কবিতার পদ্য ও গদ্য রীতি ছন্দ, মাত্রা, অন্তমিল ও অলংকরণ
প্রকাশ | ১৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
মাজহার মান্নান
একটি পাখি যেমন তার দুটি ডানায় ভর করে ওড়ে, ঠিক তেমনি যে কোনো সাহিত্য তার দুটি গুরুত্বপূূর্ণ বাহন পদ্য ও গদ্য রীতিতে ভর করে এগিয়ে চলে। পদ্য ও গদ্য উভয় রীতির জন্য শব্দের প্রয়োজন। তবে শব্দের বিন্যাসগত এবং ব্যঞ্জনাগত তারতম্যের কারণে পদ্য ও গদ্য রীতির উদ্ভব ঘটে। একই শব্দ সমূহকে সাবলীলভাবে বর্ণনা করে গেলে সেটা গদ্যের আকার ধারণ করে। কিন্তু ওই শব্দগুলোকে যখন ব্যঞ্জনা, মাত্রা এবং অনুপ্রাস আকারে প্রকাশ করা হয় তখন সেটা পদ্যের আকার ধারণ করে। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
আমরা সবাই মিলে লেখাপড়া করব এবং মানুষ হয়ে সোনার বাংলা গড়ে তুলব। (গদ্যরীতি)
ওপরের এই শব্দগুলো মাত্রা, বিন্যাস, অন্তমিল এবং ছন্দে সাজালে সেটা পদ্যরীতি ধারণ করবে।
চলো মোরা সবে মিলে
লেখাপড়া করি
মানুষ হয়ে আমরা সবে
সোনার বাংলা গড়ি।
ওপরের চরণগুলো পদ্যরীতি এবং এখানে স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রয়োগ করে ৪/৪/৪/২ মাত্রায় লেখা হয়েছে।
চলো মোরা/সবে মিলে/লেখাপড়া/করি
মানুষ হয়ে/আমরা সবে/সোনার বাংলা/গড়ি। এখানে করি ও গড়ি এ দুটির অন্তমিল করা হয়েছে এবং ২ মাত্রায় রাখা হয়েছে। অন্যগুলোকে ৪ মাত্রায় সাজানো হয়েছে।
যাহোক ছন্দ মাত্রা নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনায় যাওয়ার আগে পদ্য ও গদ্য রীতির উদ্ভব সম্পর্কে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। ইংরেজ কবি কোলেরিজের মতে, শব্দের সুসংগঠিত বিন্যাসই গদ্য। আর শব্দের ছান্দসিক, ব্যঞ্জাত্মক ও অনুপ্রাসিক বিন্যাস হলো পদ্য। যেমন, 'গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা'। আর্যভাষা থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব এবং এর আদি নিদর্শন চর্যাপদ। আর এগুলো কবিতার আঙ্গিকে রচিত। চর্যাপদ থেকে শুরু করে উনিশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত কাব্যচর্চার ইতিহাস। আঠারো শতক পর্যন্ত গদ্য সাহিত্যের তেমন কোনো অস্তিত্ব ছিল না। মধ্যযুগে চিঠিপত্র ও দলিল দস্তাবেজ তৈরিতে গদ্যের ব্যবহার হতো। উনিশ শতকে গদ্যের লিখিত রূপের বিকাশ ঘটতে থাকে। উইলিয়াম কেরি এবং রাজা রামমোহন রায় এসময় উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। তবে গদ্যকে সাহিত্যের মর্যাদায় নিয়ে আসেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। রবীঠাকুর তাকে বাংলা গদ্যের প্রথম শিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সময়চক্রে বিশুদ্ধ গদ্যের বিকাশ হতে থাকে প্যারীচাঁদ মিত্র ও মাইকেল মধুসূদনের হাত ধরে। পয়ার ছন্দেই প্রাচীন ও আধুনিককালের বেশিরভাগ কাব্য রচিত হয়েছে। পয়ার ভেঙেই আধুনিক কবিতার ছন্দ নির্মিত হয়েছে। মধুসূদন দত্ত পয়ার ভেঙেই অমিত্রাক্ষর ছন্দ সৃষ্টি করেছেন এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দই যে আধুনিক গদ্য কবিতার জনক তা ঐতিহাসিক সত্য। ছন্দ কাব্যের মধ্যে গতি, তাল, শিল্প, নান্দনিকতা ও সুষমা এনে দেয়। কবিতাকে গীতিময় ও গতিময় করতে ছন্দের কোনো বিকল্প নেই। কবিতার ছন্দ পতন হলে সমস্ত মাধুর্য নষ্ট হয়ে যায়। ছন্দের কারণে ধ্বনির মধ্যে এক ধরনের তরঙ্গ তৈরি হয়। ছন্দ একটি শিল্পকর্ম। গান শেখার প্রাথমিক হাতেখড়ি হারমোনিয়াম দিয়ে করা হয়। হামোনিয়ামের প্রাথমিক সা রে গা মা ---স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত। সুরের ঝংকার তুলতে প্রাচীনকাল থেকেই ছন্দের ব্যবহার লক্ষনীয়। চর্যাপদের মধ্যে ১৬ মাত্রার সংস্কৃত পাদাকুলাক ছন্দের প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। পদ্যের মতো গদ্যেরও ছন্দ আছে। সে ছন্দের পরিমাপ লেখকের ধ্বনি রসবোধের ওপর নির্ভর করে। তবে গদ্য ছন্দের একটি বিশেষ সুবিধা হলো এই যে এই ছন্দের কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। উচ্চারিত ধ্বনিগুলোর ভারসাম্য রক্ষার্থে গদ্য ছন্দের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
যাহোক গদ্য সাহিত্যের বহুমাত্রিক রূপ বিকশিত হয় রবীঠাকুরের ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে। সাধারণত উপন্যাস, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, গল্প, ভ্রমণ কাহিনী ইত্যাদি গদ্য আকারে লেখা হয়। তবে বর্তমানে গদ্য কবিতার চর্চা চলছে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে। অনেকে মনে করেন যে পুঁথিগাঁথা ও পালাগান থেকে পদ্য ছন্দের সৃষ্টি। ছন্দ যেখান থেকেই সৃষ্টি হোক না কেন ছন্দ কবিতার জনপ্রিয়তা প্রাচীনকালে ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতে থাকবে। ছন্দ কবিতা বা পদ্য কাব্য রচনা করতে হলে কবিকে কাব্যের ব্যাকরণ জানতে হয়। কোন মাত্রা, কত মাত্রা এবং কোন ছন্দে লেখা হবে সেটা কবিকে অবশ্যই জানতে হবে। এখানে একটি বিষয় বলে রাখা দরকার যে শুধু অন্তমিল করে লিখলেই সেটা পদ্য কাব্য হয় না। সঠিক ছন্দ ও মাত্রা বিন্যাসে রচিত না হলে সে কাব্য সাহিত্যের মর্যাদা পায় না। এ বিষয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী ব্যাখ্যা আমি দেব।
বর্তমানে যারা ছন্দ, মাত্রা, অন্তমিল দিয়ে কাব্য চর্চা করেন তাদের অনেকেই কবি বলতে নারাজ। তারা তাদের ছড়াকার বলতেই পছন্দ করেন। কিন্তু এখানে একটি বিভ্রান্তি থেকে গেছে আর সেটা হলো ছড়াকার ও কবির মধ্যে তাত্ত্বিক পার্থক্য। একটি কথা পরিষ্কার করে বলতে চাই, সব ছড়াকারকে কবি বলা গেলেও সব কবিকে কিন্তু ছড়াকার বলা যায় না। যারা গদ্য কাব্য চর্চা করেন তাদের ছড়াকার বলার সুযোগ নেই। কারণ গদ্য কাব্যের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো কাব্যিক বিধান তাদের মানতে হয় না। আমাদের মনে রাখা দরকার যে কাব্যিক ছন্দ, তাল এবং লয় পাঠক হৃদয়ে আনন্দের রসাত্মক ঝড় তোলে। ছন্দ মাত্রায় লেখা কাব্যের আবৃত্তি শুনতে সবার ভালো লাগে। যাহোক কাব্যের গদ্যরীতির দিকে আধুনিক কবিরা অনেক বেশি ঝুঁকে পড়েছেন এবং এর ফলে দুটি সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। প্রথমটি হলো কবিরা কাব্যের ছন্দ, মাত্রা এবং ব্যঞ্জনিক শব্দচয়ন