শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

বৃষ্টি থামার একটু পরে

বাসার তাসাউফ
  ৩১ মে ২০২৪, ০০:০০
বৃষ্টি থামার একটু পরে

ক লেজ থেকে ফিরে নিজের রুমে ঢুকে দরজা এঁটে দিয়েছি। বালিশে মুখ গুঁজে কিছুক্ষণ কেঁদেকেটে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, জেগে দেখি পুরো পৃথিবী আঁধার। ঝুমবৃষ্টি হয়েছে। এখনো হচ্ছে। তবে মুষলধারায় নয়, টিপটিপ করে। কখনও বেড়ে যাচ্ছে, আবার কমছে। কিন্তু থামছে না। কিছুক্ষণের মধ্যে যে থামবে সে রকম কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। আকাশের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে ছেঁড়াখোঁড়া মেঘ। পেজাতুলোর মতো হালকা ভাসমান এসব মেঘ সূর্যকে রেখেছে ঢেকে। যতক্ষণ না বৃষ্টি ঝরিয়ে নিঃশেষ হবে ততক্ষণ ভাসতে থাকবে।

আমি বসে আছি বারান্দার ব্যালকনিতে। বাইরে ঘোলাটে মেঘলা আকাশ, এলোমেলো বাতাস, গাছেদের দোলাচল ও শুকনো পাতার ঝরেপড়া দেখছি। বৃষ্টি থামার একটু পর পুবদিগন্তের শেষ সীমানা অবধি একটা বাঁকা রংধনু ভেসে উঠেছে তাও দেখছি আর ভাবছি-এসব দেখার মতো আমার কোনো চক্ষু ছিল না। সে আমাকে চক্ষু দিয়েছে। আমি শ্রবণ-বধির ছিলাম না। যদিও আমার চোখ, কান, মুখ, হাত-পা সবই আছে। কিন্তু পৃথিবী দেখার মতো, পাখির মধুরতম কুজন শোনার মতো দিব্যদৃষ্টি ও শ্রবণেন্দ্রিয় ছিল না। আমি ছিলাম অতিসাধারণ, লাজনম্র ও বোকাসোকা একটি মেয়ে। কথা বলতাম শুধু নিজের সঙ্গে। কারণ- সারাক্ষণ মগ্ন থাকতাম কেবল নিজেকে নিয়েই। সে আমাকে নতুন এক পৃথিবীতে এনে দাঁড় করিয়েছে- যেখানে আমি একেবারে সদ্যোজাত শিশুর মতো। সে আমাকে চলতে শিখিয়েছে, বলতে শিখিয়েছে, মোমের মতো গলতে না শিখিয়ে প্রদীপের মতো জ্বলতে শিখিয়ে- অবশেষে লক্ষ্য থেকে পিছু না টলতে শিখিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা আমাকে সে চোখে চোখে রেখেছে আর চোখের ভেতরে বপন করে দিয়েছে স্বপ্নবীজ।

আমাকে ডুবতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে ভেসে ওঠে জলকেলি করতে। ঝর্ণার মধ্যে স্নান করতে শিখিয়েছে, ডুবসাঁতারের মধ্যেও যে অবগাহনের আনন্দ উপভোগ করা যায় তাও শিখিয়েছে। পদ্মফুলের মতো ফুটতে শিখিয়েছে স্বচ্ছ সরোবরে, শিখিয়েছে প্রজাপতির মতো রঙিন পাখা মেলে উড়ে বেড়াতে। ভাঙতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে গড়তে আর জীবন মানে যে ভাঙা-গড়ার খেলা- শিখিয়েছে তাও। বিনিময়ে আমার কাছে কিছুই চায়নি। শুধু চেয়েছে আমি যেন তার সঙ্গে এ পৃথিবীটা দেখি, দেখি এমনভাবে ঠিক যে-ভাবে সে দেখে। এতেই আমার বিপত্তি। তাকে আমি শ্রদ্ধা করি, কৃতজ্ঞও তার কাছে। কিন্তু তার সঙ্গে একই ছাদের তলে থাকতে হবে তা কিছুতেই আমি মেনে নিতে পারছি না। যাপিত জীবনের প্রায় সবটুকুতেই কান উৎকর্ণ করে তার স্তোত্র শুনেছি। সে আমাকে প্রস্ফুটিত, উন্মুক্ত ও অনবগুণ্ঠিত করেছে এ আমি অস্বীকার করি না। বিনিময়ে সে আমাকে অন্য কারও হতে না দিয়ে নিজেই দাবি করবে তা আগে বুঝিনি। এখানে আরেকটি কথা বলে রাখি, সে ছিল আমার গৃহশিক্ষক। তবে আমার সঙ্গে তার বিয়ের কথা হওয়ার পর থেকে আর পড়াতে আসে না।

বারান্দার এই ব্যালকনিটাতে বৃষ্টির ছাঁট এসে আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে শরীরজুড়ে শীতলতা এনে দিয়েছে। কিন্তু মনের ভেতরে বেদনার উষ্ণতা। সেই উষ্ণতা আরও বাড়িয়ে দিতেই কিনা মা এসে বলে, 'অপ্সরা, তোর ফোন এসেছে।'

আমার কাছে সচরাচর কোনো ছেলের ফোন আসে না, শুধু ওই লোকটার ফোন ছাড়া। নিশ্চয়ই এখন তার কাছ থেকেই ফোনটাই এসেছে। ইচ্ছে না হলেও মুঠোফোনটা হাতে নিতে হলো। ভীষণ বিরক্ত লাগে তার সঙ্গে কথা বলতে। ফোনটা কানের কাছে ধরেই সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পাই. 'হ্যালো অপ্সরা! কী কর?'

আমি আমার মনের ভেতরের উথালপাথাল অবস্থা সামলে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলি, 'কিছুই করি না, কথা বলছি।'

'আজ সকালে একটা নতুন কবিতা লিখেছি, শুনবে?' বলেই আমাকে আর কিছুই বলার সুযোগ না দিয়ে হড়ভড় করে কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে সে। আমি কানের কাছ থেকে মুঠোফোনটা সরিয়ে রাখি। সে কবিতা-টবিতা লেখে। যতবারই আমার সঙ্গে কথা বলে- অপ্রাসঙ্গিক হলেও নিজের লেখা কবিতার অন্তত দুই লাইন আমাকে শোনাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে। আমি তার কবিতা কানে শুনলেও কখনো মন পর্যন্ত পৌঁছেনি। এসব আমার বরাবরের মতোই অপছন্দ। এমন আরও অনেক বিষয় আছে যা সে পছন্দ করে কিন্তু আমি করি না। আমি ভালোবাসি রক গান শুনতে, তার প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীত। আমি ভালোবাসি রজনীগন্ধা, তার প্রিয় গোলাপ। আমার প্রিয় টিভি চ্যানেল স্টার পস্নাস, সে দেখতে ভালোবাসে স্টার স্পোর্টস। অন্য যে কারও সঙ্গে আমার বিয়ে হলে হতে পারে। কিন্তু তার সঙ্গে কোনোভাবেই নয়।

আমি একজন সাধারণ মেয়ে। স্বপ্নও দেখি খুব সাধারণ। মধ্যবিত্তের তেল-নুন, পেঁয়াজ-রসুন, কাঁচা মরিচ আর মোটা চালের ভাতের এক জীবনই স্বপ্ন। তবু আমার জীবনসঙ্গী হবে যে তাকে আমার ভালো লাগা ও ভালোবাসার মূল্য দিতেই হবে। এই লোকটা কি তা করবে কিংবা আদৌ কি তার সঙ্গে আমার মিল হবে? মিলন সে তো অনেক পরের বিষয়। আমার পরীক্ষা শেষ হলেই নাকি সম্পন্ন করা হবে বিয়ের কাজটি। তার বাবা-মাকে পাঁচ বছর ধরে এ রকম কথা দিয়ে রেখেছে মা, আমার মতামত না নিয়েই-এ কথা ভাবলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তার সঙ্গে এ রকম কথা না হলে জীবনটা হয়তো অন্যরকম হতো।

তার কথাবার্তা শুনে মনে হয় সম্পর্কটা যেন অনেক পরিণত, যেন আর আবেগের ওপর দাঁড়িয়ে নেই, আছে দায়িত্বের ওপর এবং সেই দায়িত্ব পালন করতে প্রস্তুত সে। কিন্তু বিষয়টা আমি কীভাবে নিচ্ছি এবং তাকে নিয়ে যে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই সে বুঝতে পারে না অথবা বুঝেও না বোঝার ভান করে।

তার প্রথম কবিতার বই প্রকাশ হওয়ার পর আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য উন্মাদের মতো ছুটে এসেছিল। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে যথারীতি আমাকে। নিজের গাঁটের টাকা আর বন্ধুদের কাছ থেকে ধারদেনা করে বের করা সেই বইয়ের সব ক'টা কবিতাই যে আমাকে নিয়ে লেখা বইটির নাম থেকেই সেটা বোঝা যায়। সে হয়তো ভেবেছিল, বইয়ের উৎসর্গপত্রে নিজের নাম দেখে আমি সারপ্রাইজ হব। কিন্তু আমি বইটি খুলে তো দেখিইনি, উৎসর্গ করার জন্য ভদ্রতা করে ধন্যবাদও দিইনি তাকে। তাতে সে একটুও মনোক্ষুণ্ন হয়নি। তার এই গুণটা আছে। আমার অতিরূঢ় আচরণেও কখনো ব্যথা পেতে দেখিনি, কখনো আমার মতের বিরুদ্ধে কিছু বলেনি এবং আমার ক্ষতি হয় কিংবা আমি কষ্ট পেতে পারি-এমন কোনো কাজ কখনো করেনি। এটা কি আমাকে ভালোবাসে বলে? আমি জানি, সে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে।

'অপ্সরা, কবিতাটা কেমন হয়েছে, ভালো না?'

আমি তো তার কবিতা শুনিনি! তবু ছোট করে বলি, 'ভালোই।'

'ধন্যবাদ।' বলে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় সে। আমি আবার ব্যালকনিতে ফিরে যাই। বিকালটা এখানেই কেটে যায়। রাতে খাবার টেবিলে এসে মাকে বলি, 'আম্মা, ভাত দাও।'

টেবিলে খাবার বেড়ে দিয়ে মা বলে, 'ডিসেম্বরের শেষে বিয়ের ডেট ফেললে তোর কোনো অসুবিধা হবে না তো!'

মুক্তা আপু সালাদে লেবু চাপছিল। মায়ের কথা শেষ না হতেই সে বলে, 'ওর পরীক্ষা তো নভেম্বরেই শেষ হয়ে যাবে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তায়ই ডেট ফাইনাল করে ফেল।'

'যাহ! এত তাড়াতাড়ি!'

'শুভ কাজে দেরি করতে নেই।'

'তা বটে। তবে তাড়াহুড়ো করতেও নেই। শপিং করা, আত্মীয়স্বজন দাওয়াত দেওয়া, কত কাজ আছে।'

আমি নিঃশব্দে খেতে খেতে মা ও আপুর কথা শুনছি আর মনে মনে হাসছি। কী অসম্ভব বিষয় নিয়ে ভাবছে বাড়ির লোকেরা। যে ঘটনা কখনো ঘটবেই না সেটা নিয়ে এত কথা হচ্ছে কেন?

মা আমার পাশের চেয়ারটাতে বসতে বসতে বলে, 'অনিকেতের মা ফোন দিয়েছিল। ওরা আর দেরি করতে চায় না।'

'অসম্ভব! আমি মরে গেলেও ওই লোকটাকে বিয়ে করব না।' এ কথাটি মনে মনে বলে পেস্নটের খাবার পুরোপুরি শেষ না করেই উঠে পড়ি। নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে ফুপিয়ে কাঁদি কিছুক্ষণ। বুকের ভেতর, একেবারে গহিনে যেখানে মন থাকে- সেখানে স্তস্তূপাকারে সাজিয়ে রাখা আমার আশা, স্বপ্নগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এলোমেলো হয়ে পড়ে। বুকের ভেতর থেকে হৃৎপিন্ডটা বেরিয়ে আসতে চায় এ কথাটি ভেবে, জীবনের এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটিবারও আমার মতামতের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়নি বাবা-মায়ের।

আমি চলে এলেও মা আর মুক্তা আপুর কথা থামেনি। আমি কান পেতে শুনতে থাকি।

মা বলে, 'ওর কি অন্য কোথাও অ্যাফেয়ার আছে? কিছু বলেছে তোর কাছে?'

মুক্তা আপু বলে, 'না, সে রকম হলে অন্তত আমাকে জানাত।'

'ও অনিকেতকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না কেন?'

\হ'উনাকে নাকি ওর পছন্দ না।'

\হ'ও কি তোকে এ কথা বলেছে?'

\হ'না, মুখ দেখেই তো বোঝা যায়।'

\হমা আর কোনো কথা বলে না। আমি মনে মনে বলি, মুক্তা আপু ঠিক কথাটাই বলে দিয়েছে। আসলে আমি তাকে স্যার হিসেবে শ্রদ্ধা করি, স্বামী হিসেবে কখনো ভাবতেও পারি না।

দরজার ওপাশ থেকে মা ডাকে, 'অপ্সরা দরজা খোল, তোর ফোন এসেছে।'

আমি মুঠোফোনটা ফেলে এসেছিলাম। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে সে ফোন করে। এটা তার প্রত্যেক দিনের অভ্যেস। মায়ের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে বেশ শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে দেই। আমি যে লোকটার ওপর বিরক্ত সেটা বোঝাতে চেষ্টা করি মাকে। মা নিঃশব্দে চলে যায়।

বিছানায় শুয়ে ফোনটা কানের কাছে ধরতেই তার গলার আওয়াজ পাই, 'হ্যালো অপ্সরা!' /'জি, বলেন।'

'আমি সরাসরি একটা কথা বলি, শোনো। আমি খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাই তোমাকে।'

'আপনি চাইলেই তো হবে না। আমাকেও তো চাইতে হবে।'

'তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে রাজি নও।'

'সে কথা আমি এখন আপনাকে বলব না।'

সে আর কোনো কথা বলেনি। ফোন কেটে দিয়েছে। জানি, এখন মাকে ফোন করবে। করুক। আমি তো মায়ের কথায়ও তাকে বিয়ে করতে রাজি হব না। যতই জোরাজুরি করুক। আমি সিদ্ধান্তে অবিচল থাকব। এ কথাটিতে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি নিজের ঘরে এসে রবীন্দ্রনাথের বইয়ে মগ্ন হই। আজকাল একটু একটু গল্পের বই পড়তে শুরু করেছি। কাল পড়ে শেষ করেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'হৈমন্তি।' এ গল্পটি আগেও পড়েছি। সেটা কলেজে অধ্যয়নের সময়। অসম্ভব ভালো লেগেছিল বলে আবার পড়তে ইচ্ছে হলো।

জীবনটা গল্প কিংবা উপন্যাস নয়। তবে এর মতো হওয়াই উচিত। জানি না, আমার জীবনগল্পের শেষ পাতাটি কীভাবে লেখা হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে ধার করে বলা যায় 'হয়তো একদিন মার অনুরোধ অগ্রাহ্য করিতে পারিব না, ইহাও সম্ভব হইতে পারে। কারণ-থাক, আর কাজ কী।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে