গহিনে ঢেউ

প্রকাশ | ৩১ মে ২০২৪, ০০:০০

আহমাদ কাউসার
গ্রীষ্মের দুপুর। পুকুরের উত্তর পাড়ে বড় আম গাছটার নিচে আনমনে দক্ষিণমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদৃতা। বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুলছে থোকায় থোকায় গাছের কাঁচা আমগুলো। আদৃতার মাথার চুলগুলো কখনো কখনো কপোল স্পর্শ করছে। পরনের শাড়ির আঁচলটা পেছনের দিকে উড়ছে। পশ্চিম পাড় থেকে রোহিত লক্ষ্য করল কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে রোহিত উত্তর পাড়ে এসে দেখল আদৃতা। আদৃতার দিকে তাকাল রোহিত। আদৃতার চিরচেনা রূপ কিছুটা ম্স্নান হয়ে গেছে। মুখে লাবণ্যতা আগের মতো নেই। রোহিতের উপস্থিতি টের পেল না আদৃতা। রোহিত কিছুক্ষণ আদৃতার পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, 'কী রে কেমন আছিস?' আদৃতা থতমত খেয়ে বললো, 'আছি ভালো আছি'। আদৃতার কথায় আগে যে মাধুর্যতা ছিল রোহিতের কাছে আজ তা নেই বলে মনে হলো। মুখে এক বিষণ্ন্নতার ছাপ লক্ষ্য করল রোহিত। রোহিত আর কিছু না বলে বাড়িতে চলে এলো। আদৃতা একই ভঙ্গিতে গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে রইল। হঁ্যা, আদৃতা ভালো নেই। চাচাতো ভাই রোহিতের সঙ্গে চঞ্চলা আদৃতার ছিল প্রেমের সম্পর্ক। পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে পরিণতি পায়নি সেই প্রেম। আদৃতার বাবা সালেহ উদ্দিন তার ভাইপো রোহিতের কাছে বিয়ে দেয়নি আদৃতাকে। আদৃতার অনিচ্ছায় সালেহ উদ্দিন শহরের যুবক রাহাতের সঙ্গেই একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দেয়। বছর দুয়েক হলো আদৃতার বিয়ে হয়েছে : কোনো সন্তান হয়নি। তাই রাহাত দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। দ্বিতীয় বিয়ে করার পর থেকেই রাহাত আদৃতাকে নির্যাতন করতে থাকে। আদৃতা রাহাতের সংসার ছেড়ে চলে আসে বাবার বাড়িতে। রাহাতের সঙ্গে আদৃতার বিয়ে হয়েছে ঠিকই কিন্তুত্ম আদৃতা রোহিতকে মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারেনি। আজ তার বাবা সালেহ উদ্দিন বেঁচে নেই। মা-ই তার একমাত্র ভরসা। রোহিত বিয়ে করেনি। করবেই বা কীভাবে, রোহিতের মন মন্দিরে জায়গা করে আছে আদৃতা। রোহিত ঘরে বসে ভাবছে, কী হয়েছে আদৃতার। রূপলাবণ্যের কমতি ছিল না তার। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে যেন সেই কবে থেকে ঘুমায়নি। রোহিতের বুকে এক অস্পষ্ট আবেশ ঢেউ খেলে যায়। গতরাতেই আদৃতা শহর থেকে এসেছে। রোহিত জানে না আদৃতা রাহাতের সংসার ছেড়ে চলে এসেছে। বিকালে রোহিতের উঠানে এসে আদৃতার মা রোহিতকে ডাকল। রোহিত ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, 'কী হয়েছে চাচি, আমাকে ডাকছেন কেন? হতাশাজনিত কণ্ঠে আদৃতার মা আদৃতার সংসার ছেড়ে চলে আসার কথা বলতে লাগল। এই বিশাল বাড়িতে রোহিত আর আদৃতার মা ছাড়া কেউ নেই। রোহিতের বাবা-মা বেঁচে নেই। আদৃতারও আর ভাইবোন নেই। আদৃতার বিয়ের সময় চাচার সঙ্গে কিছুটা দ্বন্দ্ব থাকলেও পরে তা মিটে গেছে। আদৃতার মা তার দুঃখ কষ্টগুলো রোহিতের কাছেই শেয়ার করে। রোহিতও আদৃতাকে বিয়ে করতে না পারার কষ্ট ভুলে গেছে। রোহিত আর আদৃতার মা'র কথোপকথনের মাঝেই আদৃতা উপস্থিত হলো। আদৃতা চোখ তুলে রোহিতের দিকে তাকিয়ে রইল। রোহিতের চোখে চোখ পড়তেই বুকের ভেতর একটা মায়াময় টান অনুভব করল। দু'জনের চাহনিতে না পাওয়ার এক তীব্র ব্যথা অনুভব হলো। আদৃতা নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো। রোহিতের কাছে আদৃতাকে কালবৈশাখীর আঘাতে ভেঙে পড়া বৃক্ষের মতো মনে হলো। শিকারির তীরের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়া পাখির মতোই মনে হলো। নানারকম ভাবনা রোহিতের মনে উদয় হচ্ছে। তবুও তো বাঁচতে হবে। জীবনতো আর থেমে থাকার নয়। সম্পর্কে তো চাচাতো বোন। হয়তো কোনো কারণে প্রেমকে পরিণয় দিতে পারেনি। আদৃতার মা রোহিতের সঙ্গে কথা বলে ঘরে চলে গেল। রোহিত আর আদৃতা উঠোনেই দাঁড়িয়ে রইল। আদৃতার চাহনিতে অভিমানের এক অস্ফুট ছাপ লক্ষ্য করল রোহিত। মিষ্টি হাসি যার ঠোঁটের কোণায় মুক্তোর মতো ঝরত সেই আদৃতা আজ চৈত্রের খরতাপে নেতিয়ে পড়া বৃক্ষের মতো। বৃষ্টির প্রতীক্ষায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা চাতকের মতোই রোহিতের দিকে তাকিয়ে রইল। আদৃতার চোখে অসহায়ত্বের স্পষ্ট প্রতিমা রোহিতের অন্তরগহিনে চাপর মেরে যায়। দু'জন চোখের ভাষায় কথা বলে যার যার ঘরে ফিরে যায়। সকালে যখন পুব দিগন্ত ঘেঁষে সূর্যটা উঁকি দিচ্ছে, গাছের পাতায় সোনালি আলো ঝলমল করছে রোহিত উঠোনের পাশে দাঁড়িয়ে আনমনে তাকিয়ে আছে দক্ষিণের জলপাই গাছটার দিকে। কিছুক্ষণ পর রোহিত উত্তর দিকে তাকাতেই দেখে আদৃতা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দু'জন দু'জনার দিকে তাকিয়েই আছে... কত কথা বলবার আছে কিছু একটা বাধা যেন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে কথা বলার অন্তরায় হয়ে। দু'জনই পরস্পরের কাছে আসতে চায় অদৃশ্য কোনো এক প্রতিবন্ধকতা আবার ঠেলে দেয় দূরে। আদৃতার বিয়ের পর রোহিত প্রায় ভবঘুরে হয়ে যায়। মাঝে মাঝে দুই তিন দিন পর বাড়ি ফেরে। কোথায় যায় কেউ জানে না। মাঠের জমিগুলোও ঠিকভাবে চাষাবাদ করে না। তবে যতক্ষণ বাড়িতে থাকে আদৃতার মা'র খোঁজখবর রাখে। এক দুপুরে রোহিত পুকুরে গোসল করতেছিল, আদৃতা ঘাটে বসে দেখছিল। রোহিত আদৃতাকে দেখে বলল। কী রে গোসল করবি? না। তো দুপুর বেলায় ঘাটে বসে আছিস! এমনিতেই বসে আছি, ভালো লাগছে না। তুই আর ঢাকায় যাবি না? না। তোর স্বামী কী জানে, তুই তার সংসার করবি না? হঁ্যা, জানে, আমি বলে এসেছি, আমি আর যাব না। চল, বাড়িতে আয়, এখানে একা একা বসে থাকিস না। রোহিত আর আদৃতা বাড়িতে চলে এলো। বিকালে রোহিত তার রান্নাঘরে ভাত পাকাচ্ছিল; আদৃতা রান্না ঘরে ঢুকে বলল- কী করছ? ভাত পাকাই। তোরা আজ কী খেয়েছিস? মাছ আর ডাল। তুমি দুপুরে খাওনি? খেয়েছি, পান্তাভাত। এখন পাকাবো কাল দুপুর পর্যন্ত খাব। আচ্ছা আমি আসি, মা'কে ওষুধ খাওয়াব। ঠিক আছে যা- রোহিত ভাত খেয়ে কোথাও চলে গেল, আদৃতা মা'কে ওষুধ খাইয়ে এসে দেখে রোহিতের ঘর তালা দেওয়া। সন্ধ্যা হয়ে গেলে আদৃতা আর ঘর থেকে বের হলো না। সকালে আদৃতা আবার রোহিতের খোঁজে এলো। ঘর তালা। আদৃতা ভাবলো রোহিত হয়তো রাতে এসেছে আবার খুব ভোরে কোথাও গেছে। এভাবে দু'দিন কেটে গেল। আদৃতা যখনই রোহিতের ঘরের দিকে যায় গিয়ে দেখে তালা। সপ্তাহ যায় মাস যায় রোহিতের কোনো খুঁজ মেলেনি। আদৃতা গাঁয়ের রোহিতের বন্ধুদের কাছে খুঁজ নেয় কেউ বলতে পারিনি রোহিতের খবর। আদৃতা ঘরের তালা ভেঙে ঘরটাকে ঘুছিয়ে রাখে। আবার তালা লাগিয়ে নিজ ঘরে চলে যায়। আদৃতার মনে আবারো কালবৈশাখীর আঘাত লাগে; তবু আদৃতা আশা ছাড়েনি। বছর দুয়েক পর এক পড়ন্ত বিকালে আদৃতা ঘরের পাশে কুমড়ো গাছটায় পানি দিচ্ছিল, বাড়ির পুব পাশে থেকে মুখভর্তি দাড়িওয়ালা এক লোক বাড়িতে প্রবেশ করছে, আদৃতা খেয়াল করে দেখে সে আর কেও নয়... রোহিত। আদৃতা পানির বালতিটা ফেলে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি কোথায় ছিলে? রোহিত আদৃতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে শহরে গিয়েছিলাম। বলে যেতে তো পারতে। ঘরে আয় পরে সব বলব। আদৃতার চোখের জল শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে রোহিতকে নিয়ে ঘরে গেল।