-পতনের মধ্যে কবিতা ছিল তার নিত্যসঙ্গী-এ সত্যটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে তার আত্মজীবনী গ্রন্থে। তার কবিতার মধ্যে ঊর্ধগামিতা ও নিম্নগামিতার খোঁজ নিলে একটা সাধারণ সিদ্ধান্তের দেখা মেলে। জাতীয় জীবনের জলবিভাজিকার বৎসর ১৯৭১-এর পূর্বে রচিত পাঁচটি কাব্যে তিনি কবি হিসেবে তার সার্থকতার শীর্ষ পৌঁছেছেন।' (বাংলা পিডিয়া) তারা বলেন, 'সাংবাদিকতা পেশার সুবাদে তার কবিতায় রয়েছে বিস্তর সাংবাদিকতার উপাদান, কিন্তু সবই তার কবিত্বের রসে জারিত। তার প্রথম পর্বের কবিতায় যেসব পুনরাবৃত্ত প্রতীক আমরা ব্যবহৃত হতে দেখেছি- ঘোড়া, হরিণ, খঞ্জ, খাদ, ভিখিরি- সেগুলো বিদায় নিয়েছে ও তাদের জায়গায় এসেছে নতুন প্রতীক। এর মধ্যে কোনটি যথার্থ প্রতীক, কোনটি শুধুই চিত্রকল্প- এ নিয়ে তর্ক চলতে পারে। তার কবিতায় শুরু থেকেই চিত্রজয়তার লক্ষণ স্পষ্ট ছিল। ক্রমশই তা স্পষ্টতর হয়েছে। অনেক সময় মনে হয়েছে অতিরিক্ত চিত্রকল্পের ভিড়ে তার কবিতা প্রায়শই ভারাক্রান্ত, তার বক্তব্যকে ছাপিয়ে উঠেছে ছবির পর ছবি।' ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলার বুকে যে নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল, সেসব ঘটনায় কবিতার শব্দে স্থান পেয়েছে। দীর্ঘ ৯ মাসের অত্যাচারের করুণ চিত্র বর্ণনা করেছেন তার 'বন্দি শিবির থেকে' কাব্যগ্রন্থের ভূমিকাংশে। তার মাতৃভূমিকে যারা গোরস্তানে পরিণত করেছে তাদের তিনি অভিশাপ দিয়েছেন। তার 'ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা' কাব্যগ্রন্থে 'অভিশাপ দিচ্ছি' কবিতাটি সেই গণহত্যাকারীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে। 'অভিশাপ দিচ্ছি' কবিতার প্রথম কয়েক লাইনেই তিনি লিখেছেন, 'আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে অভিশাপ দিচ্ছি/ আমাদের বুকের ভেতর যারা/ ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিল সেঁটে/ মগজের কোষে কোষে যারা/ পুঁতেছিল আমাদেরই আপনজনের লাশ...।' এই কবিতার প্রতিটি পঙক্তি এক-একটি প্রতিবাদ, এক-একটি ঘৃণার বাক্যবাণ। প্রতিটি শব্দ যেন অত্যাচারীর অত্যাচারের নির্মম ও বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। বন্দিশিবির থেকে কবিতায় তিনি বলছেন তার মনের কথা। তা আসলে তার একার নয়, সবার মনের কথা হয়ে উঠেছে- ঈর্ষাতুর নই, তবু আমি তোমাদের আজ বড় ঈর্ষা করি। তোমরা সুন্দর জামা পর, পার্কের বেঞ্চিতে বসে আলাপ জমাও, কখনো সেজন্য নয়। ভালো খাও-দাও ফুর্তি করে সবান্ধব, সেজন্যও নয়। অথচ এ দেশে আমি আজ দমবন্ধ এ বন্দি শিবিরে, মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ মনের মতন শব্দ কোনো। ৪. শামসুর রাহমানের 'স্বাধীনতা তুমি' এবং 'তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা' কবিতা দুটির কাব্য প্রকরণও অনবদ্য। স্বাধীনতা যে কেবল একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আবদ্ধ নয় বা কোনো গন্ডিতে আবদ্ধ নয় তাও স্পষ্ট এই 'স্বাধীনতা তুমি' কবিতায়। তাই এই কবিতাখানি যে যুগ যুগ ধরে মানুষের অন্তরকে স্বাধীনতার প্রকৃত উপলব্ধি পেতে সাহায্য করবে তা বলাই বাহুল্য। সমালোচকদের ভাষায় 'স্বাধীনতা তুমি' কবিতায় স্বাধীনতাকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। কোথাও স্বাধীনতাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে সরলভাবে। মাঠভরা ফসল বাংলার চিরায়ত রূপ। এই চিরায়ত রূপকেই তিনি কবিতায় স্বাধীনতার উপজীব্য করেছেন। মাঠভরা ফসল দেখে কৃষক যেমন আনন্দিত হয়, তার পরিশ্রমের ফসল মাঠে বাতাসে মাথা দোলাতে দেখে যে আনন্দ হয়, সেই আনন্দঘন মুহূর্ত স্বাধীনতা।' তাই তিনি বললেন, 'স্বাধীনতা তুমি ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি'। তিনি এ কবিতায় স্বাধীনতাকে কখনো গ্রাম্য মেয়ের মধ্যপুকুরে অবাধ সাঁতার, কখনো মজুর-যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশি, কোথাও তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর তেজোদীপ্ত ভাষণের কণ্ঠস্বর, কালবৈশাখী ঝড়, শ্রাবণে অকুল মেঘনার কুল অথবা উঠানে মায়ের ছড়ানো শুভ্র শাড়ির আঁচল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। স্বাধীনতা তুমি রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান। স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উলস্নাসে কাঁপা- ... স্বাধীনতা তুমি রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার। স্বাধীনতা তুমি মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশি। ... স্বাধীনতা তুমি অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক। স্বাধীনতা তুমি শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন। স্বাধীনতা তুমি উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন। স্বাধীনতা তুমি বাগানের ঘর, কোকিলের গান, বয়সি বটের ঝিলিমিলি পাতা, যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা। ---দেখা যাচ্ছে নিজের লেখার স্বাধীনতাটাও তিনি উলেস্নখ করতে ছাড়েননি। এই কবিতার প্রকরণগত বৈশিষ্ট্য তুলনা রহিত। ফলে এটি একদিকে যেমন কালকে ধারণ করেছে অন্যদিকে সর্বসাধারণের কাছে জনপ্রিয়ও হয়েছে। একই প্রকরণগত বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা কবিতায়। এ কবিতায় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একটি জাতির কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তার নিপাট বর্ণনা মেলে। উলিস্নখিত দুটি কবিতাই গদ্যধর্মী, বিশদভাবে বলা যায় প্রবহমান গদ্যে রচিত। তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা/ তোমাকে পাওয়ার জন্য/ আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?/ আর কতবার দেখতে হবে খা-বদাহন?' 'তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা/ সাকিনা বিবির কপাল ভাঙল।' 'শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাংক এলো/ দানবের মতো চিৎকার করতে করতে/ মেশিনগান খই ফোটাল যত্রতত্র।' কবির অনেক কবিতায় ফুটে উঠেছে যান্ত্রিক শহরের একঘেয়ে ক্লান্তি, নৈরাশ্যবাদ এবং নাগরিক জীবনের সব উপাদান। শামসুর রাহমান একজন প্রতিবাদী ও দেশপ্রেমিক কবি। তার সৃষ্ট সাহিত্য কর্মের মাধ্যমে সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা দেখিয়েছেন। ১৭ আগস্ট কবি শামসুর রাহমানের মৃতু্যবার্ষিকী। এ উপলক্ষে তার প্রতি শদ্ধা।