কবি অসীম সাহা মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করেছেন পরিণত চেতনায়। ষাটের দশকে বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উত্থান এবং জাতীয় বীরের গৌরব অর্জন ষাটের তারুণ্যকে উদ্বেল করেছে, প্রাণিত করেছে। অংশগ্রহণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন আন্দোলনে। '৬২, '৬৬, '৬৯-এর বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে একজন সফল সংগঠক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। কবি অসীম সাহা ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের মতো অসভ্যতার বিরুদ্ধে যেমন তিনি সোচ্চার ছিলেন, একইভাবে মানবতার পক্ষে সবসময় বলতেন নিজের অঙ্গীকারের কথাও। নানা অসঙ্গতি অনাচারে রক্তাক্ত একজন সংবেদনশীল কবির সাহসী উচ্চারণ তাই কবিতার পাশাপাশি ইতিহাসেরও অংশ হয়ে যায়। অন্ধকার সময়কে উপস্থাপন করেছেন তিনি বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায়।
তিনি উদ্বাস্তু লিখে দেশহীন মানুষের কথা উচ্চারণ করেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে। ১৯৯২ সালের বাবরী মসজিদ ধ্বংসের পর এদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ ও নির্যাতন হয়েছিল তার প্রতিবাদে এদেশের বিবেকবান মানুষদের নিয়ে শুরু করেন 'সম্প্রীতি ও মানবাধিকার আন্দোলন'। ২০০১ সালে সাধারণ নির্বাচনের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যে বর্বর নির্যাতন হয়েছিল তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং লেখনির মাধ্যমে এদেশের মানুষের মাঝে তুলে ধরেন। বাংলাদেশের যে কোনো সুস্থ ধারার আন্দোলনে তিনি এগিয়ে যান সবসময়।
সাংবাদিকতা ও মুদ্রণ শিল্পের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন পেশার তাগিদে। তার প্রতিষ্ঠান 'ইত্যাদি' ছিল কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাহিত্যানুরাগী, চলচ্চিত্র, নাটক, শিল্পসংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সব শুভানুধ্যায়ীদের এক নিয়মিত আড্ডার একটি প্রিয় জায়গা। এক সময় আনন্দপত্র ম্যাগাজিন পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন এবং দৈনিক পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। নতুন ধারার পত্রিকা 'আমাদের নতুন সময়'-এর সংযুক্ত সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
শুদ্ধতার কবি একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ অসীম সাহা ১৮ই জুন ২০২৪ মঙ্গলবার বিকাল পৌনে ৪টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)-তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করে আমাদের ছেড়ে অনন্তলোকে যাত্রা করেছেন। ১৯৪৯ সালের ২০শে ফেব্রম্নয়ারি মামাবাড়ি নেত্রকোণা জেলা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার কর্মসূত্রে মাদারীপুরেও কাটিয়েছেন দীর্ঘদিন। পড়াশোনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্য বিভাগে। সামগ্রিকভাবে সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। শেষ দিকে চিকিৎসার খরচ মেটাতেই লড়াই করতে হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও কিছু সহায়তা করা হয়েছে।
পিতা অখিল বন্ধু সাহার কলেজের চাকরি-সূত্রে ১৯৪৮ সালে মাদারীপুর চলে গেলে, তার কয়েক বছর পর সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯৬৫-তে মাধ্যমিক পাস করার পর মাদারীপুর নাজিমুদ্দিন মহাবিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭-তে উচ্চমাধ্যমিক, ১৯৬৯-এ স্নাতক পাস করে ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে মুক্ত করার আন্দোলন। সেই আন্দোলনে প্রতিদিন রাজপথের একজন সৈনিক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত পরীক্ষা হবার কথা থাকলেও অসহযোগ আন্দোলন এবং পরে ২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পরে সে-পরীক্ষা আর অনুষ্ঠিত হয়নি। পরে ১৯৭৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কবি অসীম সাহার লেখালেখির জীবন শুরু হয় ১৯৬৪ সালে, যখন তিনি মাদারীপুরে দশম শ্রেণির ছাত্র। ১৯৬৫ সালে ঢাকার পত্রিকায় ছোটদের জন্য লেখালেখি দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে লেখালেখির শুরু। সেই থেকে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছড়া, কিশোর কবিতা, গান প্রভৃতি রচনায় সিদ্ধহস্ত কবি অসীম সাহা অব্যাহতভাবে লিখেছেন। সাহিত্যের সব বিষয়ে তুখোড় এই লেখক ছিলেন ঋদ্ধতায় বিশ্বাসী বলে সময়কে নিয়ে যেভাবে ভেবেছেন সেভাবেই কাজ করেছেন। স্ত্রী কবি অঞ্জনা সাহা ও দুই পুত্র অভ্র সাহা ও অর্ঘ্য সাহাকে নিয়েই সুখের সংসার ছিল তার।
