রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

মাস্টার মশাই

মিতুল সাইফ
  ২৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
মাস্টার মশাই

১.

পর পর কলিংবেল বাজল কয়েকবার। একটু থেমে আবার। তারপর দরজার কড়া নাড়ার খটখটানি। মেজাজটা তিরিক্ষি হয়েই ছিল। কারণ একটানা তিন দিন বিদু্যৎ নেই মহলস্নায়, ঝড়ে পোল ভেঙে গেছে। ঘুমটা কেবল এসেছিল হঠাৎ কলিংবেল আর দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে মুখে যা আসে তাই বলে বিরক্তি প্রকাশ করলাম। তারপর কণ্ঠ পাল্টে বললাম- 'সাহেব বাড়ি নেই। পরে আইসেন।' আর কোন আওয়াজ করল না। সিঁড়ি ভেঙে লোকটার চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম। ঘুম আর এলো না। হঠাৎ বজ্রপাতে মনে পড়ল ছাদে জামা কাপড় নেড়ে দেওয়া আছে। এখনি আবার বৃষ্টি আসতে পারে। দৌড়ে ছাদে গেলাম। চোখ পড়ল বাড়ির সামনের চিকন রাস্তায়-জীর্ণ জামাকাপড় পরা এক বৃদ্ধকে দেখতে পেলাম। লাঠি ভর করে অতি কষ্টে রাস্তা পার হচ্ছে। মুখটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে। চারদিকে ঘোর অন্ধকার। লোকটা যেন একটু একটু করে সেই আঁধার সাঁতরে ঢুকে যাচ্ছে আরও গহিন অন্ধকারে। কাপড়চোপড় গুছিয়ে ছাদ থেকে ফিরব। সহসা বিজলি চমকে স্পষ্ট হলো লোকটার মুখ, আমার শুকিয়ে যাওয়া কণ্ঠ থেকে অস্পষ্ট কণ্ঠে বেরিয়ে এলো 'মাস্টার মশাই!' দৌড়ে ছুটে গিয়ে আর খুঁজে পেলাম না মানুষটাকে। একটু পরে আমার কাজের লোক রামু বাজার নিয়ে ফিরে এসে বলল, 'সকালে দু'বার করে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন আপনার খোঁজে। নাম জিজ্ঞেস করলে বললেন, ওকে বোলো মাস্টার মশাই এসেছিলেন।' আমার বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আসছিল। অপরাধ বোধে আমি কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম।

এ তো সেই মাস্টার মশাই, যিনি সারাটা জীবন আমকে ফ্রি পড়িয়েছেন। বই কিনে দিয়েছেন। ঈদে পার্বনে নতুন পোশাকের ঘ্রাণে মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। অথচ নিজে এক কাপড়ে কাটিয়েছেন বছরকে বছর। একবার রোড এক্সিডেন্টে জীবন সংশয়ে নিজে রক্ত দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছিলেন... ভাবতে ভাবতে চোখে জল এসে শুকিয়ে গেছে, কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই।

২.

অফিসের শত ব্যস্ততাই আবার নিজেকে ছেড়ে দিয়েছি এই ঢাকা শহরের যান্ত্রিকতায়। কিন্তু মন বড় ছুটি চায়। আর ভালো লাগে না এই ব্যস্ততা। পাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে গ্রামে ছুটলাম। গ্রাম আর গ্রাম নেই। নতুন নতুন ঘর বাড়ি, কলকারখানা, হাসপাতাল। চিরচেনা গ্রাম আমার অচেনা মনে হলো। যে স্কুলে পড়তাম সেই স্কুলটা পুরনো শরীরে এখনো নতুন রঙে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।

স্কুল বন্ধুদের কারো কারো সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে শৈশবের ধুলো মাখলাম। কত স্মৃতি রোমন্থন হলো। আমার গ্রামে আসার প্রধান যে কারণ, তা হলো মাস্টার মশাই। খোঁজ নিয়ে জানলাম স্কুল থেকে অবসর নিয়েছেন বছর চারেক। একমাত্র মেয়ে তার ক্যানসার। তাকে বাঁচাতেই তার ঘরদোর সব গেছে। এখন কোথায় কেমন আছেন কেউ জানে না। ঢাকায় ক্যানসার হাসপাতালে ক'দিন চিকিৎসা করাচ্ছিলেন। তারপরের পর খবর আর কেউ বলতে পারে না। গ্রামে আর ভালো লাগল না, মুহূর্তেই যেন মেঘে ঢেকে দিল সারাটা আকাশ।

বিস্টু বাবুর মিষ্টির দোকানে মাস্টার মশাইয়ের ঠিকানা পাওয়া গেল। ঢাকার যেখানটাতে অস্থায়ীভাবে থাকতেন। ওখানে গেলে হয়তো জানা যাবে এখনকার ঠিকানা।

৩.

নিতু। মাস্টার মশাইয়ের মেয়ে। আমাদের সঙ্গে পড়ত। এক সঙ্গে কেটেছে জীবনে ষোলোটা বছর। ওকে কখনো রাগ করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সব সময় হাসি মুখে থাকত।

একদিন বড় মামার বিয়ের রাতে বলেছিল- 'তোমার সঙ্গে কথা আছে।' তারপর আর কথা হয়নি নিতুর সঙ্গে।

নিতুর ক্যানসার। মানতে পারছি না। ঈশ্বরের ওপর খুব রাগ হচ্ছে। বিস্টু বাবুর দেওয়া ঠিকানা মোতাবেক অফিসের গাড়ি নিয়ে ছুটলাম কমলাপুর কলোনির মোড়। না, মিলল না মাস্টার মশাইয়ের হদিস। অপরাধ বোধ বেড়ে গেছে। কিছুতেই আর শান্তি পাচ্ছিলাম না।

আমি যখন এগারো বছরের তখন বাবার মৃতু্য হয়। বন্ধ হতে বসেছিল আমার লেখাপড়া।

তারপর মাস্টার মশাই আমাকে দিলেন বাবার আদর আর শাসন।

৪.

তাকাই যতদূর, যতদূরে যেতে মন চায়; দৃষ্টি পৌঁছায় না তত দূর। শুধু ধোঁয়াশা, ঘোলাটে, অস্পষ্ট লাগে চারদিক। অস্বস্তি পিছু ছাড়ে না। অফিসের কাজের পাহাড় মস্তিষ্কে ঘা মারছে।

মোবাইলে এগারোটা মিস কল ওঠে আছে, খেয়াল করিনি। আননোন নাম্বার ... তাই ধরা হয়নি। মাস্টার মশাইয়ের ফোন নয়তো? না না তা কি করে হয়! আমার ফোন নাম্বারতো ওনার কাছে থাকার কথা নয়! তবু চিন্তা বাড়ে। বাড়ে টেনশন। ওই নাম্বারে কল করি। একবার, দু'বার, বেশ কয়েকবার। বন্ধ।

মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। কোনো কাজেই মন বসাতে ব্যর্থ হই। কোথায় গেলেন মাস্টার মশাই!

৫.

হাসপাতালের বারান্দায় চোখ মুছে আমারও কেটেছে অনেক দিন। দীর্ঘশ্বাস বুকের ভেতরে জমা হয়ে পাথর হয়েছে। মা'কে নিয়ে আমিও ডাক্তার বদলেছি, পাল্টেছি হাসপাতাল। কিন্তু মা চলে গেছে। এখন সচ্ছলতা এলেও মা নেই, মায়ের দেখা হলো না কিছুই। রামুকে নিয়ে কমলাপুরে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে আছি। রামু আমার অনেক বিশ্বস্ত কাজের মানুষ। শত আপদবিপদেও পিছু ছাড়েনি। আপন বলতে তেমন কেউ নেই। ওকে নিয়েই আমার সংসার।

এগারো মিসকলের ওই নাম্বারে মাঝে মাঝে কল দিই, ওটা বরাবরের মত বন্ধ। রামুকে বলেছি, যদি আবার তার দেখা পায় পা ধরে ক্ষমা চেয়ে নেব। আমি কেন তার খোঁজ রাখলাম না। আমার তো উচিত ছিল বিপদের দিনে ওর পাশে থাকার...! আসলে মায়ের চলে যাওয়াটা আমার সবকিছুকে বদলে দিয়েছিল। রাত ১টার ট্রেনের হুইসেল বাজল। এত রাতে আমাকে পায়চারী করতে দেখে রামু ওঠে এলো। কপালে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

৬.

নিতুকে মনে পড়ে। খুব। মাস্টার মশাইয়ের মুখটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। পুজোর ছুটি পেয়ে গেলাম সাত দিন। রামু বলল, কোথাও বেড়িয়ে এসো বাবা। ভালো লাগবে। কিন্তু কোথায় যাব! কোথাও ভালো লাগে না আমার। এসব সাত পাঁচ ভাবছি। সহসা সহেলীর ফোন- হ্যালো তমাল, তোর মাস্টার মশাইয়ের একটা ঠিকানা পেয়েছি। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারিস।

সহেলী আমার কলেজের বন্ধু। গ্রাম সুবাদে আত্মীয়। চট্টগ্রামে ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে। এক ছেলে আর ইঞ্জিনিয়ার স্বামীকে নিয়ে সোনার সংসার। মাঝে মাঝেই আমাকে ফোন করে। কিছু যেন বলতে চায়, কিন্তু বলে না। মানুষের হৃদয়ের বিচিত্র রং কখনো হলুদ কখনো সবুজ কখনো বা অন্য কোনো রঙের। যার হদিস মানুষ নিজেই জানে না। সহেলী সব সময় পরিপাটি থাকতেই পছন্দ। ইস্ত্রি করা নতুন পোশাকেই ওকে সব সময় দেখতাম। যা থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ বের হতো। এখনো গন্ধটা মাঝে মধ্যে জড়িয়ে ধরে। খুব অবাক হই।

ঠিক করলাম- কালই মাস্টার মশাইয়ের সন্ধানে বের হব।

৭.

সন্ধ্যে ৬টায় ট্রেন। আমার চেয়ে রামুই বেশি ব্যস্ত। আমার প্রয়োজনীয় পোশাক-পরিচ্ছদসহ অন্যান্য সামগ্রী, ওষুধ, কিছু শুকনা খাবার গুছিয়ে দিতে দিতে রামু বলল, সাবধানে যেও বাবা। ফোন খোলা রেখ। তুমি না ফেরা পর্যন্ত আমার ঘুম হবে না। আমার খুব টেনশন হবে। সময়মতো খেও কিন্তু। মাথাব্যথার ওষুধটা ব্যাগের ডান পকেটে রেখেছি।

\হএক নাগাড়ে বলে গেল রামু। ঠিক আমার মায়ের মতো। এমন করে আমার খেয়াল আর কে রাখব! পয়সা দিলে কাজের লোক হয়তো মেলে, কিন্তু এমন নিখাদ ভালোবাসা জোটে না। সাড়ে ৫টার দিকে অফিসের হাসান ভাই নিজে গাড়ি করে আমাকে রেলস্টেশন অবধি পৌঁছে দিয়ে গেলেন। ঘড়িতে তখন ৫টা পঞ্চান্ন। ট্রেন লেট। আধা ঘণ্টা দেরি হবে। টি স্টল থেকে গরম কফি আর সল্টেড বিস্কুটে আমার কিছুটা সময় বেশ কাটল।

ট্রেন এলো সন্ধ্যা ৬টা পঁয়ত্রিশে।

টিকিট কাটার ঝামেলা আগে থেকেই মিটিয়ে রেখে ছিলাম। তাই নির্বিঘ্নে ট্রেনে চেপে বসলাম।

পৌঁছতে পৌঁছতে ভোর হয়ে যাবে। আড়মোড়া দিয়ে তাই দীর্ঘযাত্রার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। জানালায় চোখ মুহূর্তেই হারিয়ে গেলাম শৈশবে। ডুব সাঁতার, গোলস্নাছুট, লাটাই ঘুড়ি, লাটিম, রকমারি চকচকে মার্বেলের মিষ্টি ছেলেবেলা আমার। কত তাড়াহুড়ো করে ফুরিয়ে গেল।

রেলস্টেশনে এলেই ট্রেনের কাছাকাছি হলেই কেমন একটা প্রাচীন গন্ধ পাই। যত নতুন করেই সাজানো হোক কেমন এক পুরনো হারানো ঐতিহ্য ছুঁয়ে থাকে এখানে। তাই বরাবরের মতো মনটা পুরনোতে ডুব দিতে থাকল। বাবার হাত ধরে প্রথম ট্রেনে ওঠার স্মৃতি বড় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথম ঢাকাতে এসেছিলাম ট্রেনে, মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে। নিতু তখন ছোট্ট এতটুকু। আর আমিও। আবৃত্তিতে বিভাগে প্রথম হওয়ার সুবাদে ঢাকা যাওয়া। সবাই যখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল মাস্টার মশাই তখন আমার পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন- দুনিয়া শুধু সাহসী লোকদের জন্য, দুনিয়া চেষ্টাকারীর। আমি তোমাকে নিয়ে যাব। সেই প্রথম আমার রাজধানী পদার্পণ। ঢাকায় আবৃত্তিতে তৃতীয় হয়েছিলাম তাতেই মাস্টার মশাইয়ের কি যে আনন্দ! আজো মনে পড়লে চোখের পাতা ভিজে আসে।

ট্রেনের দোলে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। হকার আর কুলির হাক ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ভোর ৫টা। খুলনা পৌঁছাতে আরও ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। সহেলীর দেওয়া ঠিকানাতে আরও কয়েকবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। মোবাইলে খেয়াল করলাম রামুর ৫টা মিসকল ওঠে আছে। রামুকে ফোন করে জানালাম ভালো আছি। পৌঁছাতে আর অল্প কিছুক্ষণ লাগবে। ঠিকমতো ওষুধ ও খাবার খেয়ে নিয়েছি।

৮.

\হখুলনায় ট্রেন থামল, তখন সকাল ৮টা। খুব ক্লান্ত লাগছিল। স্টেশন থেকে জলপান সেরে রিকশা নিলাম। রামু আর সহেলীকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম- পৌঁছে গেছি। ময়লাপোতায় ডাল মিল থেকে ডানে কিছুক্ষণ যাওয়ার পরই আইডিয়াল স্কুল, তারপর গোরস্থান। রিকশা থামিয়ে ঠিকানা অনুযায়ী খোঁজখবর নিলাম।

হঁ্যা, 'মায়ের ছায়া' নামক বাড়ি পেলাম। কিন্তু সেখানে কেউ থাকে না। একজন বাচ্চা মেয়ে বলল- এখানে এক বুড়ো দাদু থাকেন। ওই বাড়িটা দেখভাল করে। ক'দিন থেকে তাকেও আর দেখা যাচ্ছে না। শুনেছি অসুস্থ। একজন মেয়ে এসে ওকে নিয়ে গেছে। আমি আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। তবে ওই বুড়ো দাদুই কি মাস্টার মশাই! যে মেয়েটা ওকে নিয়ে গেছে ওই কি নিতু? না না প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগল।

মোবাইল নম্বর চাইলে এক মহিলা, সম্ভবত বাচ্চাটার মা- কাগজে লিখে দিলেন ওর নাম্বার। নাম জিজ্ঞেস করতেই আর বলতে পারলেন না। বললেন, আমরা সবাই ওনাকে পন্ডিত মশাই বলেই জানি। আমি পন্ডিতমশাইয়ের নাম্বারে কল দিলাম, পরিচয় দিলাম। কে একজন ভদ্রলোক বললেন, উনি অসুস্থ। আপনি কাল সকাল ১১টার দিকে ফোন দিলে হয়তো পন্ডিত মশাইকে ফোনে পাবেন। আর কিছু বলার আগে ফোন কেটে গেল। আমি সোজা রিকশা নিয়ে পিকচার প্যালেস ছাড়িয়ে হোটেল দু্যতিতে সিফ্‌ট করলাম।

আমার আর দেরি একেবারেই সহ্য হচ্ছিল না। মাথাটা বন বন করে ঘুরতে লাগল।

৯.

বাইরে এসে হোটেলে এর আগেও রাত কাটিয়েছি বেশ কয়েকবার। কিন্তু এতটা একলা লাগেনি। টেনশন হচ্ছিল, ঘেমে যাচ্ছিলাম। খবরের কাগজে ডুবে থাকলাম কিছুক্ষণ। নাহ্‌ আজ আর ঘুম আসবে না। মানিব্যাগে মাস্টার মশাই আর আমার একটা ফটো ছিল। অনেক আগেকার। তখন আমি ক্লাস ফোর, হাফ প্যান্ট। সাদাকালো ছবিতে আমি মাস্টার মশাইয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আমার ঘাড়ে মাস্টার মশাইয়ের হাত। আমার ভরসা আর প্রেরণার উৎস। আমার এগিয়ে যাওয়ার দুরন্ত সাহস। উনি বলতেন, 'দুনিয়া সাহসী মানুষের জন্য খোকা।' কথাটা এখনো কানে বাজে। বুকে এসে লাগে।

ফটোতে চোখ রেখে স্মৃতির দোলনা চেপে কেটে গেল রাত। সকাল সকাল বিছানা ছাড়লাম। চা নাস্তা আর একগাদা কাগজ পড়েও সময় যেন একই জায়গায় থেমে থাকল।

১০.

সকাল ১১টা। পন্ডিত মশাইকে ফোন দিলাম- হ্যালো আমি তমাল। কাল ফোন করেছিলাম...

ওদিক থেকে সেই একই কণ্ঠে উত্তর এলো- আপনি 'মায়ের ছায়া'তে চলে আসুন। আমরা ওখানে আছি।

দ্রম্নত রিকশা নিয়ে ছুটলাম। পন্ডিত মশাইয়ের দেখা মিলল। বিজয়কৃষ্ণ শর্মা। অসুস্থ মানুষ, লাঠি ভর দিয়ে এলেন আমার সামনে। কাঁপা কণ্ঠে বললেন- তুমিই তাহলে তমাল? তমাল মাহমুদ? তোমার কথা এত শুনেছি...। বস।

আমি মাস্টার মশাইয়ের আর নিতুর কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, এসো।

তারপর আমাকে নিয়ে গেলেন বাড়ির পেছন দিকটায় বকল গাছের তলায়। আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। পরপর দুটো কবর। এপিটাপে নিতু আর মাস্টার মশাইয়ের নাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না।

পন্ডিতমশাই চশমা খুলে চোখ মুছলেন। বললেন, 'নিতু মরে যাওয়ার পরও কিছুদিন বেঁচে ছিল। দেখতে দেখতে তিন বছর হয়ে গেল। আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমার কোলের মধ্যে মরে গেল। তোমার কথা কত শত বার ওর কাছে শুনেছি।'

আমি কাঁদতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমার চোয়াল শক্ত হয়ে আসছিল। কণ্ঠ শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল। বুকের ভেতরে ভারি একটা কিছু চেপে ধরেছিল আমায়।

তিন বছর? জানতেও পারিনি। কোনো খবর কেউ আমাকে দেয়নি। কিন্তু আমি কেন খোঁজ রাখিনি! আমি কেন খবর নিলাম না তার! আর গলির মোড়ে আমি বিজলির আলোতে কাকে দেখেছি! তবে কি আমার অবচেতন মনের খেয়াল! আমার বিবেকের যন্ত্রণা...! নিজেকে আমি কখনোই ক্ষমা করতে পারব না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে