রুদ্র মুহম্মদ শহিদুলস্নাহ সৃষ্টিবিভোর কবি
প্রকাশ | ২৮ জুন ২০২৪, ০০:০০
এস ডি সুব্রত
টালমাটাল সত্তরের দশকে সমাজ ও রাজনীতির প্রত্যাশা আর আশাভঙ্গের অনিবার্য অস্থিরতার সময়টিতে যারা কলম চালিয়েছিলেন, যারা সেই সময়টাকে সৃষ্টিশীল উন্মাদনার দ্বারা এক চিরন্তন সত্তা প্রদান করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুলস্নাহ। যার কবিতায় ছিল দ্রোহ, প্রেম, দেশপ্রেম, সমাজ সংসারের নির্মম বাস্তবতা। রুদ্রর জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশাল রেডক্রস হাসপাতালে। তার মায়ের নাম শিরিয়া বেগম, বাবার নাম শেখ ওয়ালীউলস্নাহ। তাদের স্থায়ী নিবাস ছিল বাগেরহাট জেলার মংলা থানার সাহেবের মেঠ গ্রামে। রুদ্রর নিজবাড়ি সাহেবের মেঠ থেকে তার নানাবাড়ি মিঠেখালি খুব বেশি দূরে ছিল না। রুদ্রর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি আর লেখালেখিতে আগ্রহ দুটোই তৈরি হয় এই নানাবাড়িতে। সে সময় ঢাকার বিখ্যাত 'বেগম' আর কলকাতার 'শিশুভারতী' পত্রিকা আসত তার নানাবাড়িতে। সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের বইপত্র তো ছিলই। রুদ্র মজে যান এসবের মধ্যে। নানাবাড়ির পাঠশালায় ৩য় শ্রেণি অবধি পড়েন রুদ্র, এরপর ১৯৬৬ সালে ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন মংলা থানা সদরের সেইন্ট পলস স্কুলে। এই স্কুলেই রুদ্র একসময় ৯ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। '৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তার আর ৯ম শ্রেণিতে পড়া হয়নি। যুদ্ধ শেষে ৯ম শ্রেণি টপকিয়ে কবি ১০ম শ্রেণিতে ভর্তি হন ঢাকার ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলে। এখান থেকেই ১৯৭৩ সালে ৪টি বিষয়ে লেটার মার্কসহ বিজ্ঞান শাখায় ১ম বিভাগে রুদ্র এসএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। পিতামাতার ইচ্ছা ছিল রুদ্র ডাক্তার হোক। কিন্তু রুদ্র বিজ্ঞানের পথে আর না গিয়ে তার পছন্দের মানবিক শাখায় চলে এলেন। ঢাকা কলেজে এসে রুদ্র পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করলেন; সহপাঠী হিসেবে পেলেন কামাল চৌধুরী, আলী রিয়াজ, জাফর ওয়াজেদ, ইসহাক খানসহ একঝাঁক তরুণ সাহিত্যকর্মীকে। ১৯৭৫ সালে রুদ্র উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ২য় বিভাগে। দু'বছরে তিনি ক্লাস করেছিলেন মাত্র ১৮টি। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি হন বাংলা বিভাগে।
রুদ্রর পিতৃদত্ত নাম মোহাম্মদ শহীদুলস্নাহ। ছোটবেলায় এই নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। লেখালেখির জগতে এসে নামটি তিনি নিজেই বদলে দেন। নামের আগে যোগ করেন 'রুদ্র', 'মোহাম্মদ'-কে করেন 'মুহম্মদ' আর 'শহীদুলস্নাহ'-কে 'শহিদুলস্নাহ'। নিজ প্রদত্ত এই নাম শুধু লেখক হিসেবেই নয়, পরীক্ষার সনদেও তিনি ব্যবহার করেছেন।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুলস্নাহর সাড়া জাগানো কবিতা 'বাতাসে লাশের গন্ধ'।
'আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো আমি মাটিতে মৃতু্যর নগ্ন নৃত্য দেখি
\হধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভিতর
\হএদেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত
\হসেই রক্তাক্ত সময়।' (বাতাসে লাশের গন্ধ- রুদ্র মুহম্মদ শহিদুলস্নাহ)
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুলস্নাহ কেমন কবি ছিলেন, কতটা সুগভীর ছিল তার ভাবনা দশম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় লেখা তার প্রথম কবিতা থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। কবিতাটির নাম 'আমি ঈশ্বর আমি শয়তান'। কাঁচা হাতের লেখা। কিন্তু জীবনদর্শন ও চিন্তাধারার ধারা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। এ কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন নিম্নরূপ।
'আমায় যদি তুমি বলো ঈশ্বর,/আমি বলব, হ্যাঁ আমি তাই।
আমায় যদি বল পাপী শয়তান,/আমি বলব, হঁ্যা আমি তাই-ই।
-কারণ আমার মাঝে যাদের অস্তিত্ব
তার একজন ঈশ্বর; অপরজন শয়তান।'
\হ১৯৭৩ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল কবিতাটি। কিন্তু রুদ্র এতে তার নাম ছাপেননি। নিজের কোনো বইয়ে একে স্থানও দেননি। কিন্তু রুদ্র মুহম্মদ শহিদুলস্নাহর প্রথম কবিতা হিসেবে কবিতাটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। কবি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। ১৯৭৮ সালে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুলস্নাহ ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মনোনয়নে সাহিত্য সম্পাদক পদে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কামাল চৌধুরী (ছাত্রলীগ) ও আলী রিয়াজ (জাসদ ছাত্রলীগ)। সেবার সাহিত্য সম্পাদক হন আলী রিয়াজ। রুদ্র ছিলেন ঢাবির সলিমুলস্নাহ হলের আবাসিক ছাত্র। কিন্তু তিনি বেশি থাকতেন ফজলুল হক হলে বন্ধু কামাল চৌধুরীর ৩০৯ নাম্বার কক্ষে অথবা রেজা সেলিমের ১১০ নাম্বার কক্ষে।
১৯৮০ সালে তিনি অনার্স পাস করেন। এরপর নানা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় আবারও পিছিয়ে পড়েন রুদ্র। ১৯৮৩ সালে নেন এমএ ডিগ্রি। ছাত্রজীবনেই তার দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, 'উপদ্রম্নত উপকূল' আর 'ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম'। প্রথম বইটির প্রকাশক ছিলেন আহমদ ছফা। দুটি বইয়ের জন্যই রুদ্র যথাক্রমে ১৯৮০ ও ১৯৮১ সালে সংস্কৃতি সংসদ প্রবর্তিত মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন। রুদ্র ছিলেন জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা-যুগ্ম সম্পাদক। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুলস্নাহ বিয়ে করেন ২৯ জানুয়ারি, ১৯৮১ সালে। স্ত্রীর নাম লীমা নাসরিন। পরবর্তীকালে তিনি তসলিমা নাসরিন নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন ও নিজের বিতর্কিত লেখালেখির জন্য আলোচিত হন। তসলিমা মূলত ছিলেন চিকিৎসক। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুলস্নাহ ও তসলিমা নাসরিনের পরিচয় লেখালেখির সূত্র ধরে। পরিচয় ক্রমে রূপ নেয় প্রণয়ে। রুদ্র বিয়ে করেছিলেন অভিভাবকের অমতে। তসলিমা নাসরিনের ভাষ্যে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুলস্নাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধের প্রকাশ পাওয়া যায়-- 'রুদ্রকে আমি আমার সতেরো বছর বয়স থেকে চিনি। সেই সতেরো বছর বয়স থেকে রুদ্র আমার সমস্ত চেতনাজুড়ে ছিল। আমাকে যে মানুষ অল্প অল্প করে জীবন চিনিয়েছে, জগৎ চিনিয়েছে- সে রুদ্র। আমাকে যে মানুষ একটি একটি অক্ষর জড়ো করে কবিতা শিখিয়েছে- সে রুদ্র।'
কিন্তু এই সুখের সংসার স্থায়ী হয়নি। ছয় বছর দাম্পত্য জীবন শেষে তারা আলাদা হয়ে যান। ১৯৮৬ সালে উভয়ের সম্মতিতে তালাক হয়।
রুদ্রের একটি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে সাংবাদিক শিহাব মাহমুদের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- রুদ্র ছিলেন বরাবরই উড়নচন্ডী স্বভাবের ও যাবতীয় নিয়মনীতির বিরুদ্ধ শিবিরবাসী। তিনি ভেবেছিলেন তসলিমাও তারই মতো। প্রচলিত নিয়ম-নীতির প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা তিনি তসলিমার মধ্যেও দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি আবিষ্কার করেন, তসলিমার ভেতর। তার ভাষ্যমতে, এক গোঁড়া, সংকীর্ণ রমণীর বসবাস। তিনি নাকি তার মতো করে গড়ে নিতে চেয়েছিলেন রুদ্রকে। তাই সংঘাতটা অনিবার্যই ছিল। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুলস্নাহর মৃতু্যর পর 'রুদ্র ফিরে আসুক' শীর্ষক লেখায় তসলিমা লেখেন-
'যৌথজীবন আমরা যাপন করতে পারিনি। কিন্তু যত দূরেই থাকি, আমরা পরস্পরের কল্যাণকামী ছিলাম। রুদ্রের সামান্য স্খলন আমি একদিনও মেনে নিইনি, রুদ্রের দু'চারটে অন্যায়ের সঙ্গে আমি আপস করিনি- পরে সময়ের স্রোতে ভেসে আরো জীবন ছেনে, জীবন ঘেঁটে আমি দেখেছি, রুদ্র অনেকের চেয়ে অনেক বড় ছিল, বড় ছিল হৃদয়ে, বিশ্বাসে। রুদ্রের ঔদার্য, রুদ্রের প্রাণময়তা, রুদ্রের অকৃত্রিমতার সামনে যে কাউকে দাঁড় করানো যায় না।' রুদ্র পেপটিক আলসার বাঁধিয়ে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে বিদায় নেন এই পৃথিবী থেকে বড় অসময়ে।