হাশেম কবিরাজ

প্রকাশ | ০৫ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

আবু সাইদ কামাল
ডাক্তার বিদ্যাপতি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন এক বছর। সেই থেকে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে যত ব্যস্ততাই থাকুক, স্বাস্থ্যগত কারণে ভোরে হাঁটে। সেদিন ভোরের হাঁটা শেষ করে পার্কের একটি শেডে বসে গ্রীষ্মের নিলুয়া বাতাসে গা জুড়াচ্ছে। তখনি গাঁয়ের বাড়ি থেকে একটি ফোন আসে। ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী নাজমুল বলে, দাদা! হাশেম কবিরাজ গতরাত তিনটায় মারা গেছে। কোথায়, কেমনে মারা গেছে? নিজের ঘরেই। মনে অয় হার্ট অ্যাটাকে। হার্টের ডাক্তার হয়েও আমি জানতে পারলাম না! তিনি তো আমারই রোগী... হার্ট অ্যাটাকের পর চিকিৎসার সময় পায় নাই। মনে অয় কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা গেছে। হ্যাঁ, মারাত্মক অ্যাটাক হলে তো কোনো কোনো রোগী তিন মিনিটেই পরপারে চলে যায়। আর বেশি কথা হয়নি। ফোন ছেড়ে মনে মনে বলে, বয়স তো একেবারে কম হয় নাই। আশি ছুঁইছুঁই লোকটির এাঁ স্বাভাবিক মৃতু্যই বলা যায়। অসাধারণ ব্যক্তিটি নিয়ে স্মৃতিতাড়িত হয় বিদ্যাপতি। তাকে ঘিরে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা বিজ্ঞান বা প্রকৃতির নিয়মে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। লোকটির জন্মের পর থেকে এমন কিছু এলাকায় জনশ্রম্নতিতে পরিণত হয়েছে, যা অবিশ্বাসযোগ্য মনে হলেও মানুষ বিশ্বাস করে। সরকারি হাসপাতালের একজন প্রফেসর মর্যাদার ডাকসাইটে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হলেও ডা. বিদ্যাপতিজির সঙ্গেও যা ঘটেছে, তা অবিশ্বাস করে কী করে। কবিরাজ হাশেমকে ঘিরে যে কাহিনী শোনা যায় তা হলো এই : শেষরাতে ঘুম ভাঙলে হঠাৎ বিধবা মা বিছানা থেকে লাফিয়ে ওঠে। ভয়কাঁপা স্বরে বলে, এই আমার বিছনায় ক্যাডা রে! জবাবে চৌদ্দ বছরের এক কিশোর ছেলে বলে, আমি হাশেম আম্মা। কোন হাশেম তুই! বলতে বলতে কুপি বাতি ধরায় তয়মন বেগম। হাশেম বলে, নিজের পেডের পুতেরেও চিন না আম্মা! ততক্ষণ কুপিবাতির আলোয় উজ্জ্বল ঘরের বিছানায় অবাক চোখে তাকিয়ে তয়মন বেওয়া থ বনে। মায়ামাখা ছেলেটার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে কয়, কোন হাশেম! তরে তো আমি চিনি না। আমার বিছানায় তুই আইলি কেমনে? ঘরের কপাটই খুইল্যা দিছে ক্যাডা! শোন আম্মা! জোরে চিলস্নাইয়ো না। মাইনসে হুনলে ঝামেলা অইব। আগে কতাগুলি হুইন্যা লও। আমি সব কইতাছি। হাশেম নামে তোমার চৌদ্দদিনের একটা পুত ঘরেত্যে নাই অইয়া গেছিল না! আমি হেই হাশেম। তুই আমার হাশেম! আমারে হারাইয়া তুমি কত কান্নাকাটি করছ। মনে আছে, আমারে যে বাঁশঝাড়ের আগাত দেখছিলা... হ। বাঁশঝাড়ের আগায় সুন্দর একটা বিছনায় তরে দেইখ্যা যহন কানতেছি, তহন সবাই কইল আমার মাতা নাকি নষ্ট অইয়া গেছে। কেউ কেউ কইছে, আমার পোলারে বান্দরে লইয়া গেছে। তুই অতদিন কই আছিলেরে বাজান! পরিস্তান। ঐডা আবার কোন হানে? আমিও তো জানি না। হাচাই কি তরে পরী লইয়া গেছিল! হ আম্মা। কিন্তুক এইসব কতা কেউরে কউন যাইব না। তাইলে আমার ক্ষতি অইব। আমারে আবার লইয়া যাইব গা। তাইলে মাইনসে তর কতা জিগাইলে কী কইয়াম! কইবা মা-বাপ, বাড়ি-ঘর বা কোনো ঠিকানা নাই আমার। তোমারে মা ডাইক্যা আশ্রয় চাইছে। তুই যে পরিস্তানে আছিলি, কেডা তরে পালছে। অতকিছু কওন যাইব না আম্মা। যে আমারে লইয়া আইছে, আশেপাশেই সে আছে। এইডা কী কসরে বাজান! বলেই তয়মন বেওয়া ভয়ে জড়সড় হয়। ভয়ার্ত মাকে অভয় দিয়ে হাশেম বলে, ডরাইও না আম্মা। তোমরার ডরের কোনো কারণ নাই। শুধু এইটুক হিসাব কইরা দেখ, চৌদ্দদিনের সময় আমারে যে নিয়া গেছিল, আইজ চৌদ্দ বছর পূরণের দিন আবার তোমার কাছে লইয়া আইছে। তয়মন বেওয়া চুপি চুপি কিছুক্ষণ কী যেন হিসাব করে। অতঃপর সরব হয়ে বলে, হ হ চৌদ্দ বছর আগেই তো তুই অইছিলি। এভাবে মা ও ছেলের এমন আলাপ-আলোচনায় ভোরের আলো ফোটে। মা তয়মন বলে, তর পিরানডা একটু খুলছেন দেহি! কের লাগি আম্মা? কত বড় অইছস একটু দেহি! মায়ের কথা রেখে গায়ের জামা খুলে হাশেম। অমনি বাহুতে ধরে মা বলে, এই তো তর হেই জন্মদাগ। হ, তুই আমার হেই হাশেম। তুই আমারে থইয়া আর কোনহানে যাইস না বাজান! আইচ্ছা আম্মা। হুন তাইলে, তরে দেখলে তো মাইনসে নানান কতা জিগাইব। তহন তুই কোনো কতা কইস না। যা কওনের আমি কইয়াম। বলে তয়মন বেওয়া কপাট খুলে ঘরের বাইরে যায়। খানিকক্ষণ পরে হাত-মুখ ধুয়ে আবার ঘরে আসে। মায়ের সামনেই হাশেম আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে। মুহূর্তের মধ্যেই এক প্যাকেট মিষ্টি আসে হাতে। মায়ের হাতে মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে বলে, এই নেও আম্মা! কী! মিষ্টি। এত বছর পরে বাড়িত আইলাম, মিষ্টিমুখ করবা না! এত ভোরে মিষ্টি পাইলে কই! আমি হাত বাড়াইলেই দেয়। কেডা দেয়! অতকিছু কওন যাইব না আম্মা। ছেলের কথা শুনে অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে মা। দুই ছেলের অলৌকিক কান্ড দেখে মায়ের ভিতর দেশে যে বিস্ময়ঘন আনন্দের রসায়ন চলে, তা কাউকে বুঝতে দেয়নি। ততক্ষণে তিন ছেলেমেয়েকে সকাল সকাল ঘুম থেকে ডেকে তোলে। বড় ছেলের ঘরে সবাইকে ডেকে নিয়ে ঘটনা খুলে বলে। বড় ছেলের বউ বলে, যাইয়া একটু দেখি! শাশুড়ি বাধা দিয়ে বলে, না। কোনো সাড়া-শব্দ করা যাইব না। ততক্ষণে সবার হাতে মিষ্টি বিলাতে বিলাতে বলে, পাড়ার কারও কাছে আসল ঘটনা কওন যাইব না। খালি কইতে অইব, কইত্তে আইছে কিছুই কইবার পারে না। একদিন তার মা হঠাৎ অসুস্থ হয়। হাশেম মাকে গাছের শেকড়ের ওষুধ বানিয়ে দেয়। তাতে মা তয়মন বেগম সুস্থ হয়। অতঃপর পরিবারের সদস্যদের কেউ অসুস্থ হলে হাশেমের ওষুধে ভালো হয়। পরিবার থেকে পাড়ায় তার চিকিৎসার কথা ছড়ায়। এভাবে ক্রমে হাশেম কবিরাজ বলে পরিচিতি পায়। চিকিৎসার বিনিময়ে বাড়ে আয়। সঙ্গে বাড়ে এলাকায় কদর। বিদ্যাপতিদের বাড়িতে হাশেমদের পারিবারিক সুসম্পর্ক অনেক আগে থেকেই। হাশেম কবিরাজ যখন তাগড়া যুবক তখন বিদ্যাপতি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। স্কুলের মেধাবী ছেলে। বিদ্যাপতি বেশ দুরন্ত। চিত্তও অস্থির। তার দুরন্তপনায় উদ্বিগ্ন মা-বাবা। তাতে লাগাম টেনে ধরতে মা ডেকে আনেন হাশেম কবিরাজকে। তার অস্থির মস্তিষ্কে শান্তির বাতাস বইয়ে দিতে একটি তাবিজ দেয় কবিরাজ। তাতে বেঁকে বশে বিদ্যাপতি। বলে তাবিজ সে গলায় ঝোলাবে না। বিকল্পে কালো তাগায় বেঁধে দেওয়া হয় বিদ্যাপতির ডান বাহুতে। তাতেও নিমরাজি সে। তবে একটা শর্ত দেয়। বিদ্যাপতি শুনেছে হাশেম কবিরাজ হাত বাড়িয়ে যা চায়, তা-ই অলৌকিকভাবে তার হাতে আসে। কিশোর বিদ্যাপতি বেশ কৌতূহলবশে কবিরাজকে বলে, হাশেম ভাই! আপনার হাতের আপেল খাইতে চাই! হাশেম কবিরাজ প্রথমে রাজি হয় না। বিদ্যাতির মাও তখন ছেলের বায়না পূরণের জন্য অনুরোধ করে। কবিরাজ তখন ঘরের বারান্দার এক নীরব প্রান্তে দাঁড়িয়ে মা ও ছেলের সামনে দু'চোখ বন্ধ করে শূন্যে হাত বাড়ায়। কিছুক্ষণের মধ্যে তার দেহে একটা সূক্ষ্ণ ঝাঁকুনি খায়। চোখে-মুখে অপার্থিব একটা পরিবর্তন দেখা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তার হাতে সদ্যকাটা একটা আপেলের অর্ধাংশ দেখা যায়। অমনি সে চোখ খুলে হেসে কাটা আপেলের অংশটি বিদ্যাপতির হাতে দিয়ে বলে, নেও! খাও। তার এই অলৌকিক কান্ড দেখে মা ও ছেলে অবাক। এই কবিরাজ সম্পর্কে মা আরও অনেক কাহিনী শুনেছে। তাই মা আবার বায়না ধরে। বলে, বাবা হাশেম! ব্যস্ত মানুষ তুমি। বলতে বলতে তাবিজ-তদবির বাবদ কিছু টাকা তার হাতে তুলে দেয়। তারপর বলে, শুনছি তুমি অনেক কিছু জান। আমার একটা আবদারের কথা বলি! সাড়া দিয়ে কবিরাজ বলে, জি কাকিমা বলেন! কোনোদিন তো কাঁচা লং দেখি নাই। তুমি যদি দেখাইতে পারতা, মনের খায়েশ মিটত! জি অ কাকিমা। দেহি চেষ্টা কইরা। বলেই হাশেম কবিরাজ আবার দু'চোখ বন্ধ করে। ডানহাত শূন্যে তুলে তার মতো করে প্রার্থনার মতো আবেদন জানায়। আগের মতোই তার মাঝে দৈহিক পরিবর্তন দেখা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে মুঠ বন্ধ করে। দু'চোখ খুলে হেসে দিয়ে বলে, এই নেন কাকিমা! বলেই মুঠভরা কাঁচা লং বিদ্যাপতির মায়ের হাতে দিয়ে হাশেম কবিরাজ বিদায় নেয়। তাবিজে দুরন্ত বিদ্যাপতির কতটুকু কাজ হয়েছে তা যাচাইয়ের আগেই ঘটনাটা ঘটে। তাবিজ হাতে দেওয়ার পনেরো দিন অতীত হতে পারেনি। পুকুরে বন্ধুদের সঙ্গে ডুব-সাঁতার খেলতে গিয়ে কখন যে পুকুরের জলে তাবিজ হারায়, তা আঁচ করতে পারেনি। দুপুরে স্নান সেরে বাড়ি গেলে মা বলে, কী রে বিদ্যাপতি! হাতের তাবিজ কই? বাহুর দিকে তাকিয়ে বিদ্যাপতি বলে, তাই তো তাবিজ গেল কই? পুকুরে স্নান করতে নামার সময়ও তো তাবিজ আছিল। নিশ্চিত পুকুর-জলে পড়ে গেছে। তাবিজ জলে পড়ল, আর তুই টের পাইলি না! এইডা বুঝি কথা... পরদিনই মা হাশেম কবিরাজকে খবর দেন। বিকালেই হাশেম কবিরাজ বাড়িতে আসে। মা ঘটনা খুলে বলে। জবাবে হাশেম কবিরাজ বলে, দীঘির পানিত পড়লে কি আর তাবিজ পাওয়া যাইব? বিদ্যাপতির মা বলে, আমার বিশ্বাস তুমি হারানো তাবিজটা উদ্ধার করতে পারবা। একটু চেষ্টা কইরা দেখ বাবা! আচ্ছা, এত কইরা যহন কইতেছেন, দেহি কী করন যায়। বলেই সে দু'চোখ বন্ধ করে শূন্যে হাত মেলে ধরে। কিছুক্ষণের মধ্যে তার প্রসারিত হাতে তাবিজটা আসে। হাশেম কবিরাজ মুষ্টি বন্ধ করে। বিদ্যাপতির মায়ের কাছে গিয়ে মুঠ খেলে। মা আবার বিদ্যাপতির হাতে তাবিজটি পরিয়ে দেয়। কিশোর বিদ্যাপতি খেয়াল করে দেখে বিভিন্ন সময় তাবিজটির নানা স্থানে যে কামড়িয়েছিল, তাতে তাবিজের নানা জায়গায় দেবে গিয়েছিল। অবিকল সেই তাবিজটিই ফিরিয়ে এনেছে কাশেম কবিরাজ। তিন পরের বছরই জাতীয় জীবনে একটি বিপর্যয় ঘটে। বর্বরোচিত হত্যাকান্ড ঘটিয়ে পটপরিবর্তন করা হয়। অস্থির হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ। বিদ্যাপতি তখন লেখাপড়ায় গভীর মনোযোগী। সাফল্যের সাথে এএসসি পাসের পর চলে যায় জেলা শহরে। কলেজজীবন শেষে যায় পাশের বিভাগীয় শহরের মেডিকেল কলেজে। ততদিনে হাশেম কবিরাজের যশ ছড়িয়েছে অনেক দূর। তার বড় চাচা হাইকোর্টের উকিল। মাঝেমধ্যে বাড়ি এলে ভাইপোর অলৌকিক ঘটনাবলি সম্পর্কে জানতে পারে। দেশে তখন সামরিক শাসন। সেনাশাসনের গায়ে গণতন্ত্রের পোশাক পরানোর প্রক্রিয়া চলে। তখন হাশেমের বড় চাচা তাতে যোগ দেয়। কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই নিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি। ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তির সঙ্গেও তাঁর ওঠাবসা। চাচার মাধ্যমেই হাশেম কবিরাজের অলৌকিক কর্মকান্ডের খবর যায় পাওয়ার হাউজের চালিকা শক্তির কাছে। হাশেম কবিরাজকে নেওয়া হয় ঢাকায়। চাচা আদালতে যাবেন। পাগলাটে স্বভাবের হাশেমের প্রতি তেমন আস্থা নেই। যদি চাচাকে না বলে বাড়ি বা অন্য কোথাও চলে যায়; এ ভয়ে হাশেম কবিরাজকে বাসার একটি কক্ষে তালাবদ্ধ করে কোর্টে যায় চাচা। আদালতে তার নিজের চেম্বারে ঢুকেই উকিল সাহেব অবাক। চাচার আসনে বসে আছে ভাতিজা হাশেম কবিরাজ। উকিল চাচা ভাবেন, এ কী করে সম্ভব! এই চাচার মাধ্যমেই রাষ্ট্র-ক্ষমতার প্রধান ব্যক্তি পর্যন্ত যাওয়ার সৌভাগ্য হয় হাশেম কবিরাজের। এলাকায় জনশ্রম্নতি আছে, জনৈক সামরিক শাসকের হাতের আঙুল কিংবা গলায় ঝুলন্ত লকেটে ছিল হাশেম কবিরাজের অলৌকিক আকিক পাথর। একবার বিদেশে-ভ্রমণে হাশেম কবিরাজ নাকি তার সফর সঙ্গীও হয়েছে। চার বিদ্যাপতি ততদিনে ডাক্তারি পাস করে চাকরি নিয়েছেন। বিয়ে উপলক্ষে বাড়ি এলে হাশেম কবিরাজের সঙ্গে দেখা। তখন বিদ্যাপতি তার কাছে বায়না ধরে। বলে, অনেকদিন পরে আপনাকে পেলাম, আজ একটা কিছু খাওয়াতে হবে হাশেম ভাই! কী খাইবা? আপনার যা মন চায়, অলৌকিভাবে পাওয়া খাবার একটা কিছু হলেই চলবে। হাশেম কবিরাজ বিদ্যাপতির আবদার ফেলতে পারেনি। বিদ্যাপতিদের বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে শূন্যে হাত বাড়ায়। পলকের মধ্যে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে। তারপর দুচোখ খুলে বিদ্যাপতিকে বলে, চোখ বন্ধ করো! কথামতো বিদ্যাপতি দু'চোখ বন্ধ করে। হাশেম কবিরাজ বলে, হাত মেলাও! অমনি বিদ্যাপতি হাত মেলে ধরে। হাশেম কবিরাজ তার হাতে মহার্ঘ কিছু দিয়ে বলে, হাত বন্ধ কর! ঘরের ভিতরে গিয়া হাত খুলবা! নতুন বউয়েরে লইয়া খাইবা! বলেই হাশেম কবিরাজ বিদায় নেয়। বিদ্যাপতি ঘরে গিয়ে মুঠি খুলে দেখে ছোট্ট এক প্যাকেট বিস্কুট। বিস্কুটের প্যাকেটটি সযত্নে রেখে দেয়। ক'দিন পর নববধূ বাড়ি এলে দুজন মিলে সুস্বাদু বিস্কুট খায়। বছর দুই দূরের কর্মস্থলে চাকরি করে বিদ্যাপতি। তারপর আসে নিজের জেলা শহরে। তখন থেকেই নিজের উপজেলা সদরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে বিদ্যাপতি। কিছুদিনের মধ্যেই চিকিৎসায় যশ ছড়ায়। এ সময়ে হাশেম কবিরাজ তার অসুস্থ মাকে নিয়ে বিদ্যাপতির চেম্বারে যায়। চিকিৎসা দেওয়ার সময় হাশেম কবিরাজকে বাইরে যেতে বলে। তখন একান্তে তার মা'র কাছে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা চাচি! সত্যিই কি হাশেম কবিরাজকে চৌদ্দদিনের শিশুকালে হারাইছিলেন? হ বাজান! আচম্বিৎ ঘরেত্যে নাই অয়া গেল। কত খোঁজাখুঁজি করছি। শেষে তো আশা ছাইড়াই দিছিলাম। চৌদ্দ বছর পরে শেষ রাইতে ঘুম ভাঙলে দেহি আমার লগে হুইত্যা রইছে। এতদিন কই আছিল, তা কি আপনাকে বলছে? না। জিগাইলে কয়, কওন যাইত না। তার ক্ষতি অইব। কওছেন দেহি, মা অইয়া কি পোলার ক্ষতি চাইবার পারি? ততদিনে বিদ্যাপতি চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হয়। দিনে দিনে পসার বাড়ে। চাকরি জীবনে উত্তরোত্তর আসে পদোন্নতি। জেলা শহরে যখন মেডিকেল কলেজে কর্মরত, তখন গ্রামের বাড়িতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কাশেম কবিরাজদের গোষ্ঠীগত দাঙ্গা হয়। সেই মারামারিতে হাশেম কবিরাজ আহত হয়ে জেলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়। ওই খবর শুনে বিদ্যাপতি একই হাসাপাতালে কর্মরত থাকায় হাশেম কবিরাজকে দেখতে যায়। যতটা পারে চিকিৎসায় সহযোগিতা করে। এ সময় হাশেম কবিরাজের সঙ্গে কথা হয়। তখন এক পর্যায়ে বিদ্যাপতি বলে, আচ্ছা হাশেম ভাই! আপনার তো অন্য রকম শক্তি আছে। তারপরও আপনি মার খাইলেন কেন? ইচ্ছা করলে আপনিও তো ওদের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারতেন! জবাবে হাশেম কবিরাজ বলে, না পারতাম না। ওরা আমরার জাগতিক কোনো বিষয়ে নাক গলাইতে আইব না। হাসপাতালের চিকিৎসা নিয়ে ওরা সুস্থ হয়। তারপর একে একে সবাই নিজ নিজ বাড়ি চলে যায়। কিছুদিন পর গ্রামের বাড়ি গেলে হাশেম কবিরাজের সঙ্গে দেখা। তখন বিদ্যাপতি কৌতুক করে বলে, হাশেম ভাই! আজকেও আপেল খাইতে মন চাইতেছে। এক পিস আপেল আনার ব্যবস্থা করেন না! জবাবে হাশেম কবিরাজ বলে, আইচ্ছা। খাইবার যহন চাইতাছ, কী আর করা... কিন্তু আমার আর একটা কথা আছে। কী? আমি আপনার হাতে ধরে রাখব। আইচ্ছা ধর! বলেই হাশেম কবিরাজ পথের পাশে দাঁড়ায়। বিদ্যাপতি পাশে গিয়ে কবিরাজের বাড়ানো হাতে ধরে। হাশেম কবিরাজ দু'চোখ বন্ধ করে ধ্যানগ্রস্ত হয়। বিদ্যাপতি তখন হাশেম কবিরাজের দেহের কিছু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া টের পায়। ততক্ষণে চাকু দিয়ে সদ্যকাটা আপেলের অর্ধাংশ কবিরাজের হাতে আসে। সেটি বিদ্যাপতির হাতে দেয়। হাশেম কবিরাজের এমন অলৌকিক ঘটনা দেখে ডা. বিদ্যাপতির বিস্ময় আরও জোরালো হয়। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেশে এবং বিদেশে বহু সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে গিয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করেছে। কিন্তু হাশেম কবিরাজের এমন অলৌকিক কর্মকান্ডের কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছে না। অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে হাশেম কবিরাজের মধ্যে কোনো জাদু কিংবা অনুরূপ কোনো কৌশল আছে কিনা, তা দেখেছে। কিন্তু তেমন কোনো কিছুই খুঁজে পায়নি। বরং হাশেম কবিরাজকে নিয়ে সাধ্যমতো পর্যবেক্ষণ করে বুঝেছে, সে সত্যব্রত একজন কবিরাজ। তবে অশরীরী কারও দ্বারা শাসিত। তার মধ্যে কোনো ফাঁকিঝুঁকি নেই। কবিরাজি করে পাওয়া উপার্জনের একটি অংশ যে বা যারা তাকে নিয়ন্ত্রণ করে, শূন্যে হাত মেলে পাঠিয়েছে সেই অলৌকিক জগতে। সম্ভবত কবিরাজি ওষুধের নানা উপকরণ কেনার জন্য তা ব্যয় হয়ে থাকতে পারে। এ পেশায় আয়ের বাকি অংশ দিয়ে চালিয়েছে তার সংসার। পরিবারে স্ত্রী-সন্তান সবই আছে। খুব বেশি যে সচ্ছল পরিবার তা বলা যাবে না। তবে অনটনেও পড়েনি। হাশেম কবিরাজ করতো সহজ-সরল জীবন-যাপন। রহস্যমানব হাশেম কবিরাজ বিদ্যাপতির স্মৃতির জগতে স্থায়ী জায়গা দখল করে আছে।