শওকত আলীর গল্প
মহাজন ও নিম্নবর্গের দ্বান্দ্বিকতার স্বরূপ
প্রকাশ | ২৮ জুন ২০২৪, ০০:০০
শিল্পী খানম
শওকত আলী (১৯৩৬-২০১৮) ষাটের দশকের ছোট গল্পকার। এ দশকের বেশির ভাগ গল্পকারের প্রবণতা যেখানে নাগরিক মধ্যবিত্ত মানুষের দ্বন্দ্বময় টানাপড়েন, তাদের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের ব্যর্থতাজনিত বিষাদ ও মনোজটিলতা উন্মোচন, সেখানে তিনি নিমগ্ন ছিলেন গ্রামীণ সমাজের অভ্যন্তরে মহাজনের শোষণ, বঞ্চনা, দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত নিম্নবর্গের মানবেতর জীবন ও তাদের ইন্দ্রিয়জ নানা সমস্যা উপস্থাপনে। শওকত আলী তৎকালীন পশ্চিম বাংলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তার পরিবার উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরে এসে বসতি স্থাপন করেন। এছাড়া কলেজ-শিক্ষক শওকত আলী কর্মসূত্রে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর অঞ্চলে বেশ কিছুদিন অবস্থান করার কারণে খুব কাছ থেকে দরিদ্র কৃষিজীবীদের অবলোকন করার সুযোগ পেয়েছেন। ফলে, উত্তরবঙ্গের জনজীবন তার লেখা উপন্যাস ও গল্পে একটি বিশেষ স্থান পায়। 'উত্তরবঙ্গের মানুষের প্রতি ছিল তার প্রবল টান। তার সাহিত্য জীবনের পুরোটা সময় রাজধানী ঢাকায় বসবাস করলেও তাই দেখা গেছে উত্তরবঙ্গের জনজীবনই তার লেখার উপজীব্য বিষয়।' বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে মহাজন-জোতদারের শোষণ-বঞ্চনা নিয়ে আরও যারা গল্প লিখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন আবু ইসহাক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক ও হাসান আজিজুল হক প্রমুখ। এদের গল্পে গ্রামীণ জীবনকাঠামো ও নিন্মবর্গের সঙ্গে মহাজনের দ্বন্দ্বের স্বরূপও উন্মোচিত হয়েছে। কৃষি পেশার সঙ্গে যুক্ত দরিদ্র শ্রমজীবী শ্রেণির কৃষক, আধিয়ার, বর্গাচাষি, ভাগচাষি, দিনমজুর, কামলা, বাঁধাচাকর এদের জীবনবৃত্ত ঘিরে আছে মহাজন-জোতদার। নিম্নবর্গকে শোষণ করেই তাদের প্রতিষ্ঠা। মহাজনরা ক্ষমতা ও অর্থের দাপটে নিন্মবর্গের ভিটেমাটি, জীবনজীবিকা, কন্যা, স্ত্রী কেড়ে নিয়েতাদের নিঃস্ব করে। ফলে নিম্নবর্গও সুযোগ বুঝে মহাজনের জীবন ও স্বপ্নের ওপর নির্মমভাবে আঘাত করতে দ্বিধা করে না। 'শত্রম্নতার রূপরেখা শওকত আলীর গল্পে স্পষ্ট- আধিয়ার-দিনমজুর বনাম চৌধুরী-মহাজন।'
শওকত আলীর গল্পে উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ কৃষিজীবী সমাজের অভ্যন্তরের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চিত্র ফুটে উঠেছে। আধিপত্যবাদী মহাজন ও তার অধীনে বসবাসরত নিম্নবর্গের অধীনতার স্বরূপ বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই প্রবন্ধে নিম্নবর্র্গ ও মহাজনের সম্পর্কসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। 