বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্যের সব শাখায় যার বিচরণ। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, গীতিকার, নাট্যকার, অভিনেতা, চিত্রশিল্পী ও দার্শনিক। সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক। আমরা এখন যা ভাবছি, কবিগুরু তা ভেবেছিলেন শত বছর আগেই। তিনি যে প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার প্রবন্ধ, কবিতা, নাটক ও গানে- যেখানে প্রকৃতি ছিল তার লেখার অন্যতম অনুষঙ্গ।
কবিগুরু ১৯১৪ সালে যখন সমুদ্র পথে জাপান যাচ্ছিলেন তখন পথিমধ্যে সমুদ্রে তেল নিঃসরণের দৃশ্য দেখে পরিবেশের ওপর মানুষের প্রভাব নিয়ে খুব চিন্তিত হয়েছিলেন। সেই সময়ই তিনি মানুষের লোভ ও অপরিকল্পিত নগরায়ণকে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শনে তিন ধরনের সত্তার কথা পাওয়া যায়। প্রকৃতি সত্তা, মানবসত্তা ও পরম সত্তা। প্রকৃতির সঙ্গে বিশ্বকবির গভীর সংযোগ লক্ষ্য করা যায়। তিনি জীবন শুরু করেন প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় পরিচয়ের মাধ্যমে। ভোরবেলা শয্যা ত্যাগ করে তিনি বাগানে যেতে ভুলতেন না। ভোরের আকাশে অন্যরকম আনন্দের স্বাদ পেতেন তিনি। তার কবিতায় তিনি সে ভাব ফুটিয়ে তুলেছেন নিখুঁতভাবে .....
\হ'আজ প্রথম ফুলের পাব প্রসাদখনি
\হতাই ভোরে উঠেছি।
\হআজ শুনতে পাব প্রথম আলোর বাণী
\হতাই বাইরে ছুটেছি।'
শান্তি নিকেতনে ১৯২৫ সালে ২৫ শে বৈশাখ উপলক্ষে বৃক্ষ রোপণ অনুষ্ঠানে তার লেখা একটা গান গাওয়া হয়েছিল সেখানে পরিবেশ সচেতনতা ফুটে উঠেছিল চমৎকারভাবে। তার রচিত গানটির একটি লাইন ছিল এরকম ..........
\হ'মরু বিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রাণ।...'
\হপ্রশ্ন কবিতায় কবি সৃষ্টি কর্তার কাছে বিচারের ভার দিয়েছেন এভাবে ......
\হ' যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু
\হনিভাইছে তব আলো,
\হতুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ?
\হতুমি কি বেসেছ ভালো?'
কবির যাত্রা পথে প্রথম সঙ্গী ছিল প্রকৃতি। তিনি তার জীবন স্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন.........' সদর স্ট্রিটের রাস্তাটা যেখানে গিয়া শেষ হইয়াছে, সেইখানে বোধ করি ফ্রি স্কুলের গাছ দেখা যায়।'
প্রকৃতির সৌন্দর্য কবিকে নানাভাবে আকৃষ্ট করত। শরতের আকাশের মেঘ মলস্নারের দেখা পেয়ে শুধু নয়ন ভরেনি, মনও পুলকিত হইয়াছিল। কবিগুরুর ভাষায় ......
'আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায়
\হলুকোচুরি খেলা
\হনীল আকাশে কে ভাসালে
\হসাদা মেঘের ভেলা।'
নীল আকাশের সাদা মেঘে কবির মন নেচে উঠেছিল বলেই কবি লিখতে পেরেছিলেন....
\হ'হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে, ময়ূরের মত নাচেরে, হৃদয় নাচে রে।....'
প্রাচীন কালের বৈদিক ঋষিদের ন্যায় কবিগুরু প্রকৃতির মাঝে এক প্রচ্ছন্ন সত্তার আভাস পেতেন। প্রকৃতির মধ্যে আত্ম নিমগ্ন হয়ে সবার সঙ্গে মিলিত হওয়ার ঝোঁক তৈরি হয় মানুষের মধ্যে। মানুষের এই প্রকৃতিগত ঝোকটাকে বলা হয় প্রকৃতিগত অনুপ্রেরণা।'
সভ্যতার প্রতি 'কবিতায় কবিগুরু শহুরে জীবনের প্রতি প্রচন্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এভাবে ........
'দাও ফিরে সে অরণ্য,
\হলও যত নগর,
লও যত লৌহ লোস্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নব সভ্যতা, হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী
দাও সে তপোবন পুণ্য ছায়ারাশি .....।'
প্রকৃতির শক্তিকে মানুষ যে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে পরিবেশ তথা পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলছে রবীন্দ্রনাথ শত বর্ষ আগেই সে কথা লিখে গেছেন তার বিভিন্ন লেখায়। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণেই জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব আজ সারা বিশ্বব্যাপী। মানুষ প্রকৃতির ওপর খবরদারি করুক এটা চাননি কবিগুরু।