রাত গভীর হওয়া মানেই ভয়ে তার শরীর মন কুঁচকে যাওয়া। কেবল এক রাতের ব্যাপার নয়- রাতের পর রাত চলছে এমন পরিস্থিতি। দাম্পত্যজীবনে রাত কারও কারও জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। আবার কারও কারও জীবনে নরক-যন্ত্রণা সৃষ্টি করে। সোহাগ রাত, কালরাত, বেদনার রাত, শোক ও বিরহের রাত, জ্যোৎস্নাস্নাত বা ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত, ঝড়ের রাত, বৃষ্টিমুখর রাত- এমনি নানারকম রাত এসে হাজির হয় মানুষের জীবনে। কিন্তু রেবেকার জীবনে যে রাত আসে তা কেবল অত্যাচার নির্যাতন আর আতঙ্কের। যার কারণে সে রাতের চেয়ে দিনকে বেশি পছন্দ করে। অথচ যারা সারাদিন কর্মব্যস্ত থাকে, রাত তাদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মন ও শরীর চায় শান্তি, স্বস্তি, বিশ্রাম, ঘুম। কিন্তু এই স্বাভাবিক প্রত্যাশার বাইরে রেবেকার জীবন। স্বামী সংসারে থাকা সত্ত্বেও কারও রাত যদি এমন হয় তাহলে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। রেবেকার জীবনও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এই জীবন থেকে সে এখন পালাতে চায়। কিন্তু জীবন থেকে পালানো যেমন সহজ কাজ নয়, আবার সবাই পালাতেও পারে না। কেউ কেউ জীবনের পরিসমাপ্তি টানার মাধ্যমেও জীবন থেকে পালায়। যা জীবনের কোনো সমাধান নয়।
রেবেকা সুলতানা তার এই দুঃসহ জীবনের সমাধান চায়। চায় এ জীবন থেকে দ্রম্নত মুক্তি। কারণ এভাবে চলতে থাকলে ধীরে ধীরে তার জীবন এমনিতেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। অনেক প্রত্যাশা নিয়ে সজীবকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সে, তখন দুচোখ ভরে স্বপ্ন ছিল, নতুন জীবনের স্বপ্ন, নতুন ঘর বাঁধার স্বপ্ন। বিয়ের অল্প দিনের মধ্যেই সে স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। সজীব যেন অচেনা-অজানা অন্য এক মানুষ। আগের ভালোবাসাপ্রবণ সজীবকে সে কিছুতেই শনাক্ত করতে পারছে না। লোকটাকে বড় অচেনা মনে হচ্ছে তার। সজীবের সঙ্গে প্রথম বিরোধ শুরু হয় শোকরিয়া যখন পেটে আসে। প্রথম সন্তানের আগমন বার্তায় খুশির পরিবর্তে ভীষণ বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হয়েছিল সজীব। 'আমার কি পিতা হওয়ার বয়স হয়েছে, পিতা হতে গেলে তো মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়। এ কোন সর্বনাশ তুমি করলে' বলেই রেবেকার গালে একটা চড় কষিয়ে দেয় ও। এ ঘটনায় রেবেকার মনে হয়েছিল তার স্বপ্ন-সম্ভাবনা ভালোবাসা সবকিছু তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। সপ্তাহখানেক পর রেবেকা বমি করে যখন মেঝে নোংরা করে ফেলল এবং বেসামাল অবস্থায় সজীবের পিঠের ওপর চিৎ হয়ে হেলান দিল, তখন ওর মেজাজ যেন আকাশসীমায় উঠল। এবার সে রেবেকার নাক বরাবর ঘুষি মারল। ওর নাক ফেটে রক্ত বের হলো। পরপর দুটো ঘটনাকে সে কীভাবে মূল্যায়ন করবে, ভেবে পেল না।
পরিবারের অমতে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সজীবকে। বিয়ের মাত্র দেড় বছরের মাথায় তার প্রতিদান পেল সে। বাবা সজীবকে দেখে বলেছিল, 'এ ধরনের ছেলেরা সাধারণত কালো মেয়ে পছন্দ করে না, ভালোবাসার টান যতই থাকুক না কেন, এক সময় মোহভঙ্গ হবেই।' বাবার কথা আমলে নেয়নি রেবেকা। প্রেম তো প্রেমই, এর আবার মোহভঙ্গ কী' এই সরল দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গিই তার কাল হয়ে দাঁড়াল। প্রেম কিংবা ভালোবাসার যে মোহভঙ্গ পর্ব আছে, আছে নির্যাতন পর্বও এটা রেবেকা ভুলেও কল্পনা করতে পারেনি, তার দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার সীমাবদ্ধতার কারণে।
প্রথম সন্তান পেটে আসার পর থেকেই তার ভালোবাসার সংসার পরিণত হলো যন্ত্রণার আধারে। সজীবের মা হিজাব খাতুন যেদিন প্রথম রেবেকাকে গণবিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দেখতে যান, সেদিন ওকে দেখে তার স্বপ্নভঙ্গ হয়, মনটা কুঁচকে যায়। সজীবের পছন্দ করা মেয়েকে দেখে তিনি বলেছিলেন, 'এই মায়ার শরীরে দি কিছু নাই, শুকনা কাঠ, আবার কালো- এ্যারে কী দেইখা পছন্দ করলি বাবা।'
রেবেকা তখন ক্যান্টিনে খাবারের জন্য বসেছিল। খাবার রেখে সে বারান্দায় নির্জন জায়গায় চলে গেল সে এবং অঝোর ধারায় কান্না শুরু করে দিল। কান্নারত অবস্থায় তার একটি কথাই স্মরণে এলো, সে যাকে ভালোবেসেছে তার মা তাকে বর্ণবাদী ও শরীরী আঘাত করল। বিয়ের আগেই যদি এমন ঘটনা ঘটতে পারে, তা হলে বিয়ের পর আরও নানা ধরনের অপ্রত্যাশিত ও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতেই থাকবে। কারণ ও মায়ের একান্ত অনুগত ছেলে। সুতরাং এর পরিসমাপ্তি এখানেই হওয়া উচিত। রেবেকা যখন সজীবের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হলো তার পরের দিন ও ওর বিভাগে এসে হাজির। মায়ের অশোভন আচরণের জন্য রেবেকার কাছে ক্ষমা চাইল সজীব। ওর ব্যবহারে রেবেকার মন গলে গেল। রেবেকার তখন এটা মনে হলো না যে, সজীব আর তার মা এক নয়। মা ও ছেলে ভিন্ন সত্তা, ভিন্ন মেজাজ ও মানসিকতার। প্রেম ভালোবাসা মুগ্ধতা বলে কথা। তাই রেবেকা এসব খেয়াল করল না।
রেবেকা যেহেতু স্বাধীনচেতা তাই বাবা-মায়ের মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে সজীবকে বিয়ে করল সে। বিয়ের পর থেকে ভিন্ন চরিত্রের ও মেজাজের একজন তরুণকে সে আবিষ্কার করল। রেবেকার ইচ্ছা-অনিচ্ছা তার কাছে কোনো গুরুত্ব নেই। রেবেকার মনের খবরও নিতে আগ্রহী নয়, তবে ওর শরীরের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ রয়েছে, যা ধীরে ধীরে রেবেকার কাছে নির্যাতন আর ঘৃণায় পরিণত হয়।
রেবেকা মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। অন্য দশজন উচ্চ শিক্ষিত মেয়ের মতো প্রদর্শন করতে চায় তার দক্ষতা ও যোগ্যতা। যার কারণে সে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগে শিক্ষকতার চাকরি নিয়েছে। কিন্তু তার চাকরি করাটাকে সজীবের পরিবার মেনে নিতে পারছে না। একদিন তো ওর শ্বশুর ইলস্নত শিকদার বলেই ফেলল, 'বউমা তোমার চাকরি করার দরকার নেই। তুমি সংসার সামলাও। প্রতিদিন রাত করে বাড়িতে ফেরাটা আমি পছন্দ করি না। কোনো ভদ্র ঘরের বউরা সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকে না।'
শ্বশুরের কথার মধ্যে একই সুর লক্ষ্য করেছে সে। যে কথা সজীব ও সজীবের মা প্রায়ই তাকে বলে থাকে। এ ক্ষেত্রে সজীবের বিপরীতমুখী চরিত্র। একদিকে রেবেকাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলবে অন্যদিকে তার বেতনের টাকা নানা অজুহাতে হাতিয়ে নেবে সে। নিরুপায় রেবেকা মা ও বোনের সাহায্যে হাত খরচ চালায়। ঘটনার এখানেই শেষ নয়, বাসার যে আলমারিতে সে টাকা রাখে এবং প্রতিদিনের খরচ ওখান থেকেই নেয়। ওই টাকার সঠিক হিসাব সজীব কখনো রাখতে পারে না। ফলে এক মাসের মধ্যে অন্তত তিন-চারবার অর্থ বিষয় গোলযোগ নিজের মধ্যেই বেঁধে যায় তার। তখন তার মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়, আলমারি থেকে রেবেকাই টাকা চুরি করে। এ ব্যাপারে রেবেকাকে জিজ্ঞেস করলে ওর স্পষ্ট মতামত ও টাকা নেয়নি। রেবেকার কথা বিশ্বাস করে না সজীব। ও তাকে চোর সাব্যস্ত করে। এমনকি আজেবাজে ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে মানসিক নির্যাতন করে। সজীব টাকা চুরির অভিযোগ যে একদিন এনেছে তা নয়। ব্যক্তিগত খরচের হিসাব মেলাতে না পারলেই রেবেকাকে দোষারোপ করে সে। অথচ রেবেকা সজীবের অজান্তে কোনোদিনই টাকা নেয়নি। সজীবই তো তার উপার্জনের সব টাকা নিয়ে যায়, ওর নেওয়ার সুযোগ কোথায়?
ইদানীং রেবেকার প্রতি সজীবের সন্দেহটা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ও কোথায় আছে কী করছে এ নিয়ে দিনে অন্তত ১০ বার ফোন দেবে। বাসায় এলে ব্যাগ ফোন চেক করবে। ফেসবুক, কললিস্ট ইত্যাদি দেখবে। বনানী ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার পর ঘন ঘন ফোন দেবে সে। রেবেকা অন্য কারও সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে কি না, এটাই তার সন্দেহ।
ডেমরা থেকে বনানী প্রতিদিন যাতায়াত করা একজন পুরুষের জন্যই ভয়ানক দুর্ভোগ আর কষ্টের কাজ। নারীর জন্য তো আরেক ভয়ানক। যানজটপূর্ণ এই দূরের পথের যাতায়াতজনিত ধকল সামাল দেওয়া রেবেকার জন্য অত্যন্ত কঠিন। প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা চলে যায় রাস্তায়ই, এর মধ্যে যানজট থাকলে তো কথাই নেই। কোনো কোনো দিন ৬ ঘণ্টাও লেগে যায়। যানজটে আটকে থাকাটা সজীবের কাছে কোনো যুক্তিনির্ভর অজুহাত নয়। রেবেকা যতই সজীবকে বলুক না কেন, দীর্ঘসময় সে যানজটে আটকে ছিল, সজীবের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।
সজীবের মধ্যে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে যানজট এটা একটা অজুহাত মাত্র। আসলে রেবেকা বন্ধু বা প্রেমিকের সঙ্গে আড্ডা মেরে অথবা শরীর বিলিয়ে বাসায় ফেরে। রেবেকা বাসায় যেদিন দেরিতে ফেরে সেদিন ওর ওপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন। শারীরিক নয়, মানসিক। তবে মানসিক নির্যাতন অনেক সময় শারীরিক নির্যাতন ছাপিয়ে যায়। সজীবের অপমানজনক কথা সহ্য করতে না পেরে ও একদিন বলেছিল 'তোমার সংসার আমি করব না।' রেবেকা এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সজীব তার গলা টিপে ধরেছিল। বলেছিল 'সংসার করবি না খুন কইরা ফালামু।' সজীবের এ ধরনের আচরণ ওর মধ্যে ভয় ঢুকে গিয়েছিল। যে নিষ্ঠুর সেসব কিছুই করতে পারে। স্ত্রী-সন্তান আপনজন তার কাছে তুচ্ছ। সজীবকে এমনটাই মনে হয় ওর।
ইদানীং সজীব, তাকে অদ্ভুত সব প্রশ্ন করে যার জবাব তার কাছে নেই। তুমি কী কারও সঙ্গে মানসিক অথবা শারীরিকভাবে জড়িয়ে পড়েছ। যদি জড়িয়ে থাক তাহলে তার ফল ভালো হবে না। কী সব বলছে সজীব ওকে। একদিন শারীরিকভাবে কারও সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত হয় সে কোনো রকম প্রমাণ ছাড়াই। তাই একদিন গভীর রাতে শোকরিয়া ও জিদানকে এক রুমে বন্দি করে অন্য রুমে জোর করে নিয়ে যায় রেবেকাকে। নেওয়ার সময় বলে 'মাগি আজ তোর শরীরে কত খাই আছে মিটিয়ে দেব।' তার পর রাতভর তার শরীরের ওপর নির্যাতন করে সে। কোনো নারীকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে বখাটেরা রাতভর যা করে, ওর কাছে ঘটনাটি তেমনই মনে হলো। একদিন ভালোবেসে সে তাকে বিয়ে করেছিল পরিবারের অমতে, এ কথাটা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে তার। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা আজ তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। সামনে সে যা দেখতে পাচ্ছে সবই অন্ধকার। সন্তান দুটোর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছে সে। অথচ তার ভবিষ্যতের দিনগুলো স্বপ্নময় হোক এটাই চায় সে। কিন্তু চাইলেই কি সবকিছু সম্ভব?
এমন আচরণ সজীব এক মাসে অন্তত চার রাত করেছে। যারা মদ্যপ স্বামী তারা স্ত্রীর সঙ্গে এমন আচরণ করতেই পারে বেসামাল অবস্থায়। রেবেকা যেটুকু জানে সজীব পান সিগারেট মদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ওর কোনো আসক্তি নেই। তাহলে হঠাৎ তার মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন এলো কেন। সে যদি তার আট বছরের যৌন জীবনকে সামনে আনে, তা হলে তার সামনে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সজীব কখনো এ ধরনের কামুক প্রকৃতির পুরুষ নয়। এক ধরনের যৌন ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে মাত্র।
ওর এক বান্ধবীর সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করে। বান্ধবী ওকে বলে নিশ্চয় সজীব যৌন উত্তেজক কোনো বড়ি সেবন করেছে। মূলত তোর প্রতি সন্দেহ আর জিদ থেকে এটা করেছে। এটা কোনো স্বাভাবিক যৌন জীবন নয়- স্ত্রীর প্রতি এক ধরনের প্রতিশোধকমূলক আচরণ। বান্ধবীর এ কথা শোনার পর রেবেকা তার দাম্পত্য জীবনের আরও কিছু ঘটনা ওকে বলে।
ইদানীং প্রতিরাতেই ওর কাছে যেতে হবে। ও সাধারণত নাইটি পরে ঘুমাতে যায়। কিন্তু ওর কাছে যেতে হবে শাড়ি পরে রীতিমতো সেজেগুজে। প্রসাধন মাখিয়ে। ও এক এক করে রেবেকার শরীরের পোশাক খুলবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে একদিকে যেমন ওর আকর্ষণ জাগে না একইভাবে যৌন তাড়নাও কাজ করে না। ওর বান্ধবী এ ধরনের ঘটনা কখনো শোনেনি, এ ঘটনাকে সে উন্মাদের কাজ বলে অবহিত করল। রেবেকার জীবনটা এমন, অন্যের জীবনের সঙ্গে সে নিজেকে মেলাতে পারে না। তার এখন কী করা উচিত সে ভেবে পাচ্ছে না। সজীবকে সে বারবার অনুরোধ করেছে অন্তত রোববার আর বুধবার রাতে তাকে যেন সে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দেয়। কারণ এ দুদিন তার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত টানা ক্লাস থাকে। রেবেকার কথাকে আমলে নেয় না সজীব। এর সরল অর্থ হচ্ছে রেবেকার প্রতি তার কোনো সহানুভূতি-সহমর্মিতা ভালোবাসা নেই। যা আছে তা হচ্ছে নিষ্ঠুরতা অমানবিকতা।
ঢাকার যানজটে যখন আটকে থাকে, বাসায় ফেরার তাড়া তার ভেতর যখন কাজ করে তখন সজীবের ফোন আসে। অকথ্য ভাষায় দুটো গালি দেয় ওকে। অফিস দেড় ঘণ্টা আগে শেষ হওয়ার পরও কেন সে বাসায় ফেরেনি। কার সঙ্গে কোথায় সে ফষ্টিনষ্টি করছে। সজীবের কথা শুনে উত্তর দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলে সে। বাসের জানালা দিয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা করে সে। আলো-আঁধারির নাগরিক আকাশে বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি পাখি উড়ছে। মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে পাখিরা। ওর মনে এলো যারা উড়ে সামনে যাচ্ছে, তারা কি পেছনে ফিরছে। রবীন্দ্রনাথ বলাকা কাব্যে যে গতির কথা বলেছেন সে গতিমানে পেছনে ফেরা না। কিন্তু তার জীবন তো কেবল পেছনের দিকে টানছে।
বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল, মেয়ে সংসারি হলেও নিজের পায়ে দাঁড়াবে। উচ্চশিক্ষা নিয়ে সমাজ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করবে। রেবেকাও চেয়েছিল তাই। এতদিন সজীব ও তার মা চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছে। আর এখন শ্বশুর নিজে ডেকে নিয়ে বললেন। এর মধ্যে শাশুড়ির স্থায়ী কাজের বুয়াটা চলে গেছে। অসুস্থ শাশুড়ির সেবা করার জন্য লোক দরকার। এজন্য উপযুক্ত রেবেকা। চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি সংসারী হওয়ার অর্থ সে বুঝতে পারছে।
তার যে আয় তাতে ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে আলাদা থাকতে পারে। কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। প্রথমত সজীব ওদের যেতে দেবে না। দ্বিতীয়ত ভঙ্গুর পরিবারের সন্তানরা পরিচয় সংকটে ভোগে। সামাজিকভাবে তাদের ছোট করে দেখা হয়। তাহলে এখন কী করবে রেবেকা?
এই শহরে তার মতো হাজার হাজার নির্যাতিতা নারী রয়েছে যারা সংসার ও জীবন টিকিয়ে রাখার জন্য সব ধরনের অত্যাচার-নির্যাতন নীরবে সহ্য করছে। তা হলে নারীর প্রতিবাদ ও স্বাধীনতার জায়গাটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কোথায়? এই প্রশ্ন যখন তার মধ্যে জাগ্রত হলো, তখন বাসের মধ্যে একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, 'জানেন মাত্র ১০ টাকার জন্য বউকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে এক পাষন্ড স্বামী। বুঝুন আমরা কোন সমাজে বসবাস করছি।'
ভদ্রলোকের ক্ষোভ ও আক্ষেপ মিশ্রিত কথা রেবেকার কানে পৌঁছেছে কি পৌঁছেনি সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয় রেবেকা। সম্ভবত ওই সময়ে সে অতীতে ফিরে গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সজীব তাকে স্বপ্ন দেখাত এক সুন্দর সংসারের। যেখানে সুখ আর প্রশান্তির খেলা চলে অহর্নিশ।