বাঙালির বিবেকের প্রতীক সাহিত্যিক আবুল ফজল
প্রকাশ | ১০ মে ২০২৪, ০০:০০
রোকন উদ্দীন আহমদ
বাংলা সাহিত্যের বিকাশে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করা যে ক'জন সাহিত্যিকের অবদান চিরস্মরণীয় আবুল ফজল তাদের একজন। মুক্তবুদ্ধি চর্চার পথিকৃৎ আবুল ফজল সাতকানিয়া থানার কেউচিয়া নামক নিভৃত পলস্নীতে মৌলভী ফজলুর রহমানের দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুলাই। জীবনে ঘাত-প্রতিঘাতের মুখোমুখি হলেও সমাজ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল বাঙালির বিবেকের প্রতীকরূপে।
গ্রামের মৌলভীর হাতে আমপারা পাঠ দিয়ে শুরু হয় আবুল ফজলের শিক্ষাজীবন। তার শিক্ষাজীবন ছিল বিচিত্র। কষ্টকর ও রোমাঞ্চকর দুটোই। গ্রামের মক্তবে আরবি বর্ণ শিক্ষা ছাড়া অন্য শিক্ষার সুযোগ না থাকায় পিতা ফজলুর রহমান পুত্রকে চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে গেলেন। প্রথমে চট্টগ্রাম শহরের নন্দন কানন এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাকে ভর্তি করে দেওয়া হলো। অল্প কিছুদিন পরেই চট্টগ্রাম সরকারি মাদ্রাসায় ১ম শ্রেণিতে ভর্তি করা হলো। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে তাকে চন্দনপুরায় এক বাড়িতে জায়গীর থাকতে হয়েছিল। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে চট্টগ্রাম শহরের কাজী বাড়িতে জায়গীর ছিলেন। উলেস্নখ্য, আবুল ফজলের পিতা মৌলভী ফজলুর রহমান জীবিকা অর্জনের জন্য মানুষের বাড়িতে মিলাদ পড়াতেন। মিলাদ পড়ানোর পর গৃহস্থ কত টাকা দিয়েছেন তা কখনো গুনে দেখতেন না। গৃহস্থ যা দিয়েছে তাতেই সন্তুষ্ট হতেন। মৌলভী ফজলুর রহমান দীর্ঘ ত্রিশ বছর চট্টগ্রাম জামে মসজিদের পেশ ইমাম ছিলেন। আবুল ফজল উলেস্নখ করেন, তার পিতা দরিদ্র ছিলেন। মৃতু্যর পূর্ব পর্যন্ত পিতার চাকরির মাসিক মাইনে ছিল তের টাকা। এ রকম প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও আবুল ফজল ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম শহরের নিউ স্কিম মাদ্রাসা থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ঢাকার ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে তিনি কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য শোনা ও তাকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ লাভ করেন। কবিগুরুর এই সান্নিধ্য আবুল ফজলের তরুণ জীবনে গভীরভাবে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। উলেস্নখ্য, ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলায়ের আমন্ত্রণক্রমে রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় আসেন। কবিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য গঠিত স্বেচ্চাসেবক বাহিনীতে আবুল ফজল উৎসাহ নিয়ে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯২৬ সালের ১৩ ফেব্রম্নয়ারি অপূর্ব কুমার চন্দের বাসভবনে কবিগুরুকে নিয়ে একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আবুল ফজল 'বিশ্বভারতী সম্মিলনী'র সহসম্পাদক থাকার সুবাদে সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন। সেটাই ছিল তার রবীন্দ্রনাথকে প্রথম ও শেষবারের মতো কাছে থেকে দেখা। এসব ঘটনায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তরুণ আবুল ফজলকে গভীরভাবে আলোড়িত করেন। তিনি জীবনে কবি নজরুল ইসলামেরও সান্নিধ্য লাভ করেছেন। তিনি বলেছেন, 'আমার জীবনের বড় এক সম্পদ নজরুলের স্নেহ।' বিএ পাস করে আইন বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য তিনি কলকাতা যান। কিন্তু আইন ব্যবসায় মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় বলে তার পিতা আইন অধ্যয়ন অনুমোদন করেননি। পিতার নির্দেশে শিক্ষক হওয়ার জন্য আবুল ফজল ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে বিটি পড়তে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিটি পাস করেন। বিটি পাস করার আগেই আবুল ফজলের পিতার মৃতু্য হয়।
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে আবুল ফজল মাহমুদা খাতুন চৌধুরাণীর কন্যা নূরজাহানকে বিয়ে করেন। প্রথম সন্তান প্রসবের সময় নূরজাহান মারা যান। এরপর তিনি পটিয়া থানার হাশিমপুর গ্রামের নায়েবাড়ির সাজেদা খাতুনকে বিয়ে করেন। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর সাজেদা খাতুন একটি মৃত সন্তান প্রসব করে মৃতু্যবরণ করেন। ভাগ্য বিড়ম্বিত আবুল ফজল ১ম ও ২য় স্ত্রীর মৃতু্যর কারণে তার সন্তানের লালনপালনের জন্য ৩য় বিবাহ করতে বাধ্য হন। ৩য়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন চট্টগ্রামের বিখ্যাত সাহিত্যিক পরিবারের কন্যা উমরাতুল আলমের সঙ্গে। যিনি চট্টগ্রামের সাহিত্যাঙ্গনে ও প্রগতিশীল সমাজে উমরাতুল ফজল নামেই খ্যাতিমান ছিলেন। উমরাতুল আলমকে বিয়ে করার পর আবুল ফজল নবজীবন পেলেন। তিনি পরিতৃপ্ত ভাষায় বলেছেন, 'জীবন যেন ভরে উঠল এক অপূর্ব পূর্ণতায়।' এই পরিতৃপ্তির মধ্যে তিনি ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে অনিয়মিতভাবে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
কলেজ জীবনেই আবুল ফজলের সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৫০। তার প্রথম সাহিত্যকর্ম হচ্ছে 'মশার গান' নামে কবিতা। এটি প্রকাশিত হয়েছিল একটি হাতেলেখা পত্রিকায়। তবে ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত তার প্রথম সাহিত্যকর্ম 'একটি আরবি গল্প' নামের গল্প। সাহিত্যিক জীবনে সমাজ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধ ও ধর্মের সঠিক পথের প্রতি আনুগত্যশীল আবুল ফজলকেই পেয়েছে জাতি। তার প্রথম ছোটগল্প হচ্ছে 'ইসলাম কী জয়'। মাটির পৃথিবী নামক গল্পগ্রন্থে এ ধরনের অধিকাংশ গল্পে তিনি সমাজে ধর্মের মুখোশধারী ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন। এটা তার ধর্মের সঠিক পথের প্রতি আনুগত্যশীলতারই বহিঃপ্রকাশ। জাতির প্রতি তার দায়বদ্ধতার প্রমাণ মেলে ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত 'মৃতের আত্মহত্যা' নামক তার সর্বশেষ গল্পগ্রন্থে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালির হাজার বছরের জাতিসত্তাকে হত্যা করা হয়। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন এটি ব্যক্তি শেখ মুজিব হত্যা নয়। বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিকাশকে গলাটিপে হত্যা। আবুল ফজল হাজার বছরের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ বাঙালির জাতি রাষ্ট্রের জনক হত্যাকান্ডে পীড়িত হয়ে প্রতিবাদে লিখেছেন 'মৃতের আত্মহত্যা' গল্পগ্রন্থ। এখানে জাতির প্রতি তার দায়বদ্ধতার প্রকাশ পায়।
সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণ থাকলেও প্রবন্ধ সাহিত্যেই তিনি শ্রেষ্ঠ বিকাশ লাভ করেছেন। তার প্রথম মুদ্রিত প্রবন্ধ হচ্ছে 'হযরত মুহম্মদের উদারতা' তার উলেস্নখযোগ্য প্রবন্ধের মধ্যে 'বাহাইধর্ম' অন্যতম। মানবমন্ত্র প্রবন্ধে তিনি সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত সমাজ প্রত্যাশায় মানবধর্ম প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসকগোষ্ঠীর কড়া সমালোচক ছিলেন তিনি। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সামরিক শাসন জারি করে দমননীতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আবুল ফজল শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে 'শিল্পীর স্বাধীনতা' প্রবন্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। ১৯৭১ সালের বাঙালি জীবনের দুর্বিষহ দিনগুলো নিয়ে তিনি লিখেছেন 'দুর্দিনের দিনলিপি'। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত 'শুভবুদ্ধি' নামক প্রবন্ধগ্রন্থে স্বাধীন বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাই স্থান পেয়েছে। সমাজ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে সাহিত্য বিচারে তাকে শুধু নিছক সাহিত্যিক বলা চলে না। তিনি ছিলেন মাটি ও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সচেতন সাহিত্যিক। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক দেওয়া কাজী নজরুল ইসলাম, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ ও কাজী মোতাহের হোসেনের সঙ্গে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রাপ্তি তার জীবনের প্রধান কয়েকটি স্বীকৃতি। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে অবদান রাখায় তিনি মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার, প্রেসিডেন্ট সাহিত্য পুরস্কার, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, আবদুল হাই সাহিত্য পদক, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। কর্মজীবনে বিএ পাস করার পর তিনি কলকাতায় নাসিরুদ্দিন সাহেবের সওগত পত্রিকায় সামান্য মাইনে কিছুদিন চাকরি করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রমের বাইরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন। শেষের দিকে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যাপকের পদ থেকে ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। এর পরে তিনি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন।
জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মুখোমুখি হয়েও সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহিত দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ সাহিত্যিক সমাজ সংস্কারক বুদ্ধিজীবী আবুল ফজল ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ৪ মে মৃতু্যবরণ করেন। মৃতু্যর প্রাক্কাল পর্যন্ত তিনি বাঙালিকে প্রতিবাদী ও জাগ্রত বিবেক হিসেবে ছায়া দিয়েছেন। '৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নিয়ে তার 'একুশ মানে মাথা নত না করা' এই বিখ্যাত উক্তিটি বাঙালি জাতিকে প্রেরণা যুগিয়েছে এগিয়ে যাওয়ার। কর্মেই তিনি বাঙালির বিবেকের প্রতীকরূপে আজও বাঙালির হৃদয়ে শ্রদ্ধেয়। তার বিবেকী শিক্ষাগুলো গ্রহণ করাই হবে মৃতু্যবার্ষিকীতে তার প্রতি জাতির শ্রদ্ধা।