কবিতা আবেগ আর অনুভূতির মিলিত এক শিল্পরূপ। কবি তার চেনা জগৎ সংসারের শৈল্পিক বিষয়গুলোকে পঙ্ক্তিমালায় সুসজ্জিতভাবে ধারণ করে পাঠকের সঙ্গে এক সেতুবন্ধন রচনা করেন। ব্যক্তিগত বিষয় প্রেম-বিরহ, সমাজ, রাজনীতি, প্রতিবাদ, ভাষা কবির সহযাত্রী হয়ে ওঠে। তার মধ্যে প্রচন্ড এক ঘূর্ণি তৈরি করে কবিতা। স্মৃতি, বেদনা, হাহাকার কিংবা মিলন বার্তা কবির কবিতার মূল অনুষঙ্গ।
মহাদেব সাহা বাংলা সাহিত্যের একজন অগ্রসর কবি। তার কবিতার স্নিগ্ধ গতিধারা লাবণ্যময় হয়ে গ্রাম, শহর, প্রকৃতি, প্রেম, নারী, নিঃসঙ্গ কাতরতা, উলস্নাস, হাহাকার কবিতার মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে ওঠে। শব্দ, বক্তব্য, বিষয় উপকরণ সবই তার লেখায় প্রবহমান। মানবিক আদ্রতায় আলোড়িত কবি সব সময় মানবতারই জয়গান করে গেছেন। তার সুললিত সহজ-সরল তীক্ষ্ণ কবিতা অন্তর্যাত্রার নির্যাস হিসেবে বিবেচ্য। প্রেম-প্রকৃতি, দয়িতা, জগৎ সংসার মহাদেবের কবিতায় স্বতন্ত্র ও উজ্জ্বলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। নারী, নিসর্গ, স্বদেশ, ফুল-পাখি আর আনন্দ-বেদনার উষ্ণ প্রস্রবন তার কবিতাকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও শক্তিময় করে তুলেছে। মহাদেব সাহার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'এই গৃহ এই সন্ন্যাস' (১৯৭২) থেকে শুরু করে ক্রমাগত অগ্রসর হয়ে 'মানব এসেছি কাছে', 'চাই বিষ অমরতা', 'কী সুন্দর অন্ধ', 'তোমার পায়ের শব্দ' কাব্যগ্রন্থে জীবনের বিপুলতা, প্রেমিকসত্তা ও দ্রোহের সংমিশ্রণকে সার্থকভাবে রূপায়ন ঘটিয়েছেন। ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা বোধ ও মননের অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ কবির কবিতাকে আরও সৌন্দর্যময় করে তুলেছে। একজন উন্মুল, উদ্বাস্তু মানুষ জীবনাভিজ্ঞতায় পুষ্ট হয়ে কবিতায় খুঁজে পান চরম হতাশা, ক্লান্তি, অবসাদ এবং অপার আনন্দ ও বেদনার মধ্য দিয়ে। উত্তম পুরুষে উচ্চারিত তার প্রেমের ভাষা আলাদা আলাদা দ্যোতক হয়ে সূর্যালোকের বিভায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। গৃহের মধ্যে সন্ন্যাস ও সত্তার বসবাস আবিষ্কার করেন যে কবি, পরবর্তী সময়ে রাজনীতির মাঠে ময়দানেও তার কণ্ঠ উচ্চকিত হয়।
\হজন্মগ্রাম, স্মৃতি আর স্বপ্নে গ্রোথিত মহাদেব পরম যত্নে তার কবিতাকে অভ্যস্ত শেকড়লগ্ন করে দ্রম্নত অগ্রসর হয়েছেন আরও সামনে। মা, মাতৃভূমি, ভাই-বোনের মেলবন্ধন তার নাগরিক পারিপার্শ্বিক যাপিত জীবনকে দ্রম্নত পাল্টে দেয়। তার মা পৃথিবীর সব মানুষের মায়ের মতো হয়ে যায়। একজন কবি মানুষের বদলে যাওয়া, তাদের ভেতর বাইরের মনস্তাপ বিষয়গুলোকে তার কবিতায় নিখুত কুশলতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত স্থাপন করেন, কবিতার বিষয়বস্তু ও বক্তব্যকে আর্দ্র করে তোলেন। শেকড় সন্ধানী মহাদেবের কবিতার আর্তির সঙ্গে মিশে যায় অদ্ভুত এক জীবন চলার মাদকতা। এই মাদকতার সঙ্গে একাত্ব হয়ে পাঠক চিনে নেয় তার প্রিয় জন্মভূমি, মানুষের অন্তর্গতবোধ ও আত্মোপলব্ধিকে। কবি তখন ইচ্ছে করলেই তার এই আত্মোপলব্ধি থেকে বের হয়ে আসতে পারেন না। ডুবে যান কবিতার অন্তরালে, আরও সৌন্দর্যের খোঁজে। মোবাইল, ফেসবুক, ডিশ-এন্টেনা, ইন্টারনেটের যুগে হাতে লেখা শব্দমালা কারো হৃদয়ে আলোড়ন তোলে কিনা এ প্রশ্ন যখন আসে তখন মহাদেব অবিচল আস্থাশীল চিঠির কাছে। বহুশ্রম্নত, নন্দিত পঙ্ক্তিমালা :
করুণা করে হলেও চিঠি দিও
খামে ভরে তুলে দিও
আঙুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলে তাও
এটুকু সামান্য দাবি চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।
চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও
সমুদ্র বোঝাতে চাও, মেঘ চাও, ফুল পাখি সবুজ পাহাড়
বর্ণনা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দিও!
আজো তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি,
আসবেন অচেনা রাজার লোক
তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে।
কিছু লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোট নাম,
টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে, কিছুই হয়তো পাওনি খুঁজে
সেই সব চুপচাপ দুপুর দুপুর বেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড়ো
একা লাগে, তাই লিখো
করুণা করেও হলে চিঠি দিও, মিথ্যে করে হলেও
\হবলো ভালোবাসি।
[চিঠি দিও]
আধুনিক মানুষের সাথী হচ্ছে নিঃসঙ্গতা, প্রেম-কাতরতা ও ব্যক্তিগত অনুভূতির আলোড়ন। আত্মমুগ্ধতা, বেদনা বোধ, হতাশা, দুঃখ ও স্বপ্নভঙ্গ কবিকে রক্তাক্ত করে। তাই আত্মজৈবনিক রচনায় অনেক সময় কবি স্বপ্নতাড়িত সংবেদনশীল সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন। কবি আশাহত ও স্বপ্নলগ্ন, বেদনাহত মানুষের মতো নির্বাক চেয়ে থাকেন। মানুষের ভেতরের সুপ্ত এক বোহেমিয়ান স্বভাব ও একাকি হয়ে যাওয়ার সহজাত প্রবৃত্তিকে মহাদেব গভীর মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে তার কবিতায় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেন। মাড়ী, মড়ক, যুদ্ধ, রাজনীতি মানুষের হিংস্রতা, বন্ধুত্ব, হিংসার ছুরি তার দিকে লকলকে জিভ বের করে উদ্যত সঙিন হয়ে ওঠে বারবার। এসব দেখে কবি নিরাশার দোলাচলে দুলতে দুলতে জীবনকে আরও নিবিড়ভাবে, গভীর আত্মোপলব্ধি দিয়ে অনুভব করেন এবং এসব বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলোকে তার কবিতায় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেন। যেন পাঠক বুঝতে পারে সেসবের মর্মকথা। কবি আশা ও স্বপ্ন লগ্ন।
জীবনভাষ্য অপার সম্ভাবনা, সংগ্রাম তার পথ অতিক্রমণের মাধ্যমে মহাদেব গীতল প্রেমের কবিতার পরিভ্রমণে নিমগ্ন থেকেছেন। ঘর-সংসার আর চেনাজগৎ তার কাছে অচেনা, বিবর্ণ ও ধূসর হয়ে ওঠে না। গ্রাম, শস্যখামার প্রকৃতি, ঋতুচক্র, মানবিকতা মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম তার কবিতাবদ্ধ। মহাদেবের কবিতা মানুষকে নতুন করে বাঁচতে শেখায়। চরম হতাশার মধ্যেও মানুষকে আশার আলো দেখায়। জীবন আর মানুষ যুথবদ্ধ হয়ে রহস্যময় এক অন্তর্লোক নির্মাণ করে। আর সেখানেই কবির অনুভূতিতে একাত্ম হয় :
আমার কথা তোমরা সামান্যই জানো, আমি এই হাতে
গোলাপ বাগান কত লুটতরাজ করেছি,
কত ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে ভাসিয়ে দিয়েছি বুড়িগঙ্গায়
কত গন্ধ মাখা রুমাল দলামচা করে
ফেলে দিয়েছি জঞ্জালে
কুটি কুটি করে ছিঁড়েছি চোখের জলের চিঠি
তোমরা তার কিছুই জানো না, আমি কতো সন্ধ্যা তার
বেঁধে রেখে এসেছি আচলে
কতো মৃৎশিল্পের সংগ্রহশালা আর শস্যভান্ডারের চাবি
হারিয়ে ফেলেছি স্টিমার ঘাটে
আমি স্তব্ধ করে দিয়েছি কত আকুল করা বাঁশি
কত মন উদাস করা ঘুঘুর ডাক, কত কোকিল।
[তোমরা তার কিছুই জানো না]
মহাদেব সাহা বাঙালির গৌরবগাথা বীর যোদ্ধাদের স্মরণ করেছেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে। তিনি এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধাদের নিয়েও লিখেছেন তার ব্যক্তিগত দুঃখের অনুভূতি। মহাদেব নানা রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী। তার কবিতায় আত্মজৈবনিক বিষয়, আর্থসামাজিক অবস্থা, মানুষ ও মানুষের আর্তি প্রকাশিত হয়েছে। প্রেমিক কবি ঘাতকের নৃশংসতা দেখে ভয়ে আতকে ওঠেন। স্বাধীনতা বিরোধীদের অপতৎপরতায় ক্রুদ্ধ হতে হয় কবিকে। কবি সত্য ও সংগ্রামের সারথি। অসত্য, মিথ্যা ও পিশাচ বাহিনীর নির্যাতনের ঘটনায়ও তিনি মর্মাহত। তার লেখার হাত তখন বিদ্রোহ করে। মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরের ট্রাজিক ঘটনা আর নব্বই দশকের স্বৈরশাসনের নির্যাতনের ঘটনাগুলো তার কবিতায় স্থান পেয়েছে সুনিপুণভাবে। শান্তি, সুন্দর ও প্রেমের পূজারি কবি ব্যথিত হয়ে দ্রোহে, ক্রোধে জ্বলে উঠেছেন। আর ১০ জন মানুষের মতো ব্যথিত ও স্তব্ধ তিনি। মহাদেব বাঙালি সংস্কৃতির প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ, জীবনাচরণ ও মানবিকবোধকে কবিতাবদ্ধ করে উচ্চারণ করেন :
আমার টেবিলের সামনে দেয়ালে শেখ মুজিবের একটি ছবি টাঙানো আছে।
কোনো তেল রঙ কিংবা বিখ্যাত স্কেচ জাতীয় কিছু নয়
এই সাধারণ ছবিখানা ১৭ই মার্চ এ বছর শেখ মুজিবের জন্মদিনে
একজন মুজিব প্রেমিক আমাকে উপহার দিয়েছিল
কিন্তু কে জানত এই ছবিখানা হঠাৎ দেয়াল ব্যাপী
একগুচ্ছ পত্র পুষ্পের মতো আমাদের ঘরময়
প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে রাত্রিবেলা।
তবু তাকে বলতে পারিনি বাংলার প্রিয় শেখ মুজিব
তোমার রক্ত নিয়েও বাংলার চালের দাম কমেনি
তোমার বুকে গুলি চালিয়েও কাপড় সস্তা হয়নি এখনো
দুধের শিশু এখনো না খেয়ে মরছে কেউ থামাতে পারেনি।
বলতে পারিনি তাহলে রাসেলের মাথার খুলি মেশিনগানের গুলিতে উড়ে গেল কেন?
তবু শেষবার ঘুমিয়ে পড়ার আগে তাকে আমার বলতে ইচ্ছে করছিল।
সারা বাংলায় তোমার সমান উচ্চতার আর কোনো লোক দেখিনি/তাই আমার কাছে বার্লিনে যখন একজন ভায়োলিন বাদক বাংলাদেশ/সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিল আমি আমার বুক পকেট থেকে ভাজ করা
একখানা ১০ টাকার নোট বের করে শেখ মুজিবের ছবি দেখিয়েছিলাম/বলেছিলাম দেখ এই বাংলাদেশ। এর বেশি বাংলাদেশ সম্পর্কে /আমি আর কিছুই জানি না। আমি কি বলতে পেরেছিলাম তার/শেষবার ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমি কি বলতে পেরেছিলাম?
[আমি কি বলতে পেরেছিলাম]
বাঙালির জাগৃতি, দ্রোহ অর্জনের সঙ্গে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নাম প্রেরণার উৎস হয়ে মিশে আছে মহাদেব সাহার কবিতায়। তিনি জাতির পিতাকে তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। পঁচাত্তরের ট্র্যাজিক পরিণতিকে মহাদেব দুঃখে, ক্রোধে, বেদনায় বহন করেছেন প্রতিনিয়ত। কবিতায় আপাদমস্তক নিমগ্ন কবি জীবনের কাছ থেকেই সমস্ত পাঠ গ্রহণ করেছেন। স্মৃতি কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ এবং বাঙালির জাতির জনককে স্মরণ করে তিনি অসংখ্য কবিতাও লিখে গেছেন। তার অসংখ্য স্মৃতি কবিতায় মুজিব আছে স্মরণে কৃতজ্ঞতায় উজ্জ্বল মহিমাম্বিত এক আদর্শ হয়ে।
গ্রাম থেকে শহরে আসা ছেলের জন্য মার ব্যাকুলতা আর ছেলের স্মৃতি, কর্মব্যস্ততা, নাগরিক জীবনের ক্লান্তি, হতাশা ইত্যাদি মহাদেব তার কবিতার ক্যানভাসে সূক্ষ্ণভাবে ধারণ করেছেন। বর্ষপরিক্রমায় বোশেখ আসে। শেকড় বিচ্ছিন্ন মানুষের আর্তি, বেদনা, বোধ, ক্ষরণ কবি পর্যবেক্ষণ করেন তার নিবিড় লেখনীর মাধ্যমে। প্রতীকীভাবে কবির মা যেন পৃথিবীর সব মানুষের মা হয়ে যান। ইট, কাঠ, কংক্রিটের জীবনে স্বপ্ন বন্দি হয়ে কবি বলে ওঠেন :
মা তুমি বলেছিলে পয়লা বোশেখে
বাড়ি আসবি তুই, আমার মনে আছে- আমারও
ইচ্ছে করে পয়লা বোশেখ কাটাই বাড়িতে, প্রতি বছর মনে
করে রাখি সামনের বছর পয়লা বোশেখটা বাড়িতে কাটিয়ে
আসব, খুব সকালে ওঠে দেখব পয়লা বোশেখের সূর্যোদয়
দেখতে কেমন, কিন্তু মা সারাটা বছর কাটে
\হক্যালেন্ডার পাল্টে যায়
আমার জীবনে আর আসে না পয়লা বোশেখ
[বৈশাখে নিজস্ব সংবাদ]
মহাদেব সাহার কবিতায় প্রেম এক অনিবার্য অবধারিত বিষয়। প্রেম মূলত তার কবিতা লেখার প্রধান উপাদান। সান্নিধ্য, আকাঙ্ক্ষা, ব্যাকুলতা, প্রণয়গাথা, বিরহ কাতরতার মাঝে এক অবিনাশী দ্যোতক হচ্ছে এই প্রেম। তার কবিতায় গ্রাম ছাড়াও মানুষের অন্তর্গত বোধ প্রকাশিত হয়ে শহরে এসে ভিড়ে যায়। জড়িয়ে থাকে, আলিঙ্গন করে- দায়বদ্ধতার জন্ম দেয় যে শাশ্বত প্রেম তাকে অস্বীকার করা যায় না। 'আদম হাওয়া, রোমিও জুলিয়েট'সহ ইতিহাসের উপাখ্যান প্রেম বন্দনায় মুখর মহাদেব সবখানেই স্থিত। পৃথিবীতে যুদ্ধ, হিংসা, দলাদলি, পরশ্রীকাতরতার পদধ্বনি সেখানে একজন কবি স্বাভাবিকভাবে হৃদয়ের মতো শক্তিশালী বাহনকে সঙ্গী করে কবিতা রচনায় অগ্রবর্তী থাকেন এটাই স্বাভাবিক :
তুমি ছাড়া কোনো স্মরণ যোগ্য নারী নেই।
আর নাম নেই আর
তোমার প্রতিভা এই শতাব্দী আরও বেশি কাল
পাবে প্রাধান্য
আমার ঢেড় বয়সের বেশি তবু আমাদের বয়সের চেয়ে তারুণ্যময়
তোমার রূপের দুরন্ত খ্যাতি এ শহরে আজো প্রবাদ তুল্য তুমি!
মহাদেব সাহা আনন্দ, বিষাদ, দুঃখ-কষ্ট ও দারিদ্র্যতার মাঝে বেঁচে থাকার নিরন্তর প্রয়াসকে তার 'অভিযাত্রা' কবিতায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন সুনিপুণভাবে, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। নগর সভ্যতা, চলমান জীবনে ক্লান্তির বিপরীতে দাঁড়িয়ে তার কাছে মানুষ, তার বোধ ও বোধোদয় প্রেম মুখ্য থেকেছে প্রতিবার। মহাদেব জীবন বিমুখ নন, তার কবিতায় অন্তহীন জীব বৈচিত্র্য ও মানবিক গুণাবলি এবং যাপিত জীবনকে বারবার খুঁজে পাওয়া যায় সহজ, সরল উপস্থাপনার মাধ্যমে। মহাদেবের কবিতা হৃদয়স্পর্শী। আমরা যে জীবনযাপন করছি তার পরতে পরতে দুঃখ, কষ্ট, বিয়োগ, বেদনা, হাহাকার ইত্যাদি মূর্ত হয়ে ওঠে। মহাদেব দুঃখ-কষ্টের সংসারকে প্রেমের স্পর্শ দিয়ে বুলিয়ে দেন প্রতীকী লেখার মাধ্যমে। দুঃখ-কষ্ট, হৃদয়ের হাহাকার জাগিয়ে তোলে তার আনন্দ-বেদনার কবিতাগুলোর মাধ্যমে। তাই তো তিনি সখেদে বলে ওঠেন :
তৃতীয় বিশ্বে দরিদ্রতম দেশের একজন কবির
মনু মিয়ার হাড়ির খবর ভুললে চলে না,
আমি তাই জোয়াল ভাঙা হারু শেখের দিকে তাকিয়ে
আন্তর্জাতিক শোষণের কথাই ভাবি,
পেটের ক্ষিদে এখন বুঝি কবিতার জন্য কি অপরিহার্য
জুঁই ফুলের চেয়ে কবিতার বিষয় হিসেবে আমার কাছে
তাই সাদা ভাতই অধিক জীবন্ত আর ধুলো মাটি মানুষ,
[ জুঁই ফুলের চেয়ে সাদা ভাত অধিক সুন্দর, ধুলোমাটির মানুষ]
সমকালের প্রধান কবি মহাদেব সাহা জীবন গার্হস্থ্য সংসার আর আনন্দ-বেদনা, বিষাদ, দুঃখ-কষ্টকে সমকালে ধারণ করে বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা তার কবিতায় আবদ্ধ করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্বের গস্নানি মুছে দেয় মহাদেবের কবিতা। সেগুলো পড়লে মানুষের হতাশা, ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। মানুষ ফিরে যায় স্বাভাবিক জীবনে, বাস্তবতার সঙ্গে মিশে গিয়ে কবিতায় একাত্ম হয়ে যায়। তার কবিতায় অনুরণিত হয় :
'মরবার আগে তুমি আঘাত হানো/এই যুদ্ধে বন্ধু তোমার জয়/জানি আগামীর নবীন অভু্যদয়/রক্ত দিয়েতো কিনেছ তুমি প্রাণ ও। [দিনমজুরের গান]