মখতার লুবিস কথাসাহিত্যের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর
প্রকাশ | ০৯ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
সরকার মাসুদ
মখতার লুবিসের (৭ মার্চ ১৯২২ - ২ জুলাই ২০০৪) প্রধান পরিচয় তিনি একজন কথাসাহিত্যিক। গৌণ পরিচয় তিনি সাংবাদিক। পঞ্চাশের দশকে 'ইন্দোনেশিয়া রায়া' নামে একটি পত্রিকা বেরোত জাকার্তা থেকে। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত লুবিস ওই কাগজটি সম্পাদনা করেছেন। সৃজনশীল লেখার বেলায় যেমন তেমনি তীক্ষ্ন পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ- এই দু'টি বিষয়কে তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন তার সংবাদপত্রসংশ্লিষ্ট লেখালেখির ক্ষেত্রে। পত্রিকাটি ইন্দোনেশিয়ার অভ্যন্তরীণ আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক দুর্দশা তুলে ধরতো জনসাধারণের কাছে। রায়া মানুষের অপকর্ম, অক্ষমতা, পাপ, আত্মম্ভরিতা ও দুর্নীতি অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠভাবে, বলা চলে নিষ্ঠুরভাবে প্রকাশ করেছে বছরের পর বছর। তীক্ষ্ন পর্যবেক্ষণজাত উপলব্ধি এবং সবকিছু নির্মোহ-নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করবার এক দুর্লভ ক্ষমতা মখতারের লেখাতেই প্রথম দেখা গেছে। সে অর্থে তিনি ইন্দোনেশিয়ার আধুনিক কথাকারদের গুরুস্থানীয়। মখতার লুবিস কেবল নিজে ঘনিষ্ঠভাবে চারপাশের সবকিছু দেখছেন এমন নয়, তিনি আমাদেরকেও চোখে আঙুল দিয়ে সেসব দেখিয়েছেন, আমাদেরকে ভাবতেও বাধ্য করেছেন।
ঞরিষমযঃ রহ ঔধশধৎঃধ (জাকার্তায় সন্ধ্যা) বইটির নাম আমি শুনি কুড়ি/বাইশ বছর আগে। তার তিন-চার বছর পর বইটি পড়ার সৌভাগ্য হয় আমার। এটা মখতার লুবিসের সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ। এটাই সেই উপন্যাস যেখানে লেখক নির্যাতন, বিপর্যয়, ধ্বংস, মিথ্যাচার, রুচিবিকৃতি... প্রভৃতির বস্তুনিষ্ঠ ও মর্মন্তুদ ছবি এঁকেছেন। তার কণ্ঠস্বরের বলিষ্ঠতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা এ বইটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
ঞরিষরমযঃ ওহ ঔধশধৎঃধ (১৯৬৩) কোলাজের মতো। অসংখ্য খন্ডচিত্রের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এ উপন্যাস। এসব ছবির যোগসূত্র একটিই, তা হচ্ছে সবধরনের অপকর্ম। লবিসের সমকালে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রিক-সামাজিক জীবনে যে ধ্বংস নেমে এসেছিল, যে বিকৃতির উপাসনা চলছিল সর্বত্র, তারই ভয়াবহ ও বিশ্বাস্য চিত্রাবলি আমরা দেখতে পাই এ গ্রন্থে। কোথাও শান্তি-স্থিরতা নেই। মিথ্যাচার, ভন্ডামি, অবিবেকিতা একটি জাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। মেরুদন্ডহীন অর্থনীতির দশা এমনই নৈরাজ্যব্যঞ্জক, অনাচারের চেহারা এমনই সর্বগ্রাসী যে, এক/দেড় শত ডলার উপার্জনের বিনিময়ে একজন মন্ত্রীর স্ত্রীও বিদেশি পর্যটকের শয্যাসঙ্গীনী হচ্ছেন। এ উপন্যাস যেন সেই আগুনলাগা গৃহ যার বেশিরভাগটাই অগ্নিদগ্ধ। আমরা সবুজ ভালোবাসি। কিন্তু এখানে কোনো সবুজ নেই। প্রকৃতির সবটুকু সবুজ যেন পুড়ে খাক হয়ে গেছে।
১৯৫৬/৫৭ সালের দিকে মখতার 'সিয়াসাদ' নামে একটি সাপ্তাহিক কাগজও প্রকাশ করতেন। ওই সময়ে বা তার কিছু আগে/পরে তিনি বিখ্যাত প্রতিবাদী কবি খাইরিল আনোয়ারকে সঙ্গে নিয়ে লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের একটা দল গঠন করেন। দলটি পরে 'পয়তালিস্নশের প্রজন্ম' নামে পরিচিতি পায়। এ দলের লেখকবৃন্দ কোনো সম্প্রদায় কিংবা গোষ্ঠীর কথা বলেননি, ধর্মের কথা আলোচনা করেননি। তারা ঘুরেফিরে বলেছেন মানবিকতার কথা, বিবেকিতার কথা- যা আমাদের ধর্মেরও মূল কথা। 'আমাদের বিশ্বাস' নামে যে মেনিফেস্টো তারা বের করেছিলেন সেখানে এক জায়গায় আছে, 'পৃথিবীর অগণিত মানবসম্প্রদায়ের ভেতরেই আমাদের জন্ম। আমরা তাই মনে করি, চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে আমরা নতুন ও প্রাণবন্ত একটা পৃথিবীর জন্ম দিতে পারব। এটা মনে রাখা প্রয়োজন, আমরা আমাদের পিঙ্গল গাত্রবর্ণের বা কালো চুলের অথবা সুস্পষ্ট চোয়ালের কারণে ইন্দোনেশীয়। আসল কথা হচ্ছে, আমরা আমাদের চরিত্রের দ্বারা, চিন্তার স্বাধীনতার দ্বারা ইন্দোনেশীয় হয়েছি।' (পৃষ্ঠা-৬, অনুবাদ : লেখক)
সাধারণত উপন্যাসে বা ছোটগল্পে একটা কেন্দ্রীয় চরিত্র থাকে। 'জাকার্তায় গোধূলি' উপন্যাসে তেমন কোনো চরিত্রের দেখা পাই না আমরা। একটা বিশেষ সময়পর্বই এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। স্বাধীনতার পর ইন্দোনেশিয়ায় হঠাৎ বড় রকমের পরিবর্তন এসেছিল। ভালো-মন্দ মিলিয়েই এ পরিবর্তন। মন্দের অংশটাই ভারী ছিল। সেসময় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে ইন্দোনেশিয়ার অবস্থা কোণঠাসা। দেশটি কোনোভাবেই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারছিল না। ওই অসন্তোষজনক পরিস্থিতির যে ছায়া পড়েছিল রাজধানী জাকার্তায় তারই সুস্পষ্ট ও সার্থক রেখাচিত্র এ উপন্যাস। এর কাহিনির মধ্যে অনেকগুলো ছোটগল্প আছে। লেখক খন্ড খন্ড করে ছবি এঁকেছেন। ফলে লুবিস গদ্যভাষায় বিস্ময়কর গতি আনতে পেরেছেন। ভাবদীপ্ত সাবলীলতা তার কথা গদ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ লেখকের ৩/৪টি ছোটগল্প পড়ে আমার মনে হয়েছে, ওই সাবলীলতাকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পেরেছেন ভাষার গাম্ভীর্যকে কাজে লাগিয়ে। মখতার যে ৬/৭টি ভাষা জানতেন সেটাও এক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হয়েছে বলে মনে হয়।
মখতার লুবিসের প্রথম উপন্যাসের নাম অ ৎড়ধফ রিঃয হড় বহফ (যে রাস্তার শেষ নেই)। বইটির প্রকাশকাল ১৯৫২। 'জাকার্তায় গোধূলি' থেকে এ উপন্যাস সম্পূর্ণ আলাদা। বিষয়বস্তুও পুরোপুরি ভিন্ন। কেবল একটা ব্যাপারে অনেকখানি মিল আছে, সেটা হচ্ছে রচনারীতি। ভাষা-শৈলীর দিক থেকে মখতারের উপন্যাস ও গল্পগুলোর ভেতরে পার্থক্য চোখে পড়ে না। অ ৎড়ধফ রিঃয হড় বহফ-এ যে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তা হচ্ছে, ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশদের সাহায্যে ওলন্দাজদের ইন্দোনেশিয়া পুনর্দখলের চেষ্টা। ওলন্দাজরা চুক্তিভঙ্গ করে পুনর্দখলের ওই প্রয়াস চালায়। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন নিরীহ স্কুলশিক্ষক, ইশা। সে শান্তিকামী এবং শান্তিতে থাকতে চায় বাকি জীবন। কিন্তু গোলমাল আরম্ভ হয়ে গেলে সে খুব ভীতু হয়ে পড়ে এবং অসহায় বোধ করে। শান্তিকামী এ চরিত্রটির বিশেষ পরিচয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে উপন্যাসের ঘটনাবলি। ইশার অসহায়তা ও নিঃসঙ্গতা চমৎকার দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক।
আমাদের কথাশিল্পী মাহমুদুল হকের মতো মখতার লুবিসও কবিতার প্রতি আসক্ত ছিলেন। তবে তিনি কাব্যচর্চা করেছেন এমন কথা জানা যায়নি। শুধু তাই নয়, লুবিস কবিতার তুলনায় কথাসাহিত্যকে দুর্বল ও কম প্রভাবসম্পাতী মাধ্যম মনে করতেন। কিন্তু যোগ্য লেখকের হাতে চর্চিত হলে কথাসাহিত্যও যে কতটা সবল ও সংক্রামী হয়ে উঠতে পারে তার সেরা নিদর্শন 'জাকার্তায় গোধূলি' উপন্যাসটি।
দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাষাশিল্প উভয় দিক থেকেই এ গ্রন্থ বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী শ্রেষ্ঠ উপন্যাসসমূহের পঙ্ক্তিভুক্ত হবে। এ বই আমাকে মনে পড়িয়েছে জোনাথন সুইফটকে। কেননা সুইফটের মতো মখতারের গল্প-উপন্যাসেও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও নিষ্ঠুর কৌতুক বিদ্যমান। ঞরিষরমযঃ ওহ ঔধশধৎঃধ (১ম সংস্করণ) প্রকাশিত হওয়ার পর উনপঞ্চাশ বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু উঁচু মানের সাহিত্য হিসেবে এর আবেদন এতটুকুও ম্স্নান হয়নি। লুবিসের কণ্ঠস্বরের বলিষ্ঠতা সবচেয়ে ভালোভাবে প্রকাশিত হয়েছে এ বইটির মাধ্যমেই, আমার এমনই মনে হয়। অ ৎড়ধফ রিঃয হড় বহফ-এ লেখক ইতিহাসের উপাদানসমূহকে বিরল দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। এর সঙ্গে পর্যবেক্ষণী দৃষ্টি ও মর্মগ্রাহী ভাষা যুক্ত হওয়ায় ফলেছে উৎকৃষ্ট মানের সাহিত্যফসল।