শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১

বাংলা সাহিত্যে বর্ষা

এস ডি সুব্রত
  ০৫ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
বাংলা সাহিত্যে বর্ষা

বাঙালি কবি ও লেখকদের বর্ষা যতটা আলোড়িত করে অন্য কোন ঋতু ততটা পারে না। কবি, লেখক এমনকি সাধারণ মানুষের অন্তরে বর্ষার আবেদন একটু অন্য ইমেজের। বর্ষার ঝরঝর বারিধারায় আমাদের হৃদয়কে যুগপৎ আনন্দে ও বিরহে সিক্ত করে তুলে। শুধু কালিদাস, জয়দেব, বৈষ্ণব কবি কিংবা রবীন্দ্রনাথ নন, যুগে যুগে অনেক কবি-সাহিত্যিকদের হৃদয়ানুভূতিকে বর্ষা প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। আমাদের শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীতে বর্ষা আসে অপরূপ রূপে। বর্ষা আমাদের বাংলাদেশে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ঋতু। আমাদের বাংলাদেশে মেঘ বৃষ্টি বর্ষার রয়েছে বিরাট প্রভাব। মেঘ আর বৃষ্টির ছোঁয়ায় হৃদয় মন স্মৃতিকাতর হয়ে। হয় উদাস ব্যাকুল। বর্ষার প্রকৃতি যেন এক প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে আসে। কালো মেঘ, অঝোর বৃষ্টি যেন বর্ষার চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। বইয়ের হিসেবে আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল হলেও আমাদের দেশে বাস্তবতা অন্যরকম। বর্ষা স্থায়ী হয় প্রায় চার মাস। বর্ষার নতুন জলের ছোঁয়ায় প্রকৃতি সেজে ওঠে নতুন রূপে, সবুজে সবুজে। গ্রীষ্মের প্রখর রোদে যখন বাংলার মাঠ ঘাট বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকে, তখন বর্ষার জলধারায় নাকে ভেসে আসে সোঁদা মাটির গন্ধ। বাংলা কবিতায় বর্ষাকে নানাভাবে উপস্থাপন করেছেন মধ্যযুগের এবং আধুনিক যুগের কবিরা। বর্ষা নিয়ে ছোট বড় প্রায় সব কবির রয়েছে কোনো না কোনো কবিতা কিংবা ছড়া। কালিদাসের মেঘদূত কবিতায় রামগিরি পর্বতের ওপরে নির্বাসিত একাকি জীবনে মেঘ যখন পর্বতের ওপর দিয়ে ডানা মেলে উড়ে যায় তখন বিরহী যক্ষের মনে জেগে ওঠে প্রিয়ার বিরহের যাতনা। তখন তিনি মেঘকে দূত করে পাঠাতেন প্রিয়ার কাছে। এক খন্ড মেঘ কবির কল্পনায় হয়ে উঠেছে বিরহের বার্তাবাহক এক জীবন্ত দূত। মেঘদূত কবিতায় একটি শ্লোকের বাংলা অনুবাদ এ রকম,...

সংস্কৃত :

ধারাসিক্তস্থলসুরভিণস্‌ত্বন্মুখস্যাস্য বালে

দূরীভূতং প্রতনুমপি মাং পঞ্চবাণঃ ক্ষিণোতি

ধর্মান্তে স্মিন্বিগণয কথং বাসরাণি ব্রজেযুঃ

দিক্সংসক্তপ্রবিততঘনব্যস্তসূর্যাতপানি।

বাংলা :

'স্বপন-মিলনে যদি কভু প্রিয়ে তোমার হৃদয়ে ধরিতে যায়,

\হশূন্য আকাশে প্রসারিয়া বাহু বৃথাই কেবল দুঃখ পাই!

হেরি অভাগার গভীর যাতনা দেবতারও আঁখি সজল হয়,

তরু কিশলয়ে অশ্রম্ন মুকুতা ঝরি ঝরি পড়ে বেদনাময়!'

চন্ডীদাস তার তার বিরহের কথা কবিতায় প্রকাশ করেছেন এভাবে...

এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা

কেমনে আইল বাটে

আঙিনায় মাঝে বধূয়া ভিজিছে

দেখিয়া পরাণ ফাটে।

বিদ্যাপতির কবিতায় বর্ষা বিরহের রূপ দেখতে পাই নিম্নোক্ত ভাবে...

এ সখি হামারি দুঃখের নাহি ওর

এ ভরা ভাদর মাস ভাদ্র

শূন্য মন্দির মোর।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতায় বর্ষায় প্রকৃতি ও মানুষ মিলেমিশে একাকার। তিনি তার বর্ষা কবিতায় প্রকৃতি ও মানুষের বন্ধন খুঁজেছেন এভাবে...

'গভীর গর্জন করে সদা জলধর/উথলীল নদ নদী ধরণীর ওপর

রমণী রমণ লয়ে/সুখে খেলি করে/দানবাদি দেব যক্ষ সুখিত অন্দরে।'

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিখ্যাত 'সোনার তরী' কবিতায় বর্ষার মনোরম চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন কলমের আছরে।

'গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা

কূলে একা বসে আছি। নাহি ভরসা।

রাশি রাশি ভারা ভারা

ধান কাটা হলো সারা,...'

কবিগুরু তার আষাঢ় কবিতায় বর্ষা আর বৃষ্টির অনন্য চিত্র তুলে ধরেছেন...

'নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।

ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।

বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর

আউশের ক্ষেতে জলে ভরভর,...'

কবি নূরুল হুদা তার 'বৃষ্টি পড়ে' কবিতায় বৃষ্টিকে প্রকাশ করেছেন ভিন্ন মাত্রায়...

'বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে/মনে মনে বৃষ্টি পড়ে

বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে/বনে বনে বৃষ্টি পড়ে

মনের ঘরে চরের বনে/নিখিল নিঝুম গাও গেরামে

বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে/বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে।'

শামসুর রাহমান তার 'অনাবৃষ্টি' কবিতায় লিখেছেন...

'টেবিলে রয়েছি ঝুঁকে, আমিও চাষির মতো বড়

ব্যাঘ্র হয়ে চেয়ে আছি খাতার পাতায়,

যদি ঝড়ো হয় মেঘ, যদি ঝরে ফুলবৃষ্টি

অলস পেন্সিল হাতে বকমার্কা

পাতাজুড়ে আকাশের নীল।'

বর্ষা ও মেঘে আচ্ছন্ন হয়নি এমন কবি বাংলা ভাষায় খুঁজে পাওয়া ভার। বর্ষায় মেঘেরা যখন দল বেঁধে উড়ে যায় তখন কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের মনও উড়ে যায় মেঘের দেশে। একজন বিরহকাতর মানুষের মাঝে বর্ষার বৃষ্টি বিরহের বার্তা নিয়ে আসে। মানুষের মনের সমস্ত দুঃখ-সুখ, আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ মূর্ত হয়ে ওঠে বর্ষার ঝরঝর বারিধারায় প্রবলভাবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে