কাজী নজরুল ইসলামের উপন্যাসে জীবন বাস্তবতা

প্রকাশ | ২৪ মে ২০২৪, ০০:০০

আহমদ মতিউর রহমান
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের একজন তুলনারহিত কবি-লেখক। সাহিত্যে সাধারণ মানুষের কথা আনা, দ্রোহ-বিদ্রোহ প্রতিবাদ নিয়ে আসার কাজটি তিনি করতে পেরেছেন। দেশ নেতারা যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন সেখানে তিনি মনুষ্যত্বের ঝান্ডা উঁচু করে ধরেছেন। কালের বিচারে দেখতে পাওয়া যায় তার এ কাজ এ সংগ্রাম ও বিদ্রোহ বৃথা যায়নি। তার ফল এ মাটিতেই ফলেছে। যে কোনো বিচারে তিনি যুগান্তকারী একজন মহান লেখক ও সাধক। নজরুল কবি হিসেবেই আমাদের কাছে সমধিক খ্যাত। তার নামের আগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কবি বা বিদ্রোহী কবি ইত্যাদি যোগ করা হয়। তাই তার প্রধান পরিচয় কবি। আসলে সাহিত্যের আদিম ও সমৃদ্ধ শাখা হলো কবিতা। বড় কবিরা শুধু কবিতাতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও তারা পদচারণা করেছেন। কবি নজরুল ইসলামও সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় বিচরণ করেছেন। নজরুলের এসব রচনাবলির মাঝে আছে- গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, কথিকা, সম্পাদকীয়, পত্র-সাহিত্য ও অভিভাষণ। গবেষকদের মতে, কবি নজরুলের কবিতা ও গদ্যসাহিত্য সৃষ্টি সংখ্যার দিক দিয়ে প্রায় সমান। নজরুলের ৪২টি কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি ৪১টি গদ্য গ্রন্থ রয়েছে। বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে নানা পর্যায় গেছে। অনেক কথাসাহিত্যিক কবিতা লেখা দিয়ে শুরু করেন। কিন্তু পরে হয়েছেন নামকরা কথাসাহিত্যিক। নজরুলের জীবনেও এ রকমটা দেখা যায়। তিনি কবি হিসেবে খ্যাতিমান হলেও শুরু করেন গদ্য দিয়ে। নজরুলের প্রথম দিককার কবিতার চেয়ে গল্প বেশি জনপ্রিয় ছিল। তার প্রথম প্রকাশিত লেখা 'বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী' ১৯১৯ সালে মে মাসের 'সওগাত' পত্রিকায় ছাপা হয়। তবে কথাসাহিত্যের ইতিহাসে নজরুলের সৃষ্টিগুলো ভালো অবস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছে এমনটা বলা যাবে না। এ বিষয়ে আলোচনা পর্যালোচনা গবেষণা কম। অনার্স মাস্টার্সেও নজরুলের সাহিত্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পড়ানো হয় না বলে অভিযোগ। ফলে অনেক দিক অনালোচিত থেকে গেছে। নজরুলের কবিতা নিয়ে অনেক গবেষণা হলেও কথাসাহিত্য বিষয়ে আগ্রহ কম। ২. বাংলা সাহিত্যে নজরুলের পদচারণে অসাধারণ, যা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। তার অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে অনবদ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে। বাংলা সাহিত্য চিরঋণী তার কাছে। যদি তার বিদ্রোহের দিকটা আলোচনা করি, তাহলে দেখতে পাই তিনি বুলবুল, তার কণ্ঠ সুমধুর। তিনি শুধু গান গেয়ে যান গানের পাখির মতো অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-নিপীড়ন ও মানব-বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তাই তার কবিতায় মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, অত্যাচারিতের স্বার্থ প্রতিষ্ঠার বাণী ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে নির্ভেজাল নির্ভীক কণ্ঠে। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি ও যে কোনো কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। তার বিদ্রোহী কবিতার পেছনে যে দর্শন কাজ করেছিল, তা হলো তিমির রাতকে বিদূরিত করে আলোকে উদ্ভাসিত নবপ্রভাতের অরুণোদয় ঘটালো। পরাধীনতার জিঞ্জির ভেঙে স্বাধীনতার মুক্তির বার্তা বয়ে আনতে তিনি প্রাণবন্ত কর্মী, সাধক ও ব্রতী। তাই নজরুলের কবিতা, গান ও প্রবন্ধে উচ্চারিত হয়েছে বিদ্রোহী মনোভাবের ধ্বনি। ১৯২৭ সালে এক সাহিত্য সভায় তিনি ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, 'আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভন্ডামি আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।' নজরুলের সাহিত্যে কঠোরতা আর কোমলতার অসাধারণ মিশ্রণ ঘটেছে। তার কাব্যে উচ্চারিত হয়েছে সাম্য আর মৈত্রীর বাণী। সমাজের উঁচু-নিচু সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-প্রীতি, বিরহ-মিলন মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে। নজরুল তার জীবনে প্রেম-প্রীতি, সুখ-দুঃখকে গ্রহণ করতেন অন্তরের নিভৃত কোণে। তার সন্তান বুলবুলের অকালমৃতু্য, নার্গিসের প্রেম ও পরবর্তীতে বিরহ তার সাহিত্য সাধনায় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। সব মিলিয়ে তিনি অনন্য এক কবি প্রতিভা। ৩. মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে নজরুলের রচনাসম্ভারের একটু উলেস্নখ করে নেই। কবিতার অঙ্গনে বিপুল কাজ করেছেন তিনি। এর বাইরে নজরুল ৩টি উপন্যাস ও অসংখ্য গল্প লিখেছেন। তার লেখা উলেস্নখযোগ্য গল্প হলো- রিক্তের বেদন, ব্যথার দান, পদ্ম গোখরো, অগ্নিগিরি, জিনের বাদশা, শিউলিমালা ইত্যাদি। নাটক, নাটিকা ও গীতি-বিচিত্রার মাঝে- মধুবালা, ভূতের ভয়, ঈদ, বিজয়া, শ্রীমন্ত, গুল-বাগিচা, বিদ্যাপতি, বাসন্তিকা, বাঙালি ঘরে হিন্দী গান, জন্মাষ্টমী, সাপুড়ে, বনের বেদে, লাইলী মজনু ইত্যাদি। প্রবন্ধ গ্রন্থ- যুগবাণী, রাজবন্দীর জবানবন্দী, দুর্দিনের যাত্রী, রুদ্র মঙ্গল ও ধূমকেতু। নজরুলের প্রথম গদ্য রচনা ছিল 'বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী'। ১৯১৯ সালের মে মাসে এটি সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক থাকা অবস্থায় করাচি সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেছিলেন। এখান থেকেই মূলত তার সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটেছিল। এখানে বসেই বেশ কয়েকটি গল্প লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে : 'হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে'। ১৯২২ সালে নজরুলের একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় যার নাম ব্যথার দান। এছাড়া একই বছর প্রবন্ধ-সংকলন যুগবাণী প্রকাশিত হয়। এটি নজরুলের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। এই গ্রন্থের গল্পগুলোর ভাষা আবেগাশ্রয়ী, বক্তব্য নরনারীর প্রেমকেন্দ্রিক। রিক্তের বেদন : পৌষ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ ১২ই জানুয়ারি ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ মোট ৮টি গল্প আছে এতে। নজরুলের প্রথম উপন্যাস বাঁধনহারা আগস্ট ১৯২৭-এ প্রকাশিত হয়। এটি একটি পত্রোপন্যাস। করাচিতে থাকাকালীন তিনি 'বাঁধনহারা' উপন্যাস রচনা শুরু করেন। মৃতু্যক্ষুধা নজরুলের আরেকটি উপন্যাস। মাঘ ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ জানুয়ারি ১৯৩০ সালে এটি প্রকাশিত হয়। লেখক এতে তুলে ধরেছেন তৎকালীন দারিদ্র্য, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষের পরিপ্রেক্ষিতে সপরিবার মেজ-বৌয়ের মুসলিম থেকে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ ইত্যাদি। নারী জীবনের দুবির্ষহ অন্ধকার এবং সমাজের বাস্তবচিত্র এই উপন্যাসে তুলে ধরা হয়। কুহেলিকা নজরুলের তৃতীয় উপন্যাস। শ্রাবণ ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ ২১শে জুলাই ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে এটি প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে নজরুলের রাজনৈতিক আদর্শ ও মতবাদ প্রতিফলিত হয়েছে। মনে রাখা দরকার, এরপর নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এর বছর দশেক পড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যান। বেঁচেছিলেন ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত, কিন্তু কবি বা লেখক হিসেবে নয়। শধু তার অস্তিত্ব ছিল, আর কিছু ছিল না। তিনি সাহিত্য সাধনা করেছেন মাত্র ২২ বছর। তিনি সচল থাকলে হয়তো বাংলা সাহিত্য তার কাছে আরও কিছু পেত। ৪. নজরুলের মৃতু্যক্ষুধা উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৩০ সালে। উপন্যাসটি সওগাত পত্রিকায় ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাস থেকে ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের ফাল্‌গুন মাস পর্যন্ত ?ধারাবাহিকভাবে মুদ্রিত হয়। সমালোচকদের মতে, 'মৃতু্যক্ষুধা' কাজী নজরুল ইসলামের 'কালজয়ী' উপন্যাস। বলা হয়েছে এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সাম্যবাদী চেতনার উপন্যাস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৬ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এ সময় ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে হাবিলদার হিসেবে কর্মরত অবস্থায় তিনি প্রকাশ করেন বাউন্ডেলের আত্মকথা। এটি একটি আত্মজৈবনিক উপাখ্যান। ১৯১৯-২০ পর্বে প্রকাশিত হয় ব্যথার দান ও রিক্তের বেদন গ্রন্থ দু'টির গল্পগুলো। অনেক পরে প্রকাশিত হয় চারটি গল্প নিয়ে শিউলিমালা এবং বনের পাপিয়া। 'রাজবন্দীর চিঠি' পত্রের আকারে একটি কাহিনী। 'মৃতু্যক্ষুধা' কবি নজরুলের কাহিনী বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত। ১৯২৬ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত নজরুল পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরে বাস করতেন। এখানকার চাঁদ-সড়কের পাশে বিরাট চত্বরওয়ালা একতলা গ্রেস কটেজে তিনি অবস্থান করতেন। 'মৃতু্যক্ষুধা' উপন্যাসের পটভূমিতে রয়েছে ঐ বাড়ি, ওমান কাথলিপাড়া এবং কলতলার পারিপার্শ্বিকতা। উপন্যাসটির প্রথমাংশ কৃষ্ণনগরে এবং শেষাংশ কলকাতায় অবস্থানকালে লিখিত। কৃষ্ণনগরের সংক্ষিপ্ত জীবনে নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট এবং দুঃসাধ্য কৃচ্ছ্রসাধন ছিল কবি নজরুলের নিত্যসঙ্গী। তাই দারিদ্র্যের চিত্র, সাম্য ও বিপস্নবীচেতনা এ উপন্যাসের রূপকল্পের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ। তৎকালীন দারিদ্র্য, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে কাহিনীর বিকাশ। উপন্যাসের পটভূমি কৃষ্ণনগরের চাঁদ-সড়কের বস্তি এলাকা। এ এলাকায় বাস করে একটি দরিদ্র মুসলিম পরিবার। এ পরিবারে আছে রোগগ্রস্ত বৃদ্ধ মা, তিন পুত্রবধূ যাদের সবাই বিধবা, আর তাদের সন্তানাদি। আর আছে তিন পুত্রবধূর একমাত্র দেবর পঁ্যাকালে। সে সদ্য যুবক। বয়স আঠারো-উনিশ। পরিবারের লোকসংখ্যা অনেক। সবার ভরণপোষণের ভার পঁ্যাকালের ওপর ন্যস্ত। কুর্শি খ্রিষ্টান হলেও পঁ্যাকালের ভালোবাসার জন্য ব্যাকুল। সেজন্য বিধবা-রূপসী ভ্রাতৃজায়া মেজ-বউয়ের বিয়ের প্রস্তাব তার কাছে অতি তুচ্ছ। কুর্শিকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় প্যাঁকালে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে। সপরিবার মেজ-বৌয়ের মুসলিম থেকে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ। অন্যদিকে রুবি আনসারকে ভালোবাসলেও রুবির পিতা তাকে বিয়ে দেয় আইসিএস পরীক্ষার্থী মোয়াজ্জেমের সঙ্গে। এমন একটি প্রেমের কাহিনী। মোয়াজ্জেমের মৃতু্যর পর বিধবা রুবির জীবনে নেমে আসে সমাজের সব বিধিনিষেধ। নারী জীবনের দুবির্ষহ অন্ধকার এবং সমাজের বাস্তবচিত্র এই উপন্যাসে তুলে ধরা হয়। এরপর শুরু হয় আনসার ও রুবির পর্ব। দেশপ্রেমিক সমাজকর্মী ও সংসার-বিরাগী আনসার এসে আশ্রয় গ্রহণ করে লতিফা ওরফে বুচির বাসায়। লতিফার স্বামী স্থানীয় কোর্টের নাজির। পরে কৃষ্ণনগরের জেলা-ম্যাজিস্ট্রেটের তরুণী কন্যা সদ্য-বিধবা রুবির সঙ্গে শৈশব প্রণয়ের স্মৃতি আনসারের মনে উদয় হয়। যদিও রুবি-আনসারের পুনরায় সাক্ষাৎ ঘটেছে উপন্যাসের শেষাংশে। মাঝখানে কয়েক বছর দু'জনের সাক্ষাৎ হয়নি। কারণ রুবির অমতে তার বিয়ে হয়েছিল অর্থলোভী এক যুবকের সঙ্গে। তাদের সংসার টিকে ছিল মাত্র এক মাস। বাইরের সাজসজ্জা ও আচরণ রুবির বিধবাসুলভ হলেও মনে প্রাণে সে আনসারকেই স্বামী বলে মানে। আনসার রাজবন্দি হয়ে রেঙ্গুন চলে যায়, সেখানে ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হবার আশায় ওয়ালটেয়ারে যায়। এ সংবাদ শোনামাত্র অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে যাত্রা করে রুবি। বাঁধনহারা নজরুল রচিত প্রথম উপন্যাস। করাচিতে থাকাকালীন তিনি 'বাঁধনহারা' উপন্যাস রচনা শুরু করেন। মোসলেম ভারত পত্রিকায় বাঁধনহারা-র প্রথম কিস্তি এবং ১৯২১ সালে (১৩২৭ বঙ্গাব্দ) ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ সালে জুন মাসে (শ্রাবণ, ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ) এটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্রোপন্যাস। এর প্রধান চরিত্র নুরু ও মাহবুবা। তারা একে অন্যকে পছন্দ করে এবং তাদের বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়। এই সময়ে নুরু বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। নুরুর সেনাবাহিনীতে যোগদানের পিছনে দেশ ও জাতিকে রক্ষার কোনো তাগিদ ছিল না। মাহবুবা, রাবেয়া ও সাহসিকা বাল্যসখী ও তাদের মধ্যে পত্র যোগাযোগ হয়। সাহসিকা তার নামের মতোই সাহসী ও প্রতিবাদী। চিরকুমারী সাহসিকা নারীদের ওপর অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। মাহবুবা নুরুল হুদাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। কিন্তু নুরুল হুদা কোনো বাঁধনে জড়াতে চায় না। অবশেষে মাহবুবার বিয়ে হয়ে যায় চলিস্নশোর্ধ্ব এক জমিদারের সঙ্গে। কিছুদিন বাদেই মাহবুবা বিধবা হয়ে যায়। নুরুল হুদাকে সে লেখে যে, সে মক্কা ও মদিনায় তীর্থ ভ্রমণে যাবে এবং নুরুল হুদার কর্মস্থল বাগদাদেও যেতে পারে। নুরুল হুদা মাহবুবাকে নিষেধ করে না। তাদের দু'জনের দেখা হওয়ার সম্ভাবনার মাধ্যমে শেষ হয় উপন্যাসটি। 'বাঁধনহারা' উপন্যাসে মোট চরিত্রের সংখ্যা দশটি। নুরুল হুদা মাহবুবা ছাড়া রাবেয়া, সাহসিকা, আয়েশা, আনারকলি, মা/রোকেয়া প্রমুখ। সবাই মূল ঘটনাকে প্রবাহিত করতে ভূমিকা পালন করেছে। নজরুল বাঁধনহারার মাধ্যমে বাঙালিদের প্রথম আধুনিক যুদ্ধ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জ্ঞাত করেছেন। উপন্যাসে নজরুলের সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতার ছাপ রয়েছে। এটি যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় প্রেমের আখ্যান। এটি ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কুহেলিকা তার সর্বশেষ উপন্যাস। এটি ১৩৩৪ (১৯২৭) সালে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগে এটি নওরোজ পত্রিকার পাঁচটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক নওরোজ পত্রিকায় 'কুহেলিকা' উপন্যাসের প্রথম অংশ প্রকাশিত হয়। তার কিছুদিন পর নওরোজ বন্ধ হয়ে গেলে সওগাত পত্রিকায় তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯৩১ সালে এটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে নজরুলের রাজনৈতিক আদর্শ ও মতবাদ প্রতিফলিত হয়েছে। বিপস্নবী যুবক জাহাঙ্গীর চরিত্র দিয়ে সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতির সফল প্রতিফলন ঘটেছে এই উপন্যাসে। উপন্যাসের রূপরেখা সমসাময়িক হলেও লেখক কাহিনী পরিচর্যা করেছেন নিজের মতো করে। ব্যঙ্গ, হাস্যরস ও প্রাণের স্পর্শের পাশাপাশি মিথ-কথনের প্রয়াস রয়েছে। তরুণ কবি হারুনের মেসে তার রচিত 'নারী কুহেলিকা' কবিতা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। জাহাঙ্গীর একজন বিপস্নবী স্বদেশি দলের কর্মী। নারী সম্পর্কে তার ধারণা নেতিবাচক। সে মনে করে এরা মায়াবিনীর জাত। এরা সব কল্যাণের পথে মায়াজাল পেতে রেখেছে। জাহাঙ্গীর, হারুন, প্রমথ, চম্পা, তাহমিনা (ভুণী) ও ফিরদৌস বেগম এই উপন্যাসের চরিত্র। ৫. যাদের নিয়ে তার এই গল্প কাহিনী সেইসব চরিত্রের একেবারে কাছাকাছি ছিলেন নজরুল। সাধারণ মানুষের নৈকট্য, তাদের প্রতিদিনের জীবন ও ঘটনাপ্রবাহ সরাসরি প্রত্যক্ষ করা লেখক নিজের সৃজনশক্তির মিলিত সম্পদে তৈরি করেছেন উপন্যাসের সুনির্দিষ্ট গতিপথ, চরিত্রগুলোও আপন বৈশিষ্ট্যে ঘটনার পালাক্রমে এগিয়ে যাওয়া। সবশেষে অনিবার্য পরিণতি টেনে আনতে শৈল্পিক আর মনোজাগতিক প্রভাবকেও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রেখেছেন। সব থেকে বেশি দায়বদ্ধতা ছিল প্রচলিত ব্যবস্থার সঙ্গে চরিত্রগুলোর অন্তর্নিহিত বিরোধ আর উদ্ভূত সংকট স্পষ্ট করা। মনে রাখতে হবে এগুলো নজরুলের প্রথম দিককার রচনা। তখন তার আবেগ ছিল কাচা। তারপরও তিনি নিবিষ্ট মনে কাহিনি বর্ণনের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমান চরিত্রের সমাহার ঘটিয়েছেন তা এক কথায় অসাধারণ। বাঙালি মুসলমান কথা সাহিত্যিকরা তখনো নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই সময়ে তার এই অসামান্য উদ্যোগ বাংলা কথা সাহিত্যের গতিপথকে উচ্চকিত করেছে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।