অসীম সাহা মানুষকে ভালোবাসতেন, মানুষও তাকে ভালোবাসা দিয়েছেন। ছড়া, গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প ও অনুবাদে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। শেষের দিকে ব্যাকরণ ও অভিধান প্রণয়নেও আত্মনিয়োগ করেছিলেন। একজন পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যিক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা অবলম্বনে মাসুদ পথিকের পরিচালনায় নির্মিত নাট্য চলচ্চিত্র নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ চলচ্চিত্রে তিনি গান লিখেছেন এবং সুর করেছেন আবার অভিনয় করেছেন। আবার নিজের সাংস্কৃতিক দল সহজিয়া নিয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে দর্শক ও শ্রোতাদের সামনে নতুন নতুন সঙ্গীত নিয়ে হাজির হয়েছেন।
আমার সঙ্গে কবি অসীম সাহার পরিচয় ১৯৮৭ সালে। তখন আমি তখন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের একজন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। একদিন নীলক্ষেতের ইত্যাদিতেই দাদার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়। এর পর নীলক্ষেতের সেই ইত্যাদি হয়ে ওঠে আমার অলিখিত ঠিকানা এবং নিয়মিত আড্ডা একটি অবধারিত বিষয় ছিল। কবি অসীম সাহা লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকতেন সবসময়। এর মধ্যে একটি ছিল বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি (বিজিএস)। জার্মান নাগরিক ও বাংলাদেশের নাগরিকদের সেতুবন্ধনের একটি সংগঠন। প্রফেসর কবীর চৌধুরী ছিলেন সভাপতি, লেখক আহমদ ছফা ছিলেন সাধারণ সম্পাদক এবং কবি অসীম সাহা ছিলেন সাংস্কৃতিক সম্পাদক। এরপর বিজিএস-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হবার কারণে শ্রদ্ধেয় কবি অসীম সাহাকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। একজন আদর্শবান মানুষ নিজ আস্থার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়াকে কাছে থেকে দেখেছি। বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি সাংস্কৃতিক দলের নেতৃত্বেও ছিলেন তিনি। এই সাংস্কৃতিক দলের পরিবেশনা নিয়ে গিয়েছেন জার্মানি, ফিলিপাইন, সুইজারল্যান্ডসহ আরও অনেক দেশে। দেশের অনেক জেলাতেই এই সাংস্কৃতিক দল তাদের পরিবেশনা নিয়ে হাজির হয়েছে।
কবি অসীম সাহা যে আদর্শ ও আস্থার সংস্কৃতি আমাদের সামনে রেখে গেছেন তা অব্যাহত থাকুক এই কামনা সবসময়। ১৯৬৪ সাল থেকে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছড়া, কিশোর কবিতা, গান প্রভৃতি রচনায় সিদ্ধহস্ত কবি অসীম সাহা সবার মাঝে বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টিশীল কর্মের মাঝে। তার প্রকাশিত উলেস্নখযোগ্য বইগুলোর কয়েকটি হচ্ছে : পূর্ব-পৃথিবীর অস্থির জ্যোৎস্নায় (১৯৮২), কালো পালকের নিচে (১৯৮৬), পুনরুদ্ধার (১৯৯২), উদ্বাস্তু (১৯৯৪), মধ্যরাতের প্রতিধ্বনি (২০০১), অন্ধকারে মৃতু্যর উৎসব (২০০৬), মুহূর্তের কবিতা (২০০৬), সৌর-রামায়ণ (২০১১), অক্টাভিও পাজ ও ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা (অনুবাদ) (২০১১), কবর খুঁড়ছে ইমাম (২০১১), প্রেমপদাবলি (২০১১), পুরনো দিনের ঘাসফুল (২০১২) (কবিতা)। প্রগতিশীল সাহিত্যের ধারা (১৯৭৬), অগ্নিপুরুষ ডিরোজিও (১৯৯০), উদাসীন দিন (উপন্যাস) (১৯৯২), শ্মশানঘাটের মাটি (গল্প) (১৯৯৫), কিলের চোটে কাঁঠাল পাকে (২০০২), শেয়ালের ডিগবাজি (২০০৭), হেনরি ডিরোজিও (২০১০)। ষাটের দশকের কবিদের অন্যতম প্রধান এ-পর্যন্ত আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৩), ময়মনসিংহ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফোরাম সম্মাননা (২০০৯), সাতক্ষীরা জাতীয় কবিতা পরিষদ কবিসম্মাননা (২০১০), কবিতাবাংলা কবিসম্মাননা (২০১০), বিন্দুবিসর্গ কবিসম্মাননা (২০১১), দিকচিহ্ন কবিসম্মাননা (২০১১), কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর কবিসম্মাননা (২০১১), শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পুরস্কার (২০১২) এবং কবিতালাপ পুরস্কার (২০১২) লাভ করেছেন।
বাংলা সাহিত্যকে আরও অনেক কিছু দেবার ছিল তার। তিনি যে আত্মসম্মানবোধ নিয়ে সবসময় চলতেন তা আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। ভালো থাকবেন ওপরে আর আমাদের ক্ষমা করে দিবেন আমরা কিছুই করতে পারিনি আপনার জন্য।