কাজী নজরুল ইসলাম ধর্ম, মানবতা ও বিপস্নবের এক সুসম মিশ্রণ

প্রকাশ | ২৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

আকিব শিকদার
কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্পর্শকাতর মনের মানুষ ছিলেন। তাই মানুষের দুঃখ-কষ্টের ব্যাপারে নির্বিকার থাকতে পারতেন না। বৈষম্য মানতে পারতেন না। কোনো মানুষের ওপরই অত্যাচার, অবিচার, অসম্মান করা হলে সেটা মানতে পারতেন না। এসব ব্যাপারে নির্বিকার এবং উদাসীন থেকে শিল্পসাহিত্য সৃষ্টি করার কথা ভাবতে পারতেন না। সে জন্য তার সাহিত্য সাধনা তার কাছে কোনো বিলাসিতার বিষয় ছিল না। শিল্পের জন্য শিল্প সৃষ্টি করার বিলাসিতা তার ছিল না। সাম্য ও সহাবস্থানকামী মানুষ হিসেবে অত্যন্ত সংবেদনশীল মন এবং গঠনমূলক চিন্তা-ভাবনা নিয়ে আক্ষরিক অর্থেই সব মানুষের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী সৃষ্টি করার জন্য অর্থনৈতিক সাম্য ও সামাজিক সাম্য এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহাবস্থানের সংস্থান সৃষ্টি করা হোক, এটাই তিনি চাইতেন। কাজী নজরুল ছিলেন একজন খাঁটি রোমান্টিক কবি। রোমান্টিক যুগ বাংলা সাহিত্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে আর তা আসে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের হাত ধরে। রোমান্টিসিজম পরিবর্তন নিয়ে আসে মানসিকতায়, মননে, চিন্তায় ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধে। ব্যক্তি যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন। পুরাতন ও ক্লিশে ধারণার বিপরীত স্রোতে দাঁড়িয়ে রোমান্টিকতা ব্যক্তি মননে দেয় স্বাধীনতা, নতুনত্বের আভাস। আবার অন্যদিকে সমতা, স্বাধীনতা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাও রোমান্টিকদের মাঝে এক অপূর্ব প্রচেষ্টা হয়ে থাকে। এই দিক বিবেচনায় নজরুল আর বাকি সব রোমান্টিকদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগামী, তার প্রদীপ্ত কবিতা, জ্বালাময়ী গান মানুষে মানুষে সমতার বারতা রেখে গেছে। আমরা এর প্রমাণ নজরুলের 'বিষের বাঁশি' ও 'কামাল পাশা'তে দেখতে পারি। আর 'বিদ্রোহী' কবিতাটি বিশ্বমানবতার মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার। কবি যে একই সঙ্গে বিদ্রোহী আর প্রেমিক হৃদয়-পুরুষ তা বিদ্রোহী কবিতাতেই বলে যান। কারণ তার এক হাতে প্রেমের বাঁশি আর এক হাতে থাকে রণ-তূর্য। এভাবেই নজরুল তার অসামান্য রোমান্টিক প্রতিভা দিয়ে বিদ্রোহের দীপ্ত শিখা জ্বালিয়ে চলেন কখনো কোমলভাবে আবার কখনো স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়ে। রাষ্ট্র বা সমাজ প্রভৃতির আমুল ও অতি দ্রম্নত পরিবর্তন করার কাজটা বিপস্নবী কাজ। নজরুল সমাজহীন মুসলমান সমাজকে একটি সুসংঘবদ্ধ সমাজ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। নজরুল বলেন, 'আমাদের বাঙালি মুসলমানের সমাজ, নামাজ পড়ার সমাজ। যত রকম পাপ আছে করে যাও, তার জবাবদিহি করতে হয় না এ সমাজে, কিন্তু নামাজ না পড়লে তার কৈফিয়ত তলব হয়। অথচ কোরানে ৯৯৯ জায়গায় জেহাদের কথা এবং ৩৩ জায়গায় সালাতের কথা বলা হয়েছে।' মুসলমানদের সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে, এটা চেয়েছিলেন। মুসলিম নারী স্বাধীন, শিক্ষিত ও ব্যক্তিত্ববান মানুষ হিসেবে মর্যাদা পাবেন। মুসলমানরা ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস থেকে প্রেরণা পাবেন এবং শিক্ষা নেবেন এটা তিনি চেয়েছিলেন। এসবই বিপস্নবী মানসিকতার মানুষের চাওয়া। নজরুল সাহিত্য-সঙ্গীতের মাধ্যমে বাংলার মানুষ ইসলামের এত ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছে। তাই নজরুল শুধু কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ ও প্রাবন্ধিকই নন, তিনি একজন ওলামাও। সঠিক পথে ইসলামকে মানুষের মনকে উদ্বেলিত করা, সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করা, মানবতার অবদান-মানবতা শব্দটি তো ইসলামই জগতে এনেছে। নিপীড়িত, নিষ্পেষিতের দমন তো ইসলামই শিখিয়েছে। নজরুল কোরান পড়েছেন। আত্মস্থ করেছেন এবং বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন, শিখিয়েছেন। কুরআন মুখস্থ করা মুসলমান আছে চারদিকে, কিন্তু তাদের অনেকেরই বাংলা অর্থ জানা নেই এবং এই জানা না থাকায় 'বিভ্রান্তি' ছড়িয়ে পড়েছে সর্বদিকে। নজরুল সাহিত্য-সঙ্গীতে প্রবেশ করলে ইসলাম ধর্মকে অতি নিকটে পাওয়া যাবে। ইসলাম ধর্মকে জানা যাবে। নবী (সা.) জীবন জানা যাবে নজরুলের গানে হামদ-নাত-এ। ঐতিহাসিক সবকিছু। কুরআন-হাদীস সম্পর্কে সত্য-উপলব্ধি এবং আত্মস্থ করে এ অঞ্চলের মুসলমানদের অন্ধত্ব করতে যে পরিশ্রম করেছেন তার তুলনা কোথায়? মানুষে মানুষে ভাই ভাই, এ তো ইসলামেরই শিক্ষা। নজরুলের মাধ্যমে এসব ওঠে এসেছে। নজরুল উদ্বুদ্ধ করেছেন এ অঞ্চলের মানুষদেরকে খাঁটি পথের সন্ধানে। নজরুল বলেন, 'মুসলমান সমাজ আমাকে আঘাতের পর আঘাত দিয়েছে নির্মমভাবে। তবু আমি দুঃখ করিনি বা নিরাশ হইনি। তার কারণ বাংলার অশিক্ষিত মুসলমানরা গোঁড়া এবং শিক্ষিত মুসলমানরা ঈর্ষাপরায়ণ।' নজরুল কারো সমালোচনা থেকে শুরু করে গালি-গালাজকে সামান্যতম ভয় পেতেন না। সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতেন। জবাব দিতেন হিম্মতের সঙ্গে, সেখানেও সাহিত্য ফুটে উঠতো। কবি কাজী নজরুল ইসলাম রাজনীতি সচেতন কবি ছিলেন। তার বিপস্নবী কাজের অনেক কিছুই পলেটিক্স করার লক্ষ্যে করেননি। আবার পলেটিক্স করাটাও আদৌ তার লক্ষ্যও ছিল না। গঠনমূলক চিন্তা-ভাবনা সম্পন্ন অত্যন্ত সংবেদনশীল মনের মানুষ ছিলেন তিনি। মানুষের অধিকার বঞ্চিত হয়ে থাকাটা, অবদমিত হয়ে থাকাটা এবং নির্যাতিত, অধঃপতিত এবং অসম্মানিত হয়ে থাকাটা তিনি স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মেনে নিতে পারতেন না। তাই এ অবস্থার অতিদ্রম্নত আমুল পরিবর্তন ঘটনোর বিপস্নবী কাজ তিনি করতে চেয়েছিলেন। নজরুল তার কর্মের জন্য মানুষের মননে চির অম্স্নান হয়ে রইবেন।