ক'দিন আগে নাহিদ রাতে যখন মোবাইল ফোনে বুয়েটে ভর্তিযুদ্ধে উত্তীর্ণ হওয়ার খবরটা নানিকে জানায়, তখন খুশিতে আত্মহারা হয়েছিল আয়শা বেগম। অতি আনন্দাশ্রম্নতে দু'চোখ ঝাপসা হয়েছিল। ক্ষীণধারায় উপচে উঠেছিল দু'চোখের নদী। আফসোস করে কেঁদে কেঁদে বলেছিল, আজ যদি তোর মা বেঁচে থাকত!
ঈদের দিন সকালেও নাহিদ সবার আগে ফোন করে আয়েশা বেগমকে ঈদের শুভেচ্ছা জানায়। নাহিদের ফোন পেয়ে তার মায়ের সূত্র ধরে স্মৃতি তাড়িত হয় আয়শা বেগম।
সিজার অপারেশনে একটি ছেলে সন্তান জন্ম দেওয়ার চার দিন পর বাবার বাসায় আসে ডা. শরীফা। দ্রম্নতই সুস্থ ও স্বাভাবিক হচ্ছিল মা। নবজাতকও সুস্থ। ডাক্তার দম্পতির প্রথম সন্তান ছেলে হওয়ায় উভয় পরিবারে আনন্দের বন্যা। নবজাতকের নানি আয়শা বেগম তো আদরের নাতিকে কোলে কোলেই রাখে।
ছ'দিনের মাথায় রাত বারোটায় শরীফা অসুস্থবোধ করে। স্বামী দ্রম্নত হাসপাতালে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। হাসপাতাল যাওয়ার আগে শরীফা নবজাতকে বুকের দুধ খাওয়ায়। নানির কাছে নবজাতককে রেখে ওরা বের হয়। তখন রাত বারোটা। রিকশায় ধরাধরি করে স্বামী তাকে রিকশায় তুলে। ছুটে রিকশা। রাত পোহালেই ঈদ। এ জন্যই শহর অনেকটা সরব। বলা যায় শহরটা অনেকটাই নির্ঘুম রাত যাপন করছে।
কিছুদূর এগোলে শরীফার অবস্থার অবনতি হতে থাকে। হাসপাতালে নেওয়ার পথে অ্যাম্বোলিজম দেখা দিলে বেহুঁশ হয় শরীফা। তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। বিনা মেঘে বজ্রপাত হয় স্বামী রিফাতের মাথায়।
সুস্থ হয়ে মেয়ে রাতেই ফিরবে, এই আশায় শিশুটির নানি আয়শা বেগম অপেক্ষায়। ঘরে পায়চারি করে আর নবজাতকের প্রতি খেয়াল রাখে। ঘণ্টা দুই পর শিশুটি ক্ষুধায় কান্না শুরু করে। আয়শা বেগম প্রবোধ দেয়। তাতে কোনো লাভ হয় না। শিশুর কান্নার মাত্রা বাড়ে। জন্মের পর এভাবে আর কোনোদিন কাঁদেনি বলে নানির ধারণা।
ততক্ষণে শিশুটির নানার বাড়ির ভাড়াটেদের মাঝে খবরটি জানাজানি হয়। মরহুমার বাবা প্যারালাইজড হয়ে শয্যাশায়ী। আয়শা বেগম উচ্চ রক্তচাপের রোগী। হঠাৎ করে শরীফার শর্বনাশা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার খবরটা তার মা বা বাবার কানে কেউ দিতে সাহস করছে না।
একই বাসায় ভাড়া থাকে ব্যবসায়ী পরেশ সাহা। স্ত্রী উমা সাহার কোলে এক বছরের শিশু। সদ্য মা হারা শিশুটির অপার্থিব কান্না শুনে ভাড়াটে এই মায়ের মন আনচান করে। নবজাতক শিশুটিকে বুকের দুধ দিয়ে শান্ত করতে দোতলায় উঠে। দরজায় কড়া নাড়ে। শিশু কোলে নিয়েই আয়শা বেগম দরজা খুলে।
উমা সাহা পরম যত্নে শিশুটিকে বুকের দুধ দেয়। নবজাতকও বুকের অমৃত পান করে ঘুমিয়ে যায়। ঘণ্টা দুই পর আবার শিশুটি কাঁদতে শুরু করে। আবার উমা সাহা নিচতলা থেকে উপরে উঠে। ফের দরজায় কড়া নাড়ে। নানি আবার দরজা খুলে। উমা সাহা ফের বুকের দুধ খাওয়ায়। এভাবে রাত জেগে মা হারা শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখে উমা সাহা।
নানি আয়শার চোখে ঘুম নেই। নির্ঘুম রাত দীর্ঘই হয়। ধীরে ধীরে আলো ফোটে। অন্য যে কোনো ভোরের চেয়ে এই ভোরটি আয়শা বেগমের কাছে বেশি সরব মনে হয়। বাড়ির ভাড়াটেরাও জেগে। আয়শা বেগমের মনে খটকা, আসন্ন ঈদের আনন্দেই কি সবাই জেগে রাত কাটাল?
ততক্ষণে স্বজনেরা শরীফাদের বাড়িতে আসতে শুরু করে। শহরে বসবাসকারী আয়শা বেগমের ভাইসহ স্ত্রী এবং অন্য স্বজনেরা আসছে। তার মনে বিস্ময়। তখনই তার একমাত্র ছেলেটা এসে মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়ে। বলে, আম্মা গো! সর্বনাশ অয়া গেছে। শরীফা আপা পথেই অ্যাম্বোলিজমে বেহুঁশ হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার মৃত ঘোষণা করে।
হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হলে যেমন ভিক্টিম কোনো কথা বলার সুযোগ পায় না, তেমনি বার্তাটি শুনে অকস্মাৎ মানসিক আঘাতে বাকরুদ্ধ হয় আয়শা বেগম। মুহূর্তে মুর্ছা যায়। স্বজনেরা চোখে-মুখে জল ছিটালে চেতনা ফিরে। তবে তার দু'চোখে জলের খরা। শোকে স্তব্ধ হয়ে কতক্ষণ পাথর বনেছিল মনে নেই। একমাত্র কন্যা হারিয়ে আয়শা বেগম উন্মাদ প্রায়। ছেলেকে বলে, শরীফা কই?
পাশের বাসার আঙিনায়।
আমি দেখতে যায়াম। তারে আমরার বাসায় আনা লাগব না!
আম্মা আমরা যাইতেছি। এখনই নিয়া আসতেছি।
বলেই ছেলেটা স্বজনদের নিয়ে বের হয়। মেয়েকে নিজেদের বাসায় আনা হলে মা আয়শা বেগম এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবা মেয়েকে এক নজর দেখেই জগতের সবচে ভারী শোকের পাথরে চাপা পড়ে। শোকাবহ আহাজারিতে ভেঙে পড়ে মা বলে, আইজ সবাই যখন ঈদের আনন্দে আত্মহারা, তখন আমাদের বুকে শোকের শেল এ কেমন সর্বনাশা আঘাত করল রে!
এভাবে বুকভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ে স্বজনদের ডেকে মা বলে, ঈদের প্রথম জামাতেই তার জানাজার ব্যবস্থা করো! কলিজার টুকরা মেয়েটারে আর কষ্ট দিতে চাই না।
মায়ের মৃতু্যর পর দুগ্ধপোষ্য শিশুটির খাবারে সংকট দেওয়াটাই স্বাভাবিক। একই শহরে শরীফার স্বামী আরিফের বাসা। বিধ্বস্ত দুই পরিবারে সমন্বয়হীনতার জন্য শিশুটির খাবারের ঝুঁকি দেখা যেন না দেয় সেদিকেও ষোলআনা নজর আয়শা বেগমের। নবজাতকের ফুফুর কোলে ছ'মাসের শিশু। রাতে শিশুটির নানির বাড়িতে অবস্থান করে বুকের দুধ দিতে পারত তার ফুফু। হয়ত বা সেকথা তাদের ভাবনায় আসেনি। সকালে যখন মা হারা শিশুটি ক্ষুধায় যখন কাঁদে, তখন নাতিকে কোলে নিয়ে সন্তান হারা মা-ও অভিন্ন কান্নায় একাকার হয়।
সকাল সাতটার দিকে নবজাতকের দাদা-দাদি, ফুপু আসে। শিশুটিকে কোলে তুলে নেয় তার ফুপু। ভিন্ন সম্প্রদায়ের একজন মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো হয়েছে জানতে পেরে শিশুটির রক্ষণশীল দাদা বলে, ভিন্ন ধর্মালম্বী মায়ের বুকের দুধ পান করানোর ধর্মীয় ব্যাখ্যা জানতে হবে।
শিশুটির দাদার এমন মন্তব্য নানি মনে মনে বলে, এমন পরিস্থিতিতে ধর্ম বিবেচনার চেয়ে শিশুর প্রাণ বাঁচানোই সবচে বড় বিষয় ছিল।
স্মৃতিচারণ শেষে আয়শা বেগম দেওয়ালে টানানো মেয়ে শরীফার ছবিটির দিকে এক পলক তাকায়। এদিন যখন সবাই ঈদের খুশির জোয়ারে ভাসে, আয়শা বেগমের আনন্দে তখন নামে বেদনার ছায়া।