নজরুলের সাম্যবাদী চেতনা
প্রকাশ | ২৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
এস ডি সুব্রত
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ- মুসলিম-ক্রিশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!
নজরুল ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ বিশ্বাস করতেন না।
তিনি একটি বিভেদহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। নির্যাতিত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য নজরুল আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। বিদ্রোহী কবি যেমন ছিলেন প্রেমের কবি তেমনি ছিলেন সাম্যবাদী কবি।
সব দেশের, সব ভাষার, সব জাতির কালজয়ী কবি সাহিত্যিক শিল্পীরাই ধর্মের চেয়ে মানবতা বড় এ চেতনাকে সামনে নিয়ে তারা নিজেদের মতো শিল্পসাধনা করে গেছেন। বাঙালি কবিদের মধ্যে মধ্যযুগে যেমন চন্ডীদাস বলেছেন- 'শুনহ মানুষ ভাই,/সবার ওপর মানুষ সত্য/তাহার ওপরে নাই।' পরে লালন বলেছেন, 'মানুষ ধরো, মানুষ ভজো, মানুষ খোঁজো, শোন বলিরে পাগল মন।' নজরুল আরও স্পষ্ট করে মানবতাবাদকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি ধর্মীয় সাম্য বজায় রেখে সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন তার কবিতার শব্দমালায় অসাধারণ দক্ষতায়।
ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফ্ফর আহমেদ ছিলেন কবি নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একক ব্যক্তি হিসেবে কবির মানসগঠনে তিনি যতটা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, সম্ভবত অন্য কেউ সেরকম প্রভাব বিস্তার করেননি। তার কাছ থেকে তিনি কেবল অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা লাভ করেননি, ধনী-দরিদ্রভেদে মানুষ যে সমান অর্থাৎ সাম্যবাদের ধারণা অর্জন করেছিলেন। বিদ্রোহী কবিতার একটি লাইন 'আমি দলে যাই যত নিয়মকানুন শৃঙ্খল।' সেটা শুধু কবিতার কথা ছিল না। তার নিজের স্বভাবের মধ্যেই প্রোথিত ছিল সেরকম ভাবনা-চিন্তা। এ ছাড়া প্রথম দিকে তার হৃদয়ে যে অফুরন্ত মানবপ্রেম ছিল, তা দিয়ে তিনি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না, দরিদ্ররা দুবেলা-দুমুঠো খেতে পাবে- এই সরল সত্যটা যতটা বুঝতেন, মার্ক্সবাদী শ্রেণি সংগ্রামভিত্তিক সাম্যবাদ সম্পর্কে তার ধারণা ততটা স্পষ্ট ছিল না। কবির একগুচ্ছ কবিতা 'সাম্যবাদী' নাম দিয়ে লেখা এবং তা প্রকাশিত হয় লাঙল পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়। এ কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন 'ঈশ্বর' থেকে আরম্ভ করে 'চোর-ডাকাত', 'কুলি-মজুর', 'বীরাঙ্গনা' ইত্যাদি সব মানুষ পর্যন্ত। এই কবিতাগুচ্ছ এবং সর্বহারা কাব্যের কৃষক, শ্রমিক ও ধীবরদের নিয়ে রচিত তিনটি কবিতায় সাম্যবাদ সম্পর্কে কবির ধারণা প্রকাশিত হয়েছে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে। 'কুলি-মজুর' কবিতায় তিনি বলেছেন, শ্রমজীবীদের শ্রমের বিনিময়ে সভ্যতা গড়ে উঠেছে। সুতরাং সভ্যতার পরিচালিকা শক্তি তাদেরই হাতে ন্যস্ত থাকার কথা : 'সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে/এই ধরণীর তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে!' এ কবিতাগুচ্ছের প্রথম কবিতা 'সাম্যবাদী'র বক্তব্যও মূলত এক। মানুষের 'হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।' এবং 'মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!' ভিখারি, চাষি, চন্ডাল, রাখাল মানুষ হিসেবে সবারই অভিন্ন পরিচয়। এসব কবিতার মূলে আছে মানবপ্রেম এবং শ্রেণি-নির্বিশেষে সামাজিক সাম্য। এই হলো নজরুলের সাম্যবাদী চিন্তার স্বরূপ। তিনি 'সর্বহারা' ও 'সাম্যবাদী' কবিতাগুচ্ছে সামাজিক সাম্য ও দরিদ্রদের অধিকারের কথা লিখেছেন। তিনি দূর থেকে কুলি-মজুর-চাষি-ধীবর ইত্যাদি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্রদের দেখে তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে এ কবিতাগুলো রচনা করেছিলেন।
১৯৪১-৪২ সালে সমাজের নিচের তলার মানুষের দারিদ্র্য এবং নিম্নমর্যাদা নিয়ে তিনি অনেকগুলো কবিতা রচনা করেছিলেন। কবিতাগুলোর সম্ভবত সবকটিই দৈনিক নবযুগে প্রকাশিত হয়েছিল। এসব কবিতায় তিনি সর্বহারা শ্রেণির সঙ্গে একাত্ম বোধ করেছেন এবং শ্রেণি-সংগ্রামের কথাও স্পষ্ট করে বলেছেন। ধনীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন যে, দরিদ্ররা তাদের দ্বারে এসেছে অধিকার নিয়ে, তাদের ভাগ তাদের দিয়ে দাও, নয়তো ওরা কেড়ে নেবে। ১৯৪২ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার সাড়ে চার মাস আগে প্রকাশিত একটি কবিতায় বলেছেন, 'রবে না দারিদ্র্য রবে না অসাম্য' : 'জয় হোক জয় হোক আলস্নার জয় হোক/শান্তির জয় হোক সাম্যের জয় হোক/সত্যের জয় হোক জয় হোক, জয় হোক।'
এ কবিতায় ধনীদের তিনি শ্রেণি-সংগ্রামের ভয় না দেখিয়ে দোজখের আগুনে পোড়ার ভয় দেখিয়েছেন।
কবি 'দরিদ্র মোর পরমাত্মীয়' কবিতায়ও সর্বহারাদের প্রতি কবি তার গভীর সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু শ্রেণি-সংগ্রামের শেষে তারা জয়ী হবে- এ কথা বলেননি, বরং আলস্নাহর আশ্বাসের কথা বলেছেন। 'আলস্না আমার সহায়- আলস্না পুরাবেন মোর আশ;/গরিব ভাইরা ভয় নাই, আসে আলস্নার আশ্বাস।/আসে আলস্নার কাবার শিরনী, ক্ষুধার খোরাক আসে রোজা শেষ হবে, দেখিব ঈদের চাঁদ পুন এ আকাশে।/দরিদ্র মোর নামাজ ও রোজা, আমার হজ-জাকাত; উহাদের বুকে কাবা-ঘর; মহামিলনের আরফাত।'
শ্রেণি-সংগ্রামের কথা স্মরণ করিয়ে না দিয়ে তিনি আলস্নাহর বিচারের কথা 'শ্রমিক মজুর' কবিতায়ও বলেছেন। তবে এ কবিতাটি তিনি আলস্নাহর দোহাই দিয়ে শেষ করেননি, বরং সর্বহারাদের 'শক্তি'র কথা বলেছেন। এ কবিতায় আমরা ধর্ম ও শ্রেণি-সংগ্রাম উভয়ের কথা শুনতে পাই, 'নহে আলস্নার বিচার এ ভাই, মানুষের অবিচারে/আমাদের এই লাঞ্ছনা, আছি বঞ্চিত অধিকারে/...দেখেছি নিজের শক্তিকে, আর লাঞ্ছনা সহিব না!/যে হাত হাতুড়ি দিয়া গড়িয়াছি প্রাসাদ হর্ম্যরাজি,/সেই হাত দিয়া বিলাস-কুঞ্জ ধ্বংস করিব আজি। কবি এখানে শ্রেণি-সংগ্রাম সম্পর্কে তার অভ্রান্ত সচেতনতা প্রকাশ করেছেন।
তিনি এ কথাও ঘোষণা করেছেন যে, নির্যাতিতের ধর্মীয় পরিচয় নেই। 'জানি না, তাহারা হিন্দু কি ক্রিশ্চান কি মুসলমান। নির্যাতিতের জাতি নাই, জানি মোরা মজলুম ভাই।' একুশ-বাইশ বছরজুড়ে বিস্তৃত তার কবিজীবনের প্রথম ছয়-সাত বছর পর্যন্ত তিনি যতটা শোষিত মানুষের জন্য আন্তরিক সহানুভূতি দেখিয়েছেন, পরবর্তী প্রায় বছর পনেরো সেখান থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন। তারপর আলো নেভার ঠিক আগে, শেষের আট-নয় মাস তিনি আবার নিঃস্বদের জন্য তার সমমর্মিতা প্রকাশ করেন। এবার সেই সহানুভূতির সঙ্গে বাড়তি যা দেন, তা হলো সৃষ্টিকর্তার দোহাই। শোষিত মানুষের প্রতি সচেতনতা দেখালেও দেশের রাজনীতির প্রতি তার সচেতনতা ততদিনে প্রায় লোপ পেয়েছিল। যে নজরুল একদা রাজনৈতিক কবিতা লিখে বিস্ময়ে অভিভূত পাঠক-সমাজের হৃদয় জয় করেছিলেন এবং তাদের মনে সাহস ও আশাবাদ জুগিয়েছিলেন, ১৯২৬ সালের পর থেকে সেই নজরুল রাজনীতির অঙ্গন থেকে যোজন-যোজন দূরে সরে যান।
'বন্ধু তোমার বুক ভরা লোভ,
দু'চোখে স্বার্থ-ঠুলি, নতুবা দেখিতে,
তোমারে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলি।' (মানুষ- কাজী নজরুল ইসলাম)।
বাংলা সাহিত্যে সাম্যবাদের প্রবক্তা হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত ও পথিকৃৎ কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে যে সাম্যবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতা ধারা সৃষ্টি করেছিলেন তা অভূতপূর্ব অবিস্মরণীয়। তার তীব্র সাম্যবাদী চেতনা ব্রিটিশশাসিত পরাধীন ভারতবর্ষে ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সবার মধ্যে ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের জাতীয় সংহতি সঞ্চার করেছিল। আজও নজরুল আমাদের কাছে সর্বোতভাবে প্রাসঙ্গিক এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।