আলবেনিয়ান কবি ও ঔপন্যাসিক ইসমাইল কাদারে
প্রকাশ | ০৫ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
সালাম সালেহ উদদীন
পরপারে চলে গেলেন খ্যাতিমান লেখক ইসমাইল কাদারে। তিনি আলবেনিয়ান বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। একজন আলবেনিয়ান ঔপন্যাসিক, কবি, প্রাবন্ধিক, চিত্রনাট্যকার এবং নাট্যকার ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন একজন শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী। তার লেখা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়েছে।
আলবেনিয়ান সাহিত্যের প্রথম দিকের কাজগুলি ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের দ্বারা লেখা হয়েছিল, যাদের ভ্যাটিকানের সাথে সম্পর্ক তাদের কাজ আলবেনিয়ার বাইরে, বেশিরভাগ রোমে প্রকাশ করে তুর্কি বিধিনিষেধ এড়াতে সক্ষম করেছিল। প্রাচীনতম বই, ১৬ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৮ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত, বেশিরভাগই ধর্মীয় এবং শিক্ষামূলক ছিল। রোমান্টিসিজমের আবির্ভাবে এবং ১৮ এবং ১৯ শতকের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে একটি পরিবর্তন ঘটেছে। লোককাহিনী এবং ভাষাতত্ত্বকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য শৈলীগুলির পরিসর বিস্তৃত হয়েছে এবং একটি রোমান্টিক এবং দেশপ্রেমিক প্রকৃতির বইও আবির্ভূত হয়েছে। নতুন ধারার উদ্ভাবনকারী প্রথম পর্যায়ের লেখকরা হলেন আলবেনিয়ানরা যারা বহু শতাব্দী আগে সিসিলি এবং দক্ষিণ ইতালিতে স্থানান্তরিত হয়েছিল। এই ধারার উত্তর-সাধক ইসমাইল কাদারে।
ইসমাইল কাদারে ১৯৩৬ সালে আলবেনিয়ার জিরোকাস্ত্রায় জন্মগ্রহণ করেন। সাহিত্যে কবি হিসেবে তার সূচনা। মাত্র বারো বছর বয়সে প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তার প্রথম উপন্যাসের নাম দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি, প্রকাশকাল ১৯৬৩। আরেকটি উপন্যাস দ্য প্যালেস অব ড্রিমস ১৯৮১ সালে তার দেশের কমিনিউস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সূক্ষ্ণ সমালোচনার দায়ে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই নিষিদ্ধ হয়। পরবর্তীকালে কাদারে গণতন্ত্রের পক্ষে বিবৃতি দেন। ফলে তাকে ১৯৯০ সালে ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে হয়। আসলে আলবানিয়ার স্বৈরতন্ত্র অন্যান্য দেশের স্বৈরতন্ত্রের তুলনায় কঠোর ও নির্মম ছিল, এর একটি মূলগত কারণ হয়ত-বা এই যে, দেশটি খুবই অরক্ষিত অবস্থায় ছিল।
তিনি তার প্রথম উপন্যাস দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি প্রকাশের আগপর্যন্ত কবিতায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছিলেন- যা তাকে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান করে তোলে। তিনি লেখালেখির মাধ্যমে তার দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি অন্বেষণ করেছেন এবং অর্জন করেছেন একটি আন্তর্জাতিক পাঠকপ্রিয়তা। কাদারের বাবা একজন পোস্ট অফিসের কর্মচারী ছিলেন। পোস্ট অফিসের কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার ছেলেকে তিরানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করিয়েছিলেন। পরে কাদারে গোর্কি ইনস্টিটিউট অব ওয়ার্ল্ড লিটারেচারে পড়ালেখার জন্য মস্কো যান। ১৯৬০ সালে আলবেনিয়ায় ফিরে আসার পর, তিনি একজন সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেন। তারপরে তিনি শুরু করেন সাহিত্যিক হিসেবে কর্মজীবন। লেখালেখি করতে গিয়ে নানা বাধাবিপত্তির মধ্যে পড়েন তিনি। স্বৈরাচারী সরকার কর্তৃক হুমকির আশঙ্কায় এবং গ্রেপ্তারের ভয়ে, কাদারে ১৯৬০ ফ্রান্সে চলে যান। দ্য প্যালেস অব ড্রিমস। এটি ১৯৮০ সালে লিখেছিলেন তিনি। লেখার এক বছর পরে প্রকাশিত হয়েছিল। আলবেনিয়ান স্বৈরশাসনের সবচেয়ে কালোতম অধ্যায়ের চিত্র এই উপন্যাস। এটি ছিল সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটি হাতিয়ার।
'সাকসেসর' উপন্যাস সম্পর্কে কাদারের মন্তব্য, 'সাকসেসর' বাস্তব ঘটনার বেশ নিকটবর্তী উপন্যাস, অনেক ঘটনার মধ্যে যা শোনা যায়, জানা যায়, তা-ই উঠে এসেছে 'সাকসেসর'-এ। গল্পটার আসলে দুইটা পিঠ- রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক বিবরণ, মানে একটা আত্মহত্যা। আর আরেকটি হচ্ছে একটা গুজব, যে, তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমি এর সঙ্গে একটি তৃতীয় পিঠ বা চিত্র তুলে এনেছি তাকে তার পরিবারেরই কেউ হত্যা করেছে। এটা আমি নিজেও বিশ্বাস করি। কিন্তু সেই সত্য পর্যন্ত যাওয়ার জন্য আমি কোনো গোয়েন্দার সাহায্য নিইনি। সত্যের জন্য সত্য, যার দিকে আমাকে নিয়ে গেছে সাহিত্য।
কাদারে প্রথম জীবনে একজন আলবেনিয়ান কবি হিসেবে বিশ্বের সাহিত্যপ্রেমিদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, কিন্তু তার গদ্যের কাজই তাকে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এনে দেয়। তার কবিতার কিছু পংক্তি- গভীর এক আয়েশি ঘুম থেকে যখন/ কারও ফোন পেয়ে জেগে ওঠো ত্বরিত/ অপরপাশে তখন এক তৃষাতুর কণ্ঠ;/ তবু থরথর উষ্ণতায় কাঁপো তুমি/ জানবে, তখন শীতকাল।/এক গুচ্ছ নিঃসঙ্গতা সাথে করে/ নরম সোফায় তখন ক্রমশ ডুবে যাচ্ছি/ তখনই উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালাম/ বৃষ্টি হচ্ছিল বাইরে/ আমি কৃতজ্ঞচিত্তে টেলিফোনের লম্বা তারের দিকে তাকালাম/ এই তার তোমার কথা সরাসরি কোথাও না থামিয়ে/ কত দূর থেকে নিয়ে এসেছে আমার কাছে,/ তোমার চুলের গন্ধ থেকে,/ ঠোঁটের অনুগত রেখা থেকে আর/ পথের কত না চটকদার বিজ্ঞাপন এড়িয়ে/ তুমি কি কাঁদছিলে!
কাদারের কাজের বিষয়, যা প্রায়শই তার নিজের জীবনের ওপর প্রবলভাবে আঁকেন, আলবেনিয়ান ইতিহাস, রাজনীতি এবং লোককাহিনী, রক্তবিরোধ ঐতিহ্য এবং জাতিসত্তা অন্তর্ভুক্ত করে। তার কথাসাহিত্যে রোমান্টিকতা, বাস্তববাদ এবং পরাবাস্তবতার উপাদান রয়েছে- যা পাঠককে খুব সহজেই আকর্ষণ করে। সাহিত্যের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত নির্দেশিকা থেকে ভিন্নমত পোষণ করার জন্য তাকে রাশিয়ান কবি ইয়েভজেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তুলনা করা হয়েছে কলম্বিয়ান ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সঙ্গেও, আংশিকভাবে বিভ্রান্তিকর এবং পরাবাস্তব বিষয়ে তাদের সাধারণ আগ্রহের কারণে।
কাদারেকে ১৯৯৬ সালে ফরাসি একাডেমির সদস্যপদ দেয়া হয়েছিল এবং পরে তাকে ফরাসি লিজিয়ান অব অনারের একজন কর্মকর্তা করা হযয়েছিল। রাজনীতি সম্পর্কে তার ধারণা, আমরা সবাই একটি মিথ্যার জগতে বসবাস করছিলাম। অধিকাংশ তথাকথিত 'গণতান্ত্রিক' দেশেই এমনটা হয়ে থাকে।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমি দুটি ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার সময় সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছি: একটি কালোতম অধ্যায়- যা ৩৫ বছর ধরে চলে (১৯৫৫-১৯৯০) এবং ২০ বছরের স্বাধীনতা। উভয় ক্ষেত্রেই যে জিনিসটি সাহিত্যকে ধ্বংস করতে পারে তা একই: সেলফ-সেন্সরশিপ। অন্য এক জায়গায় তিনি বলেছেন, ম্যাকবেথ। আমি ১১ বছর বয়সে এটি পড়েছিলাম। যদিও আমি সবকিছু বুঝতে পারিনি, আমি বইটি এতটাই পছন্দ করেছিলাম যে, আমি এটি নিজ হাতে লিখে কপি করতে শুরু করেছিলাম। এক বছর পরে, আমি হ্যামলেট-এর ক্ষেত্রেও একই কাজ করতে চেয়েছিলাম- যা আমার কাছে আরও অবোধ্য ছিল।
৩০টিরও বেশি ভাষায় তার বই অনূদিত হয়েছে। তিনি ফ্রান্স এবং আলবেনিয়ায় তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন। ইসমাইল কাদারের সর্বশেষ উপন্যাস এ ডিক্টেটর কলস প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালে। ১ জুলাই, ৮৮ বছর বয়সে আলবেনিয়ার তিরানায় তিনি মারা যান। ২০০৫ সালে তিনি ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার বিজয়ী হন। কাদারের অন্যান্য সম্মানের মধ্যে রয়েছে সাহিত্যের জন্য নিউস্ট্যাড আন্তর্জাতিক পুরস্কার ২০২০। তবে তিনি সাহিত্যে নোবেল পাননি- যা তার প্রাপ্য ছিল।