চল রূপা, পুকুর পাড়ে দু'জনে একটু হেঁটে আসি।
কী ব্যাপার হঠাৎ পুকুর পাড়ে হাঁটতে চাইছো?
এমনিতেই। চল।
আচ্ছা, চল।
দেখ!বিলের পানিতে কেমন ঢেউ! ঢেউগুলো পুকুরের পাড়ে এসে আঘাত করছে। আর পুকুর পাড়ের ধার ফেনায় ভরে গেছে।
তাইতো! কী সুন্দর! আচ্ছা সোহান ভাই নৌকায় চড়লে কেমন হয়? চলো দু'জনে নৌকায় চড়ি।
নৌকা পাবি কোথায়? নৌকা নিয়ে দাদু বাজারে গেছে।
ও আচ্ছা!
বর্ষাকাল! আমাদের বাড়ির তিন দিকেই পানি। কী সুন্দর চারিদিক। দক্ষিণা বাতাস। বিলের শাপলাগুলো পানিতে দোলছে। নৌকায় চড়লে অনেক মজা হতো!
তাহলে আগামীকাল আমরা নৌকায় চড়বো। দাদুকে বলে রাখব, নৌকাটা যেন বিকালে ঘাটে রাখে। নৌকা নিয়ে কোথাও যেন না যায়।
ঠিক আছে, আগামীকাল নৌকা পেলে তোকে নিয়ে বিলে যাব।
আচ্ছা!
তোকে আজ পরীর মতো লাগছে, রূপা। বাতাসে তোর চুলগুলো ওড়ছে। উতাল বাতাস শাড়ির আঁচল ধরে যেন তোকে টানছে।
তুমি এমন ভাবে বলছো... আমি মনে হয় স্বর্গ থেকে এসেছি।
সত্যিই তোকে স্বর্গের অপ্সরাই মনে হচ্ছে!
আমার কাছে মনে হয় স্বর্গের অপ্সরা যেন নেমে এলো। তোকে আজ এত সুন্দর লাগছে কেন?
আজকেই আমাকে তোমার কাছে ভালো লাগল? এতদিন তাহলে ভালো লাগেনি?
এতদিন ভালো লেগেছে। তবে আজকে তুই শাড়ি পরেছিস তো তাই আরো ভালো লাগছে।
এসব বাদ দাও!বিয়ের চিন্তা কর। প্রেম তো আর কম হলো না। সাত বছর হলো প্রেম করছি। বিয়ে করা দরকার। আমাদের প্রেমের খবর তো সবাই জানে। বিয়েতেও কারোর দ্বিমত নেই। এখন তুমি একটা কাজে লাগতে পারলেই বিয়েতে সবাই রাজি হয়ে যাবে।
আগামী মাসে ঢাকায় যাব। গাঁয়ে থেকে চাকরি পাবনা। কাল বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে। দাদুর সঙ্গেও কথা হয়েছে। একটা চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত কেউ বিয়েতে রাজি নয়। তার বাবা-ও না আমার বাবা-ও না।
তাহলে সময় নষ্ট না করে ঢাকায় যাও।
হঁ্যা, যাব।
\হচল রোহান ভাই! সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ঘরে যাই।
আরেকটু থাকি! তোর তো কোনো কাজ নেই। ঘরে যেয়ে কী করবি?
তোকে আজ কাছে পেয়েছি।
প্রতিদিনই তো তোমার সঙ্গে কথা হয়।
হয় ঠিক আছে। এমন পড়ন্ত বিকাল, নীড়ে ফেরা পাখির ডানার শব্দ, ছোট ছোট ঢেউ কখনো একসঙ্গে দেখেছিস? তোর চুলের গোছা কপোল বেয়ে কেমন দোলছে। তোর পরনের শাড়ি তোকে কত অনন্যা করছে জানিস? আরেকটু থাক ঢাকায় চলে গেলে তো আর তোকে এমনভাবে দেখতে পাবো না।
আচ্ছা ঠিক আছে বসলাম। এবার বলো ঢাকায় গিয়ে আমাকে রোজ রোজ ফোন দেবেতো?
তোকে ফোন না দিয়ে পারব? সাত বছর তোর সঙ্গে প্রেম, একই সঙ্গে চলা এসব ভুলা যায়?
শহরে গিয়ে আমায় আবার ভুলে যেও না। মনে থাকে যেন।
ওই দেখ একটা নৌকা যাচ্ছে। ঢেউয়ের সঙ্গে হেলেদুলে। নৌকাটা খুব ছোট। পাশের গাঁয়ে যাবে মনে হয়।
হুম! সারাদিন অনেক নৌকা যায় এই বিল দিয়ে।
আচ্ছা! চল এবার ঘরে যাই। সকালে কথা হবে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে রূপা আর সোহান যার যার ঘরে চলে গেল। সোহান রাতের খাবার শেষ করে শোতে যাবে এমন সময় সোহানের মোবাইলে কল এলো। আগামীকাল ঢাকায় যেতে হবে। একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সোহানের চাকরি হয়েছে। সেই কোম্পানি থেকেই সোহানকে ফোন দিয়েছে। গাঁয়ের লোকজন সাধারণত রাতের খাবার তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে যায়। তাই সোহান রাতে খবরটা রূপাকে জানায়নি। সকালে ঘুম থেকে উঠে রূপার ঘরে গেল সোহান।
রূপা! রূপা!
কে?
চাচি আমি রোহান।
\হরূপাতো ঘুমায়! রাতে দেরি করে ঘুমাইছে।
চাচি একটু ডাক দেন। আমাকে হঠাৎ ঢাকায় যেতে হবে। রূপার সঙ্গে কথা বলে যাই।
কেন বাবা? ঢাকায় কেন?
গত মাসে একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। ওরা যেতে বলেছে। রাতে ফোন দিল।
তাই, তাহলে চাকরি হয়েছে মনে হয়।
হঁ্যা, তাই বলল।
ভালো হয়েছে! এখন রূপা আর তোমার বিয়েটা হয়ে গেলেই হয়।
হঁ্যা, চাচি দোয়া করবেন।
তুমি বস আমি রূপাকে ডেকে দেই।
কী রে এত ঘুমাস কেন? কখন থেকে তোকে ডাকছি।
কেন ডাকছ?
আমি একটু পরে ঢাকায় যাব। তোকে বলতে এসেছি।
তুমি না বললে আগামী মাসে ঢাকায় যাবে।
হঁ্যা বলেছিলাম। গত মাসে যে একটা ইন্টারভিউ দিয়েছি, সেই চাকরিটা হয়েছে। রাতে ফোন দিয়ে কনফার্ম করল।
তাই!
তাহলে যাও। সাবধানে যেও। পৌঁছে ফোন দিও।
ঠিক আছে! মোবাইল খোলা রাখিস।
দাদুকে বলছ, তুমি ঢাকায় যাবে?
বলছি। দাদু বাজারে গেছে। আমি কথা বলেছি।
রোহান ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হলো। বিকালে ঢাকায় পৌঁছে তার মা-বাবাকে জানাল। রূপাকে ফোনে ঢাকায় পৌঁছার কথা জানাল। পরের দিন রোহান চাকরিতে যোগ দিল। একাউন্ট অফিসার হিসেবে জয়েন করল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে রূপার সঙ্গে কথা বলে নিয়মিত। দুইমাস পর রোহান আর রূপার দাদু ওদের বিয়ের দিন ধার্য করল। রূপা আর রোহানের মতামত নিয়েই বিয়ে ঠিক করল। রূপা রোহানের কাছে জানতে চাইল-
তুমি কবে আসবে বাড়িতে?
বিয়েতো আরো ২০ দিন বাকি। আমি তিন দিন আগে আসব।
আরো আগে আসা যায় না?
নতুন চাকরি! এতদিন ছুটি দেবে না। আমি এসে তোকে নিয়ে বিয়ের মার্কেট করব। আজকে এপ্রিলের এক তারিখ, দেখতে দেখতে সময় কেটে যাবে।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
রূপা আর রোহানের বাবা, দাদা সবাই ওদের বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত। সবার মনে আনন্দ। ওদের প্রেমের খবর সবাই জানে তবুও কেউ ওদের প্রেমে বাধা প্রদান করেনি কোন দিন। বাড়িতে এক উৎসবের আমেজ। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে। বিয়ের আয়োজনে কোনো প্রকার ত্রম্নটি যেন না হয় খেয়াল রাখছে ওদের দাদু রজব আলী। রূপা আর রোহান রজব আলীর খুব প্রিয়। রোহান দাদুর কাছ থেকে সময় সময় খোঁজ নিচ্ছে। রজব আলী রোহানকে বলল, চিন্তা করিস না আমরা সবকিছু ঠিকঠাক সামলে নেব।
রূপা রোহানের সঙ্গে প্রতিদিন কথা বলে। সময় যেন কাটছে না। কবে আসবে ২০ তারিখ? দিন গুনছে রূপা। দেখতে দেখতে সময় কেটে গেল। ষোলো তারিখ রাতে রূপা প্রতিদিনের মতো রোহানকে ফোন দিল।
আজ তো ষোলো তারিখ, তুমি কী আগামীকাল আসবে?
হঁ্যা আমি সকালে আসব। ১০টায় বাড়িতে এসে পৌঁছব।
অনেক কথা হলো দুজনের মধ্যে। কথা শেষ করে দুজনই ঘুমিয়ে গেল। সকাল হলো। ১০টা পেরিয়ে ১২টা বাজলো, রোহান এখনো বাড়িতে আসেনি দেখে রূপা রোহানের মোবাইলে কল দিল। মোবাইল বন্ধ। চিন্তায় পড়ে গেল রূপা। রজব আলীর কাছে গেল রূপা।
দাদু, রোহান ভাইতো ১০টায় আসার কথা, এখনো আসেনি। এখন ১২টা বাজে।
আসবে তুই চিন্তা করিস না।
মোবাইলতো বন্ধ!
হয়তো চার্জ নেই। তাছাড়া ঢাকা থেকে ঠিক সময়ে আসা যায় না। রাস্তায় জ্যাম থাকে। দাদুর কথায় রূপা আশ্বস্ত হলো। কিন্তু রূপার মন কেমন যেন করছে।
দিন গেল রাত এলো রোহান আসেনি দেখে সবাই চিন্তায় পড়ে গেল। মোবাইল বন্ধ। সকাল হলো তবুও রোহানের কোনো খবর নেই। রূপার চোখে জল। রোহানের মা-বাবার খাওয়া বন্ধ। বিয়ে বাড়িতে আনন্দের পরিবর্তে চলছে কান্নাকাটি। দুপুরে এক অজ্ঞাত নাম্বার থেকে ফোন এলো রজব আলীর কাছে।
হ্যালো
কে বলছেন?
আমি গজারিয়া হাইওয়ে পুলিশফাঁড়ি থেকে বলছি।
হঁ্যা, বলুন।
আজ সকালে গজারিয়ায় একটি সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে। চারজন মারা গেছে। মৃত এক যুবকের পকেটে এই মোবাইল নাম্বারটা পাওয়া গেছে। তাছাড়া তার পকেটে একটা অফিসিয়াল আইডি কার্ড পাওয়া গেছে, আইডি কার্ডে তার নাম লেখা আছে রোহান।
হঁ্যা, রোহান আমার নাতি।
আপনারা গজারিয়া থানায় এসে লাশটা নিয়ে যান।
রজব আলীর সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এলো। স্তব্ধ হয়ে গেল ক্ষণিকের মধ্যে। উঠানে দাঁড়িয়ে রজব আলী নির্বাক তাকিয়ে আছে পুব দিকে হয়ে। রূপা দৌড়ে এসে রজব আলীকে জিজ্ঞেস করল।
কী হয়েছে দাদু?
রজব আলী মিনমিনিয়ে কী যেন বলছে রূপা বুঝতে পারছে না।
রোহানের বাবা এসে জিজ্ঞেস করল।
বাবা কী হয়েছে।
রজব আলী আস্তে আস্তে উঠানের মাটিতে বসলো আর রূপার দিকে সজল চোখে তাকিয়ে বলল, রোহান সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। গজারিয়া পুলিশফাঁড়ি থেকে আমাকে ফোনে বলল লাশ আনতে, রূপার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। চিৎকার দিয়ে রূপা মাটিতে পড়ে গেল। রূপাকে সবাই ধরে ঘরে নিয়ে গেল। রূপার মুখে আর কোনো কথা নেই। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল রূপার। রূপাকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রূপার বাবা ডাক্তার আনতে গেল। ডাক্তার এসে বলল, স্ট্রোক করেছে। রজব আলী এক কঠিন পরীক্ষায় পড়ল। একদিকে রোহানের লাশ আনতে হবে অপরদিকে রূপাকে হাসপাতালে নিতে হবে। রূপাকে নিয়ে হাসপাতালে গেল রূপার বাবা, আর রজব আলী গেল রোহানের লাশ আনতে। রজব আলী সঙ্গে নিয়ে গেল তার বন্ধু হযরত আলীকে। রাত ১০টায় রোহানের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরল রজব আলী। গরমের দিন লাশ তাড়াতাড়ি দাফন করতে হবে কিন্তু রূপাকে লাশ না দেখিয়ে কীভাবে দাফন করবে ভাবছে সবাই। কিন্তু রূপার শারীরিক অবস্থা ভালো নেই, কখন জ্ঞান ফিরে ঠিক নেই, তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল লাশ দাফন করে ফেলবে। রাতেই লাশ দাফন করা হলো- রূপার জন্য অপেক্ষা করা হলো না; কারণ রূপার অবস্থা খুবই খারাপ এতক্ষণ লাশ রাখা যাবে না। রূপা হাসপাতালে, জ্ঞান ফেরেনি। সকালে রূপার জ্ঞান ফিরল কিন্তুু কথা বলতে পারছে না। ডাক্তার বলল সে আর কোনো দিন কথা বলতে পারবে না। রূপার ঝলমল আকাশে নেমে এলো কালো অন্ধকার। এভাবে একটি অপ্রত্যাশিত মৃতু্য থামিয়ে দিল দুটি জীবন।