শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

কবি ইকবাল আজিজ স্মরণে

রাকিবুল রকি
  ৩১ মে ২০২৪, ০০:০০
কবি ইকবাল আজিজ স্মরণে

মানুষ মরে গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়! কবিরা মরে গেলেও কি তারা হয়ে যায়? নাকি ফুল হয়ে ফোটে? কবির কি মৃতু্য আছে? না, নেই। তাই মৃতু্যর পরেও বারবার কবি ব্যথার মধ্যে ফুল হয়ে ফোটেন, ব্যথার মধ্যেই ঝরে যান। পাঠকের মনে ফুল হয়ে ফুটবেন বলেই হয়তো নীরবে, নিভৃতে চলে গেলেন পানশালার সবুজ ফেরেশতা। কবি ইকবাল আজিজ। সত্তরের জাতক কবি ইকবাল আজিজ জন্মেছিলেন নাটোরে মাতুলালয়ে। পৈতৃক নিবাস কুষ্টিয়ায়। শৈশবের প্রথম তিন বছর রাজধানীতে কাটিয়ে গেলেও শৈশব-কৈশোরের পুরোটাই কাটিয়েছেন নাটোর, ময়মনসিংহ ও কুষ্টিয়ায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স; রাষ্ট্রবিজ্ঞানে।

কবিতাই ছিল ধ্যান-জ্ঞান। তাই তো রাষ্ট্রের কলকাঠির চেয়ে কবিতার কুহুতান তাকে ডেকেছিল, মজিয়েছিল।

সত্তরের জাতক হলেও মূলত পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ের থেকেই কবিতার সঙ্গে বেঁধেছিলেন আজীবনের ঘরগেরাস্থালি। শব্দকে ভালোবেসেছিলেন বলেই গদ্যে নির্মাণ করেছিলেন কিছু ঘর। গল্প, উপন্যাস প্রবন্ধে ছিল তার গতায়ত। যুদ্ধের, ভাঙনের রক্তাক্ত স্মৃতি নিয়ে কাব্যাঙ্গনে পা রেখেছিলেন সত্তরের তরুণ তুর্কীরা। ফলে কালের ধর্মানুয়ায়ী তাদের কাব্যে ছিল স্স্নোগান। উচ্চনাদ। মোটা দাগের বক্তব্য। কেউ কেউ এই প্রবণতাকে ডিঙিয়ে হয়েছেন আত্মমগ্ন। অস্তিত্বসন্ধানী। শুদ্ধশিল্পের পথচারী। ইকবাল আজিজ দ্বিতীয় ঘরনারই অনুগামী ছিলেন।

তিনি তার সময়, স্বকালকে শিল্পের ডুরিতে বেঁধে নিয়ে যেতে চেয়েছেন মহাকালের পস্ন্যাটফর্মে। আশির দশকে রাজধানী ঢাকায় আসেন। দেখেছেন ঢাকার বদলে যাওয়া। দেখেছেন কীভাবে নারীরা পণ্য হয়, দূষিত হয়ে ওঠে বুড়িগঙ্গার জল। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনকে দেখেছেন পরম মমতায়। তাদের সংগ্রাম, যন্ত্রণা, দহনকে দিয়েছেন কাব্যভাষা।

ইকবাল আজিজের লেখা পড়লে দেখতে পাই, তার মধ্যে কবিতা এবং গদ্যের সহবস্থান দিয়েছে জীবনকে দেখার নির্মোহ দৃষ্টি। অথবা বলা ভালো, তিনি বিপরীত দিক থেকেও ঘটনাকে দেখতেন, জানতেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বর্ষাকে নিয়ে বাংলাসাহিত্যে অগণনীয় কাব্য রচিত হয়েছে- হবে। বাঙালি মানেই বিরহ। বিরহ মানেই বর্ষা। শুধু বিরহ নয়, রোমান্টিকতাও যেন বর্ষা ছাড়া জমে না। একা রবীন্দ্রনাথই বর্ষার নানান রূপ নিয়ে গেঁথে গেছেন অজস্র অনুভূতির মালা। এবং বর্ষার এই চিত্র পুরোটাই ইতিবাচক দৃষ্টিতে অবলোকন করা। পক্ষান্তরে ইকবাল আজিজের 'বরষার দুঃস্বপ্নে পীড়িত প্রাণীদের কথা' গদ্যের শুরুতেই লিখেছেন, 'বরষা নিয়ে বাঙালি কবি ও গবেষকদের মধ্যে উৎসাহের শেষ নেই। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কালো মেঘে ছেয়ে যায় আকাশ; কিন্তু তখন শ্রমজীবী মানুষের মনে গভীর বিষণ্নতা।'

এই যে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য, এই পার্থক্যই সাধারণত একজন লেখক বা কবিকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে। এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতাই ইকবাল আজিজকে অপরদের চেয়ে আলাদা করেছিল।

'পরিমাপ' কবিতায় ইকবাল আজিজ 'সে' সর্বনামের আড়ালে যেন নিজেকেই নির্দেশ করেছেন। তিনি লিখেছেন-

'সে তার জীবনকে মেপেছিল ফেসবুক-ইন্টারনেটে

মধ্যরাতে আকাশে আকাশে তারার নাচন

অসংখ্য অজানা ঘাতক ছুরি হাতে ঘোরে-

\হহৃৎপিন্ডে হৃৎপিন্ডে ঝড়ের কাঁপন;

সবকিছু বিজ্ঞানের রহস্যের আদি অন্ত বলে জানি।

কিন্তু সে হেঁটেছে বাঙালির অন্তরের জলাভূমি ঘেঁষে-

সে দেখেছে শস্যক্ষেত লাউয়ের মাচা ছিন্নভিন্ন

\হকরে গড়ে ওঠা অসংখ্য গার্মেন্টসে

\হবঞ্চনার রূপরেখা।'

শব্দের যথাব্যবহার একজন কবির শক্তিকে নিরূপিত করে। উপরোক্ত উদ্ধৃতাংশে লক্ষ্য করলে আমরা দেখব, 'ফেসবুক-ইন্টারনেট' বা 'গার্মেন্টস'-এর মতো শব্দ ব্যবহারের কারণে তাকে যেমন বর্তমান কালের ভাষ্যকার হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

তখন বাঙালির জীবনের রূপান্তর এবং একই সঙ্গে বর্তমান সময়ে কীভাবে যে সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে সেই রূপই ফুটে ওঠে। এক সময়ে বাঙালি ছিল ভূমিজীবী। কৃষক। ফসল ফলানোর পাশাপাশি বাড়ির আঙিনা, একটু খোলা জায়গায় লাউ, কুমড়ো ফলাতো। মাচা পেতে দিত। এখন বাঙালি ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। লাউ-কুমড়ো ফলানোর জায়গাটুকু হারিয়ে গেছে। আজ চোখেই পড়ে না আগের মতো সেই লাউ-কুমড়োর মাচা। এ দেশের অর্থনীতির প্রধান খাত এখন গার্মেন্টস। কিন্তু নিত্যনূতন শ্রমিক অসন্তোষ আমাদের বুঝিয়ে দেয়, অঙ্গুলিমেয় মালিকপক্ষ ছাড়া বঞ্চিত হচ্ছে সিংহভাগ গার্মেন্টস কর্মী।

১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার স্মৃতি নিয়ে লেখা কবিতা 'বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার স্মৃতি।' সেখানে তিনি লিখেছেন,

'শেখ মুজিবকে আমি প্রথম দেখেছিলাম ময়মনসিংহ শহরে-

সন্ধ্যার অন্ধকারে আকাশের নিচে সেই আমার প্রথম মহামানব দর্শন;

সে যেন বিশুদ্ধ মরুভূমিতে শান্তির জলধারা বর্ষণ'

জিন্নাহর সেই নির্বাচনী প্রচারণায় বেশিরভাগ নেতাই যেখানে উর্দুতে বক্তব্য দিয়েছে, বঙ্গবন্ধু সেখানে ভাষণ দিয়েছেন বাংলায়। চেয়েছেন বাঙালির স্বায়ত্তশাসন ও কথা বলেছেন গণতন্ত্রের দাবিতে। এই বিষয়টিকে গদ্যছন্দে লেখা কবিতায় কত না শৈল্পিকভাবেই উপস্থাপন করেছেন কবি। লিখেছেন,

'বেশিরভাগ নেতাই উর্দুতে ভাষণ দিলেন,

কিন্তু মুজিব দাঁড়ালেন বাংলা ভাষার প্রতিটি বর্ণকে সঙ্গে নিয়ে-

সারাদেহে বিদ্রোহের জয়গাথা এক সুদর্শন মহামানব।'

কবি ইকবাল আজিজ এক সময় 'প্রতীকের হাত ধরে অনেক প্রতীক' নিয়ে পা রেখেছিলেন বাংলা কাব্যাঙ্গনে। প্রচুর বিক্রি হয়েছিল বইটি। কিন্তু জনপ্রিয়তার পথে হাঁটেননি তিনি। যদিও লিখেছেন নিয়মিতই। তার মৃতু্যও পর যারাই তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন, সবাই বলেছেন, জীবনের শেষ সময়ে এসে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। কোনো কবিতা, সভা কিংবা আড্ডায় যেতেন না। এক স্বরচিত নির্জনতা তিনি গড়ে ছিলেন নিজেকে ঘিরে। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত ছিলেন। সেই অসুখেই পাড়ি জমান পরলোকে। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন বলেই অনেকেই জানতো না তার অসুস্থতার কথা। এই যে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন, তা কি কোনো অভিমানে? হয়তো। কবির কিছু থাক বা না থাক অভিমান তো থাকেই। অথবা এক সময় তিনি কবিতায় লিখেছিলেন,

'তিন পা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে

\হবেলা হলো অনেক বেলা

এখন আমি গানের মাঝে

\হহেঁটে যাব গভীর সাঁঝে'

এই গভীর সাঁঝে বিলীন হওয়ার আগে তিনি হতে চেয়েছেন নিঃসঙ্গ। ডুবে থাকতে চেয়েছেন গানের মাঝে। তার বিদায়ে পুরনো কথাটি আবার বলব, কবির মৃতু্য নেই। তিনি অনন্তলোকে বিলীন হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু কবিতা, তার সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে আবার ফুল হয়ে ফুটবেন পাঠকের হৃদয়ে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে