সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে আদালতের রায় প্রকাশ হলে, তার প্রতিবাদে কোটা সংস্কার আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। বিষয়টি মনে প্রভাব ফেললে হামিদা বেগম স্মৃতিতাড়িত হয়। সহকর্মী মনোয়ারা বেগম প্রসঙ্গ হয়। তাকে আপা বলে ডাকে হামিদা। একাত্তরের জানুয়ারি মাসে উত্তরবঙ্গে একটি সরকারি কলেজে যোগদান করে মনোয়ারা। মাস দুই চাকরি করার পর সন্তান জন্মদানের জন্য ময়মনসিংহে নিজের বাড়িতে আসে। মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আর কর্মস্থলে ফিরে যায়নি।
সাত মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় হামিদা বেগম রেসকোর্স ময়দানে ছিল। তারপর থেকে দেশের অবস্থা খারাপ হতে থাকলে ১৫ মার্চের দিকে রেলযোগে ময়মনসিংহে পৌঁছেন। ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে বেশ কয়েকবার শেখ মুজিবের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে গিয়েছেন। বঙ্গমাতার হাতের রান্না করা খাবারও খেয়েছেন। ২১ ফেব্রম্নয়ারির কর্মসূচিতে খালিপায়ে কতবার শহীদ মিনারে গিয়েছেন। কিন্তু অবিবাহিত তরুণী বলে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে অংশগ্রহণ করেননি মুক্তিযুদ্ধে।
যুদ্ধ শুরু হলে কেন্দুয়ায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গ্রামের বাড়ি চলে যান। তারপর থেকে নিরাপত্তার জন্য আরও দুর্গম গ্রামে আত্মীয় বাড়িতে কাটান কিছুদিন।
দেশ স্বাধীন হলে মনোয়ারা বেগম কর্মস্থলে যোগদান করেন। হামিদা বেগমও স্বাধীনতার পরপরই সরকারি কলেজে যোগদান করেন। কিছুদিনের মধ্যে মনোয়ারা বেগমও উত্তর বঙ্গ থেকে বদলি হয়ে একই কলেছে নিয়োজিত হয়। তখন থেকেই হামিদা বেগমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আরো বাড়ে। হামিদা বেগমের বাবা ময়মনসিংহে কর্মরত থাকা কালে মনোয়ারাদের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। বিহারি এক বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার ছিল তার বাবা। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিহারি ব্যবসায়ী তার ব্যবসা গুটিয়ে ভারতে চলে যায়। পানির দামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি দেয় মনোয়ারার বাবাকে। সুযোগ সন্ধ্যানী বাবা স্বাধীনতার পর হয়ে উঠেন শহরের বড় ব্যবসায়ী। তেমনি তার মেয়ে। চাকরিতে নানা সুবিধা গ্রহণের জন্য মনোয়ারা বেগমের জুড়ি নেই।
সুযোগ বুঝে সন্তান জন্মদানের জন্য চলে আসাকে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগী বলে যুদ্ধের সময়কালটি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করিয়ে নেয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চাকরিতে দুই বছরের সিনিয়রিটি নিয়ে যেমন আর্থিক সুবিধা পায়, তেমনি পদোন্নতিও বাগিয়ে নেয়। সময় অনুকূলে এলে ছেলে মেয়েদেরও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরির সুবিধা নেয়। মনোয়ারা বেগম আশি অতিক্রম করেছে। তার নাতি-নাতনিও ভোগ করে সেই সুবিধা।
হামিদা বেগমের মনে প্রশ্ন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের যথাযথ সম্মানসহ যাবতীয় সুবিধা পাবেন, তা তিনিও কামনা করেন। তবে মনোয়ারা বেগমের মতো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা যে রাষ্টীয়, সামাজিক এবং আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে যাচ্ছে, সেসব মেনে নিতে কষ্ট হয়। মুক্তিযুদ্ধে তার বা তাদের পরিবারের নূ্যনতম অবদান নেই। যুদ্ধের সময় ওপারেও যায়নি। শহর ছেড়ে যায়নি তার বাবা। তবে পরিবারের সদস্যদের দুর্গম গ্রামের আত্মীয় বাড়িতে রেখেছে ব্যবসায়ী বাবা।
অথচ হামিদা বেগমের ছাত্রজীবনে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সোনালি অতীত থাকলেও কোনো প্রকার বাড়িত সুবিধা নেয়নি। বরং ওসব সুবিধাবাদীদের জন্য বারবার বঞ্চিত হয়েছে বলে মনে করে।
সহকর্মী মনোয়ারার ছেলেমেয়েরা সেই সুবিধা নিয়ে সরকারি চাকরিতে ভালো ভালো পদ দখল করে আছে। অথচ তার ছেলেটা দেশের প্রধান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হওয়া সত্ত্বেও বঞ্চনার শিকার হয়েছে। শেষে বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি নিতে বাধ্য হয়। যদিও মা-বারবার ছেলেকে বিদেশে যাওয়ার তাগিদ দিয়েছে। মাকে একা রেখে ছেলেটিই যায়নি।