প্রিয় গ্রাম ছেড়ে ঢাকা এসেছে রাফি। কত মানুষ আসে উচ্চশিক্ষার জন্য। রাফির সেই সৌভাগ্য হয়নি। রাফি এসেছে জীবিকার তাগিদে। জীবন নামক গাড়ির থেমে যাওয়া চাকা সচল রাখতে। অথচ বয়সটা সহপাঠীদের সঙ্গে বই নিয়ে স্কুলে যাওয়ার। বিকাল হলে বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে যাওয়ার। সংসারের একমাত্র রুজি সংগ্রাহক বাবার আকস্মিক মৃতু্যতে রাফি আজ ঢাকা শহরে। জীবিকার খোঁজে।
রাফির গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ। নিজকল্পা। খাঁটি গ্রাম্য। গাঁয়ের সবুজ শ্যামল পরিবেশে বেড়ে ওঠা এক শান্ত সুবোধ ছেলে। বমির কারণে বাসে চড়তে পারে না। তাই ট্রেনে আসবে ঠিক করল। দিন-তারিখ নির্ধারণ করে সেদিনের টিকিটও কেটে ফেলল। প্রিয় মা, ফুটফুটে সুন্দর দুটো আদুরী বোন বাড়িতে রেখে চলে আসা কতটা বেদনাবিধুর তা রাফি টের পাচ্ছে। কষ্টে বুকটা ফেটে চৌচির হওয়ার উপক্রম। তবুও আসতে হবে। নির্ধারিত সময়ের আগেই রেলস্টেশনে উপস্থিত হলো রাফি। যথা সময়ে ট্রেন এলো। প্রকৃতির নির্মল বাতাস গায়ে লাগাতে জানালার পাশে গিয়ে বসলো রাফি। বসে বসে বাহিরের মনকাড়া সব দৃশ্য অবলোকন করেছে। আর স্মৃতির চোরাবালিতে হারিয়ে যাওয়া রঙিন শৈশব খুঁজে ফিরছে আনমনে। কু-ঝিকঝিক শব্দে ট্রেন চলছে বিরামহীন। হঠাৎ তার চোখে পড়লো চিরচেনা এক দৃশ্য। যে দৃশ্য তার শৈশবের সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। স্মৃতির আয়নায় এখনো ভাসমান।
আট-দশ বছরের কিছু ছেলেপুলে নাটাই হাতে রংবেরঙের ঘুড়ি উড়াচ্ছে। কেউ কাটাকাটি খেলছে। রাফির স্পষ্ট মনে আছে গত বছর এদিনগুলোতো সেও নাটাই ঘুড়ি হাতে নিয়ে খোলা মাঠে কত দৌড়াদৌড়ি করেছে। মায়ের সেলাই মেশিন থেকে সুতা নিয়ে যাওয়া। তারপর নাটাইয়ে পেঁচানো। কত স্মৃতি। রাফির বয়সটাও খুব বেশি না। সবেমাত্র শৈশবের জরাজীর্ণ পোশাক খুলে কৈশোরের রঙিন জামা গায়ে জড়িয়েছে। এই বয়সে তার জীবনে এমন ধকল আসবে কল্পনাও করেনি। বাবা থাকতে কত সুখে কেটেছে দিনগুলো। কত বায়না বাবা পূরণ করেছে তার ইয়ত্তা নেই।
ট্রেন এসে থেমেছে কমলাপুর রেলস্টেশনে। ট্রেন থেকে নেমে রাফি বেরিয়ে পড়ে এক অজানা গন্তব্যে। জীবিকার তাগিদে। খানিকবাদে রাফি হারিয়ে গেল শত লোকের ভিড়ে। যেমন হারিয়ে যায় বিশাল সমুদ্রের ঢেউ। জানা নেই, রাফি আজ কোথায় আছে। প্রিয় বসতভিটা ছেড়ে আসা রাফি ফের মায়ের কোলে ফিরেছে কিনা। এমন রাফি দেশে শহরে অহরহ। স্কুল ব্যাগের পরিবর্তে যাদের কাঁধে ঝুলে আছে সংসারের বোঝা।