সম্পর্কে দিনে দিনে অজ্ঞ হয়ে উঠছেন এবং দ্বিতীয়টি হলো কাব্য নতুন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। অতিমাত্রায় গদ্য কাব্য নির্ভরতা কবিদের ছন্দমাত্রার প্রতি উদাসীন করে তুলছে। একটি ছন্দ মাত্রার কবিতা রচনা করতে চরম পরিশ্রম করতে হয় কবিকে। কবির সহজাত মেধা ছাড়া এ ধরনের কাব্য রচনা করা যায় না। গদ্য কাব্য যেহেতু রীতির গন্ডিতে আবদ্ধ নয় তাই যে কেউ দুকলম লিখে কবিবনে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। আধুনিক যুগে গদ্য কাব্যে তাই শুরু হয়েছে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা। যে যার খুশিমতো লিখে যাচ্ছে, বই ছাপাচ্ছে কিন্তু কাব্যের বহুমাত্রিক উন্নয়নে তাদের তেমন ভূমিকা দৃশ্যমান নয়। আমার বেশকিছু কবির সঙ্গে পরিচয় আছে যারা গদ্য রীতিতে কাব্য লেখেন। তাদের বক্তব্য হলো গদ্য কাব্যে কোনো নিয়মের বালাই নেই তাই তারা মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখতে পারে। কিন্তু তাদের কাব্য সম্পর্কে যে ধারণা সেটি অনেক দুর্বল। গদ্য কাব্য চর্চার বা লেখার কোনো নির্দিষ্ট ধরন বা প্যাটার্ন নেই এ ধরনের বক্তব্য তারা কোথায় পেল? বাংলা সাহিত্যে ছন্দ কাব্যের অনেক বেশি গবেষণা হয়েছে যেটা গদ্য কাব্যে হয়নি। যার কারণে গদ্য কাব্যের বিকাশে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। মিত্রাক্ষর ছন্দে কবিরা লিখেছেন যুগের পর যুগ ধরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, ফররুখ আহমদ, জীবনানন্দ দাশ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তসহ অনেকে। মিত্রাক্ষর ছন্দের ঝংকারে তাদের লেখনীগুলো একদিকে যেমন পাঠক হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে, অন্যদিকে কাব্যকে বিশ্বসভায় এক অনন্য মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে। বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে তাদের কালজয়ী এসব কাব্য।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের সব সাহিত্যে আমূল পরিবর্তন এসেছে। বাংলা সাহিত্যেও আমরা ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করি। ছন্দমাত্রার কাব্যে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা কবিদের নতুনত্বের দিকে ধাবিত করছিল। যার ফলে বাংলা সাহিত্যে আর্বিভাব হলো পঞ্চ পান্ডবের। এ পান্ডবরা রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত হয়ে আধুনিক ধারার সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেছিল। এরা হলেন অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।
মিত্রাক্ষর ছন্দের দাপট চলেছে ১৯ শতক পর্যন্ত। ইংরেজি সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের সফল প্রয়োগ ঘটান জন মিল্টন তার প্যারাডাইস লস্ট মহাকাব্যে। আর বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের এক ঐতিহাসিক প্রয়োগ ঘটান মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তার লেখনীর মাধ্যমেই গদ্য কাব্য এক অনন্য রূপ লাভ করে। তবে তিনি গদ্য কাব্যকেও বিশেষ মাত্রা বিন্যাসে সাজিয়েছেন। ১৪ মাত্রায় ১৪ চরণের সনেট রচনা করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রবাদপুরুষ হয়ে আছেন। পঞ্চ পান্ডব কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তার অর্কেস্ট্রা কাব্য গ্রন্থের শাশ্বতী কবিতায় লিখেছেন---
একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী
একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণীজুড়ে
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি।
কালজয়ী এমন হাজারো লেখায় সমৃদ্ধ হয়েছে কাব্য। তাই যারা বলেন গদ্য কাব্যে কোনো নিয়মের বালাই নেই তারা ভুলের জগতে বাস করছেন। গদ্য কাব্যের ভাবার্থ অনেক গভীর, শব্দচয়ন অনেক তীক্ষ্ন, পদবিন্যাসে আছে বিশুদ্ধতা আর লেখায় আধুনিকতার ছোঁয়া। শোষণের বিরুদ্ধে কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন, 'আজ আমার কাছে কোনো কিছু আর ফেলনা নয়, ভাত দে হারামজাদা, তা নাহলে মানচিত্র চিবিয়ে খাবো।' কবিতা কবির জীবন খেয়ে বেঁচে থাকে। সেটা পদ্য কবিতা হোক বা গদ্য কবিতা হোক। কাব্যের গদ্য বা পদ্য দুটি ধারার কোনোটিকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। তবে নান্দনিক শব্দচয়নে ছন্দ মাত্রার কাব্যের সংখ্যা কমে যাওয়ায় কবিতা আবেদন হারাচ্ছে ক্রমশ যা দিবালোকের মতো সত্য। কবিতার প্রতি এক ধরনের অনীহা তৈরি হচ্ছে পাঠকমহলে। পাঠকদের মধ্যে জরিপ করে দেখা গেছে যে ভিন্ন চিত্র। তাদের বক্তব্য হচ্ছে তারা আধুনিক ধাঁচের কবিতা বুঝতে পারে না দুর্বোধ্য শব্দের কারণে। তাই তারা মজা পায় না। তাছাড়া ছন্দমাত্রা না থাকায় তারা কাব্য রসের স্বাদ পায় না।
ছন্দ কাব্যগুলো সাধারণত তিনটি মাত্রায় রচিত হয়ে থাকে। সেগুলো হলো স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত এবং অক্ষরবৃত্ত। এই তিন ধরনের মাত্রায় রচিত হয়ে থাকে কাব্যের বিভিন্ন ধরন। যেমন- ছড়া, রুবাই, ক্বাসিদা, লিমেরিক, হাইকু, চর্তুদশপদী কবিতা, গজল, অনুকাব্য, পরমাণু কাব্য, লতিফা, সনেট, তানকা, গীতিকাব্য, নাট্যকাব্য ইত্যাদি। ব্যাকরণ মেনে কবিতা লিখলে সেটার আবৃত্তি যেমন শুদ্ধ ও প্রাণবন্ত হয়, তেমনি সেটা মৌলিক রূপ লাভ করে। ছন্দ কবিতা বোঝার জন্য বুঝতে হবে মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর। যে অক্ষর উচ্চারণে শ্বাস আটকায় না সেটাকে মুক্তাক্ষর বলে। যেমন- ক, ল, মা, পা, ইত্যাদি। এগুলো উচ্চারণে শ্বাস কোথাও আটকায় না। অন্যদিকে যে অক্ষর উচ্চারণে শ্বাস আটকে যায় বা বাধাগ্রস্ত হয় সেটাকে বলে বদ্ধাক্ষর। যেমন খাল, তাল, মাল ইত্যাদি। একটু খেয়াল করুন খাল উচ্চারণে শ্বাস বাধাগ্রস্ত হয়। তাই এটি বদ্ধাক্ষর। মাত্রা বোঝার ক্ষেত্রে সিলেবল বোঝা খুব জরুরি। একটি শব্দকে ভেঙে ভেঙে বোঝানোর প্রক্রিয়াই হলো সিলেবল। যেমনঃ বসন্ত (ব সন ত), পড়ন্ত (প রন ত)। স্বরবৃত্ত ছন্দে মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর উভয়ই ১ মাত্রা। অর্থাৎ মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা পাবে এবং বদ্ধাক্ষরও ১ মাত্রা পাবে। যেমন: কলম।
শব্দটিকে ভাঙলে দাঁড়ায় ক লম। এখানে ক হলো মুক্তাক্ষর এবং ১ মাত্রা। আবার লম হলো বদ্ধাক্ষর এবং এটিও ১ মাত্রা। যেমন,
শরতের ঐ/নীল গগনে/সাদা মেঘের/ভেলা
মিষ্টি বাতাস/আছড়ে পড়ে/কাশফুল করে/খেলা।
এখানে মাত্রা বিন্যাস হলো ৪+৪+৪+২। স্বরবৃত্ত সাধারণত ৪ মাত্রার চালে চলতে পছন্দ করে। তাই ৪ মাত্রা করে এক একটি পর্ব করতে হবে। মাত্রাবৃত্তের মূল পর্বগুলো ৪/৫/৬/৭/৮ হতে পারে। মাত্রাবৃত্তে মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা এবং বদ্ধাক্ষর ২ মাত্রা। যেমন: কলম। এখানে ক হলো মুক্তাক্ষর। তাই এটি ১ মাত্রা। লম হলো বদ্ধাক্ষর। তাই এটি ২ মাত্রা। যেমন-
কালের চক্রে আবির্ভাব যে দাম্ভিকদের দল
নিজের কর্মে নিজেরাই হয় দুনিয়ার বড় খল।
এখানে মাত্রা বিন্যাস দাঁড়াল ৬+৬+৬+২।
অক্ষরবৃত্তের মূল পর্বগুলো সাধারণত ৮ বা ১০ মাত্রার হয়। এ ছাড়া ৮+৬, ৮+৪, ৮+২ হতে পারে। সনেটে ৮+৬ মাত্রা ব্যবহৃত হয়।
অক্ষরবৃত্তে মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা। তবে বদ্ধাক্ষরের ক্ষেত্রে নিয়ম একটু ভিন্ন। শব্দের শেষে বদ্ধাক্ষর থাকলে ২ মাত্রা। যেমন: কলম (ক/১ লম/২)। এখানে লম বদ্ধাক্ষরটি শব্দের শেষে আছে তাই ২ মাত্রা।
অনুরূপভাবে: বালক, চালক, মলম, ইত্যাদি।
বদ্ধাক্ষর যদি শব্দের প্রথমে বা মধ্যে থাকে তাহলে সেটা ১ মাত্রা পাবে। যেমনঃ লোকটি ( লোক/১ টি/১) =২ মাত্রা। এখানে লোক বদ্ধাক্ষরটি শব্দের প্রথমে আছে তাই ১ মাত্রা। অনুরূপভাবেঃ ঘাটতি, বালতি, কাটতি ইত্যাদি। আবার বদ্ধাক্ষর শব্দের মধ্যে থাকলে ১ মাত্রা পাবে।যেমনঃ বসন্ত ( ব /১ সন/১ ত/১) =৩ মাত্রা।
এখানে সন বদ্ধাক্ষর এবং এটি শব্দের মধ্যে থাকায় ১ মাত্রা পেয়েছে। অনুরূপভাবে: পড়ন্ত, বাড়ন্ত ইত্যাদি। যেমন,
হে আমার মাতৃভূমি জানাই প্রণাম,
ত্রিশ লাখ মানুষের রক্তের ই দাম
এখেনে মাত্রাবিন্যাসঃ ৮+৬।
ছড়াকার ও কবিগন যে কোনো মাত্রায় লিখতে পারেন। বর্তমান যুগের কবিদের মধ্যে আরেকটি ভুল ধারণা আছে। সেটা হলো কাব্যে সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণ করা যায় না। গদ্য কাব্যে এটা সঠিক। তবে মাত্রাযুক্ত পদ্য কাব্যে সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণ হতে পারে। মাত্রা মিলানোর জন্য কবিরা এই স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। এখানে একটি প্রাচীন পরিচিত কবিতা তুলে ধরছি যেখানে মাত্রা সঠিক বিন্যাসের জন্য সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণ হয়েছে।
সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
\হসারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।
রবিঠাকুরের একটি কবিতায় সাধু ও চলিতের মিশ্রণ দেখা যায়।
\হহেনো কালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা
\হকেরোসিন শিখা বলে এসো মোর দাদা।
কাব্যকে পাঠক প্রিয় করতে হলে কবিদের ছন্দ বিন্যাস, মাত্রা, শব্দ চয়ন, অনুপ্রাস, অন্তমিল, ব্যঞ্জনা, মুক্তক ছন্দ, মিত্রাক্ষর ছন্দ, অমিত্রাক্ষর ছন্দ, স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত এবং অক্ষরবৃত্ত সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে হবে এবং স্বচ্ছ ধারণা নিতে হবে।