নৈশভোজ প্রতু্যৎ দেবনাথ

প্রকাশ | ১০ মে ২০২৪, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক

আজ হৃদিতার নৈশভোজের নিমন্ত্রণ আবিরদের বাসায়। সদ্য নতুন অধ্যায় শুরু করা আবিরের এই বাসভবন বছর দুয়েক আগে হৃদিতার নিজেরই আলয় ছিল। শশব্যস্ত হয়ে বাইরে থেকে নানারকম জিনিসপত্র এনে নিজের ঘরটাকে সাজিয়েছিল হৃদিতা। শুধু আসবাবপত্রের ধরন পর্যবেক্ষণ ও মূল্যের খসড়া প্রস্তুত করতে একাধিকবার তার অবস্থান করতে হয়েছে বিদেশ বিভূঁইয়ে! একসঙ্গে সারাজীবন কাটাবে বলেই তো ঘর সাজানোতেও ছিল পরিপূর্ণতা। কিন্তু বিয়ের পর তিনটে বছরও টেকেনি তাদের সংসার। শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে হৃদিতা হাতঘড়ি দেখল। ঘড়িতে ৮.১৩ বাজছে। হৃদিতা মিনিটের কাঁটার অবস্থান দেখে নিমিষেই একেবারে সঠিক সময় বলে দিতে পারে। এজন্যই বোধ হয় ছোটবেলায় ডিজিটাল ঘড়ির শখ হয়নি কখনো। সময়ের ওপর এমন বেখাপ্পা দখলদারির জন্যই কি আবিরের তাকে সময় কম দেওয়ার ব্যাপারটা এত বেশি করে নজরে আসত হৃদিতার! আর এ কারণেই হয়তো তাদের বিচ্ছেদের সময়টাও বেশ তাড়াতাড়ি ঘনিয়ে এসেছিল। না, কন্টাক্টস্‌ অপশনে আবিরের নম্বর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। দু'বছরে দু'হাজার ফোন নম্বরের দুটোও অপসারণ করেনি সে। কেবল আবিরের নম্বরটাই নেই। হৃদিতা তার হরিণী চোখজোড়া বন্ধ করে চোখের পাতা দিয়ে জোরপূর্বক চাপ প্রয়োগ করে মনে করতে চেষ্টা করল। ০১৭১২৫...। না, শেষের পাঁচটা ডিজিট কিছুতেই মনে আসছে না আর। নিজের স্মরণশক্তি যতটা ভালো, কাউকে ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা যে তার চেয়েও ঢের ভালো সেটা হৃদিতা ভালোই জানে। রিকশায় চড়তে আজ কেন যেন বেশ ইচ্ছে করছে ওর। বিচ্ছেদের পর রিকশার সঙ্গেও সম্পর্ক ছেদ করেছে হৃদিতা। অফিসের মাইক্রো ছাড়া আর কোনো গাড়িতে চাপতেই ইচ্ছে হয় না। আগে আবিরকে নিয়ে অকারণে রিকশা চড়ার বাতিক ছিল। তখন হৃদিতার আইস্ক্রিমের ভূত চাপত, আর আবিরের সিগারেটের। ওর সিগারেটের নেশা ছাড়ানোর আগেই আবির তাকে ছেড়ে চলে গেছে অনেক দূরে। দূরত্ব অবস্থানের নয়, আত্মার। আত্মিক দূরত্ব। অবশ্য ছেড়ে যাওয়া মানুষটার কাছে শেষমেশ রিকশা চড়ে আসার পরই আলাপসূত্রে হৃদিতা এখন জানতে পারল যে, আবিরের সিগারেটের নেশাই আজকাল ওর হৃদরোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 'আমার সাজিয়ে রাখা শোপিসগুলো এখন আর সাজানো নেই কেন? এমন এলোমেলো করলে কিভাবে?' হৃদিতা তাচ্ছিল্যের সুরে মুচকি হেসে আবিরকে উদ্দেশ করে বলল। 'জীবনটাই যেখানে অগোছালো সেখানে জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত এই কৃত্রিম জিনিসগুলো গোছানো থাকবে কী করে বলো তো!' আবির স্বচ্ছ গাম্ভীর্যের সুরে আওড়াল। 'জীবনের সঙ্গে কেন? আমি কিনেছি বলে; নাকি ওগুলো অন্য কারও স্পর্শে সংরক্ষিত হয়েছে বলে?' আবির তর্জনী দিয়ে টোকা দিয়ে সিগারেটের ছাই মেঝেতে ফেলতে ফেলতে বলল, 'যা তুমি ভাবো।' তারপর কিছুক্ষণ বর্ণিল নীরবতা। দুজনেই ফেনিল স্মৃতির সমুদ্রে কিংবা গহ্বরে ডুবে গিয়েছিল যেন! মেঝের ওপর পাঁচ-ছয় বছর বয়সি একটি মেয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, সেটা এতক্ষণ খেয়ালই করেনি হৃদিতা। আচ্ছা, এটা কার মেয়ে? এমন সুন্দর, ফুটফুটে। হৃদিতা আবিরকে জিজ্ঞাসা করার সাহস পেল না। রান্নাঘরে কিসের শব্দ হলো যেন! মনে হলো চায়ের কেটলিটা পড়ে গিয়েছে নিচে। হৃদিতা এমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠতে গেল দেখার জন্য যে, আবিরের মনে হলো এটা ওর নিজেরই ঘর। নিজের ঘরই তো, কিন্তু হৃদিতা সেখানে একটু পর; এই যা!

