দেয়াল

প্রকাশ | ৩১ মে ২০২৪, ০০:০০

অরূপ রতন
ভরা মজলিশের মধ্যে আজিজ মাস্টার যখনই বলে উঠলেন, 'ভালোবাস্যা গুয়ামারী কাঁদো কঁ্যা?' তখনই ছেলে-ছোঁকড়ার দল এক সাথে হো হো করে হেসে উঠল। উলস্নসিত ছেলেরা কথাটির অর্থ অনুধাবন করতে পেরেছে কি না তা তাদের বাচনভঙ্গি দেখে বোঝা গেল না। কিন্তু মকসেদ চেয়ারম্যান কথাটি শোনার পর থেকেই 'থ' হয়ে বসে আছে। কোনো সাড়া-শব্দ তার মুখ থেকে বের হচ্ছে না। সে মজির মেম্বারের মুখের দিকে তাকালেন। মজির মেম্বার ভরা মজলিশে আচমকা দাঁড়িয়ে পড়লেন। উপস্থিত সবাই তো অবাক। মেম্বারের এমনভাবে দাঁড়িয়ে পড়ার অর্থ সবাই মোটামুটি জানে। সে নিশ্চয় কোনো ফাঁদ পাতার চেষ্টা করছে। আজিজ মাস্টারের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, 'আজিজ তুমি আসলে কী কোতে চাচ্ছ? একটু খোলাসা করো। আর এই ভরা মজলিশে তুমি কী সব ভাষা কতিছ্যাও। মাথাটাথা কী ঠিক আছে তুমার?' 'আমার মাথা নিয়্যা তুমাক টেনশান করা লাগবিন্যা মেম্বার। আমার মাথা ঠিকি আছে।' 'আচ্ছা বুঝল্যাম, তুমার মাথা ঠিক আছে। এখন কতা হচ্ছে যে, চেয়ারম্যান জিডা বলিসে সিডা কী মানতিছ্যাও?' 'সিডা মানতি পারলিতো মুখের ভাষাডা খারাপ করতি হতো না। মানতি পারতিছিন্যা বলেই তো এতো কতা।' 'তালি ভাই আমি স্যারেন্ডার। তুমার বিচার তুমিই করো গা।' 'তুমিতো সিডা কবেই। তুমরা বিচারও মাইনব্যা আবার বলব্যা তাল গাছডা আমার। তালি আমি সিডা মানবো কঁ্যা।' 'শোনো মাস্টার, চেয়ারম্যান কিন্তুক খারাপ কিছু কয় নাই। তার কথাডা মানলি তুমার সুবিধাই হবি।' 'মেম্বার, আমার সুবিধা কুনটি সিডাতো আমি জানি।' মজির মেম্বার আর কোনো কথা বলল না। সে বুঝেছে, আজিজ মাস্টারকে সহজে হাত করা যাবে না। এখানে অন্য কায়দায় কাজ হাসিল করতে হবে। সে চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে বলল, 'চেয়ারম্যান সাব এখন আমি কী করতি পারি কন?' এইভাবে গো র্ধযা থাকলি তো ফায়দা আসবিন্যা।' চেয়ারম্যান হঠাৎ ভরা মজলিশে দাঁড়িয়ে বলল, 'মাস্টার দেয়ালডা যখন অর্ধেক উঠ্যাই গেছে সিডাত তুমি আর বাধা দিও না। প্রথমেই যদিল তুমি আপত্তি তুলত্যা সিডা না হয় বিবেচনা করা যেত। এখন এতোগুলান ট্যাকা খরচ হওয়ার পর তুমি যদিল বাগরা দ্যাও সিডা কী মানা যাবি কও?' 'দেয়াল তোলার সময় আপনি কী আমাক জানায়্যা তুলিছিল্যান? কখন দেয়াল তুলিছ্যান আমি জানিই ন্যা।' 'তুমি তো বাড়িত ছিল্যা না মাস্টার।' 'সেই সুযোগডাইতো আপনি লিছ্যান।' 'মাস্টার এই ভরা মজলিশে তুমি কিন্তু আমাক অপমান করতিছ্যাও! 'আপনেক অপমান করার মতো কোন কতা আমি কইন্যাই। আমার খালি একটাই কতা, আমার হাঁটা চলার রাস্তা আটকায়্যা আপনি দেয়ালডা তুলিছ্যান কঁ্যা? আপনি দেয়াল তুলেবেন আপনের জমিত তোলেন, সিডা আপনি না র্কযা গোটা দেয়াল আমার জমিত গাঁথা শুরু করছেন।' 'শুনো মাস্টার, তুমিই কিন্তু বিষয়ডাক জটিল বানাইল্যা। আমরা যদি নিজেরা নিজেরা ঠিক থাইকত্যাম তালি কিন্তু এই মজলিশ ডাকা লাকতো না। তোমাক আমি বার বারই কতিছি মিস্ত্রিরির ভুলে আকামডা হয়্যা গ্যাছে। এখন যদি তুমি গোঁয়াগের মতো কও দেয়াল ভাঙা লাগবি, সিডা কী তুমার বিবেক, কও!' আজিজ মাস্টার এ কথার কোনো জবাব দিল না। সে জানে চেয়ারম্যান অত্যধিক ধুরন্ধর মানুষ। তাকে অন্য কায়দায় বশ করার চেষ্টা করবে। কিন্তু সে অনড়। মাস্টারের নীরবতা দেখে মজলিশে উপস্থিত জনতার কেউ কেউ বলল, 'মাস্টার, চুপ র্কযা থাকলি কী হবিনি। আমরাতো এই জায়গায় সারারাত কাটাতি আসিনি।' পাশ থেকে আর একজন বলল, 'চেয়ারম্যান সাব আর আজিজ মাস্টার যেভাবে গো র্ধযা বসিছে তাতে আজ কোনো সমাধানে আসা যাবি তা মনে হতিছে না।' মজির মেম্বার এবার রাগতভাবে বলল, 'কী হলো মাস্টার, একটু ঝেরে কাশো। মুখে একেবারে কুলুপ আট্যা রাখলি কী সমস্যার সমাধান করা যাবি?' রাত অনেক হয়ে গেছে। মজলিশ ছেড়ে অনেকেই নিজ নিজ বাড়ির দিকে রওনা হতে শুরু করল। দু-চারজন কেবল মাথা মুরুব্বি তখনো বসেছিল। তবে তারাও যে বিরক্ত তা অনুমান করা যাচ্ছে। মজির মেম্বার এবার গর্জন করে বলল, 'বুইঝল্যাম মাস্টারের অনেক জোর হইছে। কাইল শহর থেক্যা পৌরসভার আমিন ডাকা হবি। দেখি কার জমিত চেয়ারম্যান দেয়াল তুলিছে।' কথাটি বলেই সে উপস্থিত জনতার সামনে চেয়ারম্যানের দিকে চোখ ঘুরিয়ে বলল, 'চলেন চেয়ারম্যান সাব।' চেয়ারম্যান উঠে দাঁড়াতেই সিন্ধান্তাবহীনভাবে মজলিশ ভেঙে গেল। বাইতুন-নূর জামে মসজিদের পাশেই রাজুর চা স্টল। আজিজ মাস্টার চুপচাপ স্টলের এক কোণে বেঞ্চিতে বসে আছে। গতকাল রাতের সালিশে যে কোনো সুরাহা হয়নি তাতে সে বিচলিত নয়। লোকমান ব্যাপারী হাটের দিকে যাচ্ছিল। আজিজ মাস্টারকে দেখে তার আর তর সইল না। সামনে এগিয়ে এসে মাস্টারকে উদ্দেশ করে বলল, 'কী মাস্টার, চেয়ারম্যানের তো কিছুই করতি পাইরল্যা না। খামোখা এতো লোক জড়ো করার কোনো মানে হইল।' আজিজ মাস্টার ঘাড় ঘুরিয়ে লোকমান ব্যাপারীর দিকে তাকিয়ে বলল, 'দুঃখে আমি শালুক তুলি, আলস্নায় কয় আমাক পাছা দ্যাখাচ্ছে।' 'মানে?' লোকমান ব্যাপারী হতভম্ব! সে স্টলের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে বলল, 'তুমি মিয়্যা পঁ্যাচাইতেও পার। এতো রহস্য করা লাগবি কঁ্যা? কী হইছে বুঝায়্যা কও।' 'কী আর কবো লোকমান, তুমারে ভরসাত সালিশ ডাইকল্যাম তুমরাই তো পিছু হইটল্যা।' 'আমরা অবার কখন পিছু হইটল্যাম। সালিশ শ্যাষ না হওয়া পর্যন্ততো মজলিশেই ছিল্যাম।' 'তা আর থাক্যা কী লাভডাই হলো। আমার পক্ষেত কোনো কথা কছিল্যা?' 'কী কবো মাস্টার, ওই চেয়ারম্যানের বিপক্ষে কী কিছু কওয়া যাবি কও?' 'তুমরা যা-ই কও, ওই দেয়ালডা আমি ভাঙাবই।' 'সিডা করতি পারলিতো একটা শক্ত জবাব দেওয়া হবিনি।' লোকমান বলল। 'তাক মনে রাখা লাগবি, এই গ্রামবাসীই তাক ভোট দিয়্যা চেয়ারম্যান বানাছে। এখন সে এই গ্রামবাসীকই মানতিছে না।' আজিজ মাস্টার বলল। 'সিডা আমরা মানবো কঁ্যা?' 'না, মানবো নাতো। একটা বিহিততো হওয়াই লাগবি।' 'আচ্ছা, থাকো মাস্টার। গরমের দিন। বেলা উঠলি আর হাঁটা যাবি ন্যা। সকাল সকাল হাটের দিকে রওনা হই।' আজিজ মাস্টার কোনো জবাব দিল না। সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই রাজু চা'য়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল, 'কী মাস্টার, কুনটি যাও? এই নাও, চা খাও।' 'চা আবার দিচ্ছ্যাও কিসের জন্যি। আমিকি তুমাক চা দিতে বলিছি? তাছাড়া আমার কাছে ট্যাকা নাই।' 'আরে ট্যাকা লাগবি ন্যা। লোকমান ব্যাপারী তুমার নামে চা'য়ের অর্ডার দিয়্যা গেছে।' রাজু আশ্বস্ত করল। 'ব্যাপারী আবার আমাক চা খাওয়াতি যাবি কঁ্যা? আর অর্ডার দিয়্যা গেলি আমাক কয়্যা যাবি ন্যা?' 'আরে মাস্টার বুঝ না, ও থাকে দৌড়ের ওপর। তুমাক এক কাপ চা খাওয়াতি ইচ্ছ্যা হইছে তাই মনে হয় অর্ডার দিছে। তুমাক এতো ভাবা লাগবি ক্যা। চা'ডা খাও তো। আসলে কী জানো মাস্টার, গ্রামের সবাই কিন্তু তুমাক ভালোই বাসে।' আজিজ মাস্টার আর কোনো কথা বলল না। রাজু'র হাত থেকে চা ভর্তি কাপ নিয়ে কয়েক চুমুকেই তা শেষ করে খালি কাপ টেবিলের ওপর রেখে স্টল থেকে বেড়িয়ে এলো। পথে আর কারও সাথে তার দেখাও হয় না কথাও হয় না। সে জানে গ্রামের সবাই তার পক্ষেই আছে। কিন্তু এই সাধারণ মানুষগুলো সব সময় একটা চাপা আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করছে। তারা চেয়ারম্যানকে মন থেকে ঠিক মানতে পারে না। তাই চেয়ারম্যানের কোনো কাজে তারা মন থেকে সাপোর্টও করে না। অথচ তারাই চেয়ারম্যানকে ভোট দিয়ে তার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আজিজ মাস্টার স্রোতে গা ভাসায়নি। সে চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্য