প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বৈষয়িক চিন্তাভাবনার বাইরে নিবেদিত এক প্রাণপুরুষ সরদার ফজলুল করিম। তিনি সরদার নামে নিজের পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়কে অতিক্রমের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং সমাজ গঠিত হয়েছে। এ অন্ধকার অতিক্রমণে যুদ্ধ করেছেন সরদার ফজলুল করিম। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ সরদার ফজলুল করিম বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের অন্যতম পৃথিকৃত। জ্ঞান-পিপাসু এই বিপস্নবী মানুষটি নানা অর্থেই এক অসামান্য চরিত্র। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই বৈচিত্র্যে ভরপুর। বৈপস্নবিক আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে চাকরি ছেড়েছেন, জীবনের সব চাওয়া পাওয়াকে তুচ্ছ করে আজীবন জড়িয়ে থেকেছেন আন্দোলন সংগ্রামে। চারবার কারাবন্দি হয়ে ১১টি বছর বন্দি অবস্থায় ছিলেন। লেখালেখিকে নিলেন লড়াই-সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে। দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, রাষ্ট্র বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছেন প্রচুর। এই দেশকে আপন করে নেওয়ার অমৃতকথা আমরা তার রচনায় পাই। আমি সরদার বলছি, সরদার ফজলুল করিমের আত্মজীবনীমূলক একটি গ্রন্থ। এতে ওঠে এসেছে তার শৈশব-কৈশোর, যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা, বরিশাল থেকে রাজধানী ঢাকায় আগমন, দেশবরেণ্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে তার নানা স্মৃতি, আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির কথা, আন্দোলন-সংগ্রাম, বন্দিজীবনসহ বৈচিত্র্য-বৈভবে পরিপূর্ণ একটি জীবনের নানা কথা। আমি সরদার বলছি গ্রন্থটি সরদার ফজলুল করিমের স্মৃতিকথা ও আত্মজীবনমূলক তিনটি গ্রন্থের সংকলন। সেই, সে কাল কিছু স্মৃতি, কিছু কথা। বরিশালের পোলার ঢাকা আগমন, জীবন জয়ী হবে- এই তিনটি গ্রন্থ নিয়ে 'আমি সরদার বলছি'। 'আমি সরদার বলছি' বইয়ে গ্রন্থিত হয়েছে বহু বিচিত্র ঘটনাবলি ও ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ। এতে তিনি তার সময়, সমাজ ও বাস্তবতার বিবিধ প্রসঙ্গ, অনুষঙ্গ তুলে ধরেছেন। যা এ কালের পাঠকসমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও নতুন পথের পাথেয়। চলিস্নশ দশকের ঢাকা পর্যবেক্ষণে ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সরদারের। যে কোনো সচেতন ব্যক্তির ঢাকা আসা-যাওয়ার মধ্যে আবেগ ও বিস্ময় দুটো থাকাই স্বাভাবিক। ১৯৪০ সালে মেট্রিক পাস করে সরদারের ঢাকা শহরে আসার মধ্যে কত যে রোম্যান্টিকতা ছিল, তা কি আর বলতে হয়। বাদামতলি ঘাটে জাহাজ থেকে নেমে সেই বিস্ময়ভরা চোখে তিনি দেখেছেন ঢাকার রূপ ও চলাচল ব্যবস্থা। 'ঝমঝম' করে বিরাট জাহাজ বরিশাল থেকে ছেড়ে নদীর বুকে ঢেউ তুলে, চাঁদপুর বন্দর এবং মুন্সীগঞ্জে নোঙর করে, নারায়ণগঞ্জের নদীতে ঢুকে সেখানে কিছুক্ষণ থেমে তারপর আবার মীরকাদিম হয়ে সন্ধ্যার পরে যখন বুড়িগঙ্গায় ঢুকল, তখন কিশোরের চোখে পড়ল, দূরের রাস্তা দিয়ে আরও দ্রম্নতবেগে এক-চোখো কি একটা দৌড়ে যাচ্ছে ঢাকার দিকে। সঙ্গী বয়োজ্যেষ্ঠ ছাত্র কিশোরকে তার বিস্ময় আর ভয়ের ঘোর কাটিয়ে দেওয়ার জন্য নিশ্চয়ই বলেছিল : 'ঐ দেখ রেলগাড়ি যায়।' পর্যবেক্ষণ করেছেন শুধু ঢাকা নয়, পূর্ববঙ্গের সমাজ ও জীবন। বিশ্লেষণ করেছেন মানুষের মনোজগৎ ও সামাজিক আচার আচরণ।
অনেক কাজের মাঝে সিনেমা দেখা ছিল তার নেশা ও ভালোলাগা। প্রতিটি সিনেমা দেখে নোট খাতায় সিনেমার নামও লিখে রাখতেন। ওই নোটবুক আবার ফিরে পেয়েছেন মধ্য বয়সে পৌঁছে। আত্মকথায় আনন্দের সঙ্গে কয়েকটি নামও উলেস্নখ করেছেন। এর মধ্যে বিপস্নবী ও লেখক সোমেন চন্দের মৃতু্য তার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে দেয়। ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ শ্রমিক মিছিলে নেতৃত্বে ছিলেন সোমেন চন্দ। ওই সময় প্রতিপক্ষের আক্রমণে তিনি নিহত হন। এ নির্মম হত্যাকান্ড সরদার মেনে নিতে পারেননি। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয় তার আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন। যদিও তার আশপাশে কারো জীবন এমন ছিল না। রাজনৈতিক হুলিয়া থাকার কারণে ওই সময় ঢাকায় থাকা নিরাপদ মনে করেনি তার দল। এ জন্য দলের পরামর্শে তাকে কলকাতা যেতে হলো। কিন্তু সেখানেও গোয়েন্দা বিভাগের তৎপরতা এড়ানো যায়নি। একদিন সত্যি তাকে পুলিশের মুখোমুখি হতে হয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ সম্পর্কে জানাচ্ছেন, তার শারীরিক গঠন দেখে পুলিশ নিশ্চিত হতে পারেনি তিনি সরদার ফজলুল করিম কিনা। তারা মনে করেছে- এত ছোটখাটো ব্যক্তি সরদার ফজলুল করিম হতে পারে না। 'পুলিশের লোকজন তখন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করল, 'নো' 'নো' নট দিজ ওয়ান। সাম বিগ গাই। সাম বিগ সরদার ফ্রম ইস্ট বেঙ্গল।' এ কথাটাও আমার মনে আছে। 'ওরা আমাকে পছন্দ করছে না।' সরদার ফজলুল করিমকে অনেকে না চিনলেও সাধারণ মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করত। কেউ কেউ তার কাছেই জানতে চয়েছে- সরদার ফজলুল করিমকে চিনেন কিনা। কারাগার জীবনের কথা বলতে বলতে একটি সত্যকে তিনি তুলে ধরেছেন। 'জেলে অনেকেই লেখাপড়া ও গবেষণামূলক কাজ করতে পেরেছেন। সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, অনিল মুখার্জী এরা সবাই জেলে বসে ভালো কাজ করেছেন। হিন্দু সম্প্র্রদায়ভুক্ত যেসব রাজবন্দি, তারা জেলখানায় গিয়ে চিন্তা করতেন, জেলখানার সময়টা তারা কীভাবে ব্যবহার করবেন লেখাপড়ার কাজে। কিন্তু আমরা যারা মুসলমান রাজবন্দি আমাদের লেখাপড়ার কোনো ট্র্যাডিশন তেমন ছিল না। আমরা মুসলমানরা জেলখানায় গিয়েই ভেঙে পড়তাম। আমাদের মধ্যে ভেঙে পড়ার যে প্রবণতা এটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ছিল।' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সারাজীবন তিনি শিক্ষকতা করেছেন। এর ভেতরেও তিনি আন্দোলন সংগ্রাম থেকে সরে যাননি। বরং শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে কখনো বেছে নিয়েছেন রাজনৈতিক দায়িত্ব। পরিণামে কয়েকবার জেলযাপন। সরদারের চিন্তা, স্বতন্ত্র জীবনপ্রণালি একেবারেই ব্যতিক্রম। সরদারের মতো ত্যাগী ও জীবনবাদী মানুষ এ সমাজে নগণ্য। তিনি প্রথাগত শিক্ষক ছিলেন না। তার শিক্ষকতা, রাজনীতি, জীবনবোধ অতুলনীয়। তার জীবনপাঠে জ্ঞানচর্চা এবং শ্রমিক, কৃষক শ্রেণির মুক্তির লক্ষ্যে এক বিপস্নবী ও নিরন্তর জীবনযোদ্ধাকে আমরা পেয়ে থাকি। বিভিন্ন সময়ে তার কাছে ব্যক্তি ও সুখের লোভনীয় প্রস্তাব প্রায়ই উপস্থাপিত হয়েছে। পাকিস্তানের কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত হয়ে তিনি আত্মপ্রতারণা করেননি। বইটিকে বলা যায় নিত্যদিনের দর্শন। যতটা সহজে জীবনকে দেখা যায়, জীবনকে বিশ্লেষণ করা যায়, যতটা সহজে যাপিত জীবনের আখ্যানচিত্র এঁকে মানুষের জন্য লাগসই করা যায়, গ্রন্থটি এরই এক অনবদ্য উদাহরণ। প্রতিদিনকার জীবনের কষ্ট, যন্ত্রণা, তামাশাকে তিনি দর্শনের রাবারে ঘষামাজা করে বইটিতে তুলে ধরেছেন। এখানে রাষ্ট্র ও কাঁচাবাজার, মারণাস্ত্র ও শসা, ব্যাংকের টাকা তোলা থেকে পেস্নটোর সংলাপ, আকাশ-এম এম আকাশ ও প্রকৃতির খোলা আকাশ-দুটোই আছে। ক্যালেন্ডারের তারিখ ধরে ধরে প্রতিদিনের ঘটনা, খবরের কাগজে প্রকাশিত সংবাদ ও লেখা, মানুষ, প্রকৃতি আর বস্তুরাজির সঙ্গে সরদারের যে মিথস্ক্রিয়া, এর বিবরণ এখানে আছে। এ বিবরণের সঙ্গে বাড়তি যা আছে, তা হলো সরদারের দার্শনিক ফুটনোট, টীকা-টীপ্পনি আর অন্তর্দৃষ্টি। ভাষা দারুণ সহজ আর সাবলীল। বুদ্ধিবৃত্তিক প্যাঁচগোচ নেই, আছে নৈর্ব্যক্তিক সততা। যখন যার লেখা, বক্তব্য তার ভালো লাগছে, অবলীলায় তিনি তা বলে দিচ্ছেন, কারও কারও লেখা কেটে রাখছেন, পরে পড়বেন বলে। কিন্তু সেগুলো আদৌ কখনো পড়া হবে কিনা, দ্বিধাহীনভাবে সে দ্বিধাও প্রকাশ করেছেন। বইটিতে আত্মসমালোচনা আছে- প্রায়শ নিজেকে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিজের কোর্ট মার্শাল করার চেষ্টা করেছেন। অফিসের পিয়ন কিংবা সবজি বিক্রেতা- প্রতিদিনকার জীবনাচরণে মানুষকে প্রতিনিয়ত যে সম্মান তিনি দেখিয়েছেন, তা বিরল। সরদার ফজলুল করিমকে আমরা জানি, শিক্ষাবিদ ও জীবনসংগ্রামী হিসেবে। কিন্তু নিজেকে তিনি সগর্বে 'কৃষকের পোলা বলে' পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। বইটিতে নিজের দীনতা, অক্ষমতার কথা চাবুকের মতো প্রকাশের যে সাহস তিনি দেখিয়েছেন, এতে পাঠক হিসেবে আমাদের লজ্জা আরও বেড়ে যায়। আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে আরও সংকুচিত হয়ে পড়ি। কর্তব্যে ফাঁকি দিয়ে যখন আমরা পালানোর পথ খুঁজি, বইটিতে ঠিক তখনই তিনি সক্রেটিসকে হাজির করেন: 'সক্রেটিসকে শিষ্যরা বললেন, তুমি কারাগার থেকে পালাও। সক্রেটিস বললেন, আমি যুক্তি আর নিয়মের বন্দি। আমি পালাতে পারিনে।' কিছু বিষয় দারুণ দাগ কেটে যায়। যেমন নিজেকে তিনি বলদ বলেছেন। কীসের বলদ? বইয়ের বলদ। বই কী? 'বই অবশ্যই লিখিত এবং মুদ্রিত, মানুষের এক মহৎ আবিষ্কার। কিন্তু তথাপি, যে দেশে বই পাঠ করা হয় না, অক্ষম আমার বাসার মতো কেবল স্তূপ করে রাখা হয়, তা বস্তু বটে তবে বই নয়। ...যে বই পঠিত হয়, কিন্তু এর বিষয়বস্তু আলোচিত হয় না, তার বক্তব্য অনুসৃত হয় না, সে বইও বই নয়। বস্তুমাত্র।' তিনি অবসান চেয়েছেন মানুষের ওপর মানুষের শাসনের। কার্ল মার্ক্সকে উদ্ধৃত করেছেন, 'মানুষের ওপর মানুষের শাসন কোনো যৌক্তিক ব্যাপার নয় : আমরা কল্পনা করি, এমন একদিন আসবে যেদিন মানুষের ওপর মানুষের শাসনের জায়গাতে বস্তুর ওপর মানুষের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে।' তিন স্তরে নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি- মানুষ, কমিউনিস্ট ও বাঙালি। তিনি যৌবনের জয়গান গেয়েছেন, তারুণ্যের প্রতি ব্যক্ত করেছেন অবিচল আশাবাদ। বইটিতে নিজের ভালো লাগা কিছু বইয়ের কথা জানিয়েছেন। যেমন- শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের শাহজাদা দারাশুকো। এ জন্য খবরের কাগজে শ্যামলের মৃতু্যসংবাদ পড়ে তিনি দুঃখ পেয়েছেন। অ্যারিস্টটলের জন্য তার অপরিসীম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার বয়ান আছে এই বইতে। সরদার লিখেছেন, 'অ্যারিস্টটলের জন্য আমার মায়া হয়। তিনি আমাকে আজও মুগ্ধ করেন। অ্যারিস্টটলের পলিটিকসের গায়ের ধুলো আমার গায়ের জামা দিয়েই মুছলাম।' আরেকটি বই মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের 'সুন্দরের সংগ্রাম ও বুদ্ধিবাদের ট্র্যাজেডি'র উলেস্নখ করেছেন তিনি। বলেছেন, বইটির লেখক তার অচেনা কিন্তু তার রচনা জীবনসত্যের দলিল। এ প্রসঙ্গেই বাংলাদেশের রাজনীতি আর ভবিষ্যৎকে রবীন্দ্রনাথের শিশুতীর্থ থেকে উদ্ধৃত করে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন: '... কিন্তু সূর্য আর ওঠে না। অন্ধকার গভীর থেকে গভীরতর হয়। আর্তনাদ ওঠে। এখন কি উপায়? কোথায় যাব আমরা? কোথায় যাচ্ছি? এখন কে আমাদের পথ দেখাবে?...' এত মৃতু্য, হত্যা, যুদ্ধ দেখে এই বয়সে সরদার যেন ক্লান্ত, কখনো তিনি হতাশ হয়েছেন, মানুষের প্রতি ক্ষোভ আর বিরক্তি প্রকাশ করেছেন, সিদ্ধান্তের দ্বান্দ্বিকতায় একই সঙ্গে তাড়িত ও পীড়িত বোধ করেছেন। কিন্তু মানুষের ওপর আস্থা হারাননি, চূড়ান্ত বিচারে তিনি তাই জীবনবাদী, আশাবাদী। আত্মম্ভর আশায় অন্যত্র তিনিই আবার বলেছেন, 'জীবন বনাম মৃতু্যর যে লড়াই আজ চলছে, তাতে জীবনই জয়ী হবে, মৃতু্য নয়।' বইটিতে মানুষের শক্তি ও সম্ভাবনার কথাই বড় হয়ে বেজেছে।