'মহাজন' সংস্কৃত শব্দ- যার আক্ষরিক অর্থ মহৎ মানুষ। তবে প্রায়োগিক অর্থে এর মানে হচ্ছে বণিক, ডিলার বা দোকানদার, ব্যাংকার, পোদ্দার প্রভৃতি। বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে 'মহাজন' শব্দের একটি আপেক্ষিক অর্থ রয়েছে। মূলত উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যে ব্যক্তি অধঃস্তনের ভূমিকা পালন করে, তার পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন প্রকরণ ও বিতরণের মালিক হলেন মহাজন। তবে গ্রাম বাংলার সব ধরনের পাওনাদারকে মহাজন বলা হয়। ব্রিটিশ আমল থেকেই গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতিতে মহাজন শ্রেণির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় বাংলার কৃষকসমাজ মহাজনের হাতে সম্পূর্ণ বন্দি হয়ে পড়ে। এরপর ব্রিটিশ সরকার ঋণ সালিশি বোর্ড স্থাপন করে ঋণগ্রস্ত কৃষককুলের বোঝা লাঘবের চেষ্টা করেন। দেশ বিভাগের পর এ দেশের সমাজ ও অর্থনীতিতে মহাজনী প্রথার প্রভাব কমতে থাকে। তবে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে অভাব ও দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে মহাজন শ্রেণি নিজেদের ভোগবাদী মানসিকতা চরিতার্থ করার চেষ্টা করে। ফলে অনিবার্যভাবে মহাজন ও নিম্নবর্গের বিরোধের সূত্রপাত হয়। এই প্রেক্ষাপটে লেখা শওকত আলীর অনেক গল্প সাবঅল্টার্ন বা নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চায় হতে পারে অন্যতম অনুষঙ্গ। সাবঅল্টার্ন বা নিম্নবর্র্গ- এই ধারণাটি সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ গোষ্ঠীর লেখকরা মার্কসবাদের অন্যতম প্রবক্তা আন্তোনিও গ্রাম শির 'ঝবষবপঃরড়হং ভৎড়স :যব চৎবংরড়হ ঘড়ঃবনড়ড়শং' (১৯৪৭) গ্রন্থ থেকে পেয়েছেন। ইতালীয় 'সুবলতেনো' শব্দ থেকে ইংরেজি সাবঅল্টার্ন শব্দটি এসেছে। ইংরেজি ভাষায় যার আভিধানিক অর্থ ক্যাপ্টেনের অধঃস্তন কর্মকর্তা। ভারতবর্ষে ঝঁনধষঃবৎহ ঝঃঁফরবং গোষ্ঠীর প্রধান তাত্ত্বিক রণজিৎগুহ। তিনিই সর্বপ্রথম 'নিম্নবর্গ' শব্দটি ইংরেজি ঝঁনধষঃবৎহ শব্দের প্রতিরূপ হিসেবে বাংলায় গ্রহণ
করেন। এই গোষ্ঠীর লেখকদের মধ্যে অন্যতম হলেন- গৌতম ভদ্র, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গায়ত্রিচক্রবর্তী প্রমুখ। রণজিৎ গুহ তার ঝঁনধষঃবৎহ ঝঃঁফরবং গ্রন্থে যাদের নিম্নবর্র্গ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন তারা হলেন- গরিব চাষি, প্রায় গরিব ও মাঝারি চাষি, নির্বিত্ত ভূমিহীন, হীনবল গ্রামভদ্র, সম্পূর্ণ মাঝারি কৃষক ও ধনী কৃষক, গরিব শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, নিম্নমধ্যবিত্ত, গ্রাম ও শহরের গরিবজনতা, আদিবাসী, নিম্নবর্র্গ, এমনকি নারীরাও নিম্নবর্গের অধিভুক্ত। কথাসাহিত্যিক শওকত আলী মাকর্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতেন। ফলে মার্কসবাদী চিন্তাচেতনার কথাসাহিত্যিক শওকত আলী মাকর্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতেন। ফলে