‘তোমার উঠতে হবে না। সুরভী বোধ হয় দুষ্টুমি করছে। যা মাথায় চড়ছে মেয়েটা! ওর মা-ই ওকে আশকারা দিয়ে মাথায় তুলেছে একদম। আমার নিজের মেয়ে তো না, নিজের মেয়ে হলে তো এমন হতো না। তোমার আমার মেয়ে এমন হতো না কখনো, বুঝলে? আমি গিয়ে দেখছি। ওকে আচ্ছা করে বকে দেব।’
আবিরের সত্যি কথা মুখের ওপর বলে দেওয়ার অভ্যাসটা এখনো যায়নি। বিয়ের পর ও এমনই ছিল। বিয়ের আগেও। এখনো তেমনই আছে। ‘আচ্ছা, আমাদের কি এমন একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে হতে পারত না?’ -এমন অসম্ভব সুন্দর একটি অবাস্তব চিন্তা হৃদিতার মাথায় ক্ষণিকের জন্য এসেই আবার মিলিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ বাদে আবির ফিরে এলো। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। আবির ভীষণ ঘামে, শীতকালেও। হৃদিতার ইচ্ছে হচ্ছিল শাড়ির আঁচল দিয়ে আলতো করে মুছে দিতে। ওর মনে আছে বছর চারেক আগে নিউমার্কেটে রাস্তার ধারে শাড়ির আঁচল দিয়ে আবিরের ঘাম মুছে দেওয়ার সময় একঝাঁক লোক হা করে তাকিয়ে ছিল ওদের দিকে। হৃদিতার তাতে কোনো ভ্রæক্ষেপ ছিল না। সদ্য বিবাহিতদের এমন আবেগ থাকতেই পারে। এতে এমন বিস্মিত হওয়ার কি আছে ভেবে পায়নি হৃদিতা।
৯টা বাজতেই সশব্দে বেজে উঠল দেয়ালঘড়ি। আবিরকে পরিবেশন করতে দেখে নৈশভোজের সময়জ্ঞান নিয়ে হৃদিতার এখনো বিন্দুমাত্র প্রশ্ন জাগল না। সে যে এতটুকুও বদলে যায়নি এটা বেশ বুঝতে পারে হৃদিতা!
মাছের মুড়োটা হৃদিতার পাতে দিতে দিতে আবির বলল, ‘আচ্ছা, মানুষের ভুলে যাওয়ার এত অভ্যাস কেন বলো তো! আমি তো ভুলতে পারি না। এই যেমন তোমাকে ভুলতে পারিনি। আমার স্মৃতিশক্তি বোধ হয় ভালো। তাই ভুলতে পারি না। অবশ্য ভুলে যাওয়ার জন্য আরও বেশি শক্তি লাগে। অপার্থিব শক্তি। যাদের এই শক্তি আছে তারা আরও বেশি ক্ষমতাবান।
হৃদিতা চুপ করে রইল। মনে মনে ভাবছিল এখন বৃষ্টি আসলে নেহাত মন্দ হতো না, আবার খানিকটা অসুবিধেও হতো বটে! মন্দ হতো না, কারণ বৃষ্টি আসলে ‘এ মা, বাইরে যে প্রচÐ বৃষ্টি! এখন আমি বাসায় ফিরব কি করে?’ -এমন নাটকীয় সংলাপ দিয়ে হয়তো হৃদিতার নিস্তব্ধতা ভাঙত। এতক্ষণ অনেক চেষ্টা করেও সে চুপ করে থাকার ব্যামো কাটাতে পারছে না। আর অসুবিধাটা হতো এই হেতু যে, হৃদিতার আর বাড়ি ফেরা হতো না আজ। আগামীকাল প্রেসের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। বৃষ্টিতে ভিজে হৃদিতার গায়ে যে প্রায় জ্বর চলে এসেছে সেটা আবির জানে না। আর বৃষ্টির মধ্যে আবির তাকে এমনিতেও যে যেতে দেবে না এটা হৃদিতা নিশ্চিত। একজন বিবাহিত পুরুষের বাড়িতে রাতে অবস্থান করাটা মোটেই সমীচীন নয়, অশোভন দেখায়। আচ্ছা, কত রাতই তো তারা একসঙ্গে থেকেছে, তখন তো বেমানান লাগেনি! আদতে এসব সময়েরই আস্পর্ধা! সময় সব সময় সর্বসাকল্যে স্মৃতিকে গিলে ফেলতে চায়, গ্রাস করতে চায়। বাস্তবতাকে করতে চায় রোমন্থন। ভাবতে ভাবতেই যে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে সেটা খেয়াল করেনি সে। এটাকে কি কাকতালীয় বলা যাবে? না, অসম্ভব কিছু নয়। না বলে-কয়ে বর্ষার রাতে এমন কান্না ঝরতেই পারে।
ভেতরের ঘরে যে একজন কেউ আছে বা থাকতে পারে এটা হৃদিতার ভাবনাতেই ছিল না। গায়ে সাদা কাপড় জড়ানো একজন চব্বিশ-পঁচিশ বছরের তরুণী এসে আবিরকে উদ্দেশ করে বলল, ‘আপনার কিছু লাগবে?’
তরুণীটির মুখে লাস্যের অগভীর রেখা অবলোকন করল হৃদিতা। সামান্য কথা বলতে গেলেও টোল পড়ছে গালে। আবিরের উত্তর, ‘লাগলে তো শুনতেই পেতে। তুমি ভেতরে যাও তো!’ বেশ খানিকটা বিরক্তি নিয়েই যেন বলল আবির।
হৃদিতার বুকের ভেতরটা হঠাৎ ধক করে উঠল। কে এটা? আবিরের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী? কিন্তু আবিরের স্ত্রীর উপস্থিতিতে কেনই বা সে তাকে বাসায় ডাকবে! আবিরের স্ত্রী কি পরনারীর উপস্থিতি এত সহজে মেনে নিতে পারে!
হৃদিতা তার মুখোভঙ্গি স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় এনে আরাম করে খেতে লাগল, যেন কিছুই হয়নি। আবির তার কালো রঙের প্লেটে আরেকটা মাংসের টুকরো নিতে নিতে বলল, ‘তুমি যাবে কিভাবে? বাইরে যে বৃষ্টি থামছেই না! আমি এগিয়ে দিয়ে আসব তোমায়। আর আমার ছাতাটা নিয়ে যেয়ো। ওটার বয়স হয়েছে, সময় প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। আমার কাছে থেকে থেকে এটার মূল্যও ভীষণ কমে গেছে। অন্তত তোমার কাছে থাকলে এই ছাতার আলাদা মূল্য তৈরি হবে, আলাদা মর্যাদা পাবে আমার স্মৃতি হিসেবে।’
হৃদিতা ভেবেছিল আবির তাকে থেকে যেতে বলবে। কিন্তু আবির মোটেই তা করল না। অবশ্য ভালোই হয়েছে। অযথা মায়া বাড়িয়ে লাভই বা কী! আর তরুণীটি যদি আবিরের স্ত্রীই হয়ে থাকে তবে ও কেনই বা থাকতে বলতে যাবে তাকে!
আবির ভীষণ আপন মনে খাচ্ছে। সে যে হঠাৎ কি কারণে তাকে এই নিমন্ত্রণ করতে গেল বিষয়টা এখনো হৃদিতা নিশ্চিত নয়। তবে আবিরের কোনো কথা যে কখনো হৃদিতা ফেলনা মনে করেনি, সেটা এত বছর পরেও আবিরের এককথায় চলে আসার মধ্য দিয়ে প্রমাণিতই হলো একরকম। আবির অবশ্য নিজে তাকে আসার জন্য অনুরোধ করেনি। হয়তো হৃদিতার মতোই আবিরের কন্টাক্টস্ লিস্টে ওর ফোন নাম্বারটিও নেই। তবে আবিরের বান্ধবীর মাধ্যমেই নিমন্ত্রণের বিষয়টি জানতে পারে হৃদিতা। এত কাছে আবিরের অবস্থান সত্তে¡ও শুরুতে বাড়িটাই গুলিয়ে ফেলেছিল হৃদিতা।
হৃদিতা অনেকক্ষণ পর হকচকিয়ে বলল, ‘আমি বেশ চলে যেতে পারব, তোমার এগিয়ে আসতে হবে না।’ 
আবির সে কথার কোনো উত্তর দিল না। কিয়ৎক্ষণ পর মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল, ‘হৃদিতা, জানো তোমার হাতের সব কিছু আমার খুব প্রিয়। তোমার রেঁধে দেওয়া পায়েস যা হতো না! আর তোমার হাতের পিঠে! উফ্! তোমার হাতে তাচ্ছিল্যের শাসনও! এমনকি তোমার হাতে মৃত্যুও বোধ হয় আমার খুব প্রিয়ই হতো। হা - হা - হা!’
হৃদিতার ইচ্ছে হচ্ছিল তার হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে বলতে যে, ‘এমন কথা আর কখনো বলবে না।’ কিন্তু সে সেটা করতে পারল না। কে জানে এভাবে বলতে পারলে হয়তো আবিরের ঠোঁটে হৃদিতার হাতের স্পর্শও অজান্তেই তার প্রিয় হয়ে উঠত!
নৈশভোজের সমাপ্তি হলো আবিরের প্রিয় পায়েস দিয়ে। নীলা পায়েসটা ভালোই রেঁধেছে। তবে হৃদিতার মতো তো একদমই হয়নি। নীরবতা আর থেমে থেমে আলাপচারিতায় এতই মশগুল ছিল কখন যে গায়ে চাদর জড়ানো তরুণীটি পায়েস রেখে গেছে দেখতে পায়নি হৃদিতা। হৃদিতা খেয়াল করল তার ইংরেজি নামের প্রথম অক্ষর ‘ঐ’ লেখা তামার তাটেই পায়েস আনা হয়েছে তার জন্য। এই তাটটি আবির কিনেছিল বিয়ের পর পরই। হৃদিতার জন্য বরাদ্দ এই জিনিসটি যে কারও স্পর্শ করার ক্ষেত্রেও আবির নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল একরকম, এমনকি নিজের বেলায়ও!
খাবার পর কিছুক্ষণ এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করে আবির। এখনো সে অভ্যাস আছে। হৃদিতা সূ² বিষয়গুলোও পর্যবেক্ষণ করতে পারে। আবিরের সান্নিধ্যে এলে সে নেহাতই প্রকৃতিস্থ প্রাণী হয়ে ওঠে। আবিরের সব কিছু অবলোকন করাই যেন তার আচরণ!
বাতায়নের গøাস প্যানে বৃষ্টির ফোঁটা জমেছে। আবির জানালাটা খুলে দিল। জানালার ফাঁক দিয়ে কি শীতল স্নিগ্ধ বাতাস ঢুকছে! হৃদিতা আবিরের পাশে এসে দাঁড়াতেই বাতাসের ঝাপটায় তার কেশগুচ্ছ দোল খেতে শুরু করল। হৃদিতা সামলাতে পারছে না দেখে আবির চুলসহ পুরো শরীরে চাদর জড়িয়ে দিয়ে হৃদিতার ডান হাতে চাদরের সম্মুখভাগ জোর করে ধরিয়ে দিল এমনভাবে যেন বাতাসের ঝাপটা সামলাতে হৃদিতার কেশগুচ্ছের দিশেহারা না হতে হয়। হৃদিতার কেমন আবিরকে নিজেরই মনে হচ্ছে। সঙ্গে আফসোসও হচ্ছে বটে। এমনভাবে তখন ঝড় সামলাতে জানলে হয়তো তাদের বিচ্ছেদও হতো না! কেশগুচ্ছের মতো অনুরক্তির চাদরে হয়তো আচ্ছাদিত রাখা যেত তাদের সোনার সংসার!
হৃদিতার ইচ্ছে হচ্ছিল আবিরের বুকে হাত রেখে বলতে, ‘আবির, পাশের ঘরে যে আছে, সে কে? সে তোমাকে আর আমাকে একসঙ্গে এমনভাবে দেখেও কিছু বলছে না কেন?’
আবির অকস্মাৎ বলে উঠল, ‘ওর ল্যারেনজাইটিস আছে। ডাক্তার কথা বলতে বারণ করেছেন। তাই কিছু বলছে না।’
হৃদিতা চমকে উঠল যেন। প্রশ্নটা ভাবতে ভাবতে কি করেই ফেলেছে মুখ ফসকে!
‘কার?’ হৃদিতা কাঁপা ঠোঁটে অস্ফুট স্বরে বলল।
আবির পেছন ফিরে হাত দিয়ে ইশারা করল হৃদিতাকে। 
তিন-চার বছর বয়েসি একটি ছেলে হৃদিতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। তার পুরো শরীর বৃষ্টিতে ভেজা।
‘এই রাত দুপুরে বৃষ্টি মাথায় করে কে বন্ধুর বাসায় যেতে বলেছে তোমায়? যাও, ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।’ আবির কিঞ্চিৎ রাগান্বিত হয়ে ছেলেটিকে উদ্দেশ করে বলল।
‘কে ও?’ 
‘ও আমার ছেলে। মানে আমার আর নীলার। ওর মৃত স্বামীর প্রথম সন্তান। খুব কম বয়সে প্রথম বিয়ে হয়েছিল নীলার।’
‘ও।’ 
হৃদিতার হঠাৎ সংবিত ফিরে এলো যেন। নিজের ব্যক্তিত্বকে পুনরুদ্ধার করার প্রচেষ্টা খাটিয়ে বলল, ‘অনেক রাত হয়ে গেছে, বাড়ি ফিরতে হবে। শ্যামল অপেক্ষা করছে হয়তো আমার জন্য।’
আবিরের চোখ-মুখ হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। শ্যামল! হৃদিতা কি আবার বিয়ে করেছে তবে? আবির কি বলবে ভেবে পেল না। 
হৃদিতা চাদরখানা আবিরের হাতে দিয়ে দরজা খুলে প্রস্থান করবে এমন সময় আবির ডাকল, ‘হৃদিতা।’ 
হৃদিতা পেছন ফিরে না তাকিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে পড়ল একরাশ স্তব্ধতা নিয়ে। এই ডাক যে কত পরিচিত হৃদিতার!
‘ভেতরের ঘরের মেয়েটি কিন্তু আমার স্ত্রী নয়। কিন্তু সৌরভ আর সুরভীর মা।’
সদ্য শুরু করা দাম্পত্য জীবনেও যে আবির এতটুকুও সুখে নেই সেটি বুঝতে বাকি রইল না হৃদিতার। হয়তো তাকে নিয়েই মনোমালিন্য দুজনের মধ্যে। হৃদিতা মনে মনে ঠিক করল সে আর কখনোই এদিকে আসবে না। পারলে নিজের আবাসস্থল বদল করে আরও দূরত্ব সৃষ্টি করবে আবিরের সঙ্গে। আত্মিক দূরত্ব নয়, অবস্থানের দূরত্ব।
হৃদিতা পেছন ফিরে তাকাল একবার। আবিরের চোখজোড়া ভালোবাসায় আর্দ্র লোনা জলে ভিজে উঠেছে। হৃদিতার মনে হচ্ছে আবির তার জন্য এক তীক্ষè মায়া অনুভব করছে। যার তীক্ষèতা পৃথিবীর সব কিছুকে ভেদ করে যেতে পারে। হৃদিতা আলতো পায়ে আবিরের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল।
‘আবির, আমি তোমার জন্য পায়েস রান্না করে নিয়ে এসেছিলাম আসার সময়। পায়েস রান্নাঘরে রাখা আছে।’
‘আমি জানি।’ আবির যেন হৃদিতার প্রতি প্রবল অনুরক্তিতে আসক্ত হয়ে বলল কথাটা। আর মুচকি হাসল।
রান্নাঘর থেকে পায়েসের বাটিটা এনে আবির হৃদিতাকে খাইয়ে দিতে বললে হৃদিতা নিজের হাত দিয়ে একটুখানি পায়েস আবিরের মুখে দিল। পায়েসের থেকেও ভালোবাসার মিষ্টতা আবিরের জিহŸায় বেশি করে ধরা দিল তারপর। 
হৃদিতা চোখের জল সংবরণ করতে না পেরে বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করেই বৃষ্টিতে ভেজা রাস্তা ধরে দ্রæত পায়ে বিলীন হয়ে গেল। সে জানে এপথে তার আর আসা হবে না। কখনো না। এরপর হৃদিতাও ঝাপসা হয়ে বিলীন হয়ে গেল আবিরের চোখে। কী একটা আবছায়া! আবছায়া নাকি আলো? আবিরের মনে হলো অনেক আলো। অনেকগুলো আলোক রশ্মি ঢুকে পড়ছে তার চোখের ভেতর আর সে হারিয়ে যাচ্ছে আলোকহীন মহাসমুদ্রে।
পরদিন সকালে হৃদিতার ফোন হঠাৎ বেজে উঠল। আবিরের বান্ধবী তিয়াসা ফোন করেছে। বাঁ হাতে ফোনটা তুলে কাঁধের ওপর রেখে কান দিয়ে বেশ জোরে চেপে ধরে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফাইল ঘাটতে ঘাটতে সে বলল, ‘হ্যালো।’
‘হৃদিতা!’ ওপাশ থেকে চাপা স্বরে তিয়াসা আওড়াল।
‘কি হয়েছে, তোমার কথা এমন শোনাচ্ছে কেন?’
‘কাল রাতে আবির মারা গেছে।’
নিমিষেই পৃথিবীটা যেন অন্ধকার হয়ে আসে হৃদিতার কাছে। বুকের ভেতর অবস্থানরত চেতনারূপ আত্মাটা ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইল ওর। 
‘কি...কিন্তু কিভাবে হলো এসব?’
‘আবির কাল রাতে যে পায়েস খেয়েছিল সেটাতে বিষ মেশানো ছিল।’
হৃদিতা কিছু ভাবতে পারছে না। তবে কি শ্যামল আবিরের জন্য বানানো পায়েসে বিষ মিশিয়েছে? শ্যামল তো ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে। শ্যামল কি কোনোভাবে কাল রাতে আবিরের বাসায় যাওয়ার কথাটা জানতে পেরেছিল? 
হৃদিতা শুনতে পেল তার কানে একটা কথা প্রতিধ্বনির ন্যায় বারবার বাজছে। এটা সে পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে একসঙ্গে উপলব্ধি করতে পারল। আবির যেন ওকে ডাকছে। আর বলছে, ‘হৃদিতা, তোমার হাতে মৃত্যুও আমার ভীষণ প্রিয়।’

পরিশিষ্ট
আবিরের বাসার ভেতরের ঘর থেকে গায়ে সাদা চাদর জড়ানো তরুণীটি একটি পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চা মেয়ে সুরভীকে বলছে, ‘মামণি, আমি তো তোমাকে ঐ তামার প্লেটে এই শিশির তরল মেশাতে বলেছিলাম পায়েসের স্বাদ বাড়বে বলে। তুমি কি করেছ?’
‘আমি কিছু করিনি, মা। বাবা যখন রান্নাঘরে শব্দ শুনে এসেছিল তখন আমি তোমার কথা বলে দিয়েছি। তুমিই আমাকে ওটা মেশাতে বলেছ ওখানে।’ বলেই হাত দিয়ে ‘ঐ’ লেখা তামার তাটের দিকে ইশারা করে সুরভী।
নীলার গলায় ভয়ের তীক্ষè স্রোত পরিলক্ষিত হলো যেন। বলল, ‘তারপর?’
‘তারপর বাবা ওটা বাবার জন্য আনা হৃদিতা আন্টির পায়েসে মেশাল।’