ইলা রিমোট হাতে নিতেই টেলিভিশনের পর্দায় দেখে স্স্নোগানে মুখরিত চারপাশ। হঠাৎ কী হলো দেখতেই, মন-প্রাণ উজাড় করে দিয়ে একদম সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো। অনেক মানুষের জটলা। কেউ পস্ন্যাকার্ড নিয়ে, কেউ বা ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ ভেসে এলো এক কণ্ঠ। হাতে মাইক্রোফোন, চোখ দুটো যেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে করতে ক্লান্ত! কণ্ঠ হঠাৎ বলে উঠল, নানা দাবির কথা। ইলা তখনই বুঝল, এই ছেলেটাই নেতৃত্ব দিচ্ছে। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ইলা দেখছে আর আনমনে ভাবছে, যদি একদিন মানুষটাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ জোটে!
-ইলা, তোর মোবাইলে রিং বাজছে। ফোনটা ধর।
-হঁ্যা মা।
ইলা মেয়েটা আসলেই এমন, খবর দেখতে বসলে টেলিভিশনের মাঝে ঢুকে যায়!
ইলা বসে বসে কবিতা পড়ছে। কবিতা তার ভীষণ পছন্দের। বই কিনে কিনে পুরো ঘর সাজিয়ে রেখেছে। যে কেউ দেখলেই বলবে, এটি বুঝি পাঠাগার!
-ইলা...
-হঁ্যা মা। কিছু বলবে?
-তোর বাবা এতরাত হলো এখনো বাসায় ফিরল না। একটা কল দে তো মা।
-হঁ্যা তাই তো। বাবা তো এত দেরি করার মানুষ না। দাঁড়াও কল দিচ্ছি।
ইলা তাড়াতাড়ি মোবাইল নিয়ে বাবাকে কল দিল। অন্য পাশ থেকে ভিন্ন কণ্ঠের একটা লোক কল ধরেই বলল,
-'আপনি এ রকম দেখতে শার্ট-প্যান্ট পরা লোককে চাইছেন? বয়স ৫০!'
পরক্ষণেই ইলার বুঝতে বাকি রইল না কী হয়েছে তার বাবার!
ইলা আইসিইউ রুমের পাশে হাঁটাহাঁটি করছে। কান্নায় চোখ-মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল! ইলার খালাত ভাই ফরহাদ ছুটতে ছুটতে এসেছে হাসপাতালে।
-ইলা...
-ভাইয়া, বাবার এই অবস্থা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না, বলেই হাউমাউ করে কেঁদে দিয়েছে ইলা।
-এই ইলা শোন, ভেঙে পড়ছিস কেন? খালু সুস্থ হয়ে যাবে আলস্নাহকে ডাক।
-তুমি জান, বাবার কীভাবে সড়ক দুর্ঘটনা হলো? বাবাকে একটা গাড়ি ধাক্কা দিয়ে রোডের ডিভাইডারের মধ্যে ফেলে দিল, শুধু তাই না বাবাকে ওরা অন্ধকার রাস্তায় একা বসিয়ে রেখে চলে গিয়েছিল! এরপর কতশত মানুষ আসল সেখানে কেউ ছবি তুলছিল কেউ বা ভিডিও। রাস্তাটা মুহূর্তেই বাবার রক্তে রক্তাক্ত হয়ে গেল! ভাই আমি ওদের ছাড়ব না যারা এই সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। ভাই তুমি কিছু একটা করো।
-ইলা, আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়বি তো। ধৈর্য ধরে থাক।
একদিন যেতে-না যেতেই খবর এলো ইলার বাবা আর বেঁচে নেই। ইলা ও ইলার মা খবরটা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। ইলাকে চোখের জলে তার বাবাকে বিদায় দিতে হলো।
হঠাৎই কলিং বেল বেজে উঠল।
-ইলা...ইলা...কই রে তুই?
ইলা সামনের রুমে চলে আসল ডাক শুনে।
-হঁ্যা ভাইয়া।
-ইলা শোন তুই বলেছিস যে, খালুর দুর্ঘটনার বিচার চেয়ে আমাদের প্রতিবাদ করা উচিত। সবাই আজকে বিকালে জামালখানে প্রতিবাদ সমাবেশ করবে আর আমি সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আর এই যে দেখছিস আমার পাশে বসা, পরিচয় করিয়ে দিই। ওর নাম ইনজামুল হক। ডাকনাম ইনজাম। বন্ধু শোন, ও হচ্ছে ইলা...যার কথা বলেছিলাম।
-হ্যালো ইলা...আমি সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করি। এ নিয়ে আমার নিজস্ব সংগঠন আছে। তাই আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব তোমাকে সাহায্য করার।
-হুম, আমি কৃতজ্ঞ থাকব আপনাদের ওপর।
ইলা চোখের জল মুছতে মুছতে ছুটল রান্নাঘরের দিকে। চা-নাশতা নিয়ে আবার আসল।
-ভাইয়া আপনারা খেয়ে নিন।
এই কথা বলে পাশে চুপচাপ বসে রইল। ইলার মা কথাবার্তা বলছেন কীভাবে কী করবে এসব নিয়ে। দুপুরে খেয়ে একেবারে ইলাসহ সবাই বের হলো।
আগে থেকে সমাবেশস্থল প্রস্তুত। ইলার বন্ধুমহল, সিনিয়র ভাই-বোন, শিক্ষক, আত্মীয়রা সবাই এসেছেন। ইলার ভাই ফরহাদ সবাইকে একসঙ্গে দাঁড়ানোর জন্য নির্দেশ দিচ্ছে। মাইক্রোফোন হাতে নিয়েই ইনজামুল ছেলেটা বক্তৃতা শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাংবাদিকরা হাজির হলেন। সবাই 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস' বলে প্রতিবাদ করছেন। ইলা এক পাশে বাবার ছবিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মাঝেমধ্যে সাংবাদিকদের ঘটনার বিবরণ দিচ্ছে। প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে তদন্তকারী পুলিশ এসে বলে যে, তারা সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে গাড়িটা জব্দ করতে পেরেছে। চালককে খুঁজছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আটক করবে, আপাতত প্রতিবাদ বন্ধ রাখতে বলল। ইনজামুল যদিও বলল, তারা আগামীকালও প্রতিবাদ করবে।
টানা দুই দিন বিচার চেয়ে চেয়ে অবশেষে ঘাতক চালক ধরা পড়ল। ইলারা একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিল, তার বাবার খুনি এবার শাস্তি পাবে। কিন্তু বাবার স্মৃতি, বাবার আদর-ভালোবাসা ইলা খুব মিস করছে। এই অপূরণ কখনোই মিটবে না ইলা তা বোঝে, তবুও নয়নে জলের ছলছল ভাবটা যেন রয়ে গেছে তার!
ইলার মনে একটা অদ্ভুত বিষয় ঘুরছে। এই যে ভাইয়ের বন্ধু ইনজামকে কোথায় যেন আগে দেখেছিল। শীতের হিমপড়া রাতে ইলা ভেবেই চলেছে, দুইদিন ধরে সেই মুখ আর কণ্ঠ খুবই আপন লাগছিল। কিন্তু কেন লাগছে এমনটা সে কিছুতেই মেলাতে পারছে না। ইলা নিস্তব্ধতার চাদর নিয়ে ভেবেই চলেছে সত্যি কি আগে দেখেছিলাম? না কী কল্পনা! অনেকক্ষণ পর তার মনে পড়েছে, সেদিন টেলিভিশনে লাইভে যে ছেলেটাকে সে দেখেছিল সেই হচ্ছে এই ইনজামুল।
ইলা ভীষণ খুশি। কারণ তার উইশটা ওপরওয়ালাই পূরণ করে দিয়েছে। ইলা খুশিতে ঘুমিয়ে পড়ল।
ইলা পরদিনই সেই ছেলেটার ফেসবুক আইডি খুঁজে বের করেছে। রিকোয়েস্ট দিয়েছে চুপিচুপি। হঠাৎ টিংটং করে নোটিফিকেশন আসল, ইলা লাফিয়ে উঠল বিছানা থেকে। ইনজামের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু চ্যাটে। ইলা বাবার হত্যাকারীকে ধরিয়ে দিতে তার অক্লান্ত চেষ্টার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুলল না। সেও বলল, পাশে থাকতে পেরে শোকরিয়া জানাল ওপরওয়ালার প্রতি।
ইদানীং ইনজামের সঙ্গে ইলার খুনসুটি চলছে বেশি। ইনজাম ছেলেটা বেশি দুষ্টামি করে। ইলার মন খারাপ থাকলেও ইনজামের এই দুষ্টামিতে হাসতে সে বাধ্য! তারা দু'জনই একে-অপরকে ঘটক বানাল। ইনজাম কয়েকদিন ধরে ইলার মাথা বেশ খাচ্ছে।
-পাত্রী খুঁজে দিন না ইলা ম্যাডাম...!
-আগে আমার পাত্র খুঁজে দিন।
-না আগে আমার, এরপর আপনারটা।
-হবে না। আগে আমার।
-আচ্ছা দেখা যাক। ইলা আপনি তো ভালো কবিতা লেখেন। আমাকে একটা কবিতা পাঠাবেন? পিস্নজ...পড়তে ইচ্ছা করছে।
-আচ্ছা দিচ্ছি।
'আপনার সঙ্গে আমার পরিচয়টা এখনো ঠিকমতো জমে ওঠেনি;
সেই যে হিমশীতল দিনে আপনাকে দেখেছিলাম প্রথম,
সেই যে আপনার হাসোজ্জ্বল মুখ দেখেছিলাম প্রথম,
এই তো বেশ নিজের মতো খুঁজে পাওয়া আপনাকে।
হৃদয়ের দখিন দুয়ার খুলে দিয়ে যখনই আপনাকে নিয়ে ভেবেছি,
সেই দুই নয়ন যেন কিছু বলতে চেয়েছে আমায়!
চুপিসারে যতই কাছে এসেছি,
ততই আপনার অদ্ভুত মায়ার প্রেমে পড়েছি।
কল্পনা বাদ দিয়ে বাস্তবতায় ফিরতেই বুঝেছি,
কে আমি?
ডাকনামটাও হয়তো ঠিক করে জানেন না!
হয়ে উঠেনি যে ডাকনামে
সম্বোধন করে ডাকাডাকি,
হয়ে ওঠেনি বেনামে
লেখা চিরকুটে খোঁজাখুঁজি,
অথচ কত কাব্য লেখা হয়ে গেছে আপনার নামে,
অদূরে আপনার মনে নাম-ঠিকানাবিহীন পড়ে রয়েছি এই আমি!'
-ইলা কী সুন্দর কবিতা লেখেন আপনি! আমি মুগ্ধ হয়ে পড়ছিলাম। আচ্ছা মানুষটা কে?
-মানুষটা আছে একজন, মনের খুব কাছের।
-আচ্ছা থাক আর বলতে হবে না। বিয়েতে দাওয়াত দিয়েন তখন দেখব।
এভাবেই রোজ কথাবার্তা চলছে ইলার সঙ্গে ইনজামের।
ইলার এখন কেমন যেন মনে হয় এবার ইনজাম ছেলেটাকে সবটা স্পষ্ট করে বলা দেওয়া উচিত। ইলা মেয়েটা ছেলেটাকে প্রথমদিন দেখার পর থেকেই একটু একটু করে মনে জায়গা দিয়ে ফেলেছে।
ইলা মনের মধ্যে জমানো সব কথা গুছিয়ে ইনজামকে পাঠাল। চ্যাটগুলো দিয়েই হারিয়ে গেল সোস্যাল মিডিয়া থেকে। ইলা একদিন পর ভয়ে ভয়ে অনলাইনে আসল। দেখল ইনজাম সিন করেছে ঠিকই কিন্তু কোনো উত্তর দেয়নি। এ রকম কিন্তু কখনোই হয়নি। তার মানে ইনজাম ইলার এই প্রস্তাবে রাজি না...?
ইলা ভাবল ইনজামকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করবে কেন রিপস্নাই করল না। ভাবনামতো মোবাইল নিয়েছে হাতে, এ কী! ইনজামের আইডিটা কই? ইনজাম ইলাকে মেসেঞ্জার, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ সবখানেই বস্নক দিল।
ইলা এবার নম্বরে ডায়াল করে দেখল সেটাও বস্নক। ইনজাম যোগাযোগের কোনো উপায় রাখল না। ইলা অনেক কান্নাকাটি করল, স্বপ্নের চেনা পৃথিবীটাই বড্ড অচেনা লাগছে তার।
কিছুদিন পর ইলার বাসায় ফরহাদ আসবে তার চাকরির কাজে। কথাটা ইলা শুনল মায়ের কাছ থেকে। শুনেই ইলার মনে কেমন একটা অস্বস্তি কাজ করছে। ইনজাম ভাইকে বলে দিল কিনা এই ভয়ে তার ঘুমই আসছে না।
যেদিন আসবে সেদিন ইলা অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠে যায়। চিন্তায় ঘুম হয়নি সেটা আর মাকে বলেনি। বলল,
-কলেজ আছে তাই উঠলাম।
ইলা ফ্রেশ হতে গেল ঠিক তখনই ফরহাদ এসে পড়ল। ইলা সালাম দিয়ে রুমে ঢুকে গেল। ইলা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশে বের হলো।
ইলার কলেজ কাটছে ভালোই। ক্লাস শেষে কলেজের নিচে লোক থিয়েটারের কিছু অনুষ্ঠান দেখেই বের হয়ে গেল। মাঝ রাস্তায় হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি আসল। ইলা ছাতা নেইনি যার ফলে ভিজে ভিজে এল পুরো পথ। বৃষ্টির জলে ভিজে যখন ছাড়খাড় হচ্ছিল ইলার বারবার একটা কথা মাথায় ঘুরছিল যদি ইনজাম তাকে ভালোবাসত তবে কী আজ সে কাছে এসে ছাতা বাড়িয়ে দিত না? ইলার চোখের জল আর বৃষ্টির জল মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
শেষমেশ পথ ফুরাল।
ইলা কলিং বেল দিয়ে বাসায় এল। ফরহাদ বলে উঠল,
-ইলা, তোকে আনতে যাব ভেবেছিলাম। তুই চলে এসেছিস, এই রে এভাবে কাকভেজা হয়েছিস কেন! জ্বর এসে হাজির হলে সেই তো প্যারাসিটামলকে বুকে আগলে নিবি...!
-কী করব ভাইয়া? যে বৃষ্টি, গাড়িও পাইনি।
বিকালে ইলারা সবাই ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছে। ফরহাদ খালাকে বোঝাচ্ছে ইলার এবার বিয়ে দেওয়া উচিত। ইলা পাশ কাটিয়ে চলে গেল। সে নিজেকে রুম বন্দি করে বসে আছে।
কান্নারত অবস্থায় ইনজামের ছবি দেখে নিজে নিজে বলছে,
-আচ্ছা এত কঠিন কেন মনের মানুষকে পাওয়া? ইনজাম আমায় মেনে নিলে তো আজ এভাবে কষ্ট পেতে হতো না।
হঠাৎ দরজায় টোকার শব্দে ইলা তাড়াতাড়ি চোখ-মুখ মুছে নিল। দরজা খুলে দেখে ভাই হাজির।
-ইলা, ব্যাপারটা কী?
-মানে?
-পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন চোরের মতো? বিয়ের কথা বলতেই রাগ করে চলে আসলি! পছন্দের মানুষ আছে বুঝি? আমাকে শেয়ার কর।
ইলা বুঝছে না কী করবে, আর কী বলবে। ইনজামের কথাটা ভাইকে বলা দরকার। ইনজাম যদি কখনো বলে দেয়, ভাই তো ইলাকেই খারাপ ভাববে। আমতা আমতা করে ইলা সবকিছু খোলাখুলিভাবে বলল।
ফরহাদ বেশ গম্ভীর হয়ে শুনল সব। ইলা বলতে বলতে কান্না শুরু করে দিল।
-শোন ইলা, খালাম্মার পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে কর। খালু নেই, খালাও অসুস্থ জানিসই। তোর পছন্দের মানুষ তোর অনুভূতি বুঝল না। সে যদি বুঝত তোকে জবাব দিত। এভাবে যোগাযোগ বন্ধ করে তোকে কষ্ট দিত না। আমি আর কোনো উপায় দেখছি না।
ইলা চুপচাপ সব শুনে বসে থাকল। কান্না ছাড়া আর কী উপায় আছে- এই এক তরফা ভালোবাসাকে ভুলে যাওয়ার...!
ইলা নতুন শহরে আজ প্রথম একা একা ঘুরতে বের হয়েছে। পরনে আছে আকাশ নীল শাড়ি, হাতে চুড়ি, চুলে বেলিফুলের খোঁপা। গন্তব্যে এসেই ইলা রিকশা থামাল। ইলা ভাড়াটা দিয়ে হাঁটতে যাবে এমন সময় পা পিছলে একটা মানুষের গায়ে পড়ে গেল। ইলা লম্বা চুল সরিয়ে উঠে দেখল, যে তাকে ধরে বাঁচাল সে মানুষটা তার পুরনো শহরে ফেলা আসা একটি পুরনো মায়া!
-ইলা, তুমি এখানে?
-বাহ্! আপনি হঠাৎ আজ ধরা দিলেন আমার সামনে এসে। কী ব্যাপার বলুন তো?
-তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
-আমার তো কোনো কথা নেই আপনার সঙ্গে।
ইনজাম ইলার কথা না শুনে হাত ধরে ইলাকে ধানমন্ডি লেকের দিকে নিয়ে গেল। ইলা এতদিন পর ইনজামকে দেখে এমনিতেই কথা বলার অবস্থায় নেই। তাও চারপাশের মানুষ খারাপ ভাববে। তাই ইলা ইনজামের পাশে বসল।
-ইলা শোন, সেদিন থেকে তুমি অপেক্ষায় ছিলে অনেক; কোনো উত্তর না পেয়ে তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছ, সেটা আমি জানি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও।
-ক্ষমা আমি চাইছি, ভুলটা আমারই ছিল। আপনি চাইবেন না পিস্নজ।
-ইলা গত চার মাস ধরে তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছি। তোমার বাসার দিকে গিয়েছিলাম বাসাটা না কি ছেড়ে দিয়েছ। সোস্যাল মিডিয়ায় তোমার অ্যাকাউন্ট সব বন্ধ এমনকি তোমার নম্বরটাও! আমি যোগাযোগ করার উপায় খুঁজে না পেয়ে ফরহাদকে বললাম। সে বলল, 'তোমাকে ভুলে যেতে...!' কেন বলল, সেটাও বুঝলাম না।
-কেন খুঁজছেন আমায়?
-তোমার সেদিনের চ্যাটটা পড়ে আমার তোমার প্রতি একটা বিরক্তিমাখা অনুভূতি কাজ করছিল। আমরা যদিও বন্ধুর মতো ছিলাম। কিন্তু তোমার প্রতি তখন আমার আবেগ, ভালোবাসার মতো কোনো অনুভূতি জন্মায়নি। আমার মন পড়েছিল ক্যাম্পাসের সব থেকে সুন্দরী মেয়েটার ওপর। আমি তোমার সেদিনের সহজ সরল মনে বলা ভালোবাসার সুন্দর প্রকাশটুকু বুঝতে পারিনি।
-কৈফিয়ত চেয়েছি বুঝি?
-আমি যখন যোগাযোগ বন্ধ করি এরপর যতদিন যাচ্ছে তত আমি তোমাকে মিস করতে থাকি। আমি যাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়ে তোমার ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করলাম সেও আমাকে ঠকিয়ে চলে গেছে! এরপর বুঝলাম আমি সত্যিকারের মনের মানুষকেই চিনলাম না। যখন মনে তোমার জন্য ভালোবাসা জাগল তখন থেকেই পাগলের মতো তোমায় খুঁজেছি শহরের অলি-গলিতে। কিন্তু পেলাম না!
-শুনুন ইনজাম সাহেব- সময় একবার চলে গেলে আর সেটা ফেরত আসে না। আমি বাসলাম ভালো আপনাকে আর আপনি আমায় তার বদলে দূরত্ব উপহার দিলেন...! অদ্ভুত বিষয়, দূরত্ব মেপে আপনিই আমায় পথচলা শিখিয়েছেন।
-ইলা আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি তো ফিরে এসেছি। আমায় এখন মেনে নিতে অসুবিধা কই?
-দেখুন ইনজাম সাহেব, আমি যখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম তখন ফরহাদ ভাই আমার জন্য পাত্র দেখা শুরু করে। মায়ের পছন্দে আমি বিয়ে করে নিয়েছি।
শুনুন, জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না।
সেদিন আপনি আমার ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, আমি দূরত্ব পেয়ে নিজের গন্তব্য পাল্টিয়েছি। আপনি দূরত্ব বুঝিয়েছেন, আমিও সেই দূরত্ব বুঝে আজ সংসারি হয়েছি। 'অপেক্ষা' কেন করলাম না সেটিও বলি...। অনুভূতির মূল্য দিতে জানেন না বলেই আমি সেটি করিনি। নারীর মন বুঝে চলার সুন্দর মন আমার স্বামীর আছে। কাজেই ওপরওয়ালা আমাকে অনেক ভালো রেখেছেন।
-ইলা আমি আমার ভুল সিদ্ধান্তের জন্য তোমায় হারিয়ে ফেললাম...!
ইলা আর কথা বাড়ায়নি। ইনজামের পাশ থেকে উঠে হাঁটা শুরু করল।
ইনজাম তাকিয়ে রইল ইলার দিকে। ইনজামের দু'চোখে কান্নার বিশাল সাগর জমেছে, চোখের জলে তার সবকিছু ঝাপসা লাগছে। বিপরীত পথ ধরে হাঁটা শুরু করে সে বলছে,
-'চল আজ দূরত্ব মাপি। আমি যতটা দূরত্ব তোমায় উপহার দিলাম- তুমি তার চেয়ে দ্বিগুণ দূরত্ব আজ আমায় দিলে...!'