মার্কসবাদী চিন্তাচেতনার প্রভাব তার সাহিত্যে স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। তার গল্পগ্রন্থের সংখ্যা চারটি- উন্মূল বাসনা (১৯৬৮), লেলিহান সাধ (১৯৭৮), শুন হে লখিন্দর (১৯৮৮), বাবা আপনে যান (১৯৯৪)। তার লেলিহান সাধ ও শুন হে লখিন্দর- এ দুটি গল্পগ্রন্থে লেখকের নির্দিষ্ট একটি জীবন জিজ্ঞাসার সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে- তাহলো মার্কসীয় শ্রেণিদ্বন্দ্ব। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এখানে দরিদ্রজনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই গ্রামীণ মহাজনের অধীনে ও নিয়ন্ত্রণে থাকে। মহাজনের ভূমিতে কৃষি কাজ করে তারা জীবিকা-নির্বাহ করে। কৃষিজীবী শ্রেণির জীবনকাঠামো একটি বৃত্তে আবদ্ধ, দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেই তাদের বাঁচতে হয়। তার সঙ্গে আছে মহাজনের শোষণ, নিপীড়ন। গ্রামেরবিত্তহীন মানুষের জীবনের যন্ত্রণা, রোগ-শোক, স্বার্থপরতা, লোভ, ক্রোধ, জৈবিকতা প্রভৃতি তার গল্পে শিল্পরূপ লাভ করেছে। একইভাবে মহাজন শ্রেণির স্বার্থপরতা ও লোলুপতার চিত্রও লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। গ্রামীণ সমাজের বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বের স্বরূপ তার রচিত লেলিহান সাধ ও শুন হে লখিন্দর গ্রন্থে একটি ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। গ্রামের কৃষিনির্ভর জীবনব্যবস্থায় ভূমির মালিক মহাজন ওতাদের অধীনস্থ নিম্নবর্গের সমস্যা, সংকট ও সংগ্রাম তার গল্পে চিহ্নিত হয়েছে। সমাজে উৎপাদন কাঠামোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে মহাজন এবং তাদের অধীনস্থ দরিদ্র জনগোষ্ঠী। মহাজন অর্থ ও ভূমিসম্পদের মালিক, এ সূত্রে তারা শোষক, উৎপীড়ক, ক্ষমতাবান ও মর্যাদাবান। অন্যদিকে, নিম্নবর্গ দরিদ্র, ভূমিহীন; নিম্নবর্গের শ্রমজীবীরা সমাজে মর্যাদাশূন্য। মহাজন ও নিম্নবর্গের দ্বন্দ্বের পটভূমিতেরচিত গল্পসমূহকে বিষয়বস্তুর আলোকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করা যেতে পারে। গ্রামের প্রান্তিক চাষিদের নিয়তি মহাজনের খেরো খাতায় বন্দি হয়ে পড়ে। শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হয় বর্গাচাষিরা। ধান মাড়াই শেষে মন্তাজ ছোট মহাজনকে প্রশ্ন করে : 'আচ্ছা মহাজন তাইলে হামার কর্জটা শোধ করিতে কয় মণ ধান লাগিবে?' এরূপ প্রশ্নে মন্তাজকে ধমক খেতে হয় মহাজনপুত্রের; কারণ প্রবাদ আছে 'আধির আধা বখরা।' মন্তাজের মনে হয় ধানগুলো তার নিজের, কেননা, জমিতে লাঙ্গল চালিয়ে কঠিন পরিশ্রম করে ঘাম ঝরিয়ে তবে ফসল ফলাতে হয়েছে: 'আহ্ সে বড় কষ্ট বাহে, ধানের কথা আর কহেন না। ধান বড় কষ্টের জিনিস। মন্তাজ আলী ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে কেমন স্বগতোক্তি করতে থাকে।' সারা বছর হাড়ভাঙা খাটুনির পর ফসল উঠলে ধার পরিশোধ করে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে মন্তাজ রাজি হয় না। তার ক্ষুব্ধ মনে হঠাৎ তেভাগা আন্দোলনের কথা মনে পড়ে আর তাইতো ছোট মহাজনকে আকস্মিকভাবে বলে ওঠে: 'তেভাগার কথা জানেন তুমরা? ঐ যে ধান কাটা নিয়ে গোলমাল, জানেন তুমরা? ওই বছরও কি ধান কর্জের এই নিয়ম ছিল?' বর্গাচাষির প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে মহাজন বলেছে: 'আচ্ছা মন্তাজ, তোর কি কুনো দিন হুঁশ জ্ঞান হবেনি- কুন পুরানা কালের কথা, ওইসব শুনে তোর কী লাভ কহ? ওইসব হাঙ্গামা হুজ্জতের কথা কি ভালো?' মন্তাজের ভেতরে ধ্বনিত হয় : 'আধির আধা ভাগ হামরা পাবো নাই?' এক পর্যায়ে নিজের প্রাপ্য ধান সে বস্তায় ভরতে থাকে। এমন সময় মহাজনের দুই লাঠিয়াল দ্বারা প্রহৃত হয়ে মন্তাজের স্মৃতিতে তোলপাড় করে বাপ-দাদার মুখে শোনা তেভাগার রক্তাক্ত লড়াইয়ের কথা। এক সময় ঐক্যবদ্ধ কৃষকরা ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ পেতে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল।। মন্তাজ নিজের মধ্যে কৃষক বিদ্রোহের অনুরণন শুনতে পায়; অত্যাচারী মহাজন শ্রেণির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বাসনা জাগ্রত হয় : 'যদি আমার শক্তি থাকত। তাহলে- হঁ্যা, তা হইলে কি আর মারিবা পারে।
শওকত আলীর 'নবজাতক' গল্পে মহাজন কর্তৃক চাষিদের শোষণের সঙ্গে আবু ইসহাকের 'জোঁক' গল্পের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু জোঁক গল্পে বর্গাচাষিরা সংঘ শক্তিতে জেগে ওঠে, যা 'নবজাতক' গল্পে অনুপস্থিত। ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনে কৃষক সম্প্রদায়ের দ্রোহ আর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ জমিদার, মহাজন, জোতদার শ্রেণির ভীতকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। শওকত আলী গল্পে পুনরায় বঞ্চিত শ্রেণির উত্থান ও সম্মিলিত প্রতিবাদের জাগরণী শক্তি প্রত্যাশা করেন। এ প্রসঙ্গে সমালোচকের মন্তব্য স্মরণীয়: 'নবজাতক' গল্পের আখ্যান গড়ে উঠেছে ভূমিভিত্তিক সামন্ত শোষণের আবহমান পটভূমিকায়। এ গল্পে একটি গোবৎসের জন্মকালীন প্রতীক তার মধ্য দিয়ে বৈরী সমাজ শক্তির বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের উত্থানকেই বিস্মিত করা হয়েছে। ভূমিহীন বর্গাচাষি হাসন আলী ও পুত্র মন্তাজের দারিদ্র্যও ভূমিহীনতার যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সমগ্র তৃণমূল আশ্রয়ী খেটে খাওয়া নর-নারীর চিরায়ত বঞ্চনার
ইতিবৃত্ত বিস্মিত হয়েছে গল্পটিতে। তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস শওকত আলীর কথাসাহিত্যে চিরায়ত সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে বারংবার এসেছে। ইতিহাসের এই রক্তাক্ত অধ্যায় ভূমিহীন আধিয়ার শ্রেণির উজ্জীবনের মূলতন্ত্র। ব্রিটিশ আমলে বাংলার শোষিত, নিপীড়িত কৃষক সম্প্রদায় জমিদার, জোতদার ও সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে- যা তেভাগা আন্দোলন নামে পরিচিত। ১৯৪৬ সালে দিনাজপুর জেলায় এর সূত্রপাত হয়। তেভাগা আন্দোলনকারীদের স্স্নোগান ছিল 'আধি নয়, তেভাগা চাই, লাঙল যার জমি তার'। মূলত উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুভাগ কৃষকদের দাবি ছিল। ভূমিনির্ভর জীবন ও জীবিকার অভ্যন্তরীণ শোষণের প্রসঙ্গটি শওকত আলী রচিত 'আর মা কান্দে না' গল্পে গ্রামের হতদরিদ্র ভূমিহীন কৃষক রমজান আলীর দর্ুর্বিষহ জীবনযন্ত্রণার ছবি যেমন আছে, তেমনি রয়েছে মহাজনের প্রাচুর্যময় বিলাসী দিন-যাপনের চিত্র। বর্ষা মৌসুমে ভূমিহীন কৃষকরা বেকার হয়ে পড়ে। আধিয়ার কৃষকের পুত্র রমজানের নেই স্থায়ী উপার্জন, ভাঙা কুঁড়ে ঘরে ক্ষুধার্ত, রোগে কাতর বৃদ্ধ মাতার অবিরাম কান্না সহ্য করতে না পেরে জননীর মৃতু্য কামনা করে : 'তুই মরতে পারিস না বুড়ি। মর তুই মরে যা- আমি শান্তি পাই তাহলে।' সর্বহারা রমজানের জীবনে পিতার মৃতু্যর পর ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয় নেমে আসে ে মহাজন আধির জমি ফিরিয়ে নেয়। এরপর মহাজনের ক্ষেতে দিন মজুরি করে জীবন ধারণ করে সে। বর্ষার অবিরাম বর্ষণে তার জীবিকা বন্ধ হয়ে যায়, তখন মহাজন কোনো আর্থিক সহযোগিতা করে না। তাইতো দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা রমজান মহাজনের স্বার্থপরতায় খেদোক্তি করেছে : 'বৃষ্টির জন্য যে নিড়ানির কাজ বন্ধ আছে, আর কাজ বন্ধ থাকলে যে মহাজন পয়সা দেয় না- সেসব বিচার নেই।' গ্রামের নিম্নবর্গের মানুষ ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর রোগ-ব্যাধিতে জর্জরিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে। অথচ গাঁয়ের চৌধুরী মহাজনরা বাদল দিনে তাদের বৈঠক খানায় মনোরঞ্ছনের জন্য যৌন উত্তেজক জমজমাট গানের আসর বসিয়েছে। একটানা বর্ষণে উপার্জনহীন কামলারা তখন চৌধুরী বাড়ি ছুটে যায়। মহাজনের গানের আসরে উপস্থিত দিনমজুর রমজান ও লাল মোহাম্মদ উপলব্ধি করে মহাজনের উপভোগ্যময় জীবন। গল্পে নারী লিপ্সু মহাজন পিতা ও পুত্রের অবাধ যৌনাচারের চিত্র ফুটে উঠেছে : 'ছোট চৌধুরী ছকরা পোষে। বাপের নজর কলিমদ্দিন চোরের বউয়ের ওপর আর ছেলে অল্পবয়সি দুই ছোড়া বিনোদলাল আর শাজামালকে নিয়ে পাগল।' গল্পে একদিকে নিরন্ন সাধারণ মানুষের হাহাকার, আরেক দিকে মহাজন চৌধুরীদের আমোদ-প্রমোদ। বর্ষাকালে মহাজনের প্রতিবেশী লাল মোহাম্মদ তাকে কলিমদ্দি চোরের সাগরেদ হওয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়, চুরির স্থানও নির্ধারণ করে মহাজনের গোলা। গল্পের শেষে সর্বহারা শ্রেণির প্রতিবাদী চেতনাও ব্যক্ত হয়েছে। ধনবৈষম্যে তাদের ভেতরে ক্ষোভ জাগে, লাল মোহাম্মদ রমজানকে উদ্দেশ্য করে বলেছে : 'উদিক শালারা ধান জমা করিছে কত দ্যাখ। কেহ চৈত্রের খরার দিন আগুন লাগায় না ক্যানে?' এখানে প্রান্তিক কৃষক রমজানের কল্পনায়ও যে ভেসে ওঠে মহাজনের আশুবিনাশ। শওকত আলী রচিত 'ভবনদী' গল্পে আধিয়ার কৃষানের অভাব-অনটন ও মহাজনের প্রাচুর্যময় জীবনের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। গল্পে হতদরিদ্র উমরালি ও নসরুদ্দিনের পরিবারের রোগ-শোক, অভাব-দারিদ্র্য, দুঃখ-যন্ত্রণা ভারাক্রান্ত ছবি পাঠকের হৃদয়কে নাড়া দেয়। অপরদিকে মহাজনের প্রচুর বিত্ত-বৈভবের মাঝে সুখসমৃদ্ধিতে দিন যাপনে নেই কোনো কষ্টের ছায়া। অসুস্থ পুত্রের চিকিৎসার জন্য ব্যথিত ব্যাকুল উমরালি মহাজনের কাছে ভিটেমাটির বিনিময়ে হলেও অর্থ সাহায্য কামনা করে। কিন্তু উমরালিকে কোন টাকা-কড়ি দিয়ে সহায়তা করে না বরং এ সময় ধর্ম-সংক্রান্ত বয়ানের মাধ্যমে আখেরাত ও পরকাল সম্পর্কিত চিন্তায় মশগুল হয়। স্বার্থপর মহাজন কৌশলে সুভাষণের মাধ্যমে চাষিদের তুষ্ট করে নিজের অর্থ-সম্পদ রক্ষা করে। আর অর্থের পরিবর্তে উমরালির পুত্রের জন্য দোয়া লেখা এক টুকরা কাগজ হাতে ধরিয়ে দেয়। হাজি মহাজনের কাছে বীজ ধানের জন্য আর্জি জানায় আধিয়ার নসরুদ্দিন। হাজি কৌশলে তা এড়িয়ে যায় এবং বড়
ছেলে শহর থেকে ফিরলে তবে কোনো ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেয়। অথচ একই দাবি নিয়ে সেখানে হাজির হয় গ্রামের গৃহস্থ রামদাস বর্মণ। এ ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে রামদাসের প্রয়োজন মেটানোর জন্য ১০ মণ বীজধান দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয় গোমস্তাকে। এভাবে মহাজন বৈষম্যমূলক আচরণ করে। উমরালির সন্তান বাঁচানোর আর্তি বা নসরুদ্দিনের বীজ ধানের আকাঙ্ক্ষা হাজিকে স্পর্শ করে না। আধিয়ার নসরুদ্দিনের দুচোখে হতাশা আর যন্ত্রণার ছবি ভেসে ওঠে। রোগ-শোকে জর্জরিত তাদের পরিবারের ছবি লেখক এভাবেই তুলে ধরেছেন : তার মেয়েটি রোগকাতর, স্ত্রীর কঙ্কালসার বুকে দুধ আসে না, স্তন দুটি যেন শুকনো কাঁঠালপাতা; একটি গরুর খুরে পোকা কিলবিল করছে- হাটে ফিনাইল মেলে না; ঘরের খুঁটি দুটি নড়বড়ে, কখন যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে বলা যায় না। মহাজন বাড়ি থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে নসরুদ্দিন নদীর তীরে এসে দেখতে পায় হাজি মহাজনের বড় পুত্র সপরিবারে শহর থেকে গ্রামে এসেছে। নিজের পরিবারের হতশ্রী দশার বিপরীতে মহাজন পরিবারের জৌলুস তার অন্তরে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। এ সময় দিবোদাসের নৌকায় নদী পার হওয়ার জন্য শহর থেকে আগত বড় মহাজনদের বহনকারী নৌকা স্রোতের টানে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। তখন মাঝির সহকারী সুবলচন্দ্র সাঁতরে রশির একপ্রান্ত তীরে থাকা নসরুদ্দিনের হাতে ধরিয়ে দেয়। কিন্তু নসরুদ্দিনের মনোজগতে ঈর্ষা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, প্রকাশ্যে সে উদাসীন থাকে। সে হাত থেকে নৌকার রশিটি ছেড়ে দিলে নৌকাটি মাঝনদীতে ডুবে যায়।
শওকত আলীর গল্পে নিম্নবর্গের নর-নারী সবার মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। মহাজনের শোষণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে 'অন্ধকারের গান' গল্পে নুরবানুর জেগে ওঠার ভাষ্য শিল্পে রূপলাভ করেছে। মহাজনের বাড়িতে বংশ পরম্পরায় চাকর হিসেবে জীবন অতিবাহিত করেছে কসিমদ্দিনের বাবা-দাদা। কিন্তু কসিমদ্দিন এই গোলামি মেনে নেয় না; সে বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে স্বাধীনভাবে সুখে দিনযাপন করতে চেয়েছে। একদিন কসিমদ্দিনের সুন্দরী স্ত্রীর ওপর নজর পড়ে গাঁয়ের মাতব্বর মন্ডল মহাজনের। নারীলিপ্সু মহাজন টাকার জোরে ষড়যন্ত্রমূলক চুরির মিথ্যা মামলায় কসিমদ্দিনকে জেল হাজতে প্রেরণ করে। এরপর নুরবানু মহাজনের খাস নফর লালমিয়া থেকে হাত বদল হয়ে মহাজনের যৌনদাসী হিসেবে আমোদশালায় বন্দি হয়। ঝলমলে পোশাক আর অলঙ্কারে আবৃত অসহায় নুরবানু লাঞ্ছনা আর গঞ্জনায় দিনাতিপাত করে। তিন বছর হাজতবাস শেষে কসিমদ্দিন বাড়ি ফিরে স্ত্রী নুরবানুকে ফিরে পেতে মহাজনের মুখোমুখি হয়; কিন্তু ক্ষমতাবান মহাজনের কাছ থেকে স্ত্রীকে উদ্ধার করতে পারে না। গ্রামছাড়ার হুমকি পেয়ে রাতের অন্ধকারে স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। কসিমদ্দিন তাকে নিয়ে পালিয়ে শহরে যেতে চায়, কিন্তু মহাজনের হাত থেকে রক্ষা নেই ভেবে নুরবানু অসম্মতি জানায়। তবে নুরবানুর ভেতরে জেগে ওঠে সাহসী আরেক নুরবানু। সে দিনের পর দিন খাটের নিচে লুকিয়ে রাখা ছুরি শানিয়ে তোলে: 'মুই দেখো ছুরিখান, নুকায় নুকায় ইটা ঘষে আরো চখা করো-ছুরিখান এখন মোর হাতের রূপার পটরির
মতন ঝকঝক করে, কিন্তুক ছুরি মুই হাতত্ উঠাবা পারনা- খুব ভারী।' মহাজন বাড়িতে নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চায় নুরবানু। অবশেষে নারীলিপ্সু মহাজনকে সে একাই হত্যার করে স্বামীর হাত ধরে শহরের পথে এগিয়ে যায় উত্তরবঙ্গের রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের গ্রামীণ জোতদার, মহাজন, ভূস্বামী ও সামন্ত প্রভুদের সমবেত শোষণের বিরুদ্ধে শোষিত-বঞ্চিত নিম্নবগের্র প্রতিবাদ-প্রতিরোধ তার গল্পে শিল্পমন্ডিত হয়েছে। তাই তার গল্পকে আঞ্চলিক জীবনের আখ্যান হিসেবে দেখা হয়। 'শওকত আলীর গল্পের বৃহৎ অংশের পটভূমি বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের গ্রামজীবন। গ্রামীণ সংঘজীবনের ভাঙা-গড়ার দ্বন্দ্বে আলোড়িত ও আন্দোলিত তার ছোটগল্পের চরিত্ররা।' তিনি গল্পে শোষকশ্রেণির মুখোশ উন্মোচন করেছেন। গ্রামীণ জীবনের বৈচিত্র্যময় ঘটনাসমূহ হাসান আজিজুল হকের গল্পে শিল্পমন্ডিত হয়েছে। তিনি গ্রামের মহাজন ও নিম্নবর্গের দ্বন্দ্বের পাশাপাশি দেশ-বিভাগ, দাঙ্গা ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে গল্প লিখেছেন। গ্রামীণ পটভূমিতে সৈয়দ শামসুল হকও অনেক শিল্প সফল গল্প লিখেছেন। তিনি গ্রামের মানুষের জীবনাচরণে সমকালীন রাজনীতির প্রভাব ফুটিয়ে তুলেছেন। নিম্নবর্গের সঙ্গে মহাজন শ্রেণির ঐতিহাসিক লড়াই যেমন তেভাগা আন্দোলন, আধিয়ার আন্দোলন ও সাঁওতাল বিদ্রোহ শওকত আলীকে নাড়া দিয়েছিল বলেই গল্পের পটভূমিতে এ প্রসঙ্গগুলো বারবার এসেছে। তিনি অসমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রত্যাশা করেন। তার গল্পের পটভূমিতে আছে নিম্নবর্গের ইতিহাস। তিনি মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মহাজন ও নিম্নবর্গের দ্বন্দ্বের স্বরূপ তুলে ধরেছেন। ফলে শওকত আলীর গল্প পাঠের মাধ্যমে তৃণমূল কৃষকশ্রেণির প্রতিরোধ-উদ্যোগ সম্পর্কে জানা যায়। গল্পে একদিকে আছে কৃষকদের প্রতিবাদ কৌশল; অন্যদিকে, তাদের অধীনতার স্বরূপ। কৃষক বিদ্রোহকে তিনি নতুনভাবে তার গল্পে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন। নিম্নবর্র্গ সব সময় শাসকগোষ্ঠীর অধীনে থাকে এমনকি বিদ্রোহ ও জেগে ওঠার মুহূর্তেও তারা শাসকবর্গের কর্মকান্ডের অধীন। শওকত আলী নিম্নবর্গের এই চেতনার জগৎটাকে উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন। 'নিম্ন্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা নিম্ন্নবর্গকে নিচ থেকে দেখেন না, ওপর থেকে দেখার তো প্রশ্নই ওঠে না, দেখতে চান ভেতর থেকে। তারা খুঁজতে ও বুঝতে চান নিম্নবর্গের মানুষের চেতনার জগৎ।' মহাজনের প্রতি আনুগত্যও বিরোধিতার সমন্বয় নিম্নবর্গের চেতনায় লক্ষ্য করা যায়। তাদের প্রতিরোধ চেতনা তৈরি হয়, কিন্তু প্রবলভাবে তারা বিপস্নব করতে পারে না। এখানে ভূস্বামীরা স্বার্থের ব্যাপারে থাকে সক্রিয়। অপরদিকে, নিম্নবর্র্গ অনেকটাই থাকে নির্জীব। 'শ্রেণিবিভক্ত সমাজে প্রভূত্বের অধিকারী উচ্চ বর্গের চেতনা মৌলিক, সমগ্র, সক্রিয়। অন্যদিকে নিম্নবর্গের চেতনা খন্ডিত, নির্জীব, পরাধীন।' গ্রামের কৃষিজীবী বিত্তহীন মানুষের জীবনযাপন, মহাজনের শোষণ, অর্থনৈতিক মন্দা, মঙ্গা, খড়া, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতির পরিচয় তার গল্পে পাওয়া যায়। প্রান্তিক অস্তিত্ব সর্বস্ব মানুষের সংকট, সামন্তশ্রেণির মহাজন ও জোতদারের উপর্যুপরি নির্যাতন-নিপীড়নে দিশেহারা তৃণমূল মানুষের টিকে থাকার গল্প তিনি লিখেছেন। তার গল্পে মহাজন ও নিম্নবর্গের সম্পর্কসূত্র প্রসঙ্গে বলা যায়, 'প্রভূত্ব ও অধীনতার সম্পর্ক, বৈপরীত্যের।' একই সঙ্গে তার গল্পে অন্ত্যজ শ্রেণির মর্মবেদনার রূপায়ণ ঘটেছে। তার গ্রামীণ পটভূমিতে লেখা গল্পে নিম্নবর্গের ঘুরে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা ক্ষুদ্র হলেও তাদের মনোভাব প্রতিরোধ-প্রতিশোধের। সামাজিক দায়বোধ থেকে শওকত আলী তার গল্পের অন্তর্ভুবনে মহাজন ও সর্বহারাদের দ্বান্দ্বিক জীবনচিত্র তুলে এনেছেন। নিম্নবর্গের শোষিত মানুষের প্রতি তারছিল গভীর সহানুভূতি, তিনি সাধারণ নিপীড়িত শ্রেণির মুক্তি প্রত্যাশা করেছেন।