রোববার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১

ঋণী

আবু সাইদ কামাল
  ১৭ মে ২০২৪, ০০:০০
ঋণী

বৃদ্ধা মাকে নিয়ে জাবেদ ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে। সত্তরোর্ধ্ব মায়ের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা। থাকেন গাঁয়ে। কদাচিৎ ছেলে জাবেদের শহরের বাড়িতে এসে ডাক্তারের কাছে যান। চিকিৎসা আর জাবেদের ছোট মেয়ে আদুরির আকর্ষণে শহরে আসেন বৃদ্ধা। পঞ্চম শ্রেণিতে পাঠরত আদুরি দাদির জন্য দিওয়ানা। দাদিকে কাছে পেলে কত রকম সেবা-যত্ন করে। স্নান করিয়ে দেয়। দাদিকে নিয়ে এক সঙ্গে খায়। দাদিকে ওষুধ খাইয়ে দেয়। দাদিও নাতনিটিকে খুব আদর করে।

জাবেদ রিকশায় মাকে নিয়ে চর পড়া মোড়ে যায়। ডাক্তার পি কে দিপুকে দেখায়। ডাক্তার বৃদ্ধ মায়ের হৃৎকস্পন, রক্তচাপ ইত্যাদি পরীক্ষা করে বলেন, সবকিছুই বয়স অনুপাতে ভালো পর্যায়ে আছে। তবু ওষুধ লিখে দিচ্ছি। এগুলো খাওয়ালে আশা করি ভালো থাকবে। এই বলে ডাক্তার ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন।

জাবেদ মাকে নিয়ে বের হয়। এবার রিকশা নিয়ে বাড়ি ফেরার পালা। প্রথমে নতুন বাজার পর্যন্ত রিকশা নেয়। সন্ধ্যা নামায় রোদ না থাকলেও গরমের প্রাবল্য বেশ। রিকশাপুলার রিকশা টানছে। তার পিঠের জামা ঘামে ভিজে গেছে।

রিকশাটা নতুন বাজারের মোড়ে থামে। জাবেদ একশ' টাকার একটা নোট বের করে দেয়। রিকশাওয়ালা টাকার ভাংতি নেই বলে জানায়। মা'কে রিকশা থেকে নামিয়ে সুবিধাজনক একটা স্থানে দাঁড় করায় জাবেদ। তারপর পাশেই ওষুধের দোকানে ঢুকে। ওষুধ কিনে খুচরো টাকা হাতে নিয়েই বের হয়। তারপর রিকশাপুলারকে বলে, তোমার কাছে কি দশ টাকার নোট আছে? তাহলে আমি তোমাকে চলিস্নশ টাকা দিতে পারি।

-জি স্যার।

\হএই বলে রিকশাপুলার পকেটে হাত বুলায়। বিশ, দশ ও পাঁচ টাকার ক'টা নোট বের করে দশ টাকার একটি নোট হাত বাড়িয়ে জাবেদকে দেয়। বিশ টাকা দিয়ে জাবেদ দশ টাকার নোট নেয়। যখন চলে আসার জন্য পা বাড়ায়, তখন রিকশাপুলার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। জাবেদ বলে, কিছু বলবে?

-স্যার টাকা...আরো বিশ টাকা দেবেন না?

পকেটে হাত দিয়ে জাবেদ বলে, বিশ টাকা তোমাকে দিলাম না?

-না স্যার।

-মানে! আমার হাতে যে চলিস্নশ টাকা ছিল, তা থেকেই তোমাকে দিলাম। অবশিষ্ট এই যে তোমার দেওয়া দশ টাকা।

-না স্যার, টাকা আমাকে দেননি।

-তাহলে কী আমি তোমাকে মিথ্যা বলছি?

জাবেদের কথা শুনে রিকশাপুলার হতভম্ব। বারবার টাকা গুণে সংশয়ে জড়িয়ে সে তোতলিয়ে বলে, স্যার মাত্র দুইটা ভাড়া মারছি। এই তো দুইটা ভাড়ার টাকা আর আপনার দেওয়া দশ টাকা।

-তাহলে আমি যে চলিস্নশ টাকা নিয়ে দোকান থেকে বের হলাম, হাতে তো দশ টাকা ছাড়া আর কোনো খুচরা টাকা নেই। বাকি বিশ টাকা তাহলে গেল কই!

-স্যার...!

-তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কলের কাছে গিয়ে মাথায় কিছুক্ষণ পানি ঢাল। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। হিসাবও মিলবে। যত সব...

কথা শেষ না করেই জাবেদ আর একটা রিকশা ভাড়া করে মাকে নিয়ে রওয়ানা হয়। মোড়ে দাঁড়নো দুয়েকটা রিকশাপুলার কিংবা চলমান পথিক হয়তো বা তাদের কথা শুনেছে। কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। জাবেদের মতো সুবেশী একজন ভদ্রলোক কী সামান্য রিকশা ভাড়ার টাকা না দিয়ে মিথ্যে বলবে! তা তো বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাহলে কী রিকশাপুলার মিথ্যে বলেছে?

স্তম্ভিত রিকশাপুলারের হিসাব না মিলার ঘোর তখনো কাটে না। সে থ' হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জাবেদ ক্ষুব্ধ হয়ে মনে মনে বলে, মিথ্যে কথা বলে অর্থ উপার্জনের কী আশ্চর্য কৌশল রে বাবা!

জাবেদের রিকশা ছুটে চলে। দশ মিনিটের মধ্যেই মাকে নিয়ে বাড়ির গেটে নামে। ভেতরে ঢুকে জাবেদ কাপড় ছাড়ে। একপর্যায়ে জামার পকেটের টাকা বের করে যখন হিসেব মিলায়, তখনই ভেতরের ক্রোধ থিতিয়ে যায়। উল্টো কেমন যেন অপরাধবোধে আক্রান্ত হয়ে স্ত্রীকে ডাকে। আবেগ জড়ানো স্বরের ডাক শুনে স্ত্রী'র সঙ্গে ছুটে আসে ছোট মেয়ে আদুরি। তাদের উপস্থিতিতে জাবেদ বলে, একটা মহা অপরাধ করে ফেলেছি!

-কী রকম অপরাধ।

-টাকা দিয়ে ফেলেছি ভেবে রিকশাওয়ালাকে গালমন্দ করে মাথায় পানি দিতে বললাম, এখন দেখছি সেই টাকা আমার পকেটে রয়ে গেছে। এ আমি কী করলাম গো! রিকশাওয়ালাকে তো চিনি না যে তার পাওনা টাকা শোধ করব। তাহলে এ টাকা তাকে দেব কী করে? কী করে তার এ ঋণ পরিশোধ করব!

-মাঝেমধ্যে তুমি খুব একগুঁয়েমি কর! ও সময়ে নিজের পকেটটা একটু যাচাই করে নিলেই তো ভুলটা ধরা পড়তো।

-গরমের মধ্যে বেচারা ঘামে ভিজে রিকশা টেনে আমাদের বহন করল, আর আমি কিনা তাকে ঠকালাম!

-আমি তো দেখছি ওর মাথার বদলে তোমার মাথায় পানি ঢালা দরকার।

মায়ের এ কথা শুনে ছোট মেয়ে আদুরি হে হে করে সশব্দে হাসতে থাকে। অমনি মা ধমক দিয়ে আদুরির পূর্ণ হাসির বিকাশে ব্যাঘাত ঘটিয়ে বলে, এই! হাসার কী হলো? চুপ কর।

এবার স্বামীকে বলে, এমন আত্মভোলা হলে কী চলে? রিকশাভাড়ার টাকা নিজের পকেটে রেখে বেচারা রিকশাওয়ালাকে আবার উল্টো চাপ দিলে। যাক, মানুষ মাত্রই ভুল হয়। রিকশাওয়ালা বলে সব সময়েই তার ভুল হবে, আর সাহেবী পোশাক পরে ভদ্রলোক সাজো বলে তোমাদের ভুল হবে না- এমনটা ভাবা ঠিক না।

শোনো আদুরি! তোমাকেও বলি, একই বাবার মেয়ে তো। তোমার মধ্যেও এমন একগুঁয়েমি আছে। দেখলে তো, তোমার বাবা কীভাবে ভুল করে এলো। এজন্য সারা জীবন তাকে পস্তাতে হবে। তুমিও না জেনেশুনে এমন ভুল করে খাতা কলম কই যে রাখো, খুঁজে না পেয়ে বাড়ি তোলপাড় কর।

জাবেদ বলে, এখন আমি কী করে ওই ঋণ থেকে মুক্তি পাব বল তো!

স্ত্রী বলে, কী আর করবে, ভাড়ার সমপরিমাণ টাকা দান করে দাও! কখনো যদি ওই রিকশাওয়ালার দেখা পেয়ে যাও, টাকাটা দিয়ে ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিও। আর একটা কথা, এখন থেকে রিকশাওয়ালাদের প্রতি সদাচরণ বা সহানুভুতিশীল আচরণ করবে। ওদের দেখলেই ভাববে, ওই শ্রেণির কাছে তুমি ঋণী।

কথাগুলো বাবাকে বলে মা রান্নাঘরের কাজে যায়। বাবা জাবেদ খাটে শুয়ে অনুশোচনার অতলে ডুবে থাকে। আদুরিও এ ঘটনা থেকে একটা শিক্ষা নেয়। সেও এক ধরনের ভাবনায় পড়ে। সে ভাবে, বড় মানুষ হয়েও বাবা ভুল করে তার জন্য আফসোস করছেন। মায়ের কথামতো এমন ভুল তো আমিও করি।

\হঅনেকক্ষণ আকাশ-পাতাল ভাবে আদুরি। অতঃপর নিজেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে মনে মনে বলে, এখন থেকে আর নিজের ভুল যাচাই না করে অন্যের ভুল ধরতে যাব না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে