শহীদুল জহিরের গল্প জাদুবাস্তবতার কুহক
প্রকাশ | ২৮ জুন ২০২৪, ০০:০০
সমীর আহমেদ
শহীদুল জহিরের গল্পবয়নকৌশল, কাঠামোশৈলী, চরিত্রচিত্রণ ও জাদুবাস্তবতার প্রয়োগদক্ষতাই গল্পবোদ্ধাদের মনে করিয়ে দেয় মার্কেসের কথা, তারপর সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহর। আর পুরান ঢাকার অলিগলি ও চালচিত্র এবং উত্তরবঙ্গ তথা তার জন্মস্থান সিরাজগঞ্জের জন্য আসে শক্তিমান কথাকোবিদ ইলিয়াসের নাম। এঁদের দ্বারা তিনি কম-বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন, একথা অস্বীকার করার উপায় নাই। তবে এঁদের ভেঙেচুরে তিনি বাংলা ছোটগল্পভুবনে এমন এক কারুকার্যখচিত বর্ণময় উজ্জ্বল সুউচ্চ সৌধ নির্মাণ করলেন, যা কেবলই শহীদুল জহিরের, স্বাতন্ত্র্যবৈশিষ্ট্যমন্ডিত ধীশক্তিরই পরিচায়ক। যদিও পারাপার- এর গল্পগুলো গতানুগতিক ধারার, এতে তার তেমন কোনো স্বাতন্ত্র্যসত্তার পরিচয় পাওয়া যায় না, তবে এক শক্তিমান কথাশিল্পীর আগমনের পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। স্বাতন্ত্র্যভঙ্গি স্বল্পতার কারণেই হয়তো তিনি পারাপার গল্পগ্রন্থটি পুনর্মুদ্রণ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেননি। কারণ ততদিনে বাংলা ছোটগল্পভুবনে তিনি তার জায়গাটি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। লিখে ফেলেছেন 'আগারগাঁ কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই', 'কাঠুরে ও দাঁড়কাক', 'ডুমুরখেকো মানুষ', 'আমাদের কুটিরশিল্পের ইতিহাস' এসব গল্প, যা আন্তর্জাতিক ছোটগল্পের অঙ্গনে যে কোনো বিবেচনায় তুল্য।
শহীদুলের গল্পের জায়গাজমিন দখল করে থাকে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবর্গের মানুষ, যারা টিকে থাকতে চায়, কিন্তু পারে না বা পেরে ওঠে না। সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের টিকে থাকতে দিতে চায় না। এখানে তারা চরম নিগৃহীত, বঞ্চিত, অত্যাচারিত, হতভাগ্য মানুষ। এই সব মানুষের জীবনযাপন, কথনশৈলী, প্রত্যাশা ও স্বপ্ন এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের সৃষ্ট ফাঁদে পড়ে তাদের অস্তিত্ব সংকটের তীব্রতা তিনি জীবন্ত করে তুলেছেন, বর্ণনাত্মক গল্পবয়ানরীতি এবং অল্পস্বল্প ডায়লগ নির্মাণের মাধ্যমে। প্রমিত এবং কথ্যভাষার সংমিশ্রণে নির্মিত তার গদ্যশৈলী আমাদের দৃশ্যমান জীবন ও সমাজবাস্তবতার অন্তর্কাঠামো এমনভাবে উন্মোচন করে দেয়, আমরা হতবাক বা বিমূঢ় হয়ে যাই, মানুষের মনোজগতের লোভ ও লিবিডোপ্রবৃত্তিজাত তাড়নার বৈচিত্র্যময়তায়, শোষিতের প্রতি শোষকের ভয়ংকর নিষ্ঠুরতায়। বস্তুত সমাজ ও রাষ্ট্রে নিত্য ঘটমান অসঙ্গতির অন্তর্ক্ষত, ক্ষমতা ও স্বার্থতাড়িত শোষকের সন্ত্রাসের নগ্নরূপ, নরনারীর প্রেম, যৌনতা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন এবং অস্তিত্বের টানাপোড়েনের আদিঅন্ত মোহময় জটিল মোড়কে তুলে ধরেছেন তিনি।
তার গল্পের আরেকটি প্রধান অনুষঙ্গ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরে, তার প্রত্যক্ষিত ঘটনাগুলোই টুকরো টুকরো হয়ে চিত্রিত হয় গল্পে, নিরাবেগ নিষ্ঠুরতায়। 'গতানগতিক ধারায় উপস্থাপনার পরিবর্তে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও দার্শনিকতায় তিনি বয়ান করেছেন, যা আমাদের আলোড়িত, ভাবিত, তাড়িত ও চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করে।' [ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প : শিল্পের চতুর্মাত্রিকতা : মিহির মুসাকী, লোক] এ কথা শুধু তার মুক্তিযুদ্ধের গল্পের ক্ষেত্রেই খাটে না। অন্য গল্পগুলোর ক্ষেত্রেও বলা যায়।
গল্পবলার প্রচলনরীতিকে উপেক্ষা করে, ভিন্নতর বয়ানভঙ্গির ভেতর দিয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন কুয়াশার দুর্ভেদ্য প্রাচীর। এ প্রাচীর ভেদ করতে গেলে পাঠকের কিছুটা মগজের প্রয়োজন পড়ে। সব পাঠক তার গল্পপাঠের রস আস্বাদন করতে পারবে না। 'তবে যেহেতু জহিরের ভাষাটি বেশ সহজ এবং (সিনট্যাক্স) প্রায় কথ্য ঢঙের কাছাকাছি, সর্বোপরি একটা চাপা হিউমার তাতে বিরাজমান থাকে, সে কারণে গল্পটি শেষ না করেও পাঠক স্বস্তি পায় না। পাশাপাশি গল্পে নানান মাত্রার রূপক ও ইলিউশন ব্যবহার করে জহির গল্পকে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় দাঁড় করান। সব মিলিয়ে প্রথাগত গল্পের তুলনায় জহিরের গল্প অনেক বেশি স্ক্যাটার্ড।' [শহীদুল জহিরের গল্প : 'আটকে-পড়া' বাঙালির বহুমাত্রিক যুদ্ধ ও আশাভঙ্গের কহনকথা, লোক, শহীদুর জহির সংখ্যা, ২০০৮] তার গল্পের জমিনে নামলেই তা টের পাওয়া যায়। যেমন-
'আগারগাঁ কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই' (১৯৯২) গল্পটির আখ্যান, আগারগাঁর কলোনির বাসিন্দা চাকরিজীবী আবদুস সাত্তার এবং তার স্ত্রী প্রকৃতি আসক্ত শিরিন বানুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। গল্পটির শুরু এ রকম-
'আবদুস সাত্তার বাসায় ফিরছিল, তালতলায় বাস থেকে নেমে বিকেলের নরম আলোয় পায়ে হেঁটে যখন তার কলোনির বাসার দিকে আসছিল তখন কেউ কেউ তাকে দেখছিল, যদিও শীর্ণ এবং কালো রঙের একজন মধ্য-বয়স্ক কেরানির অপিস শেষে গৃহে প্রত্যাবর্তনের এই নিত্যদিনের ঘটনা তাকিয়ে দেখার মতো কিছু ছিল না।'
এভাবে সরলভঙ্গিতে গল্পটি আরও কিছুদূর এগোতে থাকে। কাদাপানিতে আছাড় খেয়ে আবদুস সাত্তার বাসায় ফেরে। সেখানে আমরা তার স্ত্রী শিরিন বানুকে দেখতে পাই, যার কিনা রয়েছে নিবিড় নৈসর্গপ্রীতি। সে 'বাসাটির সর্বত্র টবে লাগানো রকমারি গাছে ভরে তোলে, বারান্দায় নয়নতারা এবং পাতাবাহার গাছের সঙ্গে রজনীগন্ধার চারা লাগায়।' তার 'প্রশ্রয়ে তাদের বাসার প্রতিটি দরজায় ঢলো ঢলো পাতাবাহারের বিস্তার ঘটে। বইয়ের তাক আর খাটের মশারিস্ট্যান্ডের ওপর থেকে ঝুলে থাকে সবুজ সাপের মতো মানিপস্নান্টের শাখা।' থাকে গুল্মজাতীয় ক্যাকটাস। কলোনিতে আসার পর শিরিন বানু 'চার বছর যাবৎ টবে গাছ জন্মানোর শিল্পের চর্চার চরম বিকাশ ঘটায়' এবং তা 'তাদের সীমানা অতিক্রম তাদের প্রতিবেশীদের গৃহে ছড়িয়ে পড়ে।' এর ফলে 'কলোনির এই সকল রমণী এবং তাদের পুরুষেরা জীবনের সৌন্দর্যকে শেষপর্যন্ত আবিষ্কার করতে শেখে, অর্থহীন এবং বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনের বৃক্ষময় অর্থময়তা খুঁজে নেয়,' অথচ এর মধ্যে আবদুস সাত্তারের সম্পৃক্ততা তেমন লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠে না। এরপর আগারগাঁর কলোনির পাশে বিমানবন্দর থেকে একদিন ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি এসে আগারগাঁর কলোনির এই ভবনের সামনে এসে নয়নতারা ফুলকে ঘিরে নাচতে থাকে। বারান্দায় প্রজাপতির ভিড়ের মধ্যে অবস্থান করে আবদুস সাত্তার। এখান থেকেই গল্পটির জাদুবাস্তবতা এবং জটিলতা শুরু হয়। এই দৃশ্যচিত্রে গল্পের প্রধান চরিত্র 'আবদুস সাত্তার একটি অজর এবং অবশ্যম্ভাবী প্রস্তরখন্ডের মতো নিশ্চল অস্তিত্ব নিয়ে জেগে থাকে'। কেন তার এভাবে জেগে থাকা? এ প্রশ্নের উত্তর এত তাড়াতাড়ি এবং এত সহজে মেলে না। এ জন্য পাঠককে ঘনঘোর রহস্যের ভেতর দিয়ে ক্রমাগত এগোতে হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালা বদল ঘটে। তখন হয়তো সচেতন পাঠক নয়নতারা ফুল এবং প্রজাপতির রহস্যের একটা কূলকিনারা করতে পারে। হয়তো তখন তারা বুঝতে পারে এই নয়নতারা ফুল হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতীক এবং পঁচাত্তর-উত্তরকালে এই ক্ষমতাকে ঘিরে প্রজাপতিরূপী ক্ষমতালোভী রাজনীতিক এবং সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলাজনিত অবস্থারই ইঙ্গিত করেছেন জহির। সামরিক শাসনামলেই শুরু হয় ইতিহাস বিকৃতি। প্রকৃত ইতিহাস চেপে রেখে তাতে মিথ্যা, বানোয়াট, অসত্য তথ্য ঢুকিয়ে দিয়ে, প্রকৃত ইতিহাস থেকে মানুষের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়া অন্যদিকে। জেনারেলদের এই ইতিহাস সংস্কারই হয়তো মিরপুর চিড়িয়াখানার আধুনিকীকরণের প্রতীকী হয়ে উঠেছে শহীদুলের গল্পে। এরপর আবদুস সাত্তারের বারান্দায় বারবার গোলাপ উড়ে এসে পড়ার নামে জহির তৈরি করেন আরেক রহস্যের ঘোর। তার পর্দাও তিনি কিছুক্ষণ পর ছিঁড়ে ফেলেন। তবে আরেক রহস্য সৃষ্টি করে। তখন এই গোলাপ হয়ে ওঠে ক্ষমতাসীন জেনারেলের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা নয়, চাটুকারিতা। তবে জেনারেল তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। এ কারণেই প্রজাপতি এবং গোলাপের মধ্যে থেকেও তার সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয় না। একদিন এক আকস্মিক ভূমিকম্পে 'শহরের সাতাশটি দালানে ফাটল ধরে, রামপুরায় জলার ধারের একটি দালান কাত হয়ে যায় এবং আগারগাঁ কলোনিতে সকল নয়নতারা গাছ এবং আবদুস সাত্তার ভূপতিত হয়। আবদুস সাত্তারের মাথার খুলি থেঁতলে গলার ওপরের প্রান্তে একটি রক্তাক্ত ব্যাঙের ছাতার মতো ছড়িয়ে পড়ে, তার মগজ গলে মাটিতে মিশে যায়। আবদুস সাত্তরের দাফন হযে যাওয়ার পর কলোনির শোকার্ত লোকেরা তাদের ধরাশায়ী নয়নতারা গাছগুলো পুনরায় রেলিঙয়ের ওপর তুলে দেয়, কেবল বিধবা শিরীন বানুর গাছগুলো নিচে মাটিতে পড়ে থাকে। কয়েকদিন পর গাছগুলো পুনরায় সতেজ হয়ে ওঠে এবং প্রজাপতিরা ফিরে আসে, তখন শিরীন বানু একটু সুস্থ হয়ে ওঠে এবং মাটি থেকে তার নয়নতারা গাছগুলো তুলে এনে নূতন পটে লাগায়, কিন্তু তার এই গাছগুলো রেলিঙের ওপরে সতেজ হয়ে ওঠার বদলে দ্রম্নত মরে যেতে থাকে।' এপর চারাগুলো বিভিন্ন জায়গায় লাগানো হলেও বাঁচে না। কেবল আবদুস সাত্তারের রক্ত যেখানে মিশে গেছে, সেখানেই নয়নতারার চারা জীবিত হয়ে ওঠে। তারপর শুকিয়ে মরে যায়। এই রহস্যের কোনো কিনারা করতে পারেন না কৃষি কলেজের প্রবীণ অধ্যাপকও। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি বলেন যে, গাছগুলো স্রেফ আত্মহত্যা করে। তার এই বক্তব্য যে মোটেও বিজ্ঞানসম্মত নয়, তা তিনি নিজেও স্বীকার করেন। তার শেষ পরামর্শ, 'প্রজাপতি ও মাটির বিষয়ে সাবধান থেকে চেষ্টা করলে ভবিষ্যতে হয়তো এখানে পুনরায় নয়নতারা ফুল দেখা যাবে।' তাহলে শেষপর্যন্ত এই নয়নতারা ফুলগাছ শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতীকই হয়ে উঠল না, হয়ে উঠল আমাদের প্রকৃত গণতন্ত্র বা স্বাধীনতার প্রতীকও! আগারগাঁ কলোনিতে নয়নতারা কেন ফোটে না, এই রহস্য উদ্ঘাটিত হলেও, গোবেচারা সরকারি কেরানি আবদুস সাত্তারের চরিত্রটির রহস্য স্পষ্ট না হয়ে আরও দুর্ভেদ্যই থেকে যায় পাঠকের কাছে।
'কাঠুরে ও দাঁড়কাক' (১৯৯২) গল্পটিও জাদুবাস্তবতার রহেস্য মোড়া। দাঁড়কাককে কেন্দ্র করেই এর রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। গল্পের প্রধান চরিত্র সমাজের নিম্নবর্গীয় শ্রেণির নিতান্ত সরল প্রকৃতির ভূমিহীন কাঠুরে আকালু ও টেপি। সিরাজগঞ্জের বৈকুণ্ঠপুরে পরের জমিতে তাদের বাস। দু'জনেরই গায়ের রঙ কালো এবং স্বাস্থ্য খারাপ। দারিদ্র্যের মধ্যেও খেয়ে না খেয়ে তারা উভয়ে সুখেই ছিল বোধহয়। যদিও টেপির মধ্যে কিছুটা পাগলামির স্বভাব লক্ষ্য করেছে আকালু। মাঝে মাঝে একা একাই বিড়বিড় করে, তারপরও তাকে সে ভালোই বাসত। তাদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। দু'জনের সংসারে, হঠাৎ একদিন সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের প্রতীক হয়ে আসে দাঁড়কাক। এই দাঁড়কাকের সাথেই টেপির বড় ভাব জমে ওঠে। আকালু কাঠের গুড়ি চেরাই করতে যেতে না চাইলেও, দাঁড়কাক আদিষ্ট টেপির অনুরোধে সে গাছের গুড়ি চেরাই করতে যায়। কুড়াল দিয়ে কাঠ চেরাই করতে করতে আকালু খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে। শেষমেশ গুড়ির ফোকরে একটি টাকার থলে পায়। প্রায় লাখ টাকার মতো। এত টাকা আকালু কোনো দিন দেখেনি। তাই সে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। এত টাকা দিয়ে সে কী করবে, দিশা পায় না। তাই জুতসই পরামর্শের জন্য সিরাজগঞ্জ শহরে যায় একজন উকিলের খোঁজে। উকিলের সন্ধানদাতা সিগারেট বিক্রেতা ও ধুরন্ধর উকিলের দ্বারা প্রতারিত হয়ে সে প্রাপ্ত টাকা, সবই খোয়ায়। ঘটনা জানাজানির আশঙ্কায়, ভূস্বামী ও থানা-পুলিশের ডরে সে টেপিকে নিয়ে পালিয়ে ঢাকা শহরে যায়। সেখানে দেখা মেলে এক বাল্যবন্ধুর সঙ্গে। সে তাদের নিয়ে তোলে বস্তিতে। আকালু বেছে নেয় রিকশা চালানো পেশা। ভালোই চলছিল তাদের। কিন্তু এখানেও এসে হাজির হয় সেই দাঁড়কাক। কোনো অঘটনের ভয়ে আকালু ভীত হয়ে পড়ে। কিন্তু নিয়তিকে সে মেনে নেয়। কদিন পর এক যাত্রী তার রিকশায় টাকাভর্তি একটা মানিব্যাগ ফেলে দ্রম্নতগামী একটা বাসে ওঠে পড়ে। সততা ও পূর্বের অভিজ্ঞতালব্ধ আকালু অঘটনের ভয়ে, সেই টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য থানায় যায়। থানা-পুলিশ তার সব অর্থ ছিনিয়ে তো নেয়ই, বরং উল্টো তাকে আরও টাকা দেওয়ার জন্য অমানুষিক নির্যাতন করে। নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্যই সে তাদের সাজানো নাটকের মহড়ায় অংশ নিতে বাধ্য হয়। চোর না হয়েও চুরির কথা সে অকপটে স্বীকার করে। থানা-পুলিশ তাকে আরও বেশি টাকা দাবি করে তার ওপর নির্দয় চাপ সৃষ্টি করে। তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় শেষপর্যন্ত পুলিশের সাজানো মামলায় আকালু সস্ত্রীক জেলে যায়। সেখানেও দাঁড়কাক গিয়ে হাজির হয়। তার সেলে স্বর্ণের আংটি ফেলে গন্ডগোল পাকিয়ে তোলে। জেলার সাহেব আকালুর কাছে সব শুনে, আংটিটা রেখে তাকে ছেড়ে দেন। চার মাস জেল খাটার পর আকালু এবং টেপি জেল থেকে মুক্তি পায়। তারপর তারা আশ্রয় পায় জেলার সাহেবের মগবাজারের নয়টোলার একখন্ড জমির মাঝখানে নির্মিত একটা ঝুপড়িঘরে। এখানে এসে আকালু কামলা খাটার কাজ নেয়। আর টেপি বেছে নেয় বাসাবাড়ির ঝি-এর কাজ। এখানেও সেই দাঁড়কাক এসে হাজির হয়। তখন আকালু আর টেপি, 'তাদের ভবিতব্যকে মেনে নেয়। দু'জনে কাজ করে উপার্জিত পয়সা দিয়ে আকালু বড় বড় বোরাক বাঁশ কিনে আনে এবং তাদের প্রাঙ্গণজুড়ে মাথার ওপর দিয়ে একান্নটি লাইনে, প্রতিটি লাইনে তেরটি করে সর্বমোট ছয়শ তেষট্টিটি আড়া বেঁধে দেয়।' এরপর দিনের পর দিন এখানে কাকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। 'আকালু দিনমজুরি এবং টেপি বাসায় ঝি-এর কাজ করে সন্ধ্যায় যখন বাসায় ঘরে ফেরে তখন তাদের সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে কাক তাদের বাঁশের উন্মুক্ত খাঁচায় ফিরতে থাকে।' মহলস্নার লোকেরা প্রথমে কাকের ব্যাপারে নির্বিকার থাকলেও পরে সচেতন ও ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে, যখন 'কাকের বাসা ভেঙে আকালু সাড়ে আঠারো মণ সাইকেলের স্পোক, লোহার তার, ইস্পাত খন্ড বিক্রি করে'। এরপর টেপি মহলস্নার রাস্তার ঝাড়ুদারনি নিমফল দাসীকে বাসায় ডেকে নিয়ে কাকের ডিমের ভাজি খাওয়ায়ে বিদায়ের সময় 'কাকের বাসায় পাওয়া একজোড়া সোনার দুল বের করে' দিলে মারাত্মক বিপত্তি ঘটে। মহলস্নার লোকেরাও আকালু আর টেপির কাছে অনুরূপ সোনার দুল দাবি করে। কেউ কেউ নিজ বাড়িতে কাকের চাষ করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। সোনার দুল না পেয়ে তারা আকালু আর টেপির ওপর ক্ষেপে যায়। উত্তেজিত জনতার ভয়ে তারা বাইরে বের হয় না। ঝুপড়িঘরেই অবস্থান করে। কেউ কেউ বাড়ির ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু কাকের ঠোকর খেয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। তখন তারা আকালু আর টেপিকে অবরোধ করে রাখে। দিনের পর দিন চলে যায়, তারপরও আকালু আর টেপি বাইরে বের হয় না। তারা কাকের ডিমের ভাজি খেয়ে বেঁচে থাকে। ত্রিশতম দিনে উত্তেজিত অবরোধকারীরা গভীর রাতে 'আকালুর বাসার চারদিকে শুকনো ঘাস পাতা জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। আগুন, তাপ আর ধোঁয়া বাড়িটাকে গ্রাস করতে থাকলে কাকেরা 'বাঁশের আড়া ত্যাগ করে' চলে যায়। ভোরবেলা সম্পদলোভী মহলস্নাবাসী প্রাচীর ভেঙে আকালুর বাসার ভেতরে প্রবেশ করে এবং দেখে যে, ভেতরে মানুষের কোনো চিহ্ন নেই। সোনার দুলের লোভে তারা 'ছোট্ট কুঁড়েঘরের বেড়ার প্রতিটি বাঁশের গিট চিরে পরীক্ষা করে, মেঝের মাটি খুঁড়ে উলটপালট করে, কিন্তু তারা সেখানে কিছুই পায় না।' তখন তারা মনে করে যে বিপুল সম্পদরাজি নিয়ে আকালু আর টেপি পালিয়ে গেছে। কিন্তু এমন একটানা একটা অবরোধ ভেঙে তারা পালিয়ে যেতে পারে, একথা তাদের অনেকেই বিশ্বাস করতে পারে না। বিভ্রান্তিতে পড়ে। তারপর আকালু আর টেপির অন্তর্ধানের ব্যাপারে তারা নিজেরাই একটা মনগড়া গল্প তৈরি করে যে, কাকেরা উড়ে যাওয়ার সময় আকালু আর টেপিকে ঠোঁটে করে নিয়ে গেছে। তাদের এই গল্পকে আরও বিশ্বাসযোগ্য ও রহস্যময় করে তোলে রামপুরায় নৌকার পাটাতনে শুয়ে থাকা লোকেরা। তারা নাকি 'আকাশের আবছা আলোয় উড়ন্ত পাখিদের ভিড়ে' 'দুটো মানুষের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে' ওঠে 'রামপুরার ঝিলের ওপর দিয়ে ধলেশ্বরীর কুয়াশার ভেতর উড়ে' যেতে দেখেছিল। তারপর নাকি ঢাকা শহর বহুদিন কাকশূন্য থাকে।
এই গল্পের রহস্য কতটুকু ভেদ করা সম্ভব পাঠকের পক্ষে? আপাতত আমরা ধরে নিতে পারি, বুর্জোয়া সমাজে নিম্নবর্গীয় মানুষের চরম অস্তিত্ব সংকটের কথা। তাদের অস্তিত্বহীন করার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্র একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আর এক্ষেত্রে আমরা ফ্রান্স কাফকার 'দি ট্রায়াল' উপন্যাসের কে চরিত্রটির কথা স্মরণ করতে পারি। ব্যক্তিজীবনকে দুর্বিষহ ও অস্তত্বহীন করে তোলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের হাত যে কতোটা লম্বা ও শক্তিশালী তা এই উপন্যাসটি পড়লে উপলব্ধি করা যায়।
পাখি ও মনুষ্য সমাজে শ্রেণি বিবেচনায় কাক এবং আকালুরা সমশ্রেণি বা নিম্নগোত্রীয়। বুর্জোয়া সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নিম্নবর্গীয় মানুষের জন্য শোষণ ও বঞ্চনার ফাঁদ পাতা থাকে। নিম্নবর্গের মানুষরা ইচ্ছে করলেও এর থেকে মুক্তি পেতে পারে না। শেষমেশ নিয়তির কাছে হার মানতে তারা বাধ্য হয়। আকালু আর টেপি ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষ। সমাজ ও রাষ্ট্রে নিগৃহীত, শোষিত ও বঞ্চিত হতে হতে তারা পরিণত হয়েছে স্বপ্নহীন, খোলস মানুষে। এ সমাজে টিকে থাকতে গেলে যে পরিমাণ চতুরতা ও বুদ্ধির দরকার, তা তাদের নেই। এ কারণে কাক তাদের সমব্যথী এবং সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে এলেও তারা নিজেদের ভাগ্যকে বদলাতে পারে না। ক্রমাগত অস্তিত্বহীনতার দিকেই তাদের যাত্রা। এ যাত্রার শুরু আছে, কিন্তু শেষ নেই। বুর্জোয়াবাদীরা এই সব মানুষকে নেয় খেলার পুতুল হিসেবে। নিজেদের প্রয়োজনে তারা তাদের টিকিয়ে রাখে কিংবা অস্তিত্বহীন করে ফেলে। গল্পে জেলারের চরিত্রটি বেশ রহস্যময় ও প্রশ্নবিদ্ধ। তারই বাড়িতে এতকিছু ঘটার পরও গল্পে তাকে আর কোনো ভূমিকায়ই পাওয়া যায় না। এর কারণ কী? জেলার হিসেবে সে কি তাদের তার জায়গায় এক ধরনের নির্বাসন দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছে? এই রহস্য অভেদ্যই রয়ে গেল।
গল্পে জাদুবাস্তবতার কুহকের ভেতর দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং ক্ষয়িষ্ণু জীবনবোধ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার প্রকৃত সত্য তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন শহীদুল জহির। উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন মানুষের ভেতরের মানুষকে। যেখানে ভালোবাসা, ঘৃণা, লোভ, রিরংসা, মমতা, নিষ্ঠুরতা যুগপৎ খেলা করে ওঠে। মানুষের ভেতরের এই বিচিত্র সত্তার উন্মোচনের জন্যই হয়তো তিনি গল্পে বিভিন্ন উপকরণের সমাহার ঘটিয়ে তৈরি করেন ঘনঘোর রহস্যের জাল। হয়তো পাঠকরা এতে গোলকধাঁধাঁয় পড়ে। কিন্তু এই গোলকধাঁধাঁর মধ্যেই একজন শক্তিমান এবং স্বতন্ত্রধর্মী কথাকোবিদ হিসেবে শহীদুল জহিরের প্রকৃত সত্তাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের কাছে।