দরিয়াপুরের লস্কররা কয়েক পুরুষ ধরে কাজ করছে জাহাজে। কেউ কেউ সাত সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে বিদেশ বিভুঁইয়ে সংসারও পেয়েছে। তারা সাধারণত পশ্চিমে- ইউরোপ-আমেরিকায় গিয়ে ঠেকেছে, ব্যতিক্রম শুধু মতি লস্কর। তিনি গেছেন পূর্বদিকে। সেই সূর্যোদয়ের দেশ জাপানে। সেখানে জাপানি বিবি নিয়ে সুখেই কাটছিল দিন। ছেলেমেয়েরাও বড় হয়ে গেছে। কিন্তু ষোলোআনা সুখী হওয়াটা মানুষের কপালে থাকে না। টেলিগ্রাম পেয়ে সুদূর জাপান থেকে অসুস্থ মাকে দেখতে আসার সময় মতি লস্কর কী জানতো, দুনিয়াটা এমন বদলে যাবে! জাপান পার্ল হারবারে আক্রমণ করবে আর তিনি আটকে পড়বেন দরিয়াপুরে।
যুদ্ধ কবে থামবে কে জানে! হিটলারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জাপান এখন ব্রিটিশদের পুরো দুশমন। যুদ্ধ না থামা পর্যন্ত যাবেন কী করে- জাপান তো আর ঘরের কাছে কোনো মুলুক নয়। স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। ওদের কথা ভাবতে গেলেই মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। কে জানে কোন হালতে আছে ওরা। মনের অস্থিরতা দূর করতে কলকাতা থেকে দরিয়াপুরের পত্রিকা আনার ব্যবস্থা করেছেন। পত্রিকা পড়লে কিছুটা হলেও বিশ্ব পরিস্থিতি আন্দাজ করা যায়। নইলে দরিয়াপুরে থাকা আর অন্ধকারে থাকা একই কথা।
দরিয়াপুর ঘাটে বিকালের স্টিমারে পত্রিকা আসে। কখনো মতি লস্কর নিজে যান, কখনো লোক পাঠিয়ে পত্রিকা আনেন। শ্রাবণ মাস চলছে। কদিন ধরে ভারী বৃষ্টিপাতের দরুন বাড়ি থেকে বেরোননি। সেদিন সকাল থেকেই উজ্জ্বল রোদ। বিকালে পরিষ্কার আকাশ দেখে নিজেই পা বাড়ান ঘাটের দিকে। ঘাট বেশি দূরে নয়। বাড়ি থেকে কয়েক মিনিটের পথ। কাঠের সাঁকো পেরোলেই বাজার। আর বাজারের আরেক মাথায় ঘাট। সেখানে পা রেখে মতি লস্কর দেখলেন, নদীর পানি বাড়ছে হু- হু করে। আরো দুদিন এভাবে পানি বাড়লে রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়া শুরু হবে। ঘাটে একটা চা-দোকান আছে। দোকানদার তাকে দেখেই বাড়িয়ে দেয় কাঠের চেয়ার। চা দোকানে উপস্থিত কয়েকজন টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, কেউ হাত তুলে সালাম দেয়। শুধু দরিয়াপুরে নয়, আশেপাশের গেরামেও লস্কর বাড়ির সম্মান আছে- তালুকের জমিদার পর্যন্ত তাদের সম্মান করে। বছর পনের আগে তার জাপানি বউ আর ছেলে মেয়েদের নিয়ে যখন বাড়ি আসে তখন দশ-বারো গেরামের বউ-ঝিরা দলে দলে ভিড় জমাতো লস্কর বাড়িতে। মতি লস্করকে চোখে না দেখলেও তার নাম শুনেনি এমন লোক এ অঞ্চলে খুব কমই আছে। চেয়ারে বসেই জিজ্ঞেস করেন- স্টিমার আসতে বুঝি লেট হচ্ছে?
- আইসা পড়তো অহন। জবাবটা দিয়েই চা দোকানদার জিজ্ঞেস করে- কর্তা চা দিতাম?
আপত্তি না করতেই মাটির ভাড়ে খাঁটি দুধ মেশানো চা। চুমুক দিয়েই মতি লস্কর দেখেন, দক্ষিণ আকাশে উঠে আসা এক খন্ড সাদা মেঘ স্পর্শ করতে চাইছে কালো ধোঁয়ার কুন্ডলি। বুঝতে পারলেন, স্টিমার আসছে। উজান ঠেলে আসতে একটু সময় নেবে। স্টিমারের আগমন টের পেতেই ঘাটে ছড়িয়ে পড়ে চাঞ্চল্য। নিজের ভেতর অস্থিরতা টের পান মতি লস্কর- যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি না জানা পর্যন্ত যেন স্বস্তি নেই। কবে নাগাদ স্ত্রী-সন্তানদের মাঝে ফিরতে পারবেন তা আলস্নাহ মালুম। গেল মাসে নিজের অবস্থার কথা জানিয়ে একটা চিঠি লিখেছেন স্ত্রীকে। সেই চিঠি যুদ্ধের ডামাডোলে ঠিক মতন পৌঁছবে কিনা সন্দেহ। তবে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন এটুকুই সান্ত্বনা। এমন অবস্থায় পড়বেন বুঝতে পারেননি। আফসোস নেই এই ভেবে, মায়ের শেষদেখা তো পেয়েছেন। মা তার হাতে পানি খেয়েই শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন।
স্টিমার ঘাটে ভিড়লো। মতি লস্কর চেয়ার ছেড়ে উঠলেন না। অন্যান্য দিনের মতো ঘাট সর্দার পত্রিকা পৌঁছে দেবে গগনের চা দোকানে। ঘাট সর্দার ভালো করেই জানে, দরিয়াপুর স্টিমার ঘাটের পেছনে লস্কর বাড়ির অবদানই সবচেয়ে বেশি। ওই বাড়ির লোকরা বিদেশ-বিভুঁইয়ে থাকে, তাদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য চেষ্টা-তদবির করে এই ঘাট বসানো হয়েছে।
স্টিমার থেকে নেমে আসা যাত্রীরা যাচ্ছে দোকানের সামনে রাস্তা মাড়িয়ে। তাদের মধ্যে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা একটি লোক, মুখটা থমথমে। চা দোকানদার গগন তাকে দেখেই বলে ওঠে- ও কানু দাদা, কী সমাচার?
লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ে, শুধু গগনকে নয়, চা দোকানে উপস্থিত সবাইকে যেন শুনিয়ে বলে- সমাচার ভালা না। একটু আগেই স্টিমারে আকাশবাণীতে শুনলাম বিশ্বকবি আর নেই। আইজকা দুপুরেই মারা গেছেন।
বিশ্বকবি মানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। খবরটা শুনে মতি লস্কর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। মনে পড়লো, কদিন আগেই পত্রিকায় দেখেছিলেন, কবি অসুস্থ। মৃতু্য সংবাদ শুনিয়ে ধুতি-পাঞ্জাবি গায়ে লোকটা আর দাঁড়ায় না, পা বাড়ায়। ঘাট ছাড়ার আগে বেজে ওঠে স্টিমারের ভোঁ শব্দ। সেই সঙ্গে ইঞ্জিনের হুস-হাস্ শব্দ। চোঙ্গা উগড়ানো ধোঁয়ায় ছড়ানো কয়লা পোড়া গন্ধ নাকে আসে। মতি লস্করের কাছে শ্রাবণে অনেকটাই দুর্লভ রোদে ঝলমল করা বিকালটা কেমন বিষণ্ন্ন হয়ে গেল। তার ইচ্ছে ছিল কবির সঙ্গে একবার দেখা করার। জাপান থেকে আসার সময় ঠিক করেছিলেন, দেশে পৌঁছে কবির সঙ্গে দেখা করবেন। জীবনে অনেক মানুষ দেখেছেন, কবির মতো মানুষ আরেকটা দেখেননি। কলকাতায় জাহাজ থেকে নেমে মতি লস্কর জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে যেতে পারতেন। তখন যাওয়া হয়নি মায়ের অবস্থার কথা ভেবে। জাহাজ ঘাট থেকে সরাসরি শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে ট্রেন ধরেন। কিছুদিন পরে জাপানের সঙ্গে ব্রিটিশদের যুদ্ধ শুরু হলে, জাহাজের খোঁজ নিতে কলকাতায় গিয়ে ঠিকই যান জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ী। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, মাত্র একদিন আগেই বিশ্বকবি চলে গেছেন শান্তি নিকেতনে। শরীর ঠিক থাকলে পশ্চিমে যাবেন বেড়াতে।
ঘাট সর্দার এসে মোড়ানো পত্রিকা সরাসরি হাতে দিতেই আর দেরি করলেন না, পা বাড়ান বাড়ির দিকে। অন্যদিন হলে আরেকটু বসতেন কিংবা ঘাটের আশপাশে হয়ত নদীপাড় বরাবর হাঁটাহাঁটি করতেন। একে তো যুদ্ধের কারণে স্ত্রী সন্তানের কাছে যেতে না পারার কষ্ট, তারপর আরেক দুঃসংবাদ- বিশ্বকবি আর নেই। মন খারাপ করেই ঘাট এলাকা ছাড়লেন। তার খুব ইচ্ছে ছিল, কবির মুখোমুখি হয়ে একটা প্রশ্ন করতে, আমারে চিনতে পারছেন, আমি সেই বাঙালি নাবিক, জাহাজে দেখা হয়েছিল আমাদের? কবি দেশে-বিদেশে কত মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, তার মতো একজন সাধারণ বাঙালিকে তো মনে রাখার কথা নয়। তবু কৌতূহল পেয়ে বসেছিল মতি লস্করকে। যদি কবি বলতেন- হঁ্যা, তোমায় চিনেছি, তাহলে তো তার জীবনটাই স্বার্থক! নোবেল প্রাইজ পাওয়া বিশ্বকবি তাকে ভুলেননি! শেষমেশ যাচাই করার আর সুযোগ হলো না। একটা দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে পড়ে। কলকাতায় যাবে যাবে করেও আর যাওয়া হলো না। জাপানি বোমার আতঙ্কে কলকাতা ছেড়ে আসছে অনেকেই। হাতির বাগানে জাপানি বিমান থেকে বোমা পড়ার পর লোকে এতটাই ভীত যে ওখানে গেলে মাথার উপরেই যেন বোমা পড়বে।
দরিয়াপুর বাজার পেরিয়ে কাঠের পুলে পা রেখেই দাঁড়িয়ে পড়েন মতি লস্কর। মোড়ানো পত্রিকার লেবেল ছিঁড়ে প্রথম পৃষ্ঠা মেলে ধরতেই শিরোনাম চোখে পড়ে- আগামীকাল বিশ্বকবির অস্ত্রোপচার। এটা গত পরশুর পত্রিকা। তবু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খবরটা পড়তে থাকেন। জানতে পারেন, কবি মূত্রনালির অসুখে আক্রান্ত। ডা. বিধানচন্দ্র রায় অস্ত্রোচপার করার জন্য কবিকে রাজি করিয়েছেন। কোনো হাসপাতালে নয়, জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই অস্ত্রোপচার হবে। কেউ না বললেও মতি লস্কর ঠিকই বুঝতে পারেন, অস্ত্রোপচার সফল হয়নি বলেই মৃতু্য অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।
পত্রিকা হাতে নিয়ে বাড়িতে পৌঁছার পর বৈঠকখানার সামনের বারান্দায় ক্যানভাসের ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে বসলেন মতি লস্কর। অন্যদিন হলে চেয়ারে বসে আলোর স্বল্পতায় অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। আজ চেয়ারে বসলেও পত্রিকার প্রতি মন নেই। তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে- জাপানি জাহাজ 'তোসামারু' সিঙ্গাপুর বন্দর ত্যাগ করে হংকংয়ের দিকে যাচ্ছে। চীন সাগর পাড়ি দিতেই আবহাওয়া বিগড়ে যায়। সমুদ্র হয়ে ওঠে উত্তাল। মতি লস্কর জাহাজের পেটি অফিসার। কলকাতা বন্দরে থাকতেই খবর পেয়েছিলেন নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদের জাহাজেই জাপানে যাচ্ছেন। নামবেন কোবে বন্দরে। জাপানি স্ত্রী আর ভাষা রপ্ত করার সুবাদে জাপানি জাহাজে তার চাকরি মিলেছে। তাই বলে জাহাজ কোম্পানি জামাই আদর করে খাওয়াবে তা কিন্তু নয়। বরং একটু বেশি খাটায়। তার ডিউটি মাস্টার ব্রিজে, হুইল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আর জাপানি কাপ্তানের নির্দেশের অপেক্ষায় কান খাড়া রাখা। ইচ্ছে থাকলেও ব্যস্ততা আর দ্বিধার কারণেই কবির সামনে যাওয়া হচ্ছিল না। কলকাতা ছেড়ে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে জাহাজ পৌঁছল রেঙ্গুন বন্দরে; মাস্টার ব্রিজ থেকেই মতি লস্কর লক্ষ্য করেন, বন্দরে লোকজন এসেছে কবিকে স্বাগত জানাতে। এরপর পেনাং এবং সিঙ্গাপুর- দুই বন্দরে মতি লস্কর দূর থেকেই দেখলেন, জাহাজের রেলিং ধরে কবি বন্দরের মাল ওঠানামা বেশ উপভোগ করছেন। সিঙ্গাপুর থেকে মালাক্কা প্রণালি পেরিয়ে জাহাজ যখন চীন সাগরে প্রবেশ করল তখন তিনি ঠিক করেন, দূর থেকে আর নয়, এবার কবির সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন। জাপানি জাহাজে কাজ নেওয়া তার মতো একজন বাঙালিকে দেখলে কবি নিশ্চয় খুশি হবেন। সেই সময় যখন মতি লস্কর বের করেন তখন ঝড়ো আবহাওয়ায়, বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে ঢেউয়ের দোলায় জাহাজ দুলছে। কবি কোন কেবিনে আছে, সেটা জানা ছিল। রাত ঘনিয়েছে, ডিনার সেরে পা বাড়ালেন। দেখা করেই ফিরে আসবেন নিজ কেবিনে। সকাল ৬টার মধ্যে তাকে আবার থাকতে হবে মাস্টার ব্রিজে। জাপানিরা সময়ের ব্যাপারে বড়ই সচেতন। মিনিট তো দূরের কথা, এক সেকেন্ডও ছাড় দেবে না।
কেবিনের সামনে গিয়ে হতাশ হলেন মতি লস্কর, সেখানে নেই কবি। অপেক্ষা করলেন। তার ধারণা কবি আশপাশে গেছেন, ফিরে আসবেন। ঘন্টাখানেক পেরুতেই খানিকটা অস্থির হয়ে ঘড়ির দিকে তাকাতেই প্রশ্ন উঁকি দেয়- এই ঝড়-বাদলের রাতে কবি গেলেন কোথায়? অধৈর্য হয়ে সামনের দিকে পা বাড়ান। ডেকের ওদিকে গিয়ে প্রকৃতির রুদ্ররূপ অবলোকন করে আবার আসবেন। ডেকের কাছে যেতেই হতবাক। উত্তাল সমুদ্রে ঝড়-বৃষ্টির দাপটে যেখানে যাত্রীরা কমবেশি ভীত-সন্ত্রস্ত সেখানে এ কোন দৃশ্য দেখছেন! ঝড়ো বাতাসে তেড়ে আসা প্রকান্ড ঢেউয়ে জাহাজের আগামাথা থেকে ছিটকে আসা পানিকে পরোয়া না করেই কবি আপন মনে গেয়ে চলেছেন গান। একটির পর আরেকটি। মতি লস্কর পেশাদার নাবিক। বছরের পর বছর জাহাজে চাকরির সুবাদে সমুদ্রের ভয়াল রূপ দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু কবি তো ডাঙ্গার মানুষ! এত সাহস পাচ্ছেন কোত্থেকে? তবে রণক্ষেত্রের সেনানায়ক কিংবা ঝড়-ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে জাহাজের কাপ্তানের মতো যিনি এমন অবিচল, তিনি তো সাধারণ লোক নন। মতি লস্কর নিশ্চিত যে একজন অসাধারণ, দৃঢ় মনোবলের মানুষ বলেই কবি এমন প্রতিকূল পরিবেশে একটি নয়, পর পর কয়েকটি গান গাইলেন। গানের সুর ও বাণী মনকে এতটাই স্পর্শ করে যে তিনি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছেন। একপর্যায়ে গান গাওয়া শেষ করে ঘুরে দাঁড়াতেই তাকে দেখতে পেয়ে কিছুটা বিস্মিত হয়েই কবি জিজ্ঞেস করেন- কে তুমি?
- আমি একজন বাঙালি। এই জাহাজের পেটি অফিসার। আমার নাম মতি লস্কর। আপনার গান শুনে আমার মন ভরে গেছে। মাঝ সমুদ্রে ঝড়ের রাতে আপনি যেভাবে গান গাইলেন, আমি মনে করি, যোগ্য মানুষকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়েছে। আপনার জন্য আমরা বাঙালিরা গর্বিত।
- অত কথা বলো না হে। তুমি যে একজন বঙ্গসন্তান হয়ে জাপানি জাহাজের অফিসার হতে পেরেছো- এটা কম কিসের? তোমার জন্য আমরাও গর্বিত হতে পারি।
কবির কথায় শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায় মতি লস্করের। এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন যে কদমবুসি না করে পারেননি। কথায় কথায় কবি বলেন, আসলে কী জানো, আমি জাহাজের কেবিনে পারত পক্ষে শুইনে- ডেকে শুয়ে শুয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে। আকাশ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু আজ রাতে এত ঝড়বৃষ্টি, কোথাও যে একটু আড়াল পাওয়া পাবে খুঁজে খুঁজে পেলাম না। অনেকক্ষণ পর্যন্ত বিছানাটাকে এধার থেকে ওধার টানটানি করতে করতে শেষে দাঁড়িয়ে গান শুরু করলুম। যাই এবার রাত হয়েছে।
কবিকে বিছানা বহন করতে দেননি মতি লস্কর। নিজেই বহন করে তার কেবিন পর্যন্ত পৌঁছে দেন। অনেক রাত হয়েছে দেখে কবিকে বিরক্ত না করে ফিরে আসেন নিজ কেবিনে। ঋষিতুল্য মানুষকে একটু সেবা করতে পারায় তৃপ্তি নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েন সে রাতে।
ইচ্ছে ছিল কবির কাছে আবার যাওয়ার। কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো আর হয় না। জাহাজে কাজ থাকে ঘড়ির কাঁটা ধরে। নিজেরও বিশ্রাম নেওয়ার ব্যাপারও আছে। তাছাড়া একটা সঙ্কোচও পেয়ে বসে- বিশ্বকবির মতো অতবড় মানুষকে বিরক্ত করাটা কি ঠিক হবে? শেষে কবি জাপানের কোবে বন্দরে নেমে গেলেন। মাস্টার ব্রিজে ডিউটির ফাঁকে মতি লস্কর দেখতে পেলেন, কবিকে স্বাগত জানাতে জড়ো হয়েছে একদল মানুষ। তাদের মাঝে ভারতীয় যেমন আছে, তেমনই জাপানি আর কয়েকজন সাদা চামড়ার সাহেব।
এবার দেশে আসার সময় ঘুণাক্ষরেও মতি লস্কর আঁচ করতে পারেননি, দুনিয়াটা হঠাৎ এমন এলোমেলো হয়ে যাবে। ইউরোপের যুদ্ধ আছড়ে পড়বে এশিয়ায়। বড় আশা নিয়ে পা রেখেছিলেন কলকাতায়। কবির সঙ্গে দেখা করবেন। জোড়াসাঁকোতে গিয়ে দেখা না পাওয়ার সময়ও বুঝতে পারেননি, কবি এভাবে চলে যাবেন। ক্যানভাসের চেয়ারে গা এলিয়ে এসব ভাবতে গিয়ে মতি লস্কর টের পান, মনটা কেমন ভার হয়ে আছে। সন্ধ্যার ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে বাড়ির সামনে গাছপালা ঝাপসা হওয়ার মুহূর্তে তার কানে বাজতে থাকে কবির সেই কণ্ঠ...../পূর্ণ আনন্দ পূর্ণ মঙ্গলরূপে হৃদয়ে এসো/এসো মনোরঞ্জন/আলোকে আঁধার হউক চূর্ণ, অমৃতে মৃতু্য করো পূর্ণ ...।