রোববার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১
জন্মদিনের শুভেচ্ছা

বহুমাত্রিক চেতনার কবি শাহীন রেজা

ড. সাঈদ হাফিজ
  ০৭ জুন ২০২৪, ০০:০০
বহুমাত্রিক চেতনার কবি শাহীন রেজা

কবির আকাশ কখনো মেঘময়, কখনো রোদ্দুরে ঠাসা। একজন কবিকে রোদ বৃষ্টির এই খেলা মাথায় নিয়েই এগুতে হয়। যে কবি কবিতার এই জোয়ারভাটাকে অতিক্রম করে এগুতে পারেন প্রকৃত অর্থে তিনিই কবি হিসেবে টিকে যান। বাকিরা বিলীন হয়ে যান কালের গর্ভে। শাহীন রেজা বরিশালের সন্তান। পলিমাটির আস্তরণ তার হৃদয়ে প্রতিনিয়ত যে নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত তৈরি করে তাতেই তিনি রোপণ করেন শব্দবীজ। সত্যি কথা বলতে কি- এক একটি সেই শব্দবীজ অংকুরিত হয়ে যখন পরিণত হয় শব্দমহীবৃক্ষে তখনই তার আত্মা প্রসারিত হয় এবং সেখান থেকে ধ্বনিত হয় স্বার্থকতা।

আমি দেশি বা বিদেশি কোনো কবির উদ্ধৃতি দিয়ে শাহীনকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইব না। একজন কবি যখন সমকালকে অতিক্রম করে এগিয়ে যান তখন তাকে নিয়ে বিশদ আলোচনার অবকাশ তৈরি হয়ে যায়। আমি ক্ষুদ্র এই লেখাতে কবি শাহীন রেজাকে ধারণ করার সাহস দেখাতে চাই না। শাহীন আমার অনুজপ্রতিম। তার কবিতার বাঁক বদলকে আমি নিরীক্ষা করেছি অগ্রজের নয়, একজন পাঠক সমালোচকের দৃষ্টি দিয়ে।

এত জানা কথা যে, প্রকৃতি ও প্রেমের কবি জীবনানন্দ প্রকৃত অর্থে আবিষ্কৃত হয়েছিলেন তার মৃতু্যর তিরিশ বছর পর। একজন কবিকে উচ্চারিত হতে দীর্ঘসময় লাগে। রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুলের কথা আলাদা। তারা জীবদ্দশাতে লেখনীর মাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন, শতবর্ষ পরেও তা সচল এবং অমলিন থেকে তাদের মহিমাকীর্তন করে যাচ্ছে। কবিতায় শাহীন রেজার শুরুটা মোটামুটি হলেও মাঝখানের বিরতি তাকে নিয়ে যায় ব্যাকফুটে। তবে আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি, তিনি সেই শূন্যতাকে অতিক্রম করে ধীরে ধীরে উঠে এসে কবিতায় একটি স্থায়ী আসন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। একজন কবি হিসেবে তার এই অর্জনকে আমি সাধুবাদ জানাই।

শাহীন রেজা সমসাময়িক কবিদের মধ্যে এখন একটি উচ্চারিত নাম। একে আমি তার সাফল্য হিসেবেই শনাক্ত করতে চাই। শাহীনের কবিতায় চর্চা আছে, অভিনিবেশ আছে কিন্তু তার চেয়েও বেশি যেটা আছে তা হচ্ছে স্বচ্ছ সরল একটি গতিময়তা। কারো ভেতরে কবিতা না থাকলে অনর্গল কবিতার এই ধারাটি জন্মলাভ করে না।

শাহীনকে প্রথমে আমি চিনি তার কবিতা দিয়ে। দৈনিক জনকণ্ঠের যৌবনে শাহীন রেজা'র একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল এর সাহিত্য পাতায়। পাতাটি সম্পাদনা করতেন সত্তরের শক্তিমান কবি নাসির আহমেদ। প্রেম বিষয়ক সে কবিতাটি আমাকে চমকিত করেছিল। আমার মনে আছে, সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি ঘরে বসে অলস সে বৃষ্টিপাতে মন মেলে দিয়ে কবিতায় ডুব সাঁতার কাটছিলাম। সেদিন হাতে আসা চারটি কাগজের সাহিত্য পাতার মধ্যে শাহীনের কবিতাটি আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। আমি বারবার সেটি পাঠ করছিলাম এবং এক ধরনের মুগ্ধতায় নিমজ্জিত হচ্ছিলাম। সেই থেকে শাহীন আমার প্রিয় কবির তালিকায়। এরপর কেটে গেছে বহু বহু বছর। পত্রপত্রিকায় তার কবিতা পড়েছি। বইমেলা থেকে কিনে নিয়েছি তার বইও। আজ শাহীন পরিণত জীবনের বাসিন্দা। তার কবিতাও তারই মতো পরিণত, ঋদ্ধ এবং স্বতঃস্ফূর্ত।

শাহীনের ৪৫তম জন্মদিনের আয়োজনে আমার উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত সে আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন সেই সময়ে কবিতাকে শাসন করা দিকপালেরা। ছিলেন আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীনের মতো কবি প্রতিভারা। সে আয়োজনে অন্যান্যের সঙ্গে ছিলেন শামসুল ইসলামও। অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি হাজির হয়েছিলেন সেই আয়োজনে। এর কয়েকদিন পরেই কবি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তিনি বলেছিলেন, কবিতার জীবন বহুকষ্টের জীবন। এই জীবনটা একটা ইবাদতের মধ্য দিয়ে পার করতে হয়। তার সেই বক্তব্য এখনো কানে বাজে। সেদিনই আল মাহমুদ প্রকাশ্যে শাহীন রেজাকে কবি বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আজ আমি ঘোষণা করছি শাহীন রেজা একজন কবি। আমার মতো দৃষ্টিহীন মানুষকেও যার কবিতা স্পর্শ করে যায় তাকে কবি না বলে উপায় কি? শাহীন একদিন এই কবিতারাজ্যকে শাসন করবে এ আমার বিশ্বাস। আমি তাকে আশীর্বাদ করছি। আল মাহমুদের আশীর্বাদকে ধারণ করে শাহীন এগিয়ে চলেছেন। শাহীনের পথচলা রণভেরী বাজিয়ে নয়। তিনি এগিয়ে চলছেন ধীরে ধীরে কিন্তু সে পদক্ষেপ দৃঢ় এবং দৃপ্ত।

শাহীনের সাফল্য বাংলাদেশকে অতিক্রম করে এখন কলকাতাতেও স্থিত। তার কবিতা সেখানেও আলোচিত, সমাদৃত।

শাহীনকে তারুণ্যের কবি বললে তিনি সুখী হন কিন্তু আমি শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই না। আমি বলতে চাই, শাহীন যৌবনের কবি। প্রেমের কবি। সাম্যের কবি। দ্রোহের কবি। বহুমাত্রিক চেতনায় বিকশিত শাহীনকে আমি সমকালের অপার সম্ভাবনার কবি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই।

আমার বিশ্বাস শাহীন একদিন ঘরে ঘরে উচ্চারিত হবেন এবং সে দিনটি খুব একটা দূরে নয়। অবশেষে শাহীনেরই একটি সাম্প্রতিক কবিতা দিয়ে আমি এই লেখাটি শেষ করতে চাই -

তুমি আমি সে এবং তাহারা

বস্তুত নদী বলে কিছু নেই

ধলেশ্বরী মেঘনা গোমতী কিংবা যমুনা

সবই তো প্রবাহিত জল; জলের ধারা-

আবার যদি ধরো

পারুল রেহানা শ্যামা কিংবা জয়ীতা

সবাই তো রাধা ; রক্ত মাংসে আঁকা

তীব্র মোনালিসা-

নদী এবং নারীর সাথে জোছনার

যে তীব্র খুনসুটি

তারই আলে হেঁটে যায় রাত

চন্দ্রাবতী ছলে

বস্তুত কেউই কিছু নয়-

তুমি আমি সে এবং তাহারা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে