আইজাক বাশেভিস সিঙ্গারের শোশা

প্রকাশ | ১৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

মহীবুল আজিজ
১৯৭৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ঈডিশভাষী লেখক আইজাক বাশেভিস সিঙ্গার। বিচারকমন্ডলী তার রচনাবলির প্রশস্তি প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উলেস্নখ করেছিলেন 'শোশা' উপন্যাসটির কথা। স্মর্তব্য, ঈডিশ ভাষায় নোবেল পাওয়া প্রথম লেখকও তিনি। মজা করে বলছিলেন, যখন খবর এলো তিনি নোবেল পেয়েছেন এবং তাকে একখানা বক্তৃতা পাঠ করতে হবে। সারা নিউইয়র্কে একটা ভালো ঈডিশ টাইপমেশিন খুঁজে পাওয়া গেল না, যেটাতে তিনি নোবেল বক্তৃতা টাইপ করতে পারেন। শেষে বহু কষ্টে নিজের ভাঙা টাইপমেশিনেই টাইপ করেন তার বক্তৃতা। 'শোশা' একটি মানবিক আখ্যান নিঃসন্দেহে। কিন্তু সিঙ্গার আরও অসাধারণ সব উপন্যাস ও গল্প রচয়িতা। তার 'দ্য মেজিশিয়ান অব লুবলিন, স্নেভ, এনিমি : এ লাভ স্টোরি, দ্য ফ্যামিলি মস্কাট, দ্য পেনিট্যান্টস' প্রভৃতি উপন্যাসের কথাও ভোলা সম্ভব নয়। পোল্যান্ডের ক্র্যাকফ গ্রামের বাসিন্দা সিঙ্গার ভাগ্যের ফেরে আমেরিকা যেতে বাধ্য হন এবং বাকি জীবন সেই অভিবাসনেই কাটিয়ে দেন মৃতু্যর আগ পর্যন্ত। নোবেল তাকে বিশ্বখ্যাতি এনে দিলেও কখনো তার অগ্রজ ঔপন্যাসিক ভাইয়ের কথা বলতে ভোলেননি। বড় ভাই ইজরায়েল জশুয়া সিঙ্গারকে ভাই, বন্ধু ও পথপ্রদর্শক হিসেবে গণ্য করতেন। জশুয়া রচিত 'দ্য ব্রাদার্স আসখেনাজি' উপন্যাসটিকে বলা যায় আখ্যানাকারে লেখা এক বিস্মৃত জীবনের ইতিহাস- যা ইউরোপীয় ইহুদিদের বিকাশ ও পর্যটনের বৃত্তান্ত এ উপন্যাস। ১৯৭৮ সালে সিঙ্গার নোবেল পেলে আমাদের দেশে তার গুটি কতক গল্পমাত্রই বাংলায় অনূদিত হয়। মনে পড়ে কাজী সালাহউদ্দিন ও হারুন রশীদের কিছু গল্প তখন পড়ার সুযোগ হয়- যা সিঙ্গারের অতল সাহিত্যের খুব সামান্যই। তবু তার 'গিম্পেল দ্য ফুল' গল্প পাঠের স্মৃতি আজও ঝকঝকে। 'শোশা'র খোঁজ করি কিন্তু পাই না কোথাও। ১৯৯১ সালে আমাকে ইংল্যান্ডে যেতে হয় এবং সে বছরই মারা যান সিঙ্গার। ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ফের তিনি উপস্থিত একের পর এক উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের মধ্য দিয়ে। আর অসাধারণ দুটি আত্মজীবনী- 'ইন মাই ফাদারস কোর্ট' এবং 'লাভ অ্যান্ড এক্সাইল'। পড়লাম 'শোশা'। ঈডিশ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ- ভূমিকায় অবশ্য বলে দেওয়া হয় অনুবাদক মূল লেখকের সহায়তায় সম্পন্ন করেছেন তার অনুবাদকর্মটি। মূল ভাষায় তা পড়তে কেমন সেটা এ জন্যই আগ্রহের বিষয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে পূর্ব ইউরোপীয় ঈডিশ ভাষা পরবর্তীকালে পরিণত হয়েছে এক পবিত্র ভাষায়। যে ৬০ লাখ ইহুদি মৃতু্যবরণ করে হিটলার-যজ্ঞে, তার শতকরা ৮০ ভাগই ছিল ঈডিশভাষী- লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, ইউক্রেন, পোল্যান্ড, রাশিয়া এ রকম সব অঞ্চলের ঈডিশভাষী ইহুদিরা চিরকালের ছাই হয়ে উড়ে গিয়ে মিশে যায় আউশভিচ-ডাচাউয়ের গ্যাসের চেম্বার থেকে অনন্ত আকাশে। বেঁচে থাকা ঈডিশভাষীদের প্রায় সবাই চিরদিনের জন্য পরিণত হয় 'ভেজিটেরিয়ান'-এ, মাংস তাদের 'হারাম'- ঈডিশ ভাষায় বলে 'ট্রাইফ'। কী নেই এ উপন্যাসে- প্রেম, কাম, পরকীয়া, সমাজ, সংসার, রাজনীতি, হিংসা-দ্বেষ, ধর্ম, যুদ্ধ, গণহত্যা এবং সর্বোপরি ইতিহাস-সাম্রাজ্যবাদ। বলা যায়, এক বৃহৎ মহাকাব্যিক আয়তনে জীবনের নানা অনুভূতি ও মাত্রিকতার ছবি এঁকেছেন সিঙ্গার। সবচেয়ে বড় কথা পোল্যান্ডের যে জনগোষ্ঠীর জীবনকে তিনি এঁকে রেখে গেছেন বাস্তবে সে জনগোষ্ঠী বা তাদের সেসব নিশানা আজ আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। \হ'শোশা' পড়তে পড়তে আমার মনে হতে থাকে ১৯৭১-এর গর্ভে থাকা বাঙালির কথা। ৮০০-৯০০ বছর ধরে পোল্যান্ডে বসবাস করেও ইহুদিরা সে দেশে পোলিশ হতে পারেনি। তারা পৃথক এবং তারা চিহ্নিত যেভাবে ফ্যাসিবাদ-অধু্যষিত জার্মানিতে তাদের হলুদ বর্ণের ডেভিড-তারকা পরে পৃথক হতে বাধ্য করেছিল হিটলার। ১৯৭১-এ বাঙালি পরাজিত হলে তারা যে কী পরিস্থিতির শিকার হতো, সেই আতঙ্ক অনুভব করতে পারি সিঙ্গারের এ উপন্যাস থেকে। একজন সমালোচক বলেছিলেন, আজ যদি পোল্যান্ডের ইহুদি বসতিগুলোকে পুনরায় নির্মাণের প্রয়োজন পড়ে, তবে সে ক্ষেত্রে সিঙ্গারের উপন্যাস হতে পারে সহায়ক সূত্র। আমিও তাই বাঙালি ঔপন্যাসিকদের লেখা সেসব উপন্যাসের কথা ভাবি, যেগুলোতে রয়েছে কেবল বাংলাদেশ ও বাঙালি। 'শোশা' উপন্যাসে চিত্রিত ক্রোখমালনা স্ট্রিট আজ ইতিহাসের গর্ভে বিলীন কিন্তু উপন্যাসটি আমাদের চোখের সামনে চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে। ক্রোখমালনা, রাওয়ারুস্কা,র্ যাঝিমিন, গ্নয়না স্কয়্যার- এ রকম সব চাঞ্চল্যপূর্ণ জীবনের সবটা স্থিরচিত্রে পরিণত হয়ে গেছে এক প্রবল উন্মাদ স্নায়বিক রোগাক্রান্ত স্বৈরপ্রভুর দানবিকতার ফলে। উপন্যাসের নায়ক অ্যারন গ্রাইডিংগারের চোখেই আমরা দেখি ৮০০-৯০০ বছর ধরে পোল্যান্ডে থাকা একটি জনগোষ্ঠীর ক্রম-অধোগতির প্রবাহটিকে। অ্যারন প্রবলভাবে জীবনবাদী, যদিও তারর্ যাবাই বাবা তাকে সনাতন হাসিদ অনুসারে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। অ্যারনের ভাই মইশে ঠিক তেমন একজন। কিন্তু অ্যারনকে সিঙ্গার স্থাপন করেন জীবন ও বাস্তবতার বিভিন্নমুখী বৈশ্বিক দ্বান্দ্বিকতার বৃত্তে। অ্যারনের উপলব্ধি, ধ্বংসের মুখে নিরুপায়তা-অসহায়তা এক দারুণ মানবিক ট্র্যাজিক কাহিনীর আধার। সে দেখতে পায় পোল্যান্ডের ইহুদি মানুষ চিরকাল স্থানীয় ('জেন্টাইল') খ্রিস্টানদের ঈর্ষা-হিংসা এমনকি প্রতিহিংসার শিকার ছিল। তারা তাদের কোনোরূপ সম্ভাবনা বা উন্নতিকেই সহ্য করতে নারাজ ছিল। অথচ ঈডিশভাষী বিজ্ঞানীরা যখন খ্যাতিতে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে এবং দারুণ সব অবদানে দেশ-জাতিকে সমৃদ্ধ করে, তখন তারা পোল্যান্ডের লোক ঠিকই। এই ধর্মীয় ও জাতিগত গোলকধাঁধা ধার্মিক অ্যারনকে মাঝেমধ্যে উসকে দেয় নাস্তিকতার দিকে। সিঙ্গারকে সমালোচকরা ঐতিহ্যপন্থি বামবিরোধী লেখক হিসেবে জানলেও তিনি নাস্তিকতা-নৈরাজ্য পন্থার ধারক চরিত্রকেও আঁকেন চমৎকারভাবে এবং তাদের দৃষ্টিকোণ থেকেই। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র আজ ধ্রম্নপদী মানব-প্রতিনিধি হয়ে আছে। অ্যারন গ্রাইডিংগার, তার বাল্যপ্রেমিক ও স্ত্রী শোশা, নাস্তিক-ভোগবাদী মরিস ফাইটেলজোন, বাম রাজনীতিকর্মী ডোরা, মার্কিন ইহুদি শিল্পপতি স্যাম ড্রাইম্যান, তার স্ত্রী অভিনেত্রী যশাকাঙ্ক্ষী বেটি সব চরিত্র নিখুঁত- সময় ও স্থান আজও অবিচ্ছেদ্য হয়ে রয়েছে তাদের মধ্যে। উপন্যাসের চরিত্র হয়েও আজ তারা হয়ে গেছে ঐতিহাসিক মানব-মানবী। আমরা দেখি উল্টোটা, ঐতিহাসিক চরিত্ররা হয়ে যায় উপন্যাসের চরিত্র। উপন্যাসটির দুটি ভাগ কল্পনা করা যায়। প্রথম ভাগে এক সুপ্রাচীন পর্যটক-জাতিসত্তার সমাজ-সংসার-ব্যক্তি-জীবন-সংস্কৃতি এবং এসবের মধ্যে জাগতিক জীবনের সঞ্চালন। যখন আমরা নিজেদের মনে মনে প্রস্তুত করতে থাকি, আটপৌরে মানব-মানবীরা তাদের চিরকালের সহজ-সরল জীবনাভিব্যক্তি নিয়ে ক্রমে হয়ে উঠবে অসাধারণ, তখনই বড় করুণভাবে সব সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ হয়ে যেতে থাকে একে একে। দূর প্রদেশের আগ্রাসন সুনামি হয়ে আছড়ে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। এপিসেন্টার জার্মানি থেকে বিশাল মানচিত্রকে তা গ্রাস করে। ঠিক যে মুহূর্তে জীবন খুলে-মেলে বিকশিত হবে তখনই শুরু তার দ্বিতীয় ভাগ। সেই ভাগে অবরুদ্ধ জীবন কোণঠাসা হতে থাকে এবং প্রবল পীড়নের মুখে তার পলায়ন বা আত্মসমর্পণ ছাড়া থাকে না অন্য গতি। অ্যারন স্বপ্ন দেখেছিল, জীবনে অনেক বড় হবে, সুনাম কুড়াবে। নাট্যকার হবে- তার নাটক দেখে দর্শক হবে মোহিত। সেই নাটকে থাকবে একটি জাতির স্বপ্ন ও প্রত্যাশা। তেমনি বেটির স্বপ্ন ছিল অ্যারনের নাটকে অভিনয় করে বিশ্বজোড়া খ্যাতির অধিকারী হবে। কার্যত কিছুই হয় না নিষ্ফল বিয়োগের ক্রম রূপায়ণ ছাড়া। তবু তা জীবনেরই গল্প- ঔপন্যাসিক তো জীবনকে জোর করে জাগিয়ে তুলতে পারেন না, যখন জীবনের নিজের পক্ষেই আর জাগরণ সম্ভবপর নয়। আমাদের সৌভাগ্য ১৯৭১-এ আমরা হারিনি, হারিয়েছি। আমরা শত্রম্নকে হারিয়েছি কিন্তু জীবনেরও অনেক কিছু হারিয়েছি। তথাপি জীবনের মহিমাকে আবার জেগে উঠতে দেখেছি আমরা। সিঙ্গার তা দেখেননি কিন্তু তার উপন্যাস 'শোশা' আমাদের শেখায় যে আতঙ্ক-আগ্রাসনই শেষ কথা নয়, পৃথিবীর সব ভাষায় একটি শব্দ আছে সম্ভাবনার।