দিবালোকেই বলেছিল তাকে সে ভোট দেবে না। মূলত চেয়ারম্যানের সাথে আজিজ মাস্টারের দ্বন্দ্ব এখান থেকেই শুরু। যদিও আজিজ মাস্টারের এই কঠিন সত্যটি চেয়ারম্যানের সামনে স্পষ্ট করা উচিত হয়নি। কিন্তু মিথ্যে বলা আজিজ মাস্টারের ধাতে নেই। যেহেতু সে চেয়ারম্যানকে ভোট দেবে না তাই স্বাভাবিক এবং সরল মনেই সে কথাটি বলেছিল। আজিজ মাস্টার সরল মনে বললেও চেয়ারম্যান ব্যাপারটিকে সরলভাবে নেয়নি। আজিজ মাস্টারের কথায় সে খুব অপমানবোধ করেছিল। হাজার লোকের সামনে আজিজ মাস্টারের এমন নেতিবাচক বাক্য উচ্চারণ যে কোনো মানুষের জন্যই অপমানের। রাতে আজিজ মাস্টার বাড়িতেই ছিল। বউ-ছাওয়াল নেই। একা মানুষ। রাত্রে তেমন ঘুম হয় না। তবে অনেকদিন পর আজ তার ভালো ঘুম হয়েছে। আজিজ মাস্টারের একটাই চিন্তা, 'পৃথিবীতে মানুষ খুব সামান্য আয়ু নিয়ে আসে। আর এই অল্প সময়ে প্রাপ্ত আয়ুর বেশির ভাগ যদি ঘুমিয়ে কাটাই তবে পৃথিবীর অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হতে হয়।' দু'চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসামাত্রই মানুষ আর মানুষ থাকে না, হয়ে যায় লাশ। একজন ঘুমন্ত মানুষ আর একটা লাশের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পায় না আজিজ মাস্টার। অনেকদিন পর ভালো ঘুম হওয়ায় বেশ ফ্রেশ দেখাচ্ছে তাকে। ঘাড়ে গামছা নিয়ে মুখে দাঁতন ঘঁষতে ঘঁষতে সদর দরজা দিয়ে বের হতেই ব্যাপারটি চোখে পড়ে আজিজ মাস্টারের। সে তো একেবারে হতভম্ব। এও সম্ভব। পৃথিবীতে মানুষ কী এতটাই বিবেকহীন। আজিজ মাস্টার আর কিছু ভাবতে পারে না। এতে অবশ্য তারও কিছু ভুল হয়েছে। এত উদাসীন হওয়া তার ঠিক হয়নি। একটু সতর্ক থাকলে এ কান্ডটি হয়তো ঘটত না। সে বিরস মুখে দাঁতন ঘঁষতে ঘঁষতে পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়াল। ঘাড়ে গামছা। গায়ে মুরব্বি গোছের হাতাওয়ালা সাদা গেঞ্জি। মুখে পনেরো দিনের না কাটা কাঁচাপাকা দাড়ি। পা যেন স্থির হয়ে আছে। নড়তে চাইছে না কোথাও। হঠাৎ কোনো একটা শব্দ কানে যেতেই পেছন দিকে তাকাল সে। মজির মেম্বার বেশ উঁচু গলায় বলল, 'কী মাস্টার, এতো সকাল সকাল ডুপ দিব্যার আইছো? ব্যাপারখান কী? তুমার মিয়্যা যৈবন বল্যা কিছু আছে? কোলবালিশ সাথে লিয়্যাই জীবনডা কাটাই দিল্যা। তা কার সাথে আকাম র্কযা ফরজ গুছুল দিব্যার আইছো?' আজিজ মাস্টার খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এতো সকালে এই পুকুর ঘাটে সে মজির মেম্বারকে দেখতে পাবে আশা করেনি। সে এবার মজির মেম্বারের দিকে তাকিয়ে তার চোখে চোখ রেখে গল্প বলার মতো করে বলল, 'শোনো মেম্বার, রাতে শুয়্যা স্বপনে দেখি আকাশ ফুটা হয়্যা গেছে, আর সকালে ঘুম থেক্যা উঠ্যা দেখি আমার পাছাত আঙ্গুল ঢুক্যা আছে।' কী কও মাস্টার? তোমার রহস্যের সংলাপতো বুঝিন্যা।' 'আমার কথা তুমি বুঝ না, তাইন্যা মেম্বার? 'হ, মাস্টার, কিছুইতো বুঝিন্যা। একটু খোলাসা করত।' 'তুমরা রাতের অন্ধকারে চোরের মতো চেয়ারম্যানের দেয়ালডা তুল্যা দিল্যা।' মজির মেম্বার আঁতকে ওঠার ভঙ্গিতে বলল, 'কী কও মাস্টার? ও দেয়াল চেয়ারম্যান রাতে তুলবিক্যা। উডাতো দিনের বেলাতি তুলিছে। আর তোমার সাথেতো মীমাংসা র্কযাই লিছে।' 'মেম্বার, আমিতো জানি, তুমরা হল্যা এক ঘাটের মাঝি। তুমরা কী আর চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যাতি পার।' মজির মেম্বার একটু প্রগলভ হয়ে বলল, 'এই জন্যই তুমি মাস্টার। তাইতো বলি ইশকুল, কলেজে না পড়ায়্যা মানুষ মাস্টার হয় কীভাবে! তুমি খুব সহজেই ধরতি পারিছো মাস্টার।' মজির মেম্বার আর দাঁড়িয়ে থাকল না। সে আজিজ মাস্টারের দিকে তাচ্ছিল্যের হাসি ছুড়ে দিয়ে সামনে পা বাড়াল। আজিজ মাস্টারের মেজাজ চরমে পৌঁছে গেল। একেতো জমি দখল তার ওপর এসব চামচাদের তাচ্ছিল্যের হাসি আর সহ্য করা যায় না। এর একটা বিহিত করা দরকার। সে আর পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে রইল না। মুখ ধৌতও করল না। রাগে তার শরীর কাঁপছে। এমনিতেই হাড় জিড়জিড়ে মানুষ। রাগলে তার শরীর বেয়ে অসম্ভব ঘাম ঝরে। ভাদ্রের এই সকালে রাগে ও অভিমানে তার শরীর যেমন কাঁপছে একইভাবে ঘামছে। সে হাতে ধরে রাখা দাঁতন ছুড়ে মারল মাঝ পুকুর বরাবর। খিস্তি করতে করতে উচ্চারণ করল, 'শালার চেয়ারম্যান তুমাক আমি ছাড়ব না।' এবার আর চেয়ারম্যানের উঠানে বসেনি অজিজ মাস্টার। আশরাফ খাঁনের বাড়ির সামনে বেশ খানিকটা শান বাঁধানো ফাঁকা জায়গা আছে। গ্রাম প্রধান সাকিদারকে দিয়ে গ্রামবাসীকে আশরাফ খাঁনের ওই শান বাঁধানো ফাঁকা জায়গায় হাজির করেছে। অজিজ মাস্টার একাকী অপরাধীর মতো বসে আছে। তাকে ঘিরে হাজার জনতা। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মনে হচ্ছে এক বিরল প্রজাতির প্রাণী চিড়িয়াখানা থেকে ছুটে এসে কোনো এক জঙ্গলের গর্তে পড়ে আটকে গেছে। আজিজ মাস্টার চোখ তুলে তাকালে গ্রাম প্রধান সিদ্দিক মিঞা তার চোখে চোখ রেখে বলল, 'তালি তুমি কতিছ্যাও চেয়ারম্যান ভুয়া দলিলপত্র দাখিল করিছে, তাইন্যা আজিজ?' 'তাতো করিছেই। ওইসব দলিল ভুয়া।' আজিজ মাস্টার চিৎকার করে বলল। 'দলিলে যে সই করা আছে তালি সিডাও মিথ্যা? তুমি দলিলে সই কর নাই?' 'আমিতো কইল্যামই, সই আমি করিন্যাই। ওইড্যা আমার সই ন্যা।' 'তালি তুমার সই এই দলিলে আইসলো ক্যাবা র্কযা, কও?' 'সিডার আমি কী জানি। দলিলে আমি সই করিন্যাই, ইডাই সত্যি।' 'তালি মনে হয় তুমার সইড্যা আমিই র্কযা দিছি আজিজ।' বেশ রাগত স্বরে বলল সিদ্দিক মিঞা। আজিজ মাস্টার বুঝতে পারছে সে এবার সত্যিই গঁ্যাড়াকলে পড়ে গেছে। দেয়াল তুলতে বাধা দেওয়ায় চেয়ারম্যান এইভাবে তার বদলা নিল। একেবারে ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ! এর ভেতরের নিগৃঢ় সত্য কাহিনি সবাই জানে। অথচ গ্রামবাসী নিশ্চুপ। যেন সবাই দর্শক সারিতে দাঁড়িয়ে বিশাল রঙ্গমঞ্চে মঞ্চস্থ হওয়া নাটকে একজন পরাজিত সৈনিকের ট্র্যাজেডি দেখে আপস্নুত। তার অসহায়ত্ত দেখার কেউ নেই। গ্রামবাসীদের দু-একজন মাস্টারের পক্ষ নিলেও চেয়ারম্যানের চোখ রাঙানিতে তারাও স্তব্ধ হয়ে গেল। তাছাড়া দলিলে যেখানে মাস্টারের সই স্পষ্ট অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে সেখানে তারাও বা আর কী যুক্তি উপস্থাপন করতে পারে। চেয়ারম্যান এবার মজলিশের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল, 'আপনেরাই গ্রামের মাথা-মুরব্বি। দলিলডা হাতে নিয়্যা দ্যাখেন। দেখ্যা কন, এই সইডা কার। যদিল আপনেরা কন এই সই মাস্টারের না তালি আমার আর কিছু কওয়ার থাববিন্যা। ওই ভিট্যা আমি ছাড়্যা দেব।' সিদ্দিক মিঞার চ্যালা আব্দুল মালেক দলিলখানা পর্যবেক্ষণ করল এবং মতামত দিল এই সই আজিজ মাস্টারেরই। উপস্থিত মুরব্বিদের সবাই আব্দুল মালেকের দিকেই রায় দিল। অতএব সালিশ শেষে শেষ হাসি হাসলো চেয়ারম্যান। আজিজ মাস্টারের বাস্তুভিটার নতুন মালিক যে চেয়ারম্যান এই মজলিশ সেটাও প্রতিষ্ঠিত করে দিল। সালিশ এখানেই শেষ হলো। আজিজ মাস্টারের আর কিছু করার থাকলো না। সে অশ্রম্নসিক্ত নয়নে উঠে দাঁড়াতেই মজির মেম্বার তাকে উদ্দেশ করে বলল, 'দেখল্যা মাস্টার, চেয়ারম্যানের খুঁটির জোর। সে কী পারে আর কী পারে না। তুমিতো মিয়া আমও হারাইল্যা ছালাডাও হারাইল্যা।' সকালে ছেলে-ছোঁকড়ার দল রাজুর চা'য়ের স্টলে বসে হাসি-তামাশার সুরে ছড়া কাটতে লাগল, 'ঠক ঠক বার ঠক আঠারো ঠকের খেলা, সিদ্দিক মিঞা পরামাণিক মালেক তার চ্যালা।' মাস্টার এখন কী আর করতে পারে। সবকিছু হারিয়ে সে এখন নিঃস্ব। মানুষ কতটা স্বার্থপর হলে অন্য একজন মানুষকে এভাবে সর্বস্বান্ত করতে পারে। আজিজ মাস্টার ভেবে পায় না তার সাথে চেয়ারম্যানের বিরোধ কোথায়। সেতো আর চেয়ারম্যানের পাকা ধানে মই দিতে যায়নি। শুধু বলেছিল সে চেয়ারম্যানকে ভোট দেবে না। মাস্টার মিথ্যে বলতে পারে না। সে করণেই এই নির্মম সত্যটি উচ্চারণ করতে হয়েছিল তাকে। তাই বলে চেয়ারম্যান এত বড় প্রতিশোধ নেবে। একেবারে বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ! তাছাড়া সে ভোট না দিলেও এলাকার সবাই তাকে ভোট দিয়ে চেয়ারম্যান বানিয়েছে। একটা সত্য উচ্চারণ তাকে একেবারে শেষ করে দিল। মধ্যরাতে হঠাৎ আগুন আগুন বলে চিৎকার করে গ্রামবাসী ছুটতে শুরু করল। ফায়ার সার্ভিস অফিসে ফোন করা হয়েছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তারাও চলে আসবে। মাস্টার বাড়িতে একাই থাকতো। গত বছরে আশ্বিনের এক দুপুরে হঠাৎ মুখে রক্তবমি ওঠে তার স্ত্রী'র মৃতু্য হয়। দু'টি মেয়ে তার। দু'জনেরই বিয়ে হয়েছে ফরিদপুরের ভাঙ্গায়। ফরিদপুরেই ছিল তার নিবাস। দর্জি হিসেবে তার বেশ সুনাম ছিল। তাই তার নাম থেকে মাস্টার শব্দটি আজো ঘোচেনি। তার বাড়িটি ছিল কাঁচা-পাকায় দাঁড়ানো। ওপরে টিনের ছাউনি। আর প্রাচীর হিসেবে ছিল বাড়ির চারদিকে সোলার বেড়া। আগুনটা তাই দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়েছে। দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা এ আগুন যেন সবকিছু নিজের দখলে নিতে মরিয়া। গ্রামবাসী ভিড় জমিয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এখনো এসে পৌঁছেনি। যে যেভাবে পারছে কলসি-বালতি ভরে পানি নিয়ে ছুটে আসছে। চোখের পলকে যেন সারাবাড়ি অগ্নিকুন্ডে পরিণত হলো। জ্বলন্ত ঘরের ভেতর থেকে মানুষের আর্তনাদ ভেসে আসতেই সবাই সজাগ হলো। কিন্তু দরজায় বাহির থেকে শেকল আঁটা। শেকল খুলে ভেতরে ঢুকতেই তারা আবিষ্কার করল মাংসের টুকরোর মতো ঝলসে যাওয়া দুটি লাশ। মুখের আদল স্পষ্ট নয়। তবে বোঝা যাচ্ছে, একটি লাশ চেয়ারম্যানের অন্যটি এ গ্রামের সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে দেহ ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া ঝুমু রানীর। এবার সবাই উপলব্ধি করল, চেয়ারম্যান মাস্টারকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে এখানে জলসা ঘর। বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু বিধাতার লীলাখেলা বোঝা মুশকিল। সবাই ধারণা করছে, রাতের আঁধারে মাস্টারই হয়তো প্রতিশোধ নিতে আগুন দিয়েছে নিজের